শরৎ উপন্যাস সমগ্র pdf download (Sarat Chandra Chattopadhyay) - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র

            শরৎ সাহিত্য পাঠের ভূমিকা 

গল্পের ট্র্যাজিডি সৃষ্টির বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক এ্যারিষ্টটল বলেছিলেন— সাহিত্যে চরিত্র সৃষ্টি অপেক্ষা প্লটই মুখ্য । কারণ ঘটনা বিন্যাসের অভিনবত্ব ও বিস্ময় খুব সহজে পাঠক মনকে অভিভূত ও প্রভাবিত করতে পারে । অবশ্য এ্যারিস্টটলের এই মতবাদের সাথে পরবর্তীকালের কোন সমালোচক একমত হননি । আর সবচেয়ে বড় কথা যে প্রাচীন গ্রীক ট্র্যাজেডির প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি একথা বলেছিলেন- সেই গ্রীক ট্র্যাজেডির বেলাতেও একথা পুরোপুরি প্রযোজ্য নয় ।
Image

সাম্প্রতিককালের সমালোচকগণ তো কাহিনী বিন্যাস অপেক্ষা চরিত্র সৃষ্টিকেই বেশী প্রাধান্য দিয়ে থাকেন । কিন্তু তবু বলতে হয় , স্বার্থক গল্প সৃষ্টিতে এর কোনটার গুরুত্বই কম নয় । শরৎ রচনারীতিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে গেলেও এমন একটি অনুভূতির সৃষ্টি হয় বৈকি ! গল্প রচনায় শরৎচন্দ্রের মূল লক্ষ্য ছিল চরিত্র সৃষ্টি , সন্দেহাতীত । অথচ কাহিনীও সেখানে কাজ করেছে চরিত্র সৃষ্টির মূল সহায়ক শক্তিরূপে । শরৎচন্দ্র সমাজ জীবনের সাধারণ মানুষের রহস্যময় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষ করে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন । 

সেই অনুভূতির আত্মপ্রকাশ ঘটাতে গিয়েই সৃষ্টি করেছিলেন উপন্যাসের কাহিনীগুলোকে । সেই সাথে প্রস্ফুটিত হয়েছিল চরিত্রগুলো । তার একমাত্র ' পরিনীতিা " উপন্যাসটি ছাড়া আর সবগুলো গল্প উপন্যাসের কাহিনীতেই চরিত্র মাধুর্য প্রাধান্য লাভ করেছে । শরৎ সাহিত্যের সর্বত্র চরিত্র সৃষ্টির তাগিদেই অবতারণা করা হয়েছে আখ্যান ভাগের । শরৎচন্দ্রের অপরিনত বয়সের রচনাগুলোতে পূর্ণাঙ্গ বিকশিত চরিত্রের প্রেক্ষিতে উপযুক্ত আখ্যান ভাগের উদ্ভব ঘটেনি । তাই সেখানে তিনি এ দৈন্যতা পূরণ করেছেন গল্পের মধ্যে অবিশ্বাস্য ঘটনা ও প্রবল ভাবাবেগের সৃষ্টি করে । 

তার এ সময়কার রচনাগুলোর মধ্যে পড়ে ' দেবদাস ' , ' স্বামী ' , ' বিরাজ বৌ ' , ' বিপ্রদাস ' ইত্যাদি । অবশ্য এই অপরিপক্কতা কাটিয়ে উঠতে শরৎচন্দ্রের খুব বিলম্ব ঘটেনি । তাঁর পরিণত বয়সের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোতে চরিত্রচিত্রণ ও কাহিনী বিন্যাস এক অপূর্ব পূর্ণতা লাভ করেছে । সেখানে কোথাও ভাবের আতিশয্য নেই , গল্প সেখানে তার আপন স্বাচ্ছন্দ গতি অব্যাহত রেখে এগিয়ে গেছে । নায়ক - নায়িকার হৃদয়ের অনুভূতি প্রকাশের জন্য গল্পের গতি কোথাও ব্যাহত হয়নি এবং চরিত্রের প্রতি অনু - পরমাণুতে এসেছে পূর্ণতা পেয়েছে মাধুর্যতা । ' গৃহদাহ ' শরৎচন্দ্রের এই পর্বের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর অন্যতম । এতে নারী হৃদয়ের যে গভীরতম অন্তর্দ্ বন্দ্বের রহস্য এবং অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয়েছে তা শরৎচন্দ্রকে একজন কুশলী কথা সাহিত্যিকের অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করেছে । 


