শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়
رب العالمين، والصلاة والسلام على رسوله الكريم، الحمد لله وعلى اله واصحابه اجمعين، وعلى كل من تبعهم باحسان الى يوم
শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়
বর্তমান যুগের বাণিজ্যে এক নতুন লেনদেনের সংযোজন হয়েছে, যাকে পরিভাষায় ‘শেয়ার’ (Share) বলে। যেহেতু বিগত শতাব্দীর শেষের দিকে শেয়ারের প্রচলন শুরু হয়েছে তাই পূর্ববর্তী ফকীহগণের লিখনীতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা নেই। তাই এখানে শেয়ার এবং স্টক এক্সচেঞ্জে চলমান কিছু লেনদেন সম্পর্কে আলোচনা পেশ করছি।
শেয়ার বাজারের সূচনা
প্রথম যুগে কয়েক ব্যক্তির মাঝে যে ‘শিরকাত’ (অংশীদারিত্ব) হতো তাকে বর্তমান পরিভাষায় পার্টনারশিপ (Partnership) বলা হয়। কিন্তু গত দুই তিন শতাব্দী ধরে এক নতুন কারবারের সূচনা হয়েছে, যাকে জয়েন্ট স্টক কোম্পানী (Joint Stock Company) বলা হয়। এর কারণে ব্যবসায় নতুন রূপ ধারণ করেছে এবং শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের নতুন মাসআলা সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বব্যাপী অসংখ্য স্টক মার্কেট (Stock Market) শেয়ারের ব্যবসা করছে এবং এসব স্টক মার্কেটে কোটি কোটি বরং বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা-ডলারের লেনদেন হয়ে থাকে।
শেয়ার আসলে কী?
প্রথমে জানা উচিত শেয়ার আসলে কী? কোম্পানীর শেয়ারকে বাংলায় ‘অংশ’ এবং আরবীতে '~' বলে। শেয়ার মূলত কোম্পানীর আসবাবপত্রে শেয়ার হোল্ডারের মালিকানার আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন আমি যদি কোনো কোম্পানীর শেয়ার ক্রয় করি, তাহলে শেয়ারের সার্টিফিকেট (যা একটি কাগজ মাত্র) ওই কোম্পানীতে আমার মালিকানার প্রনিধিত্ব করবে। সুতরাং শেয়ার ক্রয়ের দ্বারা কোম্পানীর সকল আসবাবপত্র ও সম্পত্তিতে আমি আনুপাতিক হারে মালিকানা সাব্যস্ত হবে।
আগেকার যুগে ব্যবসা-বাণিজ্য হতো ছোট পরিসরে। দু'চারজন মিলে মূলধন যোগাড় করে অংশীদারী ব্যবসা করত। কিন্তু বড় আকারের ব্যবসা এবং বড় শিল্পের জন্য অধিক মূলধন যোগাড় করা তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না- এজন্যই কোম্পানীর অস্তিত্ব ঘটেছে। এর প্রসিদ্ধ পদ্ধতি হলো, কোনো কোম্পানী অস্তিত্বে আসার পূর্বেই নিজের কর্মপদ্ধতি এবং পরিচিতি (Prospectus) প্রকাশ করে। শেয়ার ইস্যু করে। শেয়ার ইস্যুর অর্থ হলো, লোকদেরকে কোম্পানীর অংশীদার হওয়ার আহ্বান করা।
