রিভিউ : কালো পঁচিশের আগে ও পরে
আবুল আসাদ একজন প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট। এ পর্যন্ত প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ইতিহাস গ্রন্থ 'কাল পঁচিশের আগে ও পরে' এবং 'একশ' বছরের রাজনীতি', ঐতিহাসিক ঘটনার চিত্রধর্মী গল্প 'আমরা সেই সে জাতি' (তিন খন্ড) এবং প্রবন্ধ সংকলন 'একুশ শতকের এজেন্ডা'। তাঁর সবচেয়ে সাড়া জাগানো সাহিত্যকর্ম হলো সাইমুম সিরিজ। এ পর্যন্ত এই সিরিজের ৫৯ টি বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি কয়েকবার গ্রেফতারও হয়েছেন।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালো রাত্রি আমাদের ইতিহাসের এক স্বতন্ত্র অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এর প্রেক্ষাপর এবং পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ সৃষ্টি করেছে এক নতুন ইতিহাস এবং জন্ম দিয়েছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের। কিন্তু এর সঠিক ইতিহাস এবং ২৫শে মার্চের আগের ও পরের ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ নতুন প্রজন্মের কাছে খুব স্পষ্ট নয়। জাতীয় জীবনের অতীত ইতিহাসের ঘটনাবলীকে সঠিকভাবে পরিবেশন না করা হলে তা জাতির জন্যই ক্ষতিকর প্রমাণিত হতে পারে।
রাজণৈতিক উত্থান, পতন ও পট পরিবর্তনের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী যথাযথভাবে উপস্থাপন না করা আত্ম প্রবঞ্চনারই শামিল। ইতিহাস কখনো বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা নয়। এ এক ধারাবাহিক এবং প্রবাহমান বিষয়বস্তু। আর ইতিহাসের নিরপেক্ষ উপস্থাপনা খুবই কঠিন কাজ। বিশেষ করে যারা ইতিহাসের অংশ বা ইতিহাস সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অবদান রাখেন তাদের জন্য এ কাজ আরো কঠিন। জাতি ঐ বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে কিভাবে সাড়া দিয়েছিল বা তখনকার পরিস্থিতিতে রাজনীর চালচিত্র এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলোর ভূমিকা কি ছিল পরবর্তী সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে অবস্থান করে তার চুলচেরা মূল্যায়ন নিঃসন্দেহে এক জটিল ব্যাপার। ঘটনা সংঘটিত হয়ে যাবার পর মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে অভ্যস্ত। আর এ কারণেই সঠিক ঘটনা অনেক সময় তলে পড়ে যায়। ঘটনার পেছনে যে ঘটনা থাকে সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করার অবকাশ অনেকের থাকে না। বিশিষ্ট লেখক এবং সাংবাদিক জনাব আবুল আসাদ দলিল প্রমানের ভিত্তিতে ২৫শে মার্চের আগের ও পরের ঘটনাবলী উপস্থানের কষ্টকর প্রয়াস চালিয়েছেন। যথাসম্ভব নিরপেক্ষ দৃষ্টিতেই তিনি ঐ সময়কার একটি বাস্তব চিত্র অঙ্কনের চেষ্টা করেছেন।
গতকাল যা ঘটে, তা আজকের ইতিহাস। কিন্তু ইতিহাস ক্যামেরার ছবি নয়, কিংবা নয় ঘটনার ধারা বিবরণী। ঘটনার পেছনে যে ঘটনা থাকে তাও ইতিহাসের অংশ। তাই মনে হয় সব লেখার মধ্যে ইতিহাস লেখার কাজ সবচেয়ে কঠিন।
জাতীয় জীবনের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ সময় ১৯৭১ সাল। এক রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে এ বছর স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পত্তন হয়। জাতীয় ইতিহাসের অবিস্মরণীয় অধ্যায় এ মহা ঘটনা। লেখক এখানে মাত্র দুটো প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে চেষ্টা করেছেন। প্রশ্ন দুটো হলো, কোন পটভূমিতে স্বাধিকারের আন্দোলন রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত হলো এবং জাতীয় জীবনের সে মহা ঘটনায় কেন জাতি একমত হয়ে এক কাঁতারে দাঁড়াতে পারেনি।
প্রশ্ন দুটির উত্তর সন্ধান করতে গিয়ে লেখক যা লিখেছেন, তা বিভিন্ন সংবাদ পত্র ও গ্রন্থের বিবরণী এবং অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তির উক্তির সমাহার মাত্র। সেই সময়ের একজন কর্মজীবী সাংবাদিক হিসেবে যা দেখেছেন, যা অনুভব করেছেন, তাও তাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে।