গঠন কৌশলের দিক দিয়েও উপন্যাসটি অদ্বিতীয় । কাহিনীর আরম্ভ এবং এর পরিণতিও অপূর্ব সামঞ্জস্য লাভ করেছে । এর কোন খণ্ড চিত্রই আনাবশ্যক না । বরং প্রতিটি খণ্ড চিত্র নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে । এর বিশাল ঐক্য । শরৎচন্দ্রের ' দত্তা ' উপন্যাসটির মধ্যেও এমনি একটি সামনজস্য বিদ্যমান । শরৎচন্দ্রের এ দু'টি গ্রন্থ তথা ' গৃহদাহ ' ও ' দত্তা ' শিল্প নিপুণতার অপূর্ব নিদর্শনের পরিচয় বহন করে । তাঁর এ জাতীয় অন্যান্য যেসব উপন্যাসের নামোল্লেখ করা যায় , সেগুলো অবশ্য ' গৃহদাহ ' কিংবা ' দত্তা'র মতো এতোখানি সুসংগঠিত নয় । দেনা - পাওনা উপন্যাসে বাইরের এবং অন্তরের আসক্তি ও বিরক্তির সমন্বয় সাধন হয়েছে বটে , কিন্তু অতোখানি মাত্রাবোধ ও সামঞ্জস্য জ্ঞান সমৃদ্ধ নয় । ' দেনা - পাওনার ' গঠন বৈশিষ্ট্যও একটু ভিন্নতর । 

এর কাহিনীতে চরম সংকটময় মূহুর্ত এসেছে উপন্যাসের শেষ প্রাপ্তে নয় , প্রারম্ভেই । তাই যে কাহিনী প্রথমেই চরমে পৌঁছায় তাকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া কষ্ট সাধ্য । কিন্তু শরৎচন্দ্র তা করেছেন একটি ভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে । লেখক এখানে অবতারণা করেছেন ভিন্ন উপ - কাহিনীর । উপন্যাসের দু'টো সমান্তরাল কাহিনীর একটি হলো জীবানন্দ - ষোড়শী কাহিনী , অপরটি নির্মল হৈমবতীর কথা । তবে শেষেরটি গৌণ । মূখ্য কাহিনীর প্রয়োজন সিদ্ধির জন্যই দ্বিতীয় কাহিনীর অবতারণা । শুধু তাই নয় , একাধিক কাহিনীর সমাবেশ ঘটানোর কৌশল শরৎচন্দ্র তাঁর অরো বেশ কয়েকটি উপন্যাসে প্রয়োগ করেছেন । ' চরিত্রহীন ' , ' বামুনের মেয়ে ' এবং ' শেষ প্রশ্ন ' - 

এ তিনটি উপন্যাসের প্রত্যেকটিতেই দুটো করে সমান্তরাল কাহিনী রয়েছে । • ‘ বামুনের মেয়ে'র প্রধান আখ্যান ভাগে রয়েছে অরুণ ও সন্ধ্যার প্রণয়নকাহিনী । অপরদিকে জ্ঞানদার কাহিনী সংক্ষিপ্ত বটে , কিন্তু অপাংতেয় নয় । ‘ শেষ প্রশ্ন ' উপন্যাসের শুরু হয়েছে শিবনাথ ও কমলের বিয়ের পর এবং এর কিছুকাল পরেই অজিত ও মনোরমার বিয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে । কিন্তু উপন্যাসের কাহিনী কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পরই দেখা গেলো শিবনাথের বিয়ে ভেঙ্গে গেছে এবং শিবনাথ আসক্ত হয়েছে মনোরমার প্রতি । অপরদিকে অজিতের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে কমলের দিকে । এখান থেকেই দুটো কাহিনী দুটো ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়ে গেছে । এর একটি কমল - অজিতের কাহিনী , অপরটি শিবনাথ - মনোরমার গল্প ।

