book > Karagare Ratdin |
উনিশ-শো চৌষট্রি সালের ফেব্রুয়ারী মাসের এক মনোরম বিকেলে নিজের গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছিলাম। হটাৎ বিপরীত দিক থেকে অন্য একটি গাড়ী এসে প্রচণ্ড বেগে আমার গাড়ীটিকে ধাক্কা মারে এবং সাথে সাথেই আমার গাড়ীটি উল্টে পড়ে যায়। এই অভাবিত-পূর্ব দুর্ঘটনায় আমি গুরুতরভাবে আহত হয়ে পড়ি এবং যন্ত্রণায় তীব্রতায় প্রায় সম্বিৎ হারিয়ে ফেলি। তখন ঘটনাস্থল এবং তার আশেপাশে কারা কোন তৎপরতায় লিপ্ত ছিল, সে সম্পর্কে কিছু অনুমান করার মতো অবস্থাও আমার ছিল না। অবশ্য মনে হচ্ছিল, কে যেন বার বার আমাকে ডাকছে।
সম্বিৎ ফিরে দেখিতে পাই, আমি পুলিশ হাসপাতালের শয্যায় শায়িত। আমার এক পাশে প্রিয়তম স্বামী ও ঘনিষ্ট আত্মীয় স্বজন এবং অন্যপাশে ইসলামী আন্দোলনের কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মী দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের প্রত্যেকের চেহারায় ছিল ভয় এবং উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট। আমি বেঁচে গেছি বলে আল্লাহ্র শোকর আদায় করি এবং দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে জানার জন্যে ওদের কিছু জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে আবার সম্বিৎ হারিয়ে ফেলি।
পুনরায় জ্ঞান ফিরে এলে দেখি, একজন মহিলা ডাক্তার তার সহযোগীদের নিয়ে আমাকে এক্সরে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসছেন। তখন একে একে পূর্বাপর সব ঘটনা আমার মনে পড়ছিল। আমি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছি বলে আমার স্বামী তখনো ভক্তিতে গদগদ কণ্ঠে আল্লাহ্কে শুকরিয়া জানাচ্ছিলেন। আমি আমার গাড়ীর ড্রাইভার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান –“ ড্রাইভার সুস্থই আছে। সামান্য আঘাত পেয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে”। পরে জেনেছি যে, ওর মাথা এবং মস্তিস্কে চোট লেগেছে। এদিকে এক্সরে রিপোর্ট মোতাবেক আমার উরুর হাড় ভেঙ্গে গেছে। সুতরাং অস্ত্রোপচারের জন্য “আমাকে মাযহার আশুর” হাসপাতালে পাঠানো হয়। এখানে প্রখ্যাত সার্জন মোহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আমার অজ্ঞান অবস্থায় সাড়ে তিন ঘণ্টা স্থায়ী অপারেশন কার্য চালিয়ে আমাকে বিপদমুক্ত করেন।
বিপদসংকুল কয়েকটি দিন কেটে যাওয়ার পর আমি বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারি যে, প্রেসিডেন্ট জামাল নাসেরের গোয়েন্দা বাহিনীই আমাকে হত্যা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরের ঘটনাবলী দ্বারা এর সত্যতা আরও স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। সরকারী সন্ত্রাসের সেই দুর্যোগপূর্ণ দিনগুলোতেও ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবী কর্মীরা আমার অবস্থা জানার জন্য নিয়মিত হাসপাতালে আসতো। হাসপাতালের বাইরে সরকারী গুপ্তচর বাহিনীর লোক মোতায়েন ছিল।
দেশের প্রতিকূল পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত অবগতির পর জনগণ এবং আন্দোলনের বৃহত্তর স্বার্থে আমি কর্মীদের তাদের প্রিয় নেতা ভাই আব্দুল ফাত্তাহ আবদুহ ইসমাইল শহীদের মাধ্যমে আমাকে দেখার জন্য হাসপাতালে আসতে বারণ করি। কিন্তু দেখে বিস্মিত হয়েছি যে, কর্মীরা কোন প্রতিকূল অবস্থার চাপ মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। কয়েকদিন পর সরকারী প্রশাসনের সেক্রেটারী আমার অনুমোদনে এর স্বাক্ষর লাভের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল নিয়ে হাসপাতালে উপস্থিত হয়। বলা বাহুল্য, আমি সংস্থার সভানেত্রী বলে আমার কাছে তার আসা স্বাভাবিক ছিল।
