বই : জানি সে আসবে না
লেখক: আরিফুর রহমান
প্রকাশনী: অন্যধারা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১২৮
মলাট মূল্য: ২৭০ টাকা
প্রচ্ছদ এবং নামকরন:
"জানি সে আসবে না" – না আসার খবরটি নিশ্চিত জেনেও লাইনটি দিয়ে কারো ফিরে আসার, কাউকে ফিরে পাওয়ার তীব্র এক আকাঙ্খা প্রকাশ করছে। পাশে পাবে না জেনেও অবাধ্য এই মন বারংবার কোনো একজনকে আশা করে। জানি সে মানুষটা আসবে না তবুও আমরা তীর্থের কাকের মত তার পথ চেয়ে থাকি। বইয়ের প্রচ্ছদে সে বিষয়টি স্পষ্ট। স্পষ্ট হয় উপন্যাসের প্রধান চরিত্র পূর্ণতা সেনের জীবনেও। সুতরাং বইয়ের প্রচ্ছদ এবং নামকরন যথাযথ হয়েছে বলেই মনে করি।
কাহিনি সংক্ষেপ:
মানব জীবনকে মাঝে মাঝে বিশৃঙখল সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তেমনি এক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র আশফাক ফাহিম। একজন লেখকের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি গল্পের। এমন একটি গল্প যা তার লেখক জীবনকে পূর্ণ করবে। সাংসারিক জীবনের টানপোড়ান এর মধ্যে তিনি যখন অনেকটাই নিমজ্জিত ঠিক সেই সময়ে তার লেখক জীবনকে পূর্ণ করতে এমনি এক গল্প নিজ পায়ে হেঁটে এসেছিল। গল্পটি পূর্ণতা সেন। পূর্ণতার নিজের জীবনের দুর্বিষহ অতীত জানানোর আকুলতা আশফাক ফাহিমকে মুগ্ধ করে। মুগ্ধ করে তার গাল বেয়ে পড়া চোখের পানি।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র পূর্ণতা সেন বনেদী হিন্দু ঘরের মেয়ে। শুরুতে পূর্ণতা সেনকে বেপরোয়া মনে হলেও উপন্যাসের ধারাবাহিকতায় পূর্ণতাকে পাওয়া গেছে কখনো চঞ্চল কিশোরী, কখনো উদ্যমী, কখনো বা ভীষণ সাহসী।
রাতের আধারে যে গল্প নিজে এসে ধরা দিয়েছিল, ঠিক তেমন করে আবার হারিয়েও যায়। হারিয়ে যায় পূর্ণতা সেন। আশফাক ফাহিম ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন পূর্ণতার খোঁজে। পূর্ণতাকে সে পায়নি, পেয়েছে পূর্ণতার জীবনের গল্প। পনেরো বছর আগে কি বিষাদময় অধ্যায় পাড়ি দিয়ে চঞ্চল কিশোরী পূর্ণতা পরিনত হয়েছে পূর্ণতা সেনে– সে গল্প। কি নিদারুণ এক যন্ত্রণা বুকে বেঁধে মেয়েটি ঘুরছে – সেই গল্প। এমনি এক গল্প যা আশফাক ফাহিমের উদ্যোগে মলাটবদ্ধ করার সাথে সাথে পাঠকসমাজ হুমড়ি খেয়ে পড়ে তা সংগ্রহের জন্য।
পূর্ণতা সেন ফিরে এল বইমেলার এক সন্ধ্যায়। বিশ্বজয়ের হাসি নিয়ে আশফাক ফাহিম পূর্ণতার হাতে তুলে দেন পূর্ণতার নিজের জীবনের গল্প। পূর্ণতা কেঁপে ওঠে বিষ্ময়ে, ভয়ে, অজানা এক ভালো লাগায়। সেই সন্ধ্যায় দুজনের মাঝে শুরু হয় নতুন এক রূপকথা। তবে তার স্থায়িত্ব অল্প সময়। সেই রূপকথা নিজেদের কাছে বাস্তব হয়ে ধরা দেয়ার আগেই খুন হয় আশফাক ফাহিম। যেই পূর্ণতা সেন আশফাক ফাহিমের ভালোবাসায় সিক্ত থাকার কথা ছিল সে এখন খুনের অভিযুক্ত আসামী। যেই সমাজের ধিক্কারের যন্ত্রণায় পূর্ণতা সেনকে পনেরো বছর আগে শৈশবের দীর্ঘ একটা সময় ঘরবন্দী হয়ে থাকতে হয়েছে, আজ এতবছর পরে এসেও সেই সমাজ আবারও তাকে খুনের অপবাদে কোনঠাসা করতে চাইছে কারাগারে।