এ দুটো উপন্যাসের তুলনায় শরৎচন্দ্রের ' চরিত্র হীন ' উপন্যাসের কাহিনী আরো অধিকতর জটিল এবং ঘটনাবলী আরো বেশী বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন । কাহিনীর শুরুতে দেখা যায় , সতীশ ও সাবিত্রীর প্রেমময় জীবনে উপেন্দ্রর কোন স্থান নেই । উপন্যাসের দুটো প্রধান নারী চরিত্র কিরণময়ী ও সাবিত্রী সম্পূর্ণ নিঃসম্পর্ক । উপন্যাসের বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে দুটো শ্ৰেণী গুচ্ছে ভাগ করা যায় । কিন্তু কোথাও এর যোগসূত্র নেই । কাহিনী চিত্রণে শরৎচন্দ্রের অদ্ভূত নৈপুণ্য এই যে , তিনি একটি কাহিনীতে বহু ঘটনার অবতারণা করেছেন বটে , কিন্তু সেগুলোকে পুনরায় সংঘবদ্ধ করতে কোন জবরদস্তি করেননি । যেন কাহিনী গুলো যে যার পথ বেছে নিয়েছে , তারপর আপনা থেকেই এক সময় ঘটনার স্রোতে আবর্তিত হতে হতে অলক্ষ্যেই এসে সংলগ্ন হয়েছে মূল কাহিনীর সাথে । 

এ ঐক্য একেবারেই স্বাচ্ছন্দ ও অকৃত্রিম । এখানেই শরৎচন্দ্রের দক্ষতা ও নিপুণতা । যেমন ' চরিত্রহীন ' উপন্যাসে কাহিনীর বাহুল্য থাকলেও সেখানে নায়ক চরিত্রহীন সতীশ । কিন্তু গোটা কাহিনীর কেন্দ্রীয় চরিত্র হলো চরিত্রবান উপেন্দ্র । কারণ তার সাথেই সকল পাত্রপাত্রির সম্পর্ক আছে এবং তার চরিত্রের পরিবর্তনকে উপন্যাসের কেন্দ্র ধরে নিয়েই সকল যোগসূত্রের সন্ধান লাভ করা যায় । এই অসম্ভব পরিবর্তনেই বিশাল উপন্যাসটির প্লট এবং উপভ্রের অন্তিম সময়ে অনাত্মীয় কিরণময়ী ও সাবিত্রীর মিলনের মধ্য দিয়ে কাহিনীর ঐক্য ও সংঘবদ্ধতা সংরক্ষিত হয়েছে । শরৎচন্দ্রের সাহিত্য কর্মের সর্বাধিক আলোচিত ও অসাধারণ বৈচিত্র মণ্ডিত উপন্যাস ' শ্রীকান্ত ’ - এ আছে অগণিত , নর - নারীর সমাগম ।


এরা নিজের প্রয়োজনেই কাহিনীতে প্রবেশ করেছে এবং প্রয়োজন শেষে অন্তর্ধানও করেছে তেমনি স্বেচ্ছায় ও সন্তর্পণে । শ্রীকান্তের আখ্যান ভাগের বিশালতা এতো ব্যাপক যে গোটা বিশ্ব সাহিত্যেও তার তুলনা মেলা ভার । কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো — এতো বিশাল বিস্তৃতির মধ্যেও শরৎচন্দ্র তার মূল সূত্র হারিয়ে ফেলেননি । কোন একটি বিচ্ছিন্ন কাহিনী বা চরিত্রই মূল কেন্দ্রকে অতিক্রম করেনি । সর্বত্র রয়েছে একটি পরিচ্ছন্ন সংযমতা । তিনি শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষ্মীর মনের যে সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ দিয়েছেন তার দক্ষতাও সত্যি অপূর্ব এবং অন্যন্য । ২ শরৎচন্দ্রের রচনা রীতির আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো— 

