সোনালি যুগের গল্পগুলো (প্রথম খণ্ড এবং ২য় খন্ড একত্রে) লেখক : আল্লামা ইবনুল জাওযী (রহঃ) | Sonali Juger Golpogulo By Allama Ibnul Jawzi

Image

সোনালি যুগের গল্পগুলো (দুই খণ্ড একত্রে)
লেখক : আল্লামা ইবনুল জাওযী (রহঃ)
প্রকাশনী : মাকতাবাতু ইবরাহীম
বিষয় : ইসলামী ব্যক্তিত্ব, তাবেই ও অলি-আওলিয়া, নবি-রাসুল
অনুবাদক : আব্দুল্লাহ জোবায়ের রাফে, কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক, কাজী মঈনুল হক, হিজবুল্লাহ ইসহাকী
সম্পাদক : কাজী মঈনুল হক
পৃষ্ঠা : 960, কভার : হার্ড কভার
আইএসবিএন : 9789849528326, ভাষা : বাংলা


কালের আবর্তে, সময়ের প্রেক্ষিতে এমন কিছু ঘটনাও ঘটে—যা সেই সময় তো বটেই, পরবর্তী সময়ের মানুষকেও সমানভাবে দীপিত ও প্রভাবিত করে; যেগুলো মানুষকে আলোকিত করে। মানুষের হৃদয় ও মস্তিষ্কে রেখাপাত করে, আলোড়ন তোলে; দিন বদলের পালাবর্তে ক্রমশ যেগুলো যুগের ভাষায় মুদ্রিত হয়ে যায়… এমনই অসাধারণ, উপকারী, হৃদয় পরিবর্তনকারী ও জ্ঞান-সমৃদ্ধ পাঁচ শতাধিক সোনালি ঘটনার অমূল্য বিস্ময়কর সংকলন উয়ুনুল হিকায়াত… তীব্র দূরদর্শী, প্রখর মেধাবী, প্রখ্যাত ফকিহ এবং পৃথিবীখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইমাম আবুল ফারাজ ইবনুল জাওযি রাহিমাহুল্লাহ সংকলিত সেই সাড়াজাগানো বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ উয়ুনুল হিকায়াতের শুদ্ধ এবং সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ সোনালি যুগের গল্পগুলো আপনার হাতে; প্রিয় পাঠক, এই সোনার খনি থেকে আপনি কি বিমুখ থাকতে পারবেন?


হিমসের প্রশাসকের সাথে

উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু

উমাইর ইবনে সা’দ রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, খলিফা উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে হিমসের ওয়ালি (শাসনকর্তা) হিসেবে পাঠালেন। কিন্তু এক বছরের মধ্যে তাঁর কোনো খবর পেলেন না। অবশেষে তিনি কাতিবকে (সেক্রেটারি) বললেন, আমার মনে হচ্ছে সে আমাদের আস্থা নষ্ট করেছে। তুমি তাঁকে লেখো – ‘আমার এ পত্র পৌঁছা এবং পাঠ মাত্র মুসলমানদের কাছ থেকে খাজনা, জাকাত—যা কিছু আদায় করেছো তা নিয়ে মদিনায় চলে আসবে।' চিঠি পেয়ে উমাইর বিলম্ব না করে একটি চামড়ার থলিতে সামান্য কিছু পাথেয় ও পানির একটি পিয়ালা ভরে কাঁধে ঝোলালেন এবং লাঠিটি হাতে নিয়ে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করলেন।

মদিনা থেকে হিমসের দূরত্ব কয়েকশো মাইল। মদিনায় যখন পৌঁছলেন তখন তাঁর মাথার চুল লম্বা হয়ে গেছে। রোদ, ধুলোবালি ও দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তিতে চেহারা হয়ে গেছে বিবর্ণ। এ অবস্থায় তিনি সরাসরি খলিফার দরবারে পৌঁছে বললেন, আসসালামু আলাইকা ইয়া আমিরাল মুমিনিন!

