সাহাবীরা যেভাবে আল্লাহকে ভয় পেতেন ..! - শায়খ মোখতার আহমাদ

          সাহাবিদের ভয়

লেখক : শায়খ মোখতার আহমাদ___
Image


আবূ বকর (রদিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর জিহ্বা টেনে ধরে বলতেন, ‘এটা আমাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে!

তিনি আরও বলতেন, 'হায়! আমি যদি একটি গাছ হতাম যা কেটে ফেলা হতো। অথবা যদি একটি লতা হতাম, যা চিবিয়ে ফেলা হতো!’

একই কথা বলতেন তালহা, আবৃদ দারদা এবং আবূ যার (রদিয়াল্লাহু আনহুমা)।

আরেকবার আমীরুল মুমিনীন উমার ইবনুল খাত্তাব (রদিয়াল্লাহু আনহু) রাতে টহল দিতে বের হয়েছিলেন। তখন তিনি একটি আয়াতের তিলাওয়াত শুনে এমনভাবে অসুস্থ হয়ে গেলেন যে, কয়েকদিন পর্যন্ত বিছানায় পড়ে রইলেন।

আরেকবার তিনি একটি ঘাস উঠিয়ে নিলেন মাটি থেকে। আর বললেন, 'হায়! আমি যদি এই ঘাস হতাম! যদি সবাই আমার কথা ভুলে যেত। যদি আমি আমার মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম না নিতাম!'

অধিক ক্রন্দনের কারণে উমার (রদিয়াল্লাহু আনহু)-এর চেহারায় দুইটি কালো দাগ পড়েছিল।

আর উসমান (রদিয়াল্লাহু আনহু) বলতেন, 'হায়! মৃত্যুই যদি আমার শেষ পরিণতি হতো। যদি আমাকে কখনোই কবর থেকে উঠানো না হতো!

আবূ উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রদিয়াল্লাহু আনহু) বলতেন, ‘হায়! আমি যদি একটি ভেড়া হতাম আর আমাকে যবাই করে ফেলা হতো! যদি আমাকে রান্না করে ঝোল মাংস খেয়ে শেষ করে ফেলা হতো!

ইমরান ইবনু হুসাইন (রদিয়াল্লাহু আনহু) বলতেন, 'আমার ইচ্ছা হয়, আমি যদি ভস্মীভূত ছাই হতাম! আর বাতাস এসে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যেত!’

হুযাইফা (রদিয়াল্লাহু আনহু) বলতেন, 'হায়! যদি এমন কোনো ব্যক্তি পেতাম, যে আমার টাকা-পয়সার সব দায়িত্ব নিয়ে নিত, তা হলে আমি দরজা বন্ধ করে থাকতাম। আমার কক্ষে কাউকে প্রবেশের অনুমতি দিতাম না, যে পর্যন্ত না আমি মৃত্যুবরণ করছি, আর আল্লাহ তাআলার সাথে সাক্ষাত করছি।'

ইবনু আব্বাস (রদিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর চেহারায় অশ্রু প্রবাহের একটি দাগ ছিল। যা দেখে মনে হতো যেন একজোড়া পুরোনো ফিতা।

আয়িশা (রদিয়াল্লাহু আনহা) বলতেন, 'হায়! যদি আমার কথা সবাই ভুলে যেত!’

