বইয়ের নামঃ সাতকাহন(অখন্ড)
লেখকঃ সমরেশ মজুমদার
সাতকাহন একটি বাগধারা যার অর্থ হচ্ছে প্রচুর পরিমাণ বা বিস্তারিত। আর সাতকাহন উপন্যাসটাতেও দীপাবলী নামের এক মেয়ের জীবনের বিস্তারিত আলাপ করা হয়েছে।
#স্পয়লার_এলার্ট
সেই দেশভাগের সময় থেকে পঞ্চাশ-ষাট দশকে যখন মেয়েরা ঘর সংসার ছাড়া কিছু করার ক্ষমতা পেতোনা বিভিন্ন কুসংস্কারে জর্জরিত ঠিক তখন জলপাইগুড়ির চা-বাগানে দীপা পুরোনাম দীপাবলী বন্দ্যোপাধ্যায় নামের একটি মেয়ে যেন সব জরাজীর্ণ নিয়ম ভাঙতে এসেছে। যে চা-বাগানের অন্যান্য বাড়ির মেয়েরা ঘরের বাহিরে সচারাচর কোন দরকার ছাড়া বের হয়না সেই একই চা-বাগানের মেয়ে দীপা এইসব কুসংস্কারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এবং পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে ছেলে বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা,ভোরবেলা ফুল কুঁড়ানো,মাছ ধরা,বাজারে যাওয়া, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যার আগে লুকিয়ে লুকিয়ে ঘরে ফেরা সকল ধরনের চঞ্চলতা তার ভিতরে খুঁজে পাওয়া যায়। এমনও না যে তাকে কিছু বলা হয়না।
বাড়ির কর্তা অমরনাথ মুখোপাধ্যায় চা-বাগানে কাজ করার জন্য ব্যাস্ত থাকে কিন্তু গিন্নি অঞ্জলি তারতো পুরো সংসার দেখতে হয় সে কড়া শাসনে রাখে দীপাকে। মায়েরা যা করে আরকি মারধোর বোকাঝোকা সবই অঞ্জলি দীপার উপর প্রয়োগ করে। কিন্তু দীপা তা যেন পরক্ষণেই ভুলে যায়। দীপার ঠাকুমা মনোরমা সেই অল্প বয়সে বৈধব্য পালন শুরু করেছে এবং সে এইসব নিয়মে অনেক কঠোর সে অঞ্জলির শাসনের সময় তেমন বাঁধা দেয় না বরং নিজেও নাতনিকে শাসন করে। দীপাবলী বন্ধু খোকন আর বিশু এদের সাথে চলার জন্য এত বাধা তবুও দীপাবলী তাদের সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট করেনা।
আর এইজন্যই বোধহয় দীপাবলীর ভাগ্যে ঝড় আসে মাত্র বারো বছর বয়সে তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। এবং বিয়ের সময় একটা কঠিন সত্যের মুখোমুখি হয় সে যাদের সেই ছোটবেলা থেকে বাবা-মা জেনে আসছে তারা আসলে তার মাসী-মেশো। একটা মেয়ে তার কৈশোর উপভোগ করার আগেই বিয়ের পিরিতে বসে পড়ে। বিয়ের তিনদিনের মাথায় দীপাবলী বিধবাও হয়ে যায়। তাকে আসলে অন্যায়ভাবে এই বিয়েটা দেওয়া হয়। বিধবা হওয়ার পরও থেমে থাকেনা দীপা তার শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ ও যাকে সবসময় বাবা জেনে আসছে সেই অমরনাথের অনুপ্রেরণায় আবার লেখাপড়া শুরু করে দীপাবলী। সে লেখাপড়ার জন্য চা-বাগান থেকে পাড়ি দেয় জলপাইগুড়ি শহর,কলকাতা।
জীবনে ধীরে ধীরে দীপা একা হয়ে পড়ে তার পরম আত্মীয় বলতে কেউ থাকেনা। তার জীবনে প্রেম এসে এসে করেও কখনো তেমনভাবে আসতে পারেনি। আই আর এস দিয়ে না টিকতে পেরে ডব্লিউ বি এস দিয়ে সরকারি ব্লকে চাকরি পায় অন্যায়ের সাথে আপোস করতে না পারার জন্য সেই চাকরি ছাড়তেও কুন্ঠাবোধ করেনি সে। তারপর আবার কঠোর পরিশ্রম করে আই আর এস দিয়ে আয়কর বিভাগে চাকরিও নেয় সে।
দীপা ছিল অনেক সাহসী, এবং কোন লুকোচুরি না করে সোজাসাপ্টা কথা বলতেই বেশি পছন্দ করে সে। একা থাকাটা কতটা কষ্টের তা কিছুটা হলেও দীপা চরিত্রের মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায়।