মানুষ অবশ্যই ক্যামেরা নয়, মানুষ মানুষই। ইচ্ছা, আবেগ বিশিষ্ট জীবন্ত সত্তা সে। এ সীমাবদ্ধতার কথা লেখকের সামনে ছিল। ইতিহাস বর্ণনায় তিনি চেষ্টা করেছেন ঘটনাকে অনুসরণ করতে, ঘটনা তাকে অনুসরণ করেনি।
গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ স্বাধীনতা যুদ্ধে জাতি এক সাথে এক কাতারে দাঁড়াতে পারলো না কেন- এ প্রশ্নের আলোচনায় একজন সাধারণ দর্শকের অবস্থান থেকে গোটা বিষয়কে লেখক দেখেছেন।
ইতিহাস কারো ইচ্ছা বা আবেগের অধীন নয়। কিংবা কোনো গ্রুপ বা মহলও একে কুক্ষিগত করতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে ইতিহাসের নামে খেয়াল খুশীর চর্চা চলছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেই এটা বেশী হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক যাকে ‘মুক্তিযুদ্ধের রূপকথা’ রচনার প্রবণতা অভিহিত করেছেন। এখন যা কিছু হচ্ছে তা সবই ইতিহাসের কাঁচামাল। এসব কাঁচামাল পরখ করেই লিখিত হবে ইতিহাস। এ গ্রন্থে লেখক ইতিহাস বর্ণনায় প্রাপ্ত কাঁচামাল নাড়াচাড়া করে ইতিহাস অনুসন্ধিৎসুদের কাছে কিছু কথা রাখতে চেষ্টা করেছেন। ইতিহাস জানতে হয় যুক্তি, তথ্য আর উপাত্ত দিয়ে। ইতিহাস আর উপন্যাস,সিনেমা এক নয়। ইতিহাস একটু রসকষহীন সত্য। এমনিতেই আমাদের দেশে ইতিহাস চর্চা খুব কম। যাও হয় তাও বেশিভাগই গল্প। বিশেষ করে আমাদের মুক্তির সংগ্রাম ৭১ কে নিয়ে।
লেখক তার বইয়ে তুলে ধরেছেন ২৫ শে মার্চের পূর্বের আর পরের বেশ কিছু ঘটনা। এই বইয়ের কিছু অংশ এরকম-"২৫ মার্চ বিকেলে মুজিব ক্যাণ্টনমেণ্ট সোর্সে জানতে পারলেন যে, রাজনৈতিক সমাধানের কোনো সম্ভাবনা নেই এবং সেনাবাহিনী তার অভিযানের জন্যে তৈরি হচ্ছে। বিকেলে ঐ একই উৎস থেকে মুজিবকে বলা হলো, ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেছেন। সেনাবাহিনীর আসন্ন অভিযানের রকম প্রকৃতি শেখ মুজিব অনুমান করতে পারলেন না। তিনি তাঁর চারদিকের সহকর্মীদের তৎক্ষণাৎ ঢাকা শহর থেকে সরে যাবার নির্দেশ দিলেন এবং তোফায়েল, রাজ্জাক প্রমুখ যুব নেতাদের বুড়িগঙ্গার ওপরে গ্রামাঞ্চলে সরে যেতে বললেন।
রাত সাড়ে দশটার দিকে একটা সেনা ইউনিট রেডিও ও টিভি স্টেশনের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলো এবং সাড়ে এগারটা থেকে ব্যাপক আকারে গোলাগুলি শুরু হলো। মুজিব বাড়ীতে থাকারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাজউদ্দীন ও আমি কয়েকজন বন্ধু সমেত হোটেল ইন্টারকন্টালে আটকা পড়েছিলাম। বাঙ্গালীদের প্রতি সহানুভূতিশীল সব বিদেশী সংবাদদাতারাও সেখানে অবস্থান করছিলেন। তাঁরাও আটকা পড়লেন। ভুট্টো ১১০০ নং স্যুটে অবস্থান করছিলেন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে সেনাবাহিনীর ৫৮ থেকে ৬০টি গাড়ীর একটা বহর প্রেসিডেণ্ট হাউজ থেকে বেরিয়ে আমাদের হোটেল অতিক্রম করে বাঁ দিকে ঘুরে শাহবাগের দিকে চলে গেল। সাথে সাথেই আমি হোটেল থেকে মুজিবের কাছে টেলিফোন করলাম। ফোনটা ধরলেন হাজী মোরশেদ। আমি তাকে জানাতে বললাম যে, আমার আশংকা আর্মি মুজিবের বাড়ী আক্রমণ করতে পারে। তাঁকে নিরাপদ স্থানে সরে পড়া দরকার।"
বইয়ের অন্যএ উল্লেখ করেছেন- পঁচিশ ও পঁচিশ-পূর্ব এ সকল ঘটনার বাস্তবতা সামনে রেখে শেখ মুজিব কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার পরবর্তীকালের দাবীকেও অস্বীকার করা হয়। পঁচিশ পরবর্তী আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কাজ ও আচরণ এবং ভারতের ভূমিকা প্রমাণ করে, তাঁরা এ ধরনের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা জানতেন না। জিয়াউর রহমান অর্থাৎ ‘মেজর জিয়া’র স্বাধীনতা ঘোষণা ছাড়া অন্য কারও কথা জনগণও জানে না। সকলের কাছে মেজর জিয়াই স্বাধীনতার ঘোষক। ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিব জানালেন, স্বাধীনতার নির্দেশনামা তিনি জহুর আহমদ চৌধুরীকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। [জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ’৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৫০১]