আলি (রদিয়াল্লাহু আনহু) বলতেন, 'আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহর রাসূলের সাহাবিদের দেখেছি। তোমাদের কেউ তাঁদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। আল্লাহর কসম! সকালবেলায় তাঁদের ঘুম ভাঙত উসকো-খুসকো চুলে। ধূলিধূসরিত অবস্থায় ও ফ্যাকাশে চেহারায়। অধিক সিজদাহর কারণে তাঁদের হাঁটু ও কপাল ছিল ছাগলের হাঁটুর মতো খসখসে। তাঁরা রাত কাটাতেন আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে, রুকু সিজদাহ করে। আর ঘুম ভাঙার পর যদি তাঁদের সামনে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হতো, তা হলে তাঁরা এমনভাবে কাঁপতেন যেভাবে ঝড়ের বাতাসে গাছপালা কাঁপতে থাকে। তাঁদের চোখ থেকে এমনভাবে অশ্রু ঝরত, যাতে তাঁদের পরিধেয় কাপড় ভিজে যেত। আল্লাহর কসম! এটাই ছিল তাঁদের অবস্থা। আর আজ আমি এমন লোকেদের দেখি যারা উদাসীন হয়ে ঘুমিয়ে থাকে। আর বেঘোরে রাত কাটিয়ে দেয়। [১৩]

মুসলিম ইবনু বশির বলেন, “মৃত্যুশয্যায় থাকাকালে আবূ হুরায়রা (রদিয়াল্লাহু আনহু) খুব কান্নাকাটি শুরু করলেন। লোকেরা জানতে চাইল, ‘আপনি এভাবে কাঁদছেন কেন?' জবাবে তিনি বললেন, ‘আমি কাঁদছি কারণ আমার সামনে এক বিরাট সফর অপেক্ষা করছে। অথচ এই সফরের জন্য তেমন কোনো পাথেয় সংগ্রহ করতে পারিনি। এই সামান্য পাথেয় নিয়ে এত দীর্ঘ সফর কীভাবে শেষ করব? হায়! কাল কিয়ামাতের দিনে সব মানুষের সাথে আমাকেও একত্রিত করা হবে। এরপর একদলকে বলা হবে জান্নাতে যেতে। আরেকদলকে বলা হবে জাহান্নামে যেতে। আমি তো জানি না আমি কোন দলের মধ্যে শামিল হব!' এই বলে আবূ হুরায়রা ক্রন্দন করতে লাগলেন। [১৪]

[১৩] মুখতাসারু মিনহাজিল কাসিদিন, ইবনু কুদামা । [১৪] ইবনু সাদ, হিলইয়া।


উসমান ইবনু আবূ সু'দাহ বলেন, একবার তিনি উবাদা ইবনু সামিত (রদিয়াল্লাহু আনহু)-কে দেখলেন একটি উপত্যকায় উপুড় হয়ে কান্নাকাটি করছেন। তিনি উবাদাকে বললেন, ‘হে আবূ ওয়ালিদ! আপনি কান্নাকাটি করছেন কেন? জবাবে উবাদা বললেন, ‘এই জায়গায় থাকাকালে নবি -কে জাহান্নামের কিছু দৃশ্য দেখানো হয়েছিল। ১)

আবূ হুরায়রা (রদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, 'যখন এই আয়াতটি নাযিল হলো—

তোমরা কি এই বিষয়ে আশ্চর্যবোধ করছ? এবং হাসছ-ক্রন্দন করছ না? তোমরা ক্রীড়া-কৌতুক করছ... ১৬।

তখন মাসজিদে নববির বারান্দায় থাকা সাহাবিরা এত বেশি কান্নাকাটি করলেন যে, তাদের দাড়ি ভিজে গেল এবং তাদের গাল দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। তাদের কান্নাকাটির শব্দ শুনে নবি সেখানে এলেন। তিনিও তাদের সাথে কাঁদতে লাগলেন। এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে হিসাবের ভয়ে কান্নাকাটি করে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। যদি তোমরা গুনাহ না করতে, তা হলে তোমাদের মধ্য থেকে আল্লাহ এমন একদল লোকের উত্থান ঘটাতেন, যারা গুনাহ করত আর আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দিতেন। ১

আনাস (রদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, যখন রাসূল এই আয়াত পড়লেন—

‘তোমরা সেই জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করো, যার জ্বালানী হবে মানুষ ও পাথর; যা প্রস্তুত করা হয়েছে কাফিরদের জন্য৷৷১৮]