পাঠ প্রতিক্রিয়া:
বইটির ক্ষেত্রে একটি কথা আমাকে অবশ্যই বলতে হবে, "বইটির ধারণ ক্ষমতা নিজের আকারের চাইতে অনেক বেশি"। সাধারণত উপন্যাসিকার ক্ষেত্রে দুইটা বা তিনটা চরিত্রকে সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়। কিন্তু এখানে পার্শ্ব চরিত্রগুলোও যেন একেকটা প্রধান চরিত্র। কি অসাধারণ সব সম্পর্কের উপস্থাপন। পূর্ণতার ভীষণ বিপদে তার বাবা মাকে লেখক যে অসাধারণ রুপে তাদেরকে অবতার করেন সত্যি প্রশংসনীয়।
গুটিকয়েক শব্দ দিয়ে একজন পাঠককে তার ব্যক্তিজগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে গল্পের মধ্যে টেনে আনার কাজটা অত্যন্ত ভারী। লেখক আরিফুর রহমান এই ভারী কাজটি করেছেন দক্ষতা এবং সফলতার সাথে। এখানেই তার সৃষ্টির স্বার্থকতা। আমি বদ্ধ রুমে মুখ গুজে আছি " জানি সে আসবে না" বইয়ে অথচ আমার মন ঘুরে বেড়াচ্ছিল দার্জিলিং এর উচু সব পাহাড়, গাছ, নির্মল আকাশ আর নদীর কলকল ধ্বনীতে। কখনো পিটার জোসেফ এর নদী, কখনো আশফাক ফাহিমের। গল্পের ধারাবাহিকতায় একেক সময় একেক চরিত্রে ডুবে যাচ্ছিলাম। কখনো ভীষণ যন্ত্রণা পাচ্ছিলাম, কখনো ভীষণ আনন্দ, ভীষণ সুখ৷ গভীর রাতের অন্ধকারে শরীর মিশিয়ে মা, মেয়ের বৃষ্টিতে ভিজতে পারার অসাধারণ সব অনুভূতি আমাকে বারবার ছুয়ে যাচ্ছিল। হারিয়ে যাচ্ছিলাম খুব বিশ্বস্ত কারো কাছে থেকে ঠকে যাওয়ার গ্লানির মাঝে। ছুয়ে যাচ্ছিল ভালোবাসাকে ভীষণ কাছে থেকে স্পর্শ করার উত্তেজনা কিংবা ভীষণভাবে ভালোবেসে ফেলা মানুষটার হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট এবং দীর্ঘশ্বাসগুলো। উপন্যাসের শেষাংশে আশফাক ফাহিমের খুনের রহস্য সমাধানে এক টানটান স্নায়ুবিক উত্তেজনা উপভোগ করেছি।
পছন্দের চরিত্র:
এই জায়গায় এসে আমি একটু অবাক হয়েছি। উপন্যাসের প্রত্যেকটা চরিত্রই অসাধারণ তবে প্রধান সব চরিত্র টপকে উপন্যাসের একটা পার্শ্বচরিত্র আমাকে বেশ টানছে। রাহা। রাহার চরিত্রটা আমার বেশ দারুণ লেগেছে।
আমাদের অনেকের মনে গভীর ভালোবাসার জন্ম হয় ঠিকই কিন্তু প্রকাশ করার সাহস হয় না। ভালোবাসলে এতটা গভীরভাবেই বাসতে হয়। এতটাই সাহসী হতে হয়। এতটাই বেহায়া হতে হয়। ভালোবাসার মানুষের কাছে থেকে সবটা আদায় করে নেয়ার সৎ সাহস রাহার আছে। আমার নেই। আফসোস হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় একবিংশ শতাব্দীতে বাস করা আমার আশি নব্বই দশকের ভীতু বাঙালিয়ানা মনটাকে যদি রাহার মনের সাথে এক্সচেঞ্জ করতে পারতাম। দারুন হতো!
তবে লিলিয়ানা চরিত্রের জন্য আমার বেশ মায়া হয়। না জানি কতকাল আবার মা'কে মায়ের মত করে পাবে না ছোট্ট মেয়েটি।
বইটি কেন পড়বেন?
কেন খুন হয় আশফাক ফাহিম? কি এমন গল্প ছিল পূর্ণতার জীবনে? পূর্ণতাই কি আশফাক ফাহিমের খুনি? "জানি সে আসবে না" এই যে দীর্ঘ দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস, ঠিক কার অপেক্ষা কিংবা কার আসার অপেক্ষার মৃত্যু হয়েছিলো উপন্যাসে? উপন্যাসে কি পূর্ণতা সেনের শুধুই অপেক্ষার মৃত্যু ঘটেছিলো নাকি আশারও মৃত্যু!