*[১] উমাইর ইবনু সা'দ ইবনু উবাইদ ইবনুন নু'মান ইবনু কায়স ইবনু আমর ইবনু আউফ ইবনু মালিক ইবনুল আওস রাদিয়াল্লাহু আনহু হলেন একজন আনসারি সাহাবি। মুজামুস সাহাবাহ গ্রন্থকার ইমাম বাগবি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, চারিত্রিক গুণ-বৈশিষ্ট্যের জন্য তিনি নাসিজু ওয়াহদিহ উপাধি লাভ করেন। তিনি মুনাফিক জুলাস ইবনু সুয়াইদের বার্তা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানাতেন। তিনি এতিম ছিলেন। শাম বিজয়ের সময় তিনি শাহাদাতপ্রাপ্ত হন। উমর রাদিয়াল্লাহু আনছ তাঁকে শামের ওয়ালি নিয়োগ করেন। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর ওফাত পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দুনিয়াবিরাগী সজ্জন ব্যক্তি।*

সোনালি যুগের গল্পগুলো-১ম খণ্ড

—আমিরুল মুমিনিন, আপনার প্রতি সালাম! খলিফা তাঁর দিকে চোখ তুলে দেখে, বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করলেন, এ তোমার কী হাল হয়েছে?

উমাইর বললেন, আপনি আমার আবার কী হাল দেখলেন? আমি কি সুস্থ নই? আমার ওপর কি দুনিয়াদারির ছোঁয়া লেগেছে? আমি কি দুনিয়ার শিং ধরে টানাটানি করছি?

খলিফা ধারণা করেছিলেন, উমাইর হয়তো প্রচুর অর্থ-সম্পদ সাথে নিয়ে এসেছেন। তাই প্রশ্ন করলেন, তুমি সাথে করে কী নিয়ে এসেছো?

উমাইর বললেন, আমার সাথে আছে শুধু এই থলেটি, যার মধ্যে আমি আমার পাথেয় বহন করি, আর আছে এই বরতনটি, যার মধ্যে আমি আহার করি ও এটা দিয়ে আমি আমার মাথা, কাপড় ধৌত করি। আর আছে এই মশকটি, এর মধ্যে আমি আমার অজু ও খাওয়ার পানি রাখি। আর এই লাঠি, যার উপর ভর দিয়ে চলি এবং শত্রুর মুখোমুখি হলে ্যমে তাকে প্রতিহত করি। জেনে রাখুন, দুনিয়া আমার এই সামান্য সফর-সামগ্রীর অনুগামী ছাড়া আর কিছুই না।

উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু জিজ্ঞেস করলেন, হেঁটে এসেছো?

উমাইর বললেন, হাঁ, হেঁটেই এসেছি।

—কেউ কি তোমাকে একটি বাহন দিয়ে সাহায্য করলো না?

—আমি কারো কাছে বাহন চাইনি, আর কেউ দেয়ওনি।

—তারা খুব খারাপ মুসলমান হয়ে গেছে।

—উমর! আল্লাহ আপনাকে মানুষের গীবত করতে নিষেধ করেছেন। আমি তো তাদেরকে ফজরের নামাজ জামায়াতে আদায় করতে দেখেছি। খলিফা নির্দেশ দিলেন, উমাইরের নিয়োগ নবায়ন করা হোক।

উমাইর বললেন, আমি আপনার অধীনে বা ভবিষ্যতে অন্য কারো অধীনে আর কোনো দায়িত্ব পালন করবো না। কারণ, অপরাধ থেকে আমি মুক্ত থাকতে পারিনি। সেখানে খ্রিস্টান জিম্মিকে আমি বলেছি, আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করুন। ওহে উমর! আপনি কি আমাকে এমন কাজের জন্য পাঠিয়েছিলেন? যেদিন থেকে আমি আপনার সাথে কাজ করছি সেদিনটি আমার জীবনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট দিন। এরপর তিনি খলিফার অনুমতি নিয়ে মদিনা থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি নিরিবিলি স্থানে চলে যান এবং স্থায়ীভাবে সেখানে বসবাস করতে থাকেন।


একদিন খলিফার মনে হলো, উমাইর বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। তাই তাঁকে পরীক্ষার জন্য একশো দিনারসহ হারিস নামক এক ব্যক্তিকে পাঠালেন তাঁর কাছে। যাওয়ার সময় লোকটিকে বললেন, তুমি উমাইরের কাছে যাবে একজন অতিথির ছদ্মবেশে। যদি তাঁর ওখানে পার্থিব ভোগ-বিলাসের কোনো চিহ্ন দেখতে পাও তাহলে সাথে সাথে ফিরে আসবে। আর তাঁকে খুব করুণ অবস্থায় দেখলে এই একশো দিনার তাঁকে দান করবে।

লোকটি চলে গেল। উমাইরের বাসস্থানে পৌঁছে দেখলো, তিনি দেয়ালের পাশে বসে জামার ময়লা খুটে খুটে তাতে তালি লাগাচ্ছেন। লোকটি সালাম দিল। উমাইর সালামের জবাব দিয়ে তাকে থাকার অনুরোধ করলেন। লোকটি থেকে গেল।

উমাইর—কোথা থেকে এসেছেন?

আগন্তুক—মদিনা থেকে।

উমাইর—আমিরুল মুমিনিনকে কেমন রেখে এসেছেন?

আগন্তুক—একজন সৎকর্মশীল ব্যক্তি হিসেবে।

উমাইর—মুসলমানদের কেমন রেখে এসেছেন?

আগন্তুক—নেককার বান্দা হিসেবে।

উমাইর—আমিরুল মুমিনিন কি এখন আর হদ (শরিয়ত নির্ধারিত শাস্তি) কায়েম করেন না?

আগন্তুক—অবশ্যই, তিনি তাঁর এক ছেলেকে সম্প্রতি ব্যভিচারের শাস্তি প্রদান করেছেন। ছেলেটি মারা গেছে। 

*[২] এখানে ব্যভিচারের কথা উল্লেখ করা হলেও মূলত তাঁকে শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল মদ্যপানের অপরাধে। ঘটনাটি হলো— উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর এই পুত্রের নাম ছিল আবদুর রহমান আবু শাহমা। তিনি মুসলিম সেনাবাহিনীর হয়ে মিশরে যুদ্ধ করে জয়লাভ করার পর সেখানেই আবস্থান করেছিলেন। একদিন তিনি বন্ধুকে নিয়ে নাবিষ( খেজুর ভিজিয়ে তৈরি করা শরবত) পান করেন। কোনো কারণে নাবিয়ে মাদকতা চলে এসেছিল। ফলে অনিচ্ছাকৃতভাবে তাদের মধ্যে মাতলামী চলে আসে।

পরদিন তিনি তাঁর বন্ধুকে নিয়ে মিশরের তৎকালীন প্রশাসক আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বিস্তারিত ঘটনা জানান এবং শরিয়তের নির্ধারিত হদ চান। তখন আমার ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে ও তার বন্ধুকে নিজ ঘরের মধ্যেই বেত্রাঘাত করেন। পরবর্তীতে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এ ঘটনা জানতে পেরে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তিরস্কার করেন এবং বলেন, সাধারণ জনগণের মতো আমার পুত্রকেও জনসমক্ষে শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল। এরপর তিনি আবু শাহমাকে মদিনায় ফেরত পাঠাকে বলেন। মদিনায় পৌঁছার পর উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজে পুনরায় তাকে

উমাইর—আল্লাহ! তুমি উমরকে সাহায্য কর। তোমার ভালোবাসা ছাড়া তাঁর মধ্যে আর কিছু আছে বলে আমার জানা নেই।

লোকটি তিন দিন অতিথি হিসেবে থাকলো উমাইরের ঘরে। এ তিনটি দিন শুধু যবের রুটির কিছু টুকরো চিবিয়েই তাকে কাটাতে হলো। এ অবস্থা দেখে লোকটি বললো, এ কয়টি দিন তো আপনি আমাকে প্রায় অভুক্তই রেখেছেন। উমাইর বললেন, আপনি চলে যেতে চাইলে চলে যান। এরপর সে দিনারগুলো বের করে উমাইরের দিকে এগিয়ে দিল। দিনার দেখামাত্র তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, আমার প্রয়োজন নেই।

—একথা বলেই দিনারের থলিটি তিনি লোকটির দিকে ঠেলে দিলেন। এ সময় উমাইরের সহধর্মিণী বললেন, আপনার প্রয়োজন না থাকলে যাদের প্রয়োজন আছে, তাদের মধ্যে বিলিয়ে দিন।

উমাইর বললেন, এগুলোর ব্যাপারে কিছু করার কোনো অধিকার আমার নেই। তখন স্ত্রী তাঁর ওড়না ছিঁড়ে কয়েকটি টুকরো করেন। তারপর দিনারগুলো ভাগ করে সেই টুকরোগুলোতে বেঁধে আশেপাশের শহিদদের সন্তানদের মাঝে বণ্টন করে দেন।

এদিকে লোকটি খলিফা উমরের নিকট ফিরে গেল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, উমাইর দিনারগুলো কী করেছে?

লোকটি জবাব দিল— আমি তো জানি না।

এবার খলিফা উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু দিনারগুলো সহ উমাইরকে আসার জন্য লিখলেন। উমাইর হাজির হলেন খলিফার দরবারে।

—খলিফা জানতে চাইলেন, দিনারগুলো কী করেছো?

—আমার যা ইচ্ছা হয়েছে করেছি। তার সাথে আপনার সম্পর্ক কী?

—না তোমাকে বলতেই হবে। খলিফা জোর দিয়ে বললেন।

উমাইর বললেন, আমি সেগুলো আমার আখিরাতের প্রয়োজনে আগে পাঠিয়ে দিয়েছি। খলিফা তখন কিছু খাদ্যদ্রব্য ও দুটি কাপড় তাঁকে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। উমাইর তখন বললেন, খাদ্যের প্রয়োজন আমার নেই। বাড়িতে আমি

জনসমক্ষে বেত্রাঘাত করেন। এর কিছুদিন বা কয়েক সপ্তাহ পর আবু শাহামা ইন্তেকাল করেন। জান্নাতুল বাকীতে তাকে দাফন করা হয়। 

দুই সা’ ও পরিমাণ যব রেখে এসেছি। সেগুলো খেতে খেতেই আল্লাহ তাআলা হয়তো অন্য রিজিকের ব্যবস্থা করবেন। তবে কাপড় দুইটি নেওয়া যেতে পারে। কারণ আসার সময় আমি দেখে এসেছি, অমুকের মায়ের কাপড় নেই। একথা বলে তিনি কাপড় দুটি বগলদাবা করে বাড়িতে ফিরে আসেন। এর অল্পদিন পরেই তিনি মারা যান।

উমাইরের মৃত্যুর খবর পেয়ে খলিফা উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর জন্য ভীষণ ব্যথিত হন ও মাগফিরাত কামনা করেন। তারপর তিনি মদিনার ‘বাকিউল গারকাদ’ গোরস্থানে যান। তাঁকে অনুসরণ করে আরো অনেকে যান সেখানে। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের লক্ষ্য করে বললেন, আচ্ছা, আপনারা প্রত্যেকে নিজ নিজ বাসনা প্রকাশ করুন তো!

একজন বললো, আমার যদি প্রচুর ধন-সম্পদ থাকতো, তাহলে তা দিয়ে আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এত পরিমাণ দাস মুক্ত করতাম। আরেকজন বললো, আমার দেহে যদি অদমনীয় শক্তি হতো তাহলে আমি যমযম কূপ থেকে বালতি দিয়ে পানি তুলে হাজিদের পান করাতাম।

এভাবে আরো অনেকে নিজ নিজ মনোবাসনা ব্যক্ত করলো। সবশেষে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি যদি উমাইর ইবনে সাআদের মতো আরো যোগ্য লোক পেতাম তাহলে মুসলমানদের কাজে আমি তাদের সাহায্য নিতাম।

[৩] এক সা' = (৪) চার মুদ। ১ মুদ = একটি নির্দিষ্ট আকারের পাত্রের পরিমাণকে মূদ বলা হয়, কাপ বা বল বা মগ জাতীয় । যার আনুমানিক পরিমাণ দুই হাত মুনাজাতের মতো একত্রিত করে তাতে যতটুকু ফসল নেয়া যায়। ওই পাত্রের আকারে ১ মুদ= আনুমানিক প্রায় ০.৭৫০ লিটার অর্থাৎ ৭৫০ মিলিলিটার! এখন ৭৫০ মিলিলিটার আয়তনের পাত্রে ফসল ভরলে যতটুকু হয় তা হচ্ছে এক মুদ। তাহলে ১ সা' = 8মুদ = 8 x ০.৭৫০মিলি লিটার=৩ লিটার। এখন ১ সা* ফসল-৩ লিটার পাত্রে যেই পরিমান ফসল ধরে স্বাভাবিকভাবে। এভাবে একেক ফসলের ওজন ভিন্ন ভিন্ন হবে!

শায়খ সালেহ আল উসায়মিন ফতোয়া আরকানুল ইসলামে উল্লেখ করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এক সা' ছিল আনুমানিক ২ কেজি ৪০ গ্রাম পাকাপুষ্ট গম। এখন ওই পাত্রের পরিমান অনুযায়ী পাকা পুষ্ট গমের কেজি করলে তা দাড়ায় ২ কেজি ৪০ গ্রাম! এখন ওই পাত্রে যদি খেজুর পূর্ণ করে ওজন দেয়া হয় তখন তো আর ২ কেজি ৪০ গ্রাম হবে না! বেশি হতে পারে! কারণ খেজুরের আয়তন বড় এবং ওজন বেশি! একইভাবে যদি ওই পাত্র পূর্ণ চাল ওজন দেয়া হয় তাহলেও ওজনের তারতম্য ঘটবে!! স্কলারগণ মানুষের সুবিধার্থে এই কেজির সংখ্যা নিরুপন করেছেন যে গম হিসেবে তা ২ কেজি ৪০ গ্রাম থেকে শুরু করে প্রায় ৩ কেজি পর্যন্ত।

২. প্রশাসকের ব্যাপারে হিমসবাসীর অভিযোগ

খালিদ ইবনে মাদান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু হিমসে সাইদ ইবনে জুযাইম রাদিয়াল্লাহু আনহুকে আমাদের গভর্নর বানিয়ে পাঠালেন। একবার উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু হিমসে আগমন করে বললেন, হে হিমসবাসী! তোমরা তোমাদের গভর্নরকে কেমন পেয়েছো? তখন তারা গভর্নরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করল। তারা বলল, তাঁর ব্যাপারে আমাদের চারটি অভিযোগ রয়েছে। তিনি দুপুর হওয়ার আগে আমাদের কাছে বের হয়ে আসেন না।

উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, গুরুতর অভিযোগ। আর কী অভিযোগ আছে?

তারা বলল, তিনি রাতের বেলায় কারও আহ্বানে সাড়া দেন না। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, এটাও গুরুতর অভিযোগ। আর কী

অভিযোগ আছে? তারা বলল, প্রতি মাসে একদিন এমন আসে, যেদিন তিনি আমাদের সম্মুখে বের হন না।

উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু এবারও বললেন, গুরুতর অভিযোগ। আর কী

অভিযোগ আছে?

তারা বলল, মাঝে মাঝে তিনি বেহুঁশ হয়ে যান।

তখন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু সাইদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগকারীদেরকে একত্র করলেন। মনে মনে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানালেন, হে আল্লাহ! যে সুধারণার আমি ভিত্তিতে সাইদকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ করেছিলাম তা ব্যর্থ করো না।

তিনি বিচারের কাঠগড