তখন নবি ও বললেন, ‘জাহান্নামের আগুনকে এক হাজার বছর জ্বালানোর পর তা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। এরপর আরও এক হাজার বছর জ্বালানোর পর তা সাদা বর্ণ ধারণ করেছে। এরপর আরও এক হাজার বছর জ্বালানোর পর তা ঘোর কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে। এখন এর রং কালো এবং এর অগ্নিশিখা কখনো নিভে যায় না।'

হাদীসের বর্ণনাকারী বলেন, 'রাসূলুল্লাহ -এর সামনে একজন হাবশী বসে ছিল। সে এই হাদীস শুনে কাঁদতে লাগল। এমন সময় জিবরীল (আলাইহিস সালাম) সেখানে এলেন এবং রাসূল -এর কাছে ঐ ক্রন্দনরত লোকটি সম্পর্কে জানতে

[১৫] আল-হিলইয়া, ভলিউম ৬, পৃ ১১০। [১৬] সূরা নাজম, ৫৩:৫৯-৬১

[১৭] বাইহাকি, তারগীব, ভলিউম ৫, পৃষ্ঠা ১৯০।

[১৮] সূরা বাকারাহ, ২ : ২৪।


___চাইলেন। নবি বললেন, সে ইথিওপিয়ার অধিবাসী। এরপর তার কিছু নেক আমলের কথা বললেন। একথা শুনে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) বললেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “আমার ইজ্জতের কসম! আমার বড়ত্বের কসম! আমার মহান আরশের কসম! যখন কোনো বান্দা আমার ভয়ে ক্রন্দন করে, তখন তার জন্য আমি জান্নাতে হাসি-আনন্দের ব্যবস্থা করে দিই।””

উমার (রদিয়াল্লাহু আনহু) আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করতেন। অধিক ক্রন্দনের কারণে তাঁর চেহারায় দুইটি কালো দাগ বসে গিয়েছিল। একবার তিনি জুমার খুতবা দেওয়ার সময় সূরা তাকভীর-এর এই আয়াতটি পড়লেন—

علمت نفس ما أحضرت

‘তখন প্রত্যেকেই জেনে নিবে সে কী উপস্থিত করেছে৷ ১৯

এসময় আল্লাহর শাস্তির ভয়ে তাঁর কণ্ঠ ভারী হয়ে এল। তিনি আর তিলাওয়াত করতে পারলেন না। আরেকবার রাত্রিকালীন টহল দেওয়ার সময় উমার (রদিয়াল্লাহু আনহু) একটি ঘর থেকে এই আয়াতের তিলাওয়াত শুনলেন—

إن عذاب ربك لواقع ما له من دافع ‘আপনার পালনকর্তার শাস্তি অবশ্যম্ভাবী, তা কেউ প্রতিরোধ করতে পারবে না। ২০১

এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে গেলেন। প্রায় বিশ দিন ধরে তিনি অসুস্থ থাকলেন৷৷৷৷

তামিম আদ-দারী (রদিয়াল্লাহু আনহু) একবার এই আয়াতটি পড়লেন—

أم حسب الذين اجترحوا السيئات أن تجعلهم كالذين آمنوا وعملوا الصالحات سواء محياهم ومماتهم ساء ما يحكمون

‘যারা দুস্কর্ম উপার্জন করেছে তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে সে লোকদের মতো করে দেব, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং তাদের জীবন ও মুত্যু কি সমান হবে? তাদের দাবি কত মন্দ|২২|

[১৯] সূরা তাকভীর, ৮১ : ১৪। [২০] সূরা তূর ৫২: ৭-৮।

[২১] বাইহাকি, তারগীব, ভলিউম ৫, পৃষ্ঠা ১৯৪। [২২] সূরা জাছিয়াহ, ৪৫ : ২১।


এরপর সকাল হওয়া পর্যন্ত তিনি এই আয়াতটি বারবার পড়তে লাগলেন। আর কাঁদতে লাগলেন।

হুযাইফা (রদিয়াল্লাহু আনহু) প্রচুর কান্নাকাটি করতেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আপনি এত কাঁদেন কেন?” তিনি বললেন, 'আমি জানি না আমার সামনে কী আছে! চিরকালের সন্তুষ্টি না কি চিরকালের অসন্তুষ্টি?’