আরেকটা বিবরণ পওয়া যায় ডেভিড লোসাকের লেখা লণ্ডনে প্রকাশিত ‘Pakistan Crisis’ গ্রন্থ থেকে। ঐ বর্ণনা অনুসারে ‘(২৫ মার্চ রাতে) যখন প্রথম গুলীটি বর্ষিত হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিও’র সরকার তরঙ্গের (ওয়েভ লেনথ) কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে শেখ মুজিবের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। ওই কণ্ঠের বাণী মনে হয় আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিলো। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রিক বাংলাদেশে হিসেবে ঘোষণা করেন।’
[নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, সিদ্দিক সালিক, পৃষ্ঠা-৮৫] শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার অন্য একটি বিবরণ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহির্বিশ্ব প্রচার বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তিকা ‘বঙ্গবন্ধু স্পীকস’। স্বাধীনতার এ ঘোষণাটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে প্রচারিত হয়। [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১]
স্বাধীনতা সংক্রান্ত এ তিনটি ঘোষণার মধ্যে স্থানকাল-পাত্র ও বক্তব্যের দিক দিয়ে অসংগতি প্রকট। শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তাঁর যে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা উল্লেখ করেছেন তা জহুর আহমদ চৌধুরীর মাধ্যমে চট্টগ্রামের কাছাকাছি বঙ্গোপসাগরে নোঙর করা জাহাজ হতে টেকনাফ থেকে দিনাজপুর দেশের সর্বত্র এবং বন্ধুদেশগুলোতে প্রচার করা হয়।
[Tis message was communicated from Teknaf to Dinajpur and to friendly countries through some vessel which was anchored at Bay of bengal near chittagong by Mr. Zahur Ahmed Choudhury.“জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ’৭৫, অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৫০২”]
ডেভিড লোসাক তাঁর ‘পাকিস্তান ক্রাইসিস’ গ্রন্থে পূর্ব বাণীবদ্ধ স্বাধীনতা ঘোষণায় সে সময়ের কথা (যা সিদ্দিক সালিকের ‘নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল’ বইতে উদ্ধৃত হয়েছে) বলেছেন, সেটা হলো ২৫ মার্চের মধ্যরাত। প্রচারের মাধ্যম ছিলো বেনামী ওয়েভলেনথ, কারণ তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আর বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহির্বিশ্ব প্রচার বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু স্পীকস’ পুস্তিকায় শেখ মুজিব কর্তৃক স্বাধীনতার যে ঘোষণাটির কথা বলা হয়েছে, তা চিটাগাং থেকে সাবেক ইপিআর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রচার করা হয়। আবার পুস্তিকাটির শিরোনামায় এ ঘোষণাটি ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে’ প্রচার হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
[Message enbodying declaration of independence sent by Bangabandhu Shaik Mujibur Rahman to Chittagong Shortly after miidnight of 26th March, 1971 for transmission through out Bangladesh over the ex-EPR Transmitter.” বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১] শিরোনাম : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণা।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, তৃতীয খণ্ড, পৃষ্ঠা-১]] কিন্তু সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপিত হয়নি। স্থান-কাল-পাত্রের এ পার্থক্য ছাড়াও ঘোষণার বক্তব্যের বিরাট পার্থক্য লক্ষণীয়।
এরকম একাত্তরের সময়ের ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন দলীয় ইতিহাস আছে। কিন্তু ইতিহাসের সেই মহেন্দ্রক্ষনে আসলে কি ঘটেছিল? সেই সত্যকে জানতে হলে
পড়তে হবে "কালো পঁচিশের আগে ও পরে" বইটি।
নিরপেক্ষ চিন্তা নিয়ে বইটি পাঠ করলে অনেক চিন্তার খোরাক পাওয়া যাবে আশা করি। যদিও বইটিতে ছোট-ছোট কিছু শাব্দিক ভুল নজরে এসেছে, তারপরেও বইটি ছিলো চমৎকার শিক্ষনীয় একটি পাঠ্য। অনুরোধ রইলো একটিবার পড়ে দেখার জন্য, অজানা অনেক তথ্য সমম্পর্কে জানার সূযোগ হবে। দোয়া রইলো লেখকের জন্য।
রিভিউ লিখেছেন :- Jabal Att Tariq
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....