তাঁর কাহিনীর বহু নায়ক নায়িকার এক একটি করে অতীত ইতিহাস থাকে , যার সাথে বর্ণিত উপন্যাসের মূল আখ্যান ভাগেরও প্রচ্ছন্ন সম্পর্ক আছে । তবে তিনি কখনো পূর্ব ইতিহাসের কাহিনীকে দ্বীর্ঘায়িত করেননি , যাতে পাঠক চিত্তের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে । সর্বত্র দিয়েছেন সংযমের পরিচয় । পিয়ারী বাইজীর মধ্যে কেমন করে রাজলক্ষ্মী সংগোপনে আত্মরক্ষা করেছিলো , কেমনভাবে জীবানন্দের ‘ বাহন অলকার বিয়ে হয়েছিল , অথবা কেমন করে একজন ভৈরবীর অন্তরালে অলকা লুক্কায়িত ছিল এবং মেসে ঝি হবার আগে সাবিত্রী কি করেছিলো -এসব কাহিনীর বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে তিনি কাহিনীকে ভারাক্রান্ত করেননি । 

তিনি মূল অখ্যান ভাগের মধ্যেই পাঠকের কৌতূহলকে কৌশলে ধরে রেখে সংক্ষিপ্ত কথোপকথনের মাধ্যমে আভাষে ইংগিতে পরিতৃপ্ত করেছেন সকলকে । যার ফলে সে কাহিনী এক সুন্দর রহস্যময়তার আড়ালে থেকে গেছে আপন স্ব - মহিমায় । 9 শরৎচন্দ্রের রচনা রীতির বড় বৈশিষ্ট্য হলো কাহিনীর বাস্তবতা । তাঁর অনুভূতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোমান্টিক বটে , কিন্তু তা কখনো রিয়ালিস্ট বা বস্তুতান্ত্রিক সাহিত্য পদ বাচ্যতা থেকে দূরে নয় । ডঃ শ্রী কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এ বাস্তবতা প্রসংগে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন , ' আমাদের সাহিত্যে নৌ - যাত্রা বর্ণনার অনেক কবিত্বপূর্ণ , সুষম অনুভূতির বিবরণ আছে । কিন্তু শরৎচন্দ্রের বর্ণনা ভিন্ন জাতীয় । 

ইহার মধ্যে কবিত্বের অভাব নাই , কিন্তু কবিত্ব ইহার সম্বন্ধে প্রধান কথা নহে । ইহার মধ্যে যে অকুণ্ঠিত বাস্তবতা , যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সুর পাওয়া যায় তাহা কবিত্বকে অতিক্রম করিয়া অনেক ঊর্ধ্বে উঠিয়াছে । শ্রীকান্তের প্রথম পর্বে ছিদাম বহুরূপীর কাহিনীর মেজদার কঠোরতা , নতুন দার পাপ এবং প্রায়শ্চিত্ত – এ সকল বর্ণনা শরৎচন্দ্রের বাস্তব দক্ষতার ফসল । তিনি প্রতিটি বস্তু বাস্তবে দেখেছেন , তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তির মধ্য দিয়ে । বাস্তব দৃষ্টি ভংগীতে ।


শরৎচন্দ্রের এই বাস্তবতা চরম সাফল্য লাভ করেছে ‘ অরক্ষণীয়া ’ - তে এসে । বাস্তবতা এখানে সর্বপ্রকার কাব্যিক সুষমা বিবর্জিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে । এখানে স্বল্পভাষী জ্ঞানদার চরিত্র ও অনুভূতি প্রকাশে শরৎচন্দ্র যথেষ্ট সংযমতারও পরিচয় দিয়েছেন । দারিদ্র নিষ্পেষিত করেছে , তার জীবনকে , কঠিন ব্যাধি হরণ করেছে তার রূপ সৌন্দর্য , তার প্রেমাষ্পের কাছে সে হয়েছে উপেক্ষিতা , ভয় , কুসংস্কার আর শোকে জননীর স্নেহকেও সে ধরে রাখতে পারেনি । “ কিন্তু সর্বাপেক্ষা সহনাতীত অপমান আসিয়াছে জ্ঞানদার নিজের হাত হইতে বিবাহের পন্যশালায় নিজেকে বিকাইবার জন্য তাহার স্বহস্ত রচিত ব্যর্থ সজ্জানুষ্ঠানই তাহার চরম লাঞ্চনা । ” মানবতার এই চরম লাঞ্চনার বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তিল তিল করে । কোনকিছুকেই তিনি হালকা করে দেখেননি । 