সা'দ ইবনু আল-আখরাম বলেন, 'একবার আমি ইবনু মাসউদ (রদিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে হাঁটছিলাম। আর তিনি এক কামারের পাশ দিয়ে গেলেন। সেই কামার আগুনের মধ্য থেকে একটি জ্বলন্ত লোহার টুকরা বের করে আনলো। এই দৃশ্য দেখে ইবনু মাসঊদ (রদিয়াল্লাহু আনহু) সেখানে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি সেই জ্বলন্ত লোহার দন্ড দেখে কাঁদতে লাগলেন!'

তাবিয়ি ও পরবর্তীদের মধ্যে আল্লাহর ভয়

হারাম ইবনু হাইয়ান বলতেন, 'আল্লাহর কসম! আমার ইচ্ছা হয়, আমি যদি একটা গাছ হতাম! আর কোনো উট এসে আমাকে খেয়ে ফেলত। আমি যদি সেই উটের মলমূত্র হয়ে নিঃশেষ হয়ে যেতাম! হায়, আমাকে যদি কিয়ামাতের দিন বিচারের জন্য উঠানো না হতো। নিশ্চয়ই আমি সেই ভয়াবহ বিপদের দিনকে ভয় করি!”

যাইনুল আবিদীন আলি ইবনুল হুসাইন (রহিমাহুল্লাহ)-এর চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যেত যখন তিনি ওযু করে সালাতের প্রস্তুতি নিতেন। লোকেরা বলত, ‘আপনার চেহারা এমন হয়ে গেছে কেন?' জবাবে তিনি বলতেন, “তোমরা কি জানো না, আমি কার সামনে দাঁড়াতে যাচ্ছি?'

মুহাম্মদ ইবনু ওয়াসি (রহিমাহুল্লাহ) রাতের অধিকাংশ সময় কান্নাকাটি করে কাটাতেন।

আর উমার ইবনু আবদিল আযীয (রহিমাহুল্লাহ)-এর সামনে যদি মৃত্যুর আলোচনা করা হতো, তিনি এমনভাবে কাঁপতেন যেভাবে পাখির ছানা কাঁপতে থাকে। আর এমনভাবে কাঁদতেন যে, তাঁর দাড়ি ভিজে যেত।

এক রাতে তিনি অনেক কান্নাকাটি করতে লাগলেন। তাঁর সাথে বাড়ির লোকেরাও কান্নাকাটি করতে লাগল। তখন উমারের স্ত্রী ফাতিমা বললেন, 'হে আমীরুল মুমিনীন! আপনার এমন অবস্থা হয়েছে কেন? আপনি কেন কাঁদছেন?” তিনি জবাব দিলেন, ‘আমি সেই দিনের কথা স্মরণ করছিলাম, যখন মানুষ আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে। আর তাদের একদলকে জান্নাতে যেতে বলা হবে, আরেক দলকে জাহান্নামের জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করা হবে।

একথা বলেই তিনি চিৎকার করে উঠলেন।

একবার আব্বাসীয় খলীফা আল-মনসুর জেরুজালেমে গেলেন। তখন সেখানকার একটি খানকার পাশে এসে যাত্রাবিরতি করলেন। সেই খানকায় এসে উমার ইবনু আবদিল আযীয (রহিমাহুল্লাহ) রাত্রিযাপন করতেন। খলীফা মনসুর জানতে চাইলেন, ‘তোমরা যদি উমার ইবনু আবদিল আযীয-এর ব্যাপারে কোনো আশ্চর্যজনক ঘটনা দেখে থাকো, তা হলে সেসব ঘটনা আমাকে বর্ণনা করো।'