কিন্তু আমার স্বামী সেক্রেটারিকে দেখা মাত্রই উঠে তার হাত থেকে ফাইল কেড়ে নিয়ে ওকে নিয়ে কক্ষের বাইরে চলে যান। তাদের কথাবার্তায় প্রকাশ পেলো যে, এর আগেও একবার সেক্রেটারীকে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেয়া হয়নি। ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগেনি। আমি আমার স্বামীকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি সংক্ষেপে কেবল এতটুকুই বলেন- “আমি ডাক্তারের হুকুম পালন করছি মাত্র”।
পরে ডাক্তার এসে আমার ক্ষতস্থান পরীক্ষা করেন এবং আমাকে সব রকমের কাজ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি আরো জানান যে, ফাইলে বিভিন্ন কাগজপত্র এবং তথ্যাদি ছিল। কিন্তু ওসব আপনার কাছে পৌঁছানো নিষেধ আছে। আমি সাথে সাথেই তাঁর একথার প্রতিবাদ করে বলি যে,এসব কাগজপত্র এমন কোন ভয়ঙ্কর কিছুতো নয় যে, তা আমার কাছে পৌঁছাতে দেয়া হচ্ছে না। বস্তুতঃ ওসব দলিলপত্র সাক্ষরের জন্য আমার কাছে পৌঁছানোই উচিৎ। কিন্তু তিনি আমাকে ফাইল দিতে অস্বীকার করেন। এর কয়েকদিন পর আমি শয্যায় বসে সংস্থার কিছু কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করি। কিন্তু তাও প্রত্যাখ্যান করা হয়। এসব দেখে-শুনে আমার সন্দেহ বিশ্বাসে রুপান্তরিত হলো যে, নিশ্চয়ই এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটেছে, যা এঁরা ইচ্ছাকৃত ভাবেই আমার কাছ থেকে লুকোবার চেষ্টা করেছেন। আমার স্বামী, প্রাইভেট সেক্রেটারি, এমনকি সংসদের কার্য্যনির্বাহী পরিষদের সাধারণ সম্পাদিকার কোন কোন আলোচনা থেকেও এটা বোঝা যাচ্ছিল যে, এরা সবাই আমার কাছে ঘটনা বিশেষ গোপন রাখার চেষ্টা করেছেন।
যা আশংকা করছিলাম, শেষ পর্যন্ত তাই হলো। পরদিন বিকালে সরকারী সচিবালয়ের মহিলা সেক্রেটারি আমার স্বামীর উপস্থিতিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করেই আমার কাছে এগিয়ে এলেন। প্রকৃত ঘটনা খুলে বলার আগে তিনি আমাকে ধৈর্য্য ও সাহসিকতার সাথে যেকোনো কথা শুনার জন্য মানসিক প্রস্তুতি অর্জনের পরামর্শ দেন। এরপর বিন্দুমাত্র ইতস্ততঃ না করে আমার সামনে ফাইল খুলে ধরেন। দেখি যে, ফাইলে সেই অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজটি, যা আমার কাছ থেকে লুকানো চেষ্টা চলছিল তা আর কিছু নয়,-আমাদের মহিলা সংস্থাকে নিষিদ্ধ ঘোষণার সরকারী ফরমান মাত্র।
সরকারের মহিলা সেক্রেটারী আমাকে সাময়িক সান্তনা দেয়ার জন্য বলছিলেন-স্বভাবতই, এতে আপনার ভীষণ দুঃখ পাওয়ার কথা। “আল্লাহ্কে অশেষ ধন্যবাদ, কিন্তু মহিলা সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞা আরপের কোন যুক্তি বা সাংবিধানিক ক্ষমতা সরকার কোথায় পেলো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সরকারের সামনে এ প্রশ্ন তুলে ধরার মতো কোন একজন লোক ও এখন মুক্ত নয়। আমার আমাদের পর্যায়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, কিন্তু জামাল নাসের ইসলামী মহিলা সংস্থাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে দৃঢ়সংকল্প। সে ব্যক্তিগত ভাবে আপনার উপর দারুণ নাখোশ; এমন কি, কারো মুখে আপনার নাম পর্যন্ত তার অসহ্য। কেউ অজান্তে আপনার নাম উচ্চারণ করলে তিনি এমনই বিরুপ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করেন, যা বলার মতো নয়। আপনার ব্যক্তিত্ব এবং আন্দোলন তার স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে যেন’। সরকারী সেক্রেটারীর কথা শুনে আমি বললাম –“ আল্লাহ্র শোকর যে, নাসের শুধু এই জন্যেই আমাকে এবং দলকে ভয় করে যে, আমরা মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির জন্যে ইসলামী সমাজ কায়েমের আন্দোলন চালাচ্ছি। আর নাসেরের প্রতি আমার অসন্তুষ্টির মূল কারণ হচ্ছে, সে জনগণের ইসলামী দাবী উপেক্ষা করে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী চক্রের পদলেহন করছে। যাই হোক, সে অনতবিলম্বেই টের পাবে যে, সরকারী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আমাদের হত্যা করে বা জেলে পুরে রেখে ইসলামী আন্দোলনকে স্তব্ধ করা সম্ভব নয়। ইসলামী আন্দোলন তার স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে যাবেই। দুনিয়ার কোন শক্তিই এই আন্দোলনের সামনে বেশী দিন টিকে থাকতে পারবে না। আল্লাহ্র দ্বীনের মুজাহিদদের দূর্বার অভিযানের সামনে এসব তথাকথিত শক্তি খড়কুটোর মতো উড়ে যেতে বাধ্য। আল্লাহ্ আমাদেরকে গঠনমূলক এবং সৃজনশীল কাজ করতে বলেছেন এবং ধ্বংস ও বিকৃতির কাজে রুখে দাঁড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন”।
আমার কথা শুনে সচিবালয়ের সেক্রেটারী অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললেন- “সম্মানিত সভানেত্রী! আমি যথার্থভাবেই আশা করি যে, আপনার দলের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে”। এরপর এদিক ওদিক দেখে ঈষৎ চাপা স্বরে বললেন “এখানে কোন গোপন মাইক্রোফোন লুকিয়ে রাখা হয়েছে কিনা, ভয় হচ্ছে। জানেন তো, দেয়ালেরও কান আছে”। এবার সরকারী সচিবালয়ের সেক্রেটারী গুপ্ত পকেট থেকে একখানা কাগজ বের করে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আশেপাশে দৃষ্টি রেখে বললেনঃ “মহামান্য সভানেত্রী ! আপনার কাছে আমার একান্ত অনুরোধ , অনুগ্রহ করে এই কাগজটিতে স্বাক্ষর করুন। এতে স্বাক্ষর করার সাথে সাথেই আপনার দলের উপর সরকারী নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নাকচ হয়ে যাবে”।
পড়ার জন্যে কাগজখানা হাতে নিয়ে আমার ক্ষোভ আর বিস্ময়ের সীমা রইলো না যে , এটি হচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকারী সমাজতান্ত্রিক দলে যোগদানের আবেদন পত্র।
আমি কয়েক মুহূর্ত যেন পাথর হয়ে রইলাম। এরপর সব তিক্ততা হজম করে জামাল নাসেরের সেক্রেটারীকে বললাম-
সেক্রেটারী, কোন সৎকাজ পেলে গিয়ে করোগে। মনে রেখো এবং নাসের কে জানিয়ে দিও, তার মতো অতাচারি শাসকের পক্ষ সমর্থনে স্বাক্ষর করার আগে আমার হাত যদি জ্বলে পুড়ে গলে যায়,তাও ভালো। জামাল নাসের আল্লাহ্ এবং ইসলামের বিরুদ্ধে অন্যায় তৎপরতায় লিপ্ত। সে জনগণের দুশমন; জননেতা আব্দুল কাদের আওদাহ এবং অসংখ্য বিপ্লবী মুসলমানের না হোক রক্তে রঞ্জিত তার কলঙ্কিত হাত। তার মতো নিষ্ঠুর জালিমের পক্ষ অবলম্বনের চেয়ে আমার দলের অবলুপ্তি মেনে নেয়াই আমার কাছে অগ্রগণ্য।
এরপর সরকারী সচিবালয়ের সেক্রেটারী আমার হস্ত চুম্বন করে বললো-
:মা, আপনি কি আমাকে মেয়ে বলে মেনে নিতে পারেন?
:কেন নয়? আমি বললাম।
:তাহলে, ও প্রসঙ্গ ছাড়ুন, তার চেয়ে ………
:না, কোন বৃহত্তর কোরবানির বিনিময়েও জামাল নাসেরের অত্যাচারী শাসনের সমর্থনে স্বাক্ষর করা সম্বভ নয়। মিথ্যের সাথে সত্যের মিত্রতা অচিন্তনীয়। তুমি আসতে পার,সেক্রেটারী!
ক্রমশঃ সুস্থ হওয়ার পর হাসপাতালের দিনগুলো ফুরিয়ে আসে। আমি গৃহে ফিরে যাই।
বই: কারাগারে রাতদিন
লেখক: জয়নাব আল-গাজালী
বই লিংক:
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....