8. শরৎ সাহিত্যের এই বাস্তবতা সর্বজন বিদিত । শুধু বাস্তববাদী নন । তিনি ছিলেন মুলতঃ মুক্তিবাদী লেখক । তিনি তাঁর গল্প উপন্যাসে যে শুধু সামাজিক বা রাজনৈতিক বিদ্রোহের কথা লিখেছেন তা - ই নয় । তিনি তাঁর সাহিত্য কর্মের এই দিকটার ‘ কথা নির্দেশ করতে গিয়ে নিজেও বলেছেন , ' ভাবে , কাজে , চিন্তায় মুক্তি এনে দেয়াইতো সাহিত্যের কাজ । ' কিন্তু এই মুক্তি সম্পর্কে তার ধারণা ছিল অত্যন্ত ব্যাপক । তিনি বলছেন , ' সাহিত্য কোন আদর্শের বাহন হবে না । শরৎচন্দ্রের মতে সাহিত্য হলো মানবাত্মার অভিব্যক্তি । বাইরের কোন আদর্শ , কিংবা দার্শনিক মতবাদ দিয়েই তাকে সীমাবদ্ধ করা ঠিক নয় । তিনি নিজেও বলেছেন , — ‘ মন্ত্রের ওকালতি করিতে কোন সাহিত্যিক কোনদিন সাহিত্যের আসরে অবতীর্ণ হয় না , কিন্তু ভুলাইয়া নীতি শিক্ষা দেওয়াও সে আপনার কর্তব্য বলিয়া জ্ঞান করে না । 


একটুখানি তলাইয়া দেখিলে তাহার সমস্ত সাহিত্যিক দুর্নীতির মূলে হয়ত একটা চেষ্টাই ধরা পড়িবে যে সে মানুষকে মানুষ বলিয়াই প্রতিপন্ন করিতে চায় । এটাই ছিল শরৎচন্দ্রের সাহিত্য ধর্ম । শরৎচন্দ্র আইডিয়ালিস্ট কিংবা রিয়ালিস্ট ছিলেন তা বিতর্কিত । মনে হয় তাঁকে এ দুটোর কোনোটির মধ্যেই সীমারেখা টেনে চিহ্নিত করা যায় না । তাঁর নিজের বক্তব্য হলো — ' গোটা দুই শব্দ আজকাল প্রায় শোনা যায় , Idealistic and Realistic , আমি নাকি এই শেষ সম্প্রদায়ের লেখক । অথচ কি করে যে এ দুটোকে ভাগ করেলেখা যায় , আমার অজ্ঞাত । 

------- যা কিছু তার নিখুঁত ছবিকেও আমি যেমন সাহিত্য বস্তু বলিনে , তেমনি যা ঘটে না , অথচ সমাজ বা প্রচলিত নীতির দিক দিয়ে ঘটলে ভাল হয় । কল্পনার মধ্যে দিয়ে তার উচ্ছৃঙ্খল গতিতেও সাহিত্যের ঢের বেশী বিড়ম্বনা ঘটে । ” বস্তুত শরৎচন্দ্র কোন ছক বাধা আদর্শেই শৃংখলিত ছিলেন না । তিনি সম্পূর্ণ মোহমুক্ত এবং অশৃংখলিত মন নিয়ে মানব জীবনকে উপলব্ধি করতেন । কল্পিত কোন আদর্শ দিয়ে নিজেকে ভারাক্রান্ত করতেন না । বস্তুতঃ এ হিসাবেও তিনি ছিলেন বাস্তববাদী । এই বাস্তব চিন্তার নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে তিনি শুধু বাইরের দৃষ্টি দিয়ে প্রত্যক্ষ করেননি । তার মূল উদ্দেশ্য ছিল চরিত্র সৃষ্টি । ঘটনার অন্তরালে ঘটনার অনুধাবন করা । . শরৎচন্দ্র তাঁর সাহিত্যের এই চরিত্র সৃষ্টি প্রসংগে বলেছেন— ' আমি ত জানি কি করে আমার চরিত্রগুলি গড়ে উঠে । বাস্তব অভিজ্ঞতাকে আমি উপেক্ষা করছিনে , কিন্তু বাস্তব ও অবাস্তবের সংমিশ্রণে কত ব্যথা , কত সহানুভূতি , কতখানি বুকের রক্ত দিয়ে এরা ধীরে ধীরে বড় হয়ে ফোটে সে আর কেউ না জানে আমি তা জানি । 