জবাবে এক ব্যক্তি বলল, ‘এক রাতে তিনি এই ঘরের ছাদের ওপর ছিলেন। এই ঘরটির ছাদ ছিল মার্বেল পাথর দ্বারা নির্মিত। আমি দেখলাম ছাদের ওপর থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ছাদের ওপর কী হয়েছে দেখার জন্য আমি সেখানে গেলাম। গিয়ে দেখলাম উমার ইবনু আবদিল আযীয (রহিমাহুল্লাহ) সিজদাহরত অবস্থায় আছেন। আর তাঁর চোখ থেকে অবিরাম অশ্রুধারা বইছে! ছাদ থেকে সেই অশ্রু গড়িয়ে পাশের নালায় পড়ছে!

ইবরাহীম ইবনু ঈসা আল-ইয়াশকারী বলেন, ‘একবার আমি বাহরাইনের এক লোকের কাছে গেলাম। সেই লোকটি ছিল দুনিয়াবিমুখ। সে দুনিয়ার সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। সে একাকী সময় কাটাত। একবার সে আখিরাতের কিছু কথা স্মরণ করল আর মৃত্যুর আলোচনা করতে লাগল। এরপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। আর এতেই তাঁর মৃত্যু হয়ে গেল!'

মাসমা’ (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, “একবার আবদুল ওয়াহিদ ইবনি যাইদ খুতবা দিচ্ছিলেন। সেই খুতবায় উপস্থিত লোকের মধ্যে চারজন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল!'

ইয়াজিদ ইবনু মুরশিদ (রহিমাহুল্লাহ) প্রায়ই কাঁদতেন আর বলতেন, 'আল্লাহর কসম! যদি আমার রব আমাকে বাথরুমে বন্দি করে শাস্তি দেওয়ার ঘোষণা দিতেন, তবুও এটা আজীবন কান্নাকাটি করার জন্য যথেষ্ট হতো। অথচ তিনি তাঁর বান্দাদেরকে জানিয়েছেন, তাদেরকে জাহান্নামের আগুনে শাস্তি দেওয়া হবে। এরপরেও কীভাবে আমরা তাঁর অবাধ্য হতে পারি?

সারি আস-সাকাতি বলেন, 'প্রতিদিন আমি আমার চেহারার দিকে তাকাই। আর ভয়ে-ভয়ে ভাবি, যদি আল্লাহর অবাধ্যতার কারণে তিনি আমার চেহারাকে কালো পাঠক! এই ছিল ফেরেশতাবৃন্দ, আম্বিয়া (আলাইহিমুস সালাম) ও পূর্ববর্তী নেককার বান্দাদের মধ্যে থাকা আল্লাহর ভয়ের কিছু বিবরণ। তাদের থেকে আমাদেরই তো আল্লাহকে বেশি ভয় করা ও কান্নাকাটি করা উচিত।

আসলে আল্লাহকে ভয় করার বিষয়টি বান্দার গুনাহের পরিমাণের ওপর নির্ভরশীল নয়। যার গুনাহ যত বেশি, সে আল্লাহকে তত ভয় করে—বিষয়টি এমন নয়। বরং যার অন্তর যত পরিষ্কার এবং যার অন্তরে আল্লাহর ব্যাপারে যত বেশি ভালোবাসা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা আছে, আল্লাহর ব্যাপারে জ্ঞান আছে, সে আল্লাহকে তত বেশি ভয় করে। এজন্যই আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই তাঁকে ভয় করে। [২]

আমরা তো মূর্খ ও অজ্ঞ! এ কারণেই আমরা নিজেদেরকে নির মনে করি আল্লাহর শাস্তি থেকে। আর আমাদের অন্তরের কাঠিন্যের ব্যাপারে কোনো চিন্তাভাবনা করি না।