যখন কোনো কোম্পানী অস্তিত্বে আসে তখন সে কোম্পানী বাজারে শেয়ার ছেড়ে লোকদেরকে শেয়ার ক্রয়ের আহ্বান করে। তখন যে ব্যক্তি শেয়ার ক্রয় করে সে মূলত কোম্পানীর কারবারে অংশীদার হচ্ছে এবং কোম্পানীর সম্পত্তিতে অংশীদার হচ্ছে। যদিও এটাকে সাধারণ পরিভাষায় শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় বলে কিন্তু শরয়ী দৃষ্টিকোণে এটা কোনো ক্রয়-বিক্রয় নয়। বরং যখন কেউ টাকা দিয়ে শেয়ার ক্রয় করছে তখন সে কোনো পণ্য পাচ্ছে না। কেননা কোম্পানী এখনও ব্যবসা শুরু করেনি এবং এখন পর্যন্ত তার কোনো সম্পত্তিও নেই। বরং কোম্পানী সবেমাত্র শুরু হচ্ছে। যেমনিভাবে প্রথমে কয়েক ব্যক্তি টাকা যোগাড় করে কারবার শুরু করে তেমনিভাবে কোম্পানী শুরুলগ্নেই লোকদেরকে কোম্পানীর অংশীদার হওয়ার আহ্বান করছে। সুতরাং যে ব্যক্তি শেয়ার ক্রয় করছে সে মূলত কোম্পানীর অংশীদার হচ্ছে। অতএব যে ব্যক্তি অংশীদারী কারবারে যে শেয়ার সার্টিফিকেট গ্রহণ করছে সেই শেয়ার সার্টিফিকেট মূলত কোম্পানীর আসবাবপত্র ও সম্পত্তিতে আনুপাতিক হারে ওই ব্যক্তির মালিকানার প্রতিনিধিত্ব করছে। এটাই হলো শেয়ারের বাস্তবতা।
নতুন কোম্পানীর শেয়ারের বিধান
যখন কোনো কোম্পানী শেয়ার ইস্যু করে তখন ওই কোম্পানীর শেয়ার ক্রয় করা শর্ত সাপেক্ষে জায়েয আছে। শর্ত হলো, ওই কোম্পানী কোনো হারাম কারবার শুরু করছে না। যদি কোনো হারাম কারবার শুরু করতে যাচ্ছে, তাহলে কোনোভাবেই ওই কোম্পানীর শেয়ার ক্রয় করা জায়েয নেই। যেমন মদ তৈরির কারখানা লাগানো হচ্ছে। সুদি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। ইনস্যুরেন্স কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। তবে যদি হালাল কারবারের জন্য কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে শেয়ার ইস্যু করা হয়, তাহলে সেই শেয়ার ক্রয় করাতে কোনো অসুবিধা নেই, জায়েয আছে। যেমন কোনো টেক্সটাইল কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করা হলো। কিংবা অটো মোবাইল কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করা হলো।
শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের বাস্তবতা
যখন কোনো ব্যক্তি শেয়ার ক্রয় করল সে ওই কোম্পানীর অংশীদার হয়ে গেল। কিন্তু সাধারণ নিয়ম হলো, শেয়ার হোল্ডার তার শেয়ারগুলো স্টক মার্কেটে বেচাকেনা করে থাকে। সুতরাং যখন একটি কোম্পানী প্রতিষ্ঠা হলো এবং তার সকল শেয়ার বিক্রি হয়ে গেল তারপর যখন ওই কোম্পানীর শেয়ার স্টক মার্কেটে বেচাকেনা হবে বস্তুত শরীআতের দৃষ্টিকোণ থেকে এটাই হলো ‘শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়’। উদাহরণস্বরূপ যখন একটি কোম্পানী শুরু হলো তখন আমি দশটি শেয়ার ক্রয় করেছি। অতঃপর আমি ওই শেয়ারগুলো স্টক মার্কেটে বিক্রয় করছি। তাহলে যে ব্যক্তি আমার শেয়ারগুলো ক্রয় করল সে মূলত কোম্পানীতে আমার আনুপাতিকহারের মালিকানা ক্রয় করল। আর এই ক্রয়ের দ্বারা সে আমার স্থলে কোম্পানীতে আমার অংশীদারিত্বের মালিক হয়ে যাবে। এটাই হচ্ছে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের বাস্তবতা।
চারটি শর্তে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় জায়েয
যে ব্যক্তি স্টক মার্কেটে থেকে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করতে চায় তার জন্য চারটি শর্ত মেনে চলা আবশ্যক।
প্রথম শর্ত
সে কোম্পানী যেন হারাম কারবারে জড়িত না থাকে। যেমন সুদি ব্যাংক, সুদ ও জুয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত ইনস্যুরেন্স কোম্পানী, মদের ব্যবসায়ী কোম্পানী অথবা অন্য কোনো হারাম কারবারে জড়িত কোম্পানী। এ ধরণের কোম্পানীর শেয়ার ক্রয় করা কোনো অবস্থাতেই জায়েয নেই। কোম্পানীর প্রতিষ্ঠালগ্নেও জায়েয নেই এবং পরবর্তীতে শেয়ার বাজার থেকে ক্রয় করাও জায়েয নেই
দ্বিতীয় শর্ত
ওই কোম্পানীর সকল সম্পত্তি যেন অস্থাবর (Lequid Assets) অর্থাৎ নগদ টাকা-পয়সা না হয়, বরং কিছু স্থাবর সম্পত্তিও (Fixed Assets) থাকতে হবে।
ক্রয় বিক্রয়ের পদ্ধতি - ২
যেমন বিল্ডিং নির্মাণ করেছে অথবা জমি ক্রয় করেছে। আর যদি কোম্পানীর কোনো স্থাবর সম্পত্তি না থাকে, বরং সবই অস্থাবর সম্পত্তি (টাকা-পয়সা) তাহলে ওই কোম্পানীর শেয়ার গায়ে লেখা মূল্যের (Face Value) চেয়ে কমবেশি (Above Par or Below Par) দামে বিক্রয় করা জায়েয নেই। বরং সমান সমান দামে বিক্রয় করা আবশ্যক।
এটা সুদ হবে
এর কারণ হলো, যত লোক টাকা দিয়ে এই কোম্পানীর শেয়ার ক্রয় করেল সেই টাকা দিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আসবাবপত্র ক্রয় করা হয়নি। কোনো বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়নি। কোনো মেশিনারী ইত্যাদি ক্রয় করা হয়নি। বরং সকল টাকা এখন পর্যন্ত নগদ হিসেবেই রয়ে গেছে। এমতাবস্থায় দশ টাকার শেয়ার দশ টাকার প্রতিনিধিত্ব (Represent) করছে। যেমনিভাবে দশ টাকার বন্ড (Bond) দশ টাকার প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। অথবা দশ টাকার নোট দশ টাকার প্রতিনিধিত্ব করে। অতএব দশ টাকার শেয়ার যেহেতু দশ টাকার প্রতিনিধিত্ব করছে তাই এটা এগারো বা নয় টাকায় বেচাকেনা করা জায়েয নেই। কেননা এটা দশ টাকার নোট এগারো বা নয় টাকায় বিক্রি করার মতো বিষয় হবে, যা স্পষ্ট সুদ হওয়ার কারণে নাজায়েয।
তবে যদি কোম্পানীর কিছু স্থাবর সম্পত্তি থাকে, যেমন টাকা দিয়ে কোম্পানী কাঁচামাল (Raw Material) বা তৈরি মাল (Produced Good) ক্রয় করেছে। বিল্ডিং নির্মাণ করেছে অথবা কোনো মেশিনারী ইত্যাদি ক্রয় করেছে, তাহলে এমাতবস্থায় লিখিত মূল্যের চেয়ে কম বা বেশি মূল্যে শেয়ার বিক্রয় করা জায়েয আছে। আর এটা একটি ফিকহী মূলনীতির ভিত্তিতে জায়েয হয়েছে। তা হলো, যখন স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ বিক্রি করা হবে অথবা টাকার পরিবর্তে টাকা লেনদেন করা হবে তখন সমান সমান হওয়া জরুরী। আর যদি স্বর্ণের সাথে অন্য কোনো জিনিস মিশ্রিত হয় তাহলে স্বর্ণ সমানভাবে বিক্রয় আবশ্যক, তবে মিশ্রিত বস্তু কমবেশি করা জায়েয আছে। যেমন মুক্তাযুক্ত একটি স্বর্ণের হার, যার ওজন এক তোলা। কেউ যদি এই হার ক্রয় করতে চায়, তাহলে এক তোলা ও এক আনা দিয়ে ক্রয় করতে পারবে। তখন এক তোলা স্বর্ণ হবে এক তোলা স্বর্ণের বিনিময়ে আর এক আনা স্বর্ণ মুক্তার বিনিময় সাব্যস্ত হবে। তেমনিভাবে কোম্পানীর সম্পত্তিতে যদি কিছু নগদ অর্থ, কিছু স্থাবর সম্পত্তি অথবা কিছু কাঁচামাল থাকে, তাহলে এক্ষেত্রেও উপরোল্লিখিত নীতিমালা প্রযোজ্য হবে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো কোম্পানী দশ টাকা মূল্যের একশ শেয়ার ইস্যু করেছে, যা দশ ব্যক্তি ক্রয় করল। প্রত্যেকেই কোম্পানীকে দশ দশ টাকা প্রদান করে শেয়ার গ্রহণ করল । কোম্পানী এখন পর্যন্ত কোনো সম্পত্তি ক্রয় করেনি। তাহলে দশজনের একশ টাকার শেয়ার কোম্পানীর একশ টাকার প্রতিনিধিত্ব করছে। এমতাবস্থায় ধরুন এক ব্যক্তি ‘ক’ এর নিকট একটি শেয়ার আছে। সে এই শেয়ার দশ টাকার পরিবের্ত এগারো টাকায় বিক্রি করতে চায়। এটা জায়েয নেই। কেননা এটা দশ টাকা এগারো টাকায় বিক্রির নামান্তর। কারণ কোম্পানী ওই টাকা দিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো স্থাবর সম্পত্তি ক্রয় করেনি, বরং নগদ অর্থ হিসেবে মজুত আছে। সুতরাং এই শেয়ার কম বা বেশি মূল্যে বিক্রয় করা জায়েয নেই।
উদাহরণস্বরূপ, যখন কোম্পানীর নিকট একশ টাকা জমা হলো তখন চল্লিশ টাকা দিয়ে বিল্ডিং ক্রয় করল। বিশ টাকার মেশিনারী এবং বিশ টাকার কাঁচামাল ক্রয় করল। দশ টাকা হস্তমজুদ আছে এবং পণ্য বিক্রির কারণে দশ টাকা ক্রেতাদের নিকট পাওনা আছে। নকশা দিয়ে বুঝলে বিষয়টি আরও সহজবোধগম্য হবে।
কোম্পানীর সর্বমোট পুঁজি ১০০/- (একশত) টাকা =
এমতাবস্থায় কোম্পানীর সম্পত্তি পাঁচ ভাগে বিভক্ত হলো। এখন ‘ক’ এর নিকট যে দশ টাকার শেয়ার আছে তা ওই অনুপাতে ভাগ হবে। অর্থাৎ ‘ক’ এর দশ টাকা হচ্ছে চার টাকা বিল্ডিং, দুই টাকা মেশিনারী, দুই টাকা কাঁচামাল, এক টাকা পাওনা এবং এক টাকা হস্তমজুদ বাবদ। এখন ‘ক’ যদি দশ টাকার শেয়ার বারো টাকায় বিক্রি করতে চায়, তাহলে জায়েয হবে। এই বিক্রির অর্থ হচ্ছে, ‘ক’ এক টাকায় এক টাকার পাওনা বিক্রয় করল। আর এক টাকায় এক টাকার নগদ অর্থ বিক্রয় করল। বাকি দশ টাকার বিনিময়ে অন্যান্য আসবাবপত্র বিক্রয় করল। সুতরাং তার এ বিক্রয় শুদ্ধ হয়েছে। সে যে দুই টাকার মুনাফা করেছে তা নগদ অর্থ ও পাওনা টাকার বিনিময়ে নয়, বরং তা অন্যান্য আসবাবপত্রের বিনিময়ে লাভ করেছে এবং এ মুনাফা গ্রহণ করা জায়েয আছে।
কিন্তু যদি কখনও কোম্পানীর পাওনা এবং নগদ অর্থ দশ টাকার বেশি হয়ে যায়, তখন ‘ক’ এর জন্য দশ টাকার শেয়ার নয় টাকায় বিক্রি করা জায়েয হবে না। If you want to read more - You Must Buy ( ক্রয়-বিক্রয়ের ইসলামী পদ্ধতি ) Hardcover
Credit Of This Article :- শায়খুল ইসলাম জাস্টিস মুফতী মুহাম্মদ তকী উসমানী দা.বা.
মুফতী ওসমান গনী
মুহাদ্দিস, জামি‘আ ইসলামিয়া দারুল উলূম ঢাকা
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....