সুনীতি - দুর্নীতির স্থাপন এর মধ্যে আছে , কিন্তু বিবাদ করবার জায়গা এতে নেই— এ বস্তু এদের অনেক উচ্চে । ' তিনি আরেক জায়গায় বলেছেন , — ' মানুষের সু - গভীর বাসনা নর - নারীর একান্ত নিগুড় বেদনার বিবরণ সে প্রকাশ করবে না ত ’ করবে কে ? ” শরৎচন্দ্র যে কোন ছক বাধা আদর্শ থেকে সাহিত্যকে মুক্ত করতে চেয়েছেন । তিনি দৈনন্দিন ঘটনাকে চরম সত্য বলে গ্রহণ করেননি । কিন্তু এসব ঘটনার অন্তরালে ক্ষণজীবী অনুভূতিকে রূপ দিয়ে চরিত্র সৃষ্টি করতে চেয়েছেন । সাহিত্য যে অনুভূতিকে প্রকাশ তা কল্পনা মাত্র নয় । 

সাহিত্যে তাঁর সবচেয়ে দান তিনি সাহিত্যিকে যথাসম্ভব ভারমুক্ত করতে চেয়েছেন । সাহিত্যের অনুভূতি জন্ম লাভ হয় এর বাস্তব সত্যের মধ্যে এবং এর প্রকাশ ঘটে বাইরের ঘটনার মধ্য দিয়ে । কিন্তু বাইরের কোন আদর্শের দ্বারা সাহিত্যকে নিয়ন্ত্রিত করা চলবে না , নইলে তাকে পঙ্গু করে ফেলা হবে । তাই দেখা যায় , Idealistic and Realistic এই পরস্পর বিরোধী দুটো ধারার অপূর্ব সমন্বয় সাধন ঘটেছে শরৎ সাহিত্যে । রসতত্ত্ব বিচারেও এখানেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব । তিনি সাহিত্যে চিন্তার বিস্তৃতি ও মতের ঔদার্যের যে পরিচয় দিয়েছেন তার তুলনা বিরল । রস বিচারেও অনন্য সাধারণ ।

« আর সে জন্যই সৃষ্টির আদি থেকে অদ্যাবধি কাল পর্যন্ত শরৎ সাহিত্যের জনপ্রিয়তা এতটুকু স্নান হয়নি । আঙ্গো পাঠক সাগ্রহে গ্রহণ করে তাঁর গল্পকে । আজ আমরাও আনন্দিত এই কারণে যে , বাংলা সাহিত্যের এই অমর কথা শিল্পী শরৎচন্দ্রের কালজয়ী সাহিত্য কর্মকে তাঁর অগণিত ভক্ত পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারছি । আমাদের প্রকাশিত এই গ্রন্থাবলী সংস্করণের একটা বিশেষত্ব হলো এখানে পর্যায়ক্রমে উপন্যাস , গল্প , নাটক , প্রবন্ধ এবং প্রকীর্ণ রচনাগুলোকে সন্নিবিশেত করা হয়েছে । 

আলোচ্য সংকলনে শরৎচন্দ্রের সাহিত্য শিল্প যথোচিত সুসামঞ্জস্যভাবে পরিবেশিত হয়েছে । যাতে অল্প মূল্যে ভক্ত পাঠকগণ তাদের প্রিয় লেখকের সামগ্রিক রচনার সাথে পরিচিত হতে পারেন তার দিকে লক্ষ্য রেখেই আমাদের এই পদক্ষেপ । শরৎচন্দ্রের এই সমগ্র সাহিত্য পাঠকগণের সমাদর লাভ করলে আমরাও নিজেদেরকে ধন্য মনে করবো । 

ভবেশ রায়, ৫ ই জুন , ১৯৮৮ 
২২ শে জ্যৈষ্ঠ , ১৩৯৫ ।

Sarat Chandra Chattopadhyay novels pdf download free

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