আল কুরআনের হরফ যত অর্থ তত..! আবদুল্লাহ আল মাসউদ

আল কুরআনের হরফ যত অর্থ তত..!  আবদুল্লাহ আল মাসউদ,কুরআনের সৌন্দর্য pdf download no available by আবদুল্লাহ আল মাসউদ | সন্দীপন প্রকাশনী বই পিডিএফ
Cover Image : কোরআনের সৌন্দর্য

কুরআনের সৌন্দর্য
by আবদুল্লাহ আল মাসউদ | সন্দীপন প্রকাশনী

আরবি ভাষার একটি নিয়ম হলো, কাসরতুল মাবানি তাদুল্লু আলা কাসরতিল মাআনি। অর্থাৎ, একটি শব্দে হরফের সংখ্যা বাড়লে তার সাথে পাল্লা দিয়ে অর্থও বাড়বে। ফলে একই অর্থের এক ধরনের দু’টি শব্দের মধ্যে একটিতে কম আর অন্যটিতে বেশি হরফ থাকলে যে শব্দে হরফ বেশি আছে তা অর্থের দিক থেকে ব্যাপকতা লাভ করে। ইতিপূর্বে রহমান আর রহীম শব্দের আলোচনায় আমরা এটি দেখেছি।

এই ধরনেরই আরেকটি বিষয় এখন জানব। সূরা কাহফে মূসা ও খাযির এ-এর আলোচনা করা হয়েছে। তাদের ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হলো, জ্ঞান অন্বেষণের উদ্দেশ্যে মূসা তাঁর একজন সহচর-সহ খাযির -এর কাছে আগমন করেন এবং তাঁর কাছ থেকে শেখার আবেদন জানান। খাযির ৯ তাঁর আবেদন মঞ্জুর করেন। তবে শর্তারোপ করেন যে, তিনি নিজ থেকে ব্যাখ্যা প্রদান করার আগে তাঁর কোনো কর্ম সম্পর্কে আপত্তি করা যাবে না। কিন্তু মূসা * আপাত দৃষ্টিতে শরীয়ত-বিরোধী মনে হওয়ায় তাঁর কয়েকটি কর্মের ওপর আপত্তি করেন। একে একে তিনবার শর্ত ভঙ্গের ভুল করায় খাযির তাকে নিজের থেকে পৃথক করে দেন।

আর নবিরা কখনো অন্যায় দেখে চুপ থাকেন না। যথাসাধ্য প্রতিবাদের চেষ্টা করেন। তাই তিনি আপত্তি তুলে বলেন, 'আপনি নৌকার আরোহীদের ডুবিয়ে মারার জন্য নৌকাটি ফুটো করে দিলেন?

তাঁর মুখে এমন প্রশ্ন শুনে খাযির বললেন,

ألم أقل إنك لن تستطيع معي صبرا

‘আমি কি বলিনি যে, আপনি আমার সাথে থেকে সবর করতে পারবেন এখানে কথাটা যে তিনি মূসা -কে বলেছেন সেটা আলোচনার ধারাবাহিকতা

থেকেই বুঝে আসে। তিনি নরমালি বললেন, 'আমি কি বলিনি যে...’

এরপর মূসা শর্তের কথা বিস্মৃত হবার ওজর পেশ করে কঠোরতা আরোপ না করার আবেদন করেন। খাযির তাঁর আবেদন মেনে নেন এবং তাকে নিয়ে আবার পথচলা শুরু করেন। এবার পথ চলতে চলতে একটি অল্প বয়স্ক ছেলে তাদের সামনে পড়ল। খাযির তাকে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই হত্যা করে ফেলেন। এমন একটি নিরপরাধ ছেলেকে হত্যার দৃশ্য দেখে মূসা এর নববি মেজাজ খামোশ থাকতে পারেনি। তিনি যথারীতি এই কাজের ওপর আপত্তি তুলে প্রতিবাদ করলেন। খাযির প্রতিউত্তরে তাকে বললেন,

ألم أقل لك إنك لن تستطيع معي صبرا

‘আমি কি আপনাকে বলিনি যে, আপনি আমার সাথে থেকে সবর করতে পারবেন না! (১০)

এখানে তিনি হুবহু আগের কথাই উল্লেখ করলেন। শুধু একটা ‘লাকা’ বাড়িয়েছেন, যার মানে হলো আপনাকে'। অর্থাৎ, আগের তুলনায় এইবার প্রতিউত্তরে তিনি আরেকটু জোর দিলেন এবং ‘আপনি’ শব্দটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন “আমি আপনাকে বলেছিলাম যে, আপনি সবর করতে পারবেন না; কিন্তু সেটা আপনি মানতে পারলেন না। এখন দেখলেন তো?