যে অন্তর স্বচ্ছ, সেই অন্তরে সামান্য ইলমের ছোঁয়া পেলেই আগুন জ্বলে উঠে। আর যে অন্তর যত কঠিন তাতে হাজার ওয়াজ নসিহত করলেও কোনো ভাবান্তর হয় না।

এজন্যই সালাফদের কেউ কেউ বলতেন, ‘আমি এক দরবেশকে বললাম, “আমাকে কিছু উপদেশ দিন।” জবাবে তিনি বললেন, “নিজেকে সেই ব্যক্তির জায়গায় চিন্তা করো, যাকে চারদিক থেকে হিংস্র জীবজন্তু ও বিষাক্ত সাপবিচ্ছু ঘিরে আছে। যদি এক মুহূর্তের জন্য অসতর্ক হও, তা হলে হিংস্র জন্তু তোমাকে খেয়ে ফেলবে অথবা কোনো সাপ-বিচ্ছু তোমাকে ধ্বংস করবে। তখন তোমার অন্তরে যে পরিমাণ ভয়ভীতি এবং সতর্কতা থাকে, তুমি আল্লাহর ব্যাপারে সেইরকম সাবধান হয়ে যাও!””

বলাই বাহুল্য, এখানে সতর্কতা বোঝানোর জন্য এই দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। নইলে আল্লাহর প্রতি ভয় আর সাপ-বিচ্ছুর প্রতি ভয় তো কখনোই এক নয়। আল্লাহকে ভয় করার মধ্যেও ভক্তি ও ভালোবাসা মিশে থাকে।

তবে দুনিয়াতে আমাদের অবস্থানকে সেই দরবেশের দেওয়া দৃষ্টান্তের সাথে মেলাতে

বাধা নেই। কারণ, এই দুনিয়া একটি অভিশপ্ত জায়গা। একজন মুমিন সবসময় চিন্তা

[২৩] মুখতাসারু মিনহাজিল কাসিদিন, ইবনু কুদামা , পৃ ৩১৯-৩২৩। [২৪] সূরা ফাতির, ৩৫ : ২৮]

করবে, সে দুনিয়াতে বিপদগ্রস্ত অবস্থায় আছে। চারদিক থেকে তাকে ঘিরে আছে অসংখ্য সাপ-বিচ্ছু ও বিষাক্ত জীবজন্তু।

যে মুমিনের অন্তর্দৃষ্টি আছে, সে আরও সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে বুঝতে পারবে, এই সাপ-বিচ্ছু তার চারপাশে নয় বরং তার অন্তরের ভেতরেই আসন গেড়ে আছে। এগুলো প্রকাশ পায় হিংসা, ক্রোধ, রাগ, ঘৃণা, গর্ব-অহংকার কিংবা লোক দেখানোর ইচ্ছার মধ্যে। যখনই সে অসতর্ক হয়, তখনই এগুলো তাকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খেতে থাকে। দুনিয়াতে আমাদের চোখের সামনে পর্দা পড়ে আছে, তাই আমরা ওদেরকে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু যেদিন গায়িবের পর্দা উঠে যাবে, আর আমাদেরকে কবরে মাটি চাপা দিয়ে আসা হবে, সেদিন আমরা নিজের চোখেই এসব সাপ-বিচ্ছু দেখতে পাব। এসব সাপ-বিচ্ছু মিশে আছে আমাদের আমল-আখলাক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে। তাই বুদ্ধিমান ব্যক্তির জন্য করণীয় হবে, মৃত্যুর আগেই নিজের ভেতরে বাস করা এসব সাপ-বিচ্ছুকে নির্মূল করা। নইলে আগামীকাল এরাই আমাদের কুরে কুরে খাবে। আর প্রতিমুহূর্তে দংশন করে বিষের যন্ত্রণা দিতে থাকবে।

@ এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে পড়ুন :-

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