পথিকৃৎআব্দুল মান্নান তালিব জীবনী গ্রন্থby আবুল আসাদ (সম্পাদক)
Title পথিকৃৎAuthor আবুল আসাদ
Publisher বাংলা সাহিত্য পরিষদ
Quality পেপারব্যাক
Edition 1st Published, 2015Number of Pages 466
Country বাংলাদেশ
Language বাংলা
File Type : PDF Download Free
আব্দুল মান্নান তালিব জীবনী (সম্পূর্ণ)
আবদুল মান্নান তালিব ভাইয়ের জীবন ও সাহিত্যকর্মের ওপর একটি স্মারক গ্রন্থ আমরা প্রকাশ করছি । তাঁর প্রশংসা - প্রশস্তি আমাদের লক্ষ্য নয় । তালিব ভাইও জীবনে কখনো এটা চাননি । পরের জন্য যার জীবন , তিনি এটা চাইতেও পারেন না । তাঁকে স্মরণ করা আমাদের লক্ষ্য । উদ্দেশ্য তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নেয়া , প্রেরণা পাওয়া । মহৎ জীবন বাতিঘরের মতো । বাতিঘর অন্ধকারের পথিককে পথ দেখায় । এজন্য প্রয়োজন হয় বাতিঘরকে প্রজ্বলিত রাখা । মহৎ জীবনের ক্ষেত্রে এটাই সত্য । তাঁদের কীর্তি কথা যদি উত্তরসূরিরা স্মরণ না করে , আলোচনা না হয় , মূল্য ও মূল্যায়ন না পায় , তা হলে তেলহীন নিভে যাওয়া বাতির মতো তাঁরা বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যান ।
হারিয়ে ফেলার অভ্যাস আমাদের আছে । সাহিত্য - সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যাঁরা আমাদেরকে পথ দেখিয়েছেন , যাঁরা পথ দেখাতে পারেন , তাঁদের সিংহভাগকে আজ বিস্মৃতির অন্ধকারে আমরা ঠেলে দিয়েছি । মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী , আকরম খাঁ , ড . মুহম্মদ শহীদুল্লাহ , ইসমাঈল হোসেন সিরাজী , আবুল মনসুর আহমদ , আবুল কালাম শামসুদ্দিন প্রমুখ ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্বের জীবন ও সাহিত্যকর্ম , তাঁদের চিন্তা , মননশীলতা ও স্বপ্ন , আমাদের সামনে আছে তা বলা যাবে না । এক ধরনের সংকীর্ণ রাজনীতির কালো ছায়া আমাদের অতীতকে যেন ঢেকে দিতে চাচ্ছে । জীবনানন্দ দাশ আমাদের ভাষার একজন শ্রেষ্ঠ কবি । জসীম উদ্দীনও বাংলা কাব্যসাহিত্যের একজন অনন্য প্রতিভা । কায়কোবাদ মহাকবি ।
কিন্তু আমরা কায়কোবাদের কয়টা মহাকাব্যের নাম জানি ? জীবনানন্দ দাশকে আমরা স্মরণ করব , কিন্তু জসীম উদ্দীন , কায়কোবাদ , বেনজীর আহমদ , ফররুখ আহমদদের আমরা ভুলে যাবো কেন ? আমার ভয় হয় কবি নজরুল আমাদের জাতীয় কবি না হলে তাঁকেও কায়কোবাদের মতো বিস্মৃতির তালিকায় স্থান পেতে হতো কি না ? অতীতকে , আমাদের অতীত অগ্রজদের এই ভুলে যাওয়া ভাল কাজ নয় । যারা বা যে জাতি অতীতকে , অতীতের , মশাল - বরদারদের ভুলে যায় , তারা সামনে চলার পথ পায় না , তাদের ভবিষ্যৎ বলেও কিছু থাকে না । এমন জাতি স্বাধীনতা রক্ষার যোগ্যতাও হারিয়ে ফেলে । এটা আশংকার কথা , ভয়ের কথা , ভাবনার কথা । আমরা সকলে এই ভয় ভাবনার হাত থেকে বাঁচতে চাই । এ লক্ষ্যেই আমরা আমাদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে আমাদের অগ্রজদের অন্ধকার থেকে দিনের আলোতে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি । চেষ্টা করছি নানা প্রোগ্রামের মাধ্যমে । আবদুল মান্নান তালিবের জীবন ও সাহিত্যকর্মের ওপর এই স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ আমাদের চলমান কাজেরই একটা অংশ । আবদুল মান্নান তালিব একজন নীরব সাহিত্য সাধক । কিন্তু অত্যন্ত সমাজ সচেতন ।
চোখ বন্ধ করা , জগৎ - বিচ্ছিন্ন , বাস্তবতাবিমুখ অন্ধকারে লুকানো সাধক তিনি নন । হাল - নোঙরহীন সাহিত্য - স্বত : স্ফূর্ততা নামক নৈরাজ্যের অনুসারী তিনি ছিলেন না।'আর্ট ফর আর্ট সেক ’ মানবতাবিরোধী এক উচ্ছৃঙ্খল ধারণা । আবদুল মান্নান তালিবের চাওয়া - পাওয়ার তৃষ্ণা পূরণে তাঁর সাহিত্য ছিল উচ্চকণ্ঠ । এই দৃষ্টিকোণ থেকেই আবদুল মান্নান তালিবের অনুবাদ সাহিত্যকে দেখতে হবে । আবদুল মান্নান তালিবের অনুবাদ সাহিত্য বলতে গেলে বাংলা ভাষায় যুগান্ত সৃষ্টিকারী । এই সাহিত্য যেমন সংখ্যার দিক দিয়ে বড় , তেমনি ওজনে পর্বতের মতো ভারি । তাঁর নব্বইয়ের অধিক গ্রন্থের মধ্যে তাঁর অনুবাদকর্মের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশের মতো ( খণ্ড শিরোনামসহ ) । এর মধ্যে রয়েছে ' পয়গামে মোহাম্মদী ' , ' ইসলামে রেনেসাঁ আন্দোলন ' , ' ইসলামী সমাজ দর্শন ' , ' সূদ ও আধুনিক ব্যাংকিং ' , ' ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার মূলনীতি ' , ' চরিত্র গঠনের মৌলিক উপাদান ' , ' সীরাতে সরওয়ারে আলম ' , ' ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী'র মতো যুগান্তকারী গ্রন্থ । এর সাথে রয়েছে সহীহ আল বুখারী ( চতুর্থ খণ্ড ) , রিয়াদুস সালেহীন ( ২ য় , ৩ য় ও ৪ র্থ খণ্ড ) শীর্ষক বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থের অনুবাদ । তাঁর সবচেয়ে বড় অনুবাদকীর্তি পবিত্র কুরআনুল মাজিদের তাফসীরের অনুবাদ ।
১৯ খণ্ডে সমাপ্ত অনুবাদের মধ্যে ১৪ টি তিনি অনুবাদ করেছেন । অনূদিত তাঁর গ্রন্থগুলো পিপাসার্ত লাখো মানুষের তৃষ্ণা মিটিয়ে আসছে । আবদুল মান্নান তালিবের সাহিত্য প্রকাশনা শুরু ১৯৬২ সালে । কিন্তু তাঁর সাংবাদিকতা শুরু এর অনেক আগে । ১৯৫২ সালে ‘ বীরভূম ' বার্ষিকীর সম্পাদনার মধ্য দিয়ে তাঁর সাংবাদিকতা জীবন শুরু । দৈনিক ‘ তাসনিম ' ( ১৯৫৭ থেকে ১৯৫৯ ) ও দৈনিক ইত্তেহাদ ' ( ১৯৫৯ থেকে ১৯৬০ ) -এর তিনি সাব- এডিটর ছিলেন । ১৯৬২ থেকে ১৯৬৬ তিনি সাপ্তাহিক ‘ জাহানে নও ’ সম্পদনা করেছেন । তিনি মাসিক ‘ পৃথিবী’র সম্পাদক ছিলেন ১৯৮১ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত । সাহিত্য মাসিক ' কলম ' তিনি সম্পাদনা করেছেন ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত । তিনি দৈনিক সংগ্রামে’র একজন কলামিস্ট এবং ছোটদের ‘ শাহীন শিবির ' পাতার দীর্ঘদিন পরিচালক ছিলেন ।
১৯৬২ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম সাহিত্য গ্রন্থের নাম ' অবরুদ্ধ জীবনের কথা । তিনি তাঁর প্রথম সাহিত্যকর্ম সমাজের বঞ্চিত অবহেলিত নারীদের জীবন কথার ওপর লিখেছেন । মহিলাদের জীবন ছিল সমাজের অত্যন্ত বেদনাদায়ক একটা সমস্যার নাম । আবদুল মান্নান তালিব এদের পক্ষেই প্রথম কলম ধরেন । ইসলামের শিক্ষা ও সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁর মধ্যে এই সচেতনতা আসে । ইসলামে নারীদের অবস্থান বিষয়ে পরবর্তীকালে তিনি আরো কাজ করেন । ' রসুলের ( স . ) যুগে নারী স্বাধীনতা ' শীর্ষক বিশাল গ্রন্থটির চার খণ্ড তাঁর উদ্যোগে অনূদিত ও প্রকাশিত হয় । আবদুল মান্নান তালিব একটি বহুমুখী সাহিত্য - প্রতিভা । তাঁর রয়েছে মৌলিক গ্রন্থ , শিশু - কিশোর সাহিত্য , সম্পাদিত গ্রন্থ ও বহুমুখী অনুবাদ সাহিত্য । তিনি শিশু - কিশোরদেরকে অর্থহীন রূপকথা শোনাননি । শিশুদের হাতে শিক্ষা ও তাদের জীবন গঠনমূলক বই তিনি তুলে দিয়েছেন । তাঁর শিশুতোষ বইয়ের সংখ্যা এক ডজনের মতো । তাঁর সাহিত্য - সংগঠকও ছিলেন । ছিলেন তিনি অগ্রগণ্য সাহিত্য প্রতিভার জনকও । আমাদের দেশে কায়কোবাদ , সিরাজী , নজরুল , ফররুখ ধারার বাহক হিসাবে সত্তর - আশির দশক থেকে কবি - সাহিত্যিকদের একটা নতুন প্রজন্মের যে শক্তিমান যাত্রা শুরু হয়েছে , তার একজন নীরব নকশাকার ছিলেন আবদুল মান্নান তালিব ।
তিনি বাংলা সাহিত্য পরিষদের পরিচালক ছিলেন প্রায় ২৭ বছর । তাঁর নেতৃত্বে বাংলা সাহিত্য পরিষদ লেখক গড়ার প্লাটফরম হিসাবে কাজ করেছে । এর মাধ্যমে তিনি অসংখ্য কিশোর - তরুণের সংস্পর্শে এসেছেন । এঁদেরকেই তিনি উপদেশ দিয়ে উৎসাহ দিয়ে হাতে কলমে শিখিয়ে সাহিত্যের পথে পরিচালনা করেন । বর্তমান প্রজন্মের যাঁরা কবি , গল্পকার , প্রাবন্ধিক তাঁদের অনেকেই এটা স্বীকার করবেন । তিনি সাপ্তাহিক ' জাহানে নও ’ - এর সম্পাদক ছিলেন ৪ বছর । মাসিক ‘ পৃথিবী’র সম্পাদক তিনি ছিলেন ১৮ বছর । মাসিক ' কলম ' - এর সম্পাদক ছিলেন ১৭ বছর । দীর্ঘকাল একাধিক পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে থাকায় হাজারো নতুন কবি- সাহিত্যিকদের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটেছে । এঁরা সকলেই তাঁর পরিচর্যা , তাঁর সাহায্য - সহযোগিতা , উপদেশ - পরামর্শ পেয়েছেন অব্যাহতভাবে ।
বাংলা সাহিত্য পরিষদের পরিচালক হিসাবে , সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকাগুলোর সম্পাদক হিসাবে যাঁরাই তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন , তাঁরা স্বীকার করবেন যে , পিতৃসুলভ স্নেহ ও শিক্ষকসুলভ সহযোগিতা তাঁর কাছ থেকে তাঁরা পেয়েছেন । আবদুল মান্নান তালিব সাহিত্য ক্ষেত্রে কবি লেখক গড়ার যে বহুমুখী সুযোগ দীর্ঘকাল ধরে পেয়েছেন , তেমন সুযোগ কদাচিৎ কোনো মানুষের ভাগ্যে ঘটে । সেদিক থেকে তিনি সৌভাগ্যবান । এই সৌভাগ্য তিনি নব্য লেখক গড়ার কাজে ব্যয় করেছেন । মানুষ হিসাবে তিনি আল্লাহ'র মুহসীন বান্দার সুস্পষ্ট এক প্রতিচ্ছবি । জ্ঞানের সন্ধানে জাতির প্রয়োজনে তিনি হিজরত করেছেন । তাঁর হিজরতকারী গোটা জীবনকে তিনি আল্লাহর জন্য ব্যয় করেছেন । তাঁর কুরআন মাজীদ - এর বিশাল তাফসীর গ্রন্থের অনুবাদ , হাদীস গ্রন্থের অনুবাদ , অতি প্রয়োজনীয় সব ইসলামী সাহিত্যের অনুবাদ , তাঁর মৌলিক গ্রন্থসমূহ ও দীর্ঘকাল ধরে হাজারো সাহিত্য - মানস গড়ার তাঁর কাজ সবই ছিল আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য । আল্লাহ তাঁর এই ভালো কাজকে কবুল করুন এবং তাঁর জান্নাত নসীব করুন ! আল্লাহর বান্দাদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এমন একজন মানুষের জীবন ও সাহিত্যকর্মের ওপর আলোচনা গ্রন্থ প্রকাশ করতে পেরে আমরা আনন্দিত ।
যারা এই স্মারকে লেখা দিয়ে আমাদের এই উদ্যোগকে সমৃদ্ধ ও সফল করেছেন তাদের ধন্যবাদ । এর যাযাহ তারা আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে পাবেন । আল্লাহ ছাড়া কোনো কিছুই সম্পূর্ণ নয় । অনেকের কাছ থেকে লেখা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি । সময় অভাবে এবং নানান টানাপোড়েনে অনেকে লেখা দিতে পারেননি । এসব ব্যক্তির লেখা পেলে নিঃসন্দেহে স্মারক গ্রন্থটি আরো সমৃদ্ধ হতো । আমাদের এই স্মারক গ্রন্থে অনেক অসম্পূর্ণতা থেকে গেল । আমাদের অনিচ্ছাকৃত ত্রুটিকে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা হবে , এই প্রত্যশা আমরা করছি ।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....