মূসা এবার শেষ সুযোগ চাইলেন। তিনি বললেন, “আচ্ছা ঠিকাছে। যদি আমি আর কোনো প্রশ্ন করি তাহলে আমাকে আপনার সাথে রাখবেন না।'

তারা আবার চলতে শুরু করলেন। এবার একটা গ্রামে পৌঁছে সেখানকার লোকদের

[৯] সূরা কাহফ, ১৮৭২।

[১০] সূরা কাহফ ১৮: ৭৫।

কাছে খাবার চাইলে তারা তা দিতে অস্বীকার করল। এদিকে খাযির সেই জনপদের ভগ্নপ্রায় একটি দেয়াল বিনা পারিশ্রমিকে মেরামত করে দিলেন। মূসা তাঁর কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বলে ফেললেন, ‘আপনি তো চাইলে এর জন্য পারিশ্রমিক নিতে পারতেন!'

এই কথা শুনে খাযির বললেন,

هذا فراق بيني وبينك سأنبئك بتأويل ما لم تستطع عليه صبرا

‘এবার আপনার আর আমার আলাদা হওয়ার পালা। তবে আমি অবশ্যই আপনাকে সেই রহস্যের কথা জানাব, আপনি যেই ব্যাপারে সবর করতে পারলেন না। গ

এরপর তিনি তাঁর কাজগুলোর ব্যাখ্যা দিলেন। বললেন, 'আমি জাহাজটি ফুটো করে দিয়েছি; কারণ এটি ছিল কিছু মিসকীন ছেলের। তারা সুমুদ্রে এটা দিয়ে জীবিকানির্বাহ করত। সেখানে একজন যালিম বাদশাহ মানুষের নৌযান ছিনিয়ে নিচ্ছিল। আমি এটি ত্রুটিযুক্ত করে দিয়েছি, যেন সে এটি ছিনিয়ে না নেয়। আর অল্প বয়সী ছেলেটিকে হত্যা করার কারণ হলো, তাঁর বাবা-মা মুমিন ছিল। সে বড় হয়ে তাদেরকে কুফরিতে লিপ্ত হতে বাধ্য করার আশঙ্কা ছিল। তাই আমি তাকে মেরে ফেলি। এর পরিবর্তে আল্লাহ তাদেরকে আরও উত্তম সন্তান দান করবেন। আর সর্বশেষ যে দেয়াল মেরামত করে দিয়েছিলাম এর পেছনে রহস্য হলো, এটি ছিল সেই এলাকার কিছু ইয়াতীম ছেলের। তাদের বাবা ছিল সৎ। সেই দেয়ালের নিচে তিনি সন্তানদের জন্য কিছু সম্পদ গচ্ছিত রেখে গিয়েছিলেন। তারা বড় হয়ে সে সম্পদ হস্তগত করা অবধি যেন তা নিরাপদ থাকে সেজন্য দেয়ালটা মেরামত করা।' ব্যাখ্যা প্রদান শেষে তিনি বললেন,

ذلك تأويل ما لم تسطع عليه صبرا

‘এগুলো সেই কাজের ব্যাখ্যা, যেই বিষয়ে আপনি সবর করতে পারেননি। ১২

খাযির স্বীয় কর্মের ব্যাখ্যা করার আগে ও পরে মূসা -এর সবর করতে না পারার জন্য যে শব্দ নির্বাচন করলেন তা খেয়াল করুন। কাছাকাছি হলেও উভয়টার মধ্যে একটু পার্থক্য আছে। প্রথম তিনটি জায়গায় সবর করতে না পারার বিষয়টির জন্য তিনি নির্বাচন করলেন—‘লান তাসতাতীয়া’ (alati gj) এবং ‘মা

[১১] সূরা কাহফ, ১৮ : ৭৮। [১২] সূরা কাহফ, ১৮:৮২।

লামতাসতাতি’ (৬১)। অর্থাৎ, এগুলোতে ‘সীন’-এর পর একটি ‘তা’ আছে। আর ব্যাখ্যাঁ শুনানোর পরে বললেন- “মা লামতাসতি’ (Japai)। এতে ‘সীন’-এর পর ‘তা’ নেই। একটি হরফ কমে আসার দরুন অর্থের মধ্যেও কমতি চলে আসল। এমন করার কারণ হলো, কাজগুলোর ব্যাখ্যা করার আগ পর্যন্ত মূসা -এর সবর করতে না পারার ব্যাপারটা গাড় ছিল। যেহেতু তিনি এর রহস্য তখন পর্যন্ত জানতেন না। তাই সেখানে বাড়তি একটা হরফ আনায় অর্থের মধ্যে আধিক্য আসে এবং উনার সেই সময়কার অবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। কিন্তু ব্যাখ্যা শুনার পর যেহেতু পুরো বিষয়টা তাঁর কাছে দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, তাই তখন আর সবর করতে না পারার ব্যাপারটি আগের মতো গাড় ছিল না, হালকা হয়ে গিয়েছিল। সেজন্য ‘সীন’-এর পর ‘তা’ আনা হয়নি আর। এই একটি হরফ কম করে দেওয়ায় অর্থের মধ্যেও তার প্রভাব পড়ে এবং সবর করতে না পারার ব্যাপারটা আগের তুলনায় হালকাভাবে উপস্থাপিত হয়।

এই সূরাতে যুলকারনাইনের কথাও আলোচনা করা হয়েছে। তাঁর ঘটনাতেও এমন একটি ভাষাগত ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। তিনি পূর্ব-পশ্চিম বিজেতা ছিলেন। ইয়াজুজ-মাজুজের অত্যাচার থেকে একটি জনপদের অধিবাসীদের রক্ষা করার জন্য তিনি লোহার পাত গলিয়ে মজবুত দেয়াল নির্মাণ করেন। যাতে ওপাশ থেকে তারা এই জনপদে ঢুকে হামলা করতে না পারে। দেয়াল নির্মাণ শেষে তিনি বললেন,

فما اسطاعوا أن يظهروه وما استطاعوا له نفبا

‘ইয়াজুজ-মাজুজ এই দেয়ালে চড়তে সক্ষম হবে না এবং তারা তা ফুটাও করতে পারবে না। :)

এই আয়াতেও প্রথম শব্দটাতে ‘তা’ ছাড়াই বলা হলো ‘মাসতাউ’ ( তারা সক্ষম হবে না। পরের অংশে ‘তা' বৃদ্ধি করে বলা হলো ‘মাসতাতাউ’ (C)- তারা সক্ষম হবে না। এই একটি হরফ বৃদ্ধি করার দরুন সক্ষম না হওয়ার অর্থে আধিক্য তৈরি হয়, যা প্রথমটাতে ছিল না। কারণ হলো, লোহার দ্বারা নির্মিত সেই দেয়ালে চড়তে পারা যতটা কঠিন, তা ফুটা করা ছিল আরও বেশি কঠিন। এভাবে বলার দ্বারা দ্বিতীয়ক্ষেত্রে তাদের অক্ষমতা প্রথমটার তুলনায় বেশি হওয়ার দিকটি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।

[১৩] সূরা কাহফ, ১৮:১৭।

মূসা -এর পক্ষে খাযির-এর কাজ দেখে বাহ্যিকভাবে আপত্তি না তুলে নিশ্চুপ থাকা যে সম্ভব হবে না, সেই কথা তিনি বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। এই স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গটা কুরআনে আলোচিত হয়েছে একই রকমের শব্দে; সামান্য তারতম্যের সাথে। এই তারতম্যের ভেতর দিয়েই কুরআনের অসাধারণ ভাষাগত সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

প্রথমবার তারা সফর শুরু করে একটি নৌকাতে আরোহণ করেন। মাঝ নদীতে যাওয়ার পর খাযির নৌকাটি ফুটো করে দেন। বাহ্যিকভাবে এটি অন্যায় মনে হওয়ায় মূসা * চুপ করে থাকতে পারেননি। কারণ তিনি ছিলেন একজন নবি।

আরো জানতে পড়ুন ⤵️

কুরআনের সৌন্দর্য বইটি কেন আপনার পড়া উচিৎ?

পৃষ্ঠা : 144, কভার : পেপার ব্যাক
ভাষা : বাংলা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