সাতকাহন বইটির প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড মিলে দীপার শৈশব,কৈশোর,চাকরিজীবন,সংসারজীবন,সেই ষাটের দশকের কলকাতার চেহারা, সরকার বিরোধী আন্দোলন,ছাত্ররাজনীতি, দেশ বিভাগে মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন, সরকারি চাকরিতে সৎ থেকে টিকে থাকার লড়াই,অসৎ মানুষদের আধিপত্য সবদিকগুলো ফুটে উঠেছে।
সাতকাহন পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ
বইটা পড়ার সময় মনে হচ্ছিল আমি দীপাবলী নামের একটি মেয়ের বায়োগ্রাফি পড়ছি। এত অসাধারণ একটা বই। অনেক দীর্ঘ একটা উপন্যাস কিন্তু বিন্দু পরিমান বিরক্ত হয়নি পড়তে। লেখকের বর্ণনাশৈলী ভীষণ শক্তিশালী চা-বাগান,আঙরাভাসা নদী কলকাতা,জলপাইগুড়ির বন্যা, দিল্লি শহর সব যেন আমার চোখের সামনে এমন মনে হয়েছে।
শুধু পড়তেই ইচ্ছে করেছে আমার। সবমিলিয়ে অনেক ভালো লেগেছে বইটি। হুম কিছু জায়গায় বিরক্তি কাজ করেছে সেটা দীপাবলী চরিত্রের এক রোখামির কারনে কিন্তু লেখকের লেখায় আমার কোন খারাপ লাগা কাজ করেনি।
প্রিয় কিছু চরিত্রঃ
দীপাবলীঃ এই চরিত্রটায় উপন্যাসে মূল চরিত্র এই চরিত্রকে ঘিড়েই সকল চরিত্রের আগমন ঘটেছে। আর এই চরিত্রটার মাধ্যমে লেখক মেয়েদের মাথা তুলে দাঁড়াবার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এবং যা বলার মানুষের সামনে অকপটে বলার সাহস ছিল যা প্রতিটা মানুষের ইচ্ছে বলেই আমি মনে করি। একটা মেয়ের পৃথিবীতে আপন বলতে কেউ নেই তবুও সে পড়ালেখাকে আপন করে নিয়ে সকল প্রতিকূল পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করে জীবনে সফলতা অর্জন করেছে। কিন্তু তবুও এই চরিত্রের মাধ্যমে লেখক একটা কথা বুঝিয়ে দিয়েছে পৃথিবীতে একা বাস করা আসলেই সম্ভব না পাশে কাউকে না কাউকে চাই সে বুড়ো ঠাকুমা হলেও অন্তত পাশে থাকুক কেউ। আমার পাঠক জীবনে অন্যতম প্রিয় একটা চরিত্র হয়ে থাকবে দীপাবলী।
অমরনাথঃ অমরনাথ দীপার বাবা ছিলো। এতো মায়া লেগেছে এই চরিত্রটার জন্য এই চরিত্রটা থেকে মানুষের শিখার আছে অনেক কিছু নিজের মেয়ে না হওয়া স্বত্বেও দীপাকে সে সবসময় আগলে রেখেছে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষটা দীপার জন্য ভেবে গেছে।
দীপার বন্ধু খোকনঃ আহা একেই বলে বন্ধুত্ব। সেই ছোট থেকে সে পাশে ছিল বড় হয়েও পাশে থাকার চেষ্টা করেছে দীপার। খোকন চরিত্রটার জন্য কেন জানিনা বুকের ভিতর শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল।
মনোরমাঃ একজন মহিলা যে সারাজীবন তার আদর্শে ছিল অনড়। সে যা শিখেছে যা করেছে সারাজীবন তাই আগলে রাখবে সেটাই স্বাভাবিক ছিল কিন্তু শেষে এসে সে তার ভুল বুঝতে পারে এটাই বা কম কিসে। ঠাকুমাওতো একা হয়ে গিয়েছিলো খুব। বুড়ো মানুষগুলোকে আমাদের সময় দেওয়া উচিত ভালোবাসা উচিত।
অঞ্জলি,মায়া,রমলা সেন,অমল,অলোক,শমিত, এই চরিত্রগুলোও মনে রাখার মত ছিল।
সবশেষে বলবো বইটা সকল মেয়েদের পড়া উচিত জীবনে হার না মানা শিখার জন্য। আর ছেলেদের পড়া উচিত মেয়েদের প্রতি সম্মানটা আরো বাড়বে এবং সংগ্রামী মেয়েদের পথের বাঁধা নয় পাশে হাটার,সাহায্য করার মানসিকতা তৈরী হবে....
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....