এতগুলো প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে বইটি পড়তে হবে। সুতরাং আমার লেখা কয়েক লাইনের কাহিনি সংক্ষেপে যে উপন্যাসের আদ্যোপান্ত তুলে ধরা সম্ভব হয়নি এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন।
উপন্যাসটা দাঁড়িয়ে রয়েছে সুন্দর একটা প্লটের উপর ভিত্তি করে। আর পুরো উপন্যাস জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন সব অনুভূতির সংমিশ্রণ। সেই অনুভূতির সাক্ষাৎ পেতে হলে বইটি আপনাকে পড়তে হবে। প্রথমেই বলেছি, "বইটির ধারণ ক্ষমতা তার আকারের চাইতে অনেক বেশি" সেই ধারণ ক্ষমতা মাপার জন্য হলেও বইটা আপনাকে সংগ্রহ করতে হবে।
নিজেদের আচরণের কারণে অনেক কাছের মানুষ হারিয়ে ফেলি। আবার ভুল আবেগে ভুল মানুষের সাথে জড়িয়ে পড়ি। প্রত্যাশার পরিমান আকাশচুম্বী করে পরক্ষণেই হাতাশায় ডুবে মরি। উপন্যাসে এমন কয়েকটি বাস্তবিক দিক উপস্থাপন করা হয়েছে। উপন্যাসটি পড়ে এক ধরনের আত্নতৃপ্তি হয়। খুব ব্যস্ততার মাঝে একটা ভালো সময় কাটানোর জন্য বইটি পড়া যেতে পারে। মনের খোরাক মিটবে। অবসর সুন্দর হবে।
লেখক: আরিফুর রহমান পরিচিতি
নাম , ধাম , বয়স , সময় বিবিধের ভিড়ে তিনি হারাতে চাননি কোনোদিন । তাই তাঁর পরিচয় অতি সাধারণ । লেখার আনন্দে লেখেন , সৃষ্টি সুখের উল্লাসে গল্প বলেন , আর ভাগ করে নিতে ভালোবাসেন নানা রকমের গল্প সকল বন্ধুদের সঙ্গে । ছোটবেলায় কেটেছে সিরাজগঞ্জের কাজিপুরের বিস্তৃত সবুজ গ্রাম নাটুয়ার পাড়ায় । বাবা প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ আব্দুল কুদ্দুস সরকার , মা আসমা সরকার , ছয় ভাই - বোনের মধ্যে কনিষ্ট সন্তান । জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন তিনি । হুটহাট করে ঘুরতে বের হওয়া এবং জমিয়ে আড্ডা দেওয়া তাঁর ভালোলাগা । চেনা - অচেনা গ্রামের মেঠোপথে হাঁটতে ভীষণ ভালোলাগে তাঁর । অন্যরকম বর্তমানে বাস করছেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত প্রশান্তিকা পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন । কবিতা পড়তে ভীষণ ভালোবাসেন । যাঁরা তাঁকে চেনেন এবং জানেন তাঁরাই বলেন , তিনি তাঁর লেখার মতোই সহজ ও সরল । তাঁর পাঁচটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে । সন্ধ্যারাগ , নিঃশব্দ প্রহরে , দহন দিনের গান , এবং একা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং দৃষ্টি কেড়েছিল পাঠকমহলের । সেই অনুপ্রেরণায় ষষ্ঠ উপন্যাস জানি সে আসবে না ।
প্রশান্তিকা বইঘর থেকে আজ অনেক কেই 'জানি সে আসবে না' দিতে পারিনি। সে জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। সেই সঙ্গে এখানকার প্রিয় মানুষদের কাছে চির কৃতজ্ঞ। আমার মতো ক্ষুদ্র লেখকের উপন্যাস এত আগ্রহে সংগ্রহ করবেন ভাবতে পারিনি।
যে কয়েক কপি বই আনা হয়েছিল দুদিনে শেষ হয়ে গেছে। এই সপ্তাহের মধ্যে আরো বই আসছে। তখন নিশ্চয়ই ' জানি সে আসবে না আপনার কাছে পৌঁছে যাবে। সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও নিরন্তর ভালোবাসা।
আর যে ছবিটি দেখছেন । এই ছবিতে যিনি আছেন তিনি সিডনিতে আমার প্রিয় একজন। একজন বিজ্ঞ, উদার রাজনীতিবিদ। শুধু তাই নয় তিনি হলেন আমাদের সর্বজন একজন মুরব্বি। আরেকটি পরিচয় দিই। তিনি অসম্ভব রকমের একজন সেরা পাঠক। প্রশান্তিকা বইঘরের অন্যতম একজন পাঠক। তিনি যে শুধু রাজনৈতিক বই পড়েন তা কিন্তু নয়। তিনি সকল ধরণের উপন্যাস পড়েন। বিশেষ করে সাদাত হোসাইনের সকল উপন্যাস তার পড়া। এবং আমার সকল উপন্যাস। তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। সেই প্রিয় Gama Kadir ভাইকে আবারও জানাই শ্রদ্ধা ও সালাম।
বই পড়ুন, বই উপহার দিন প্রিয়জন কে।
জানি সে আসবে না পাওয়া যাচ্ছে প্রশান্তিকা বইঘরে এবং বাংলাশের মেলায় পাওয়া যাচ্ছে ৩১৩-৩১৬ নং স্টলে অথবা রকমারি তে।
বইটি কোথায় পাবো?
বইটি ২০২২ এর বইমেলায় প্রকাশ হয়। কিন্তু বইমেলা তো শেষ তবে সংগ্রহের উপায়? ঘরে বসেই বইটি অনলাইনে অর্ডার করতে পারবেন রকমারী থেকে।
অর্ডার করতে ক্লিক করুন এই লিংকে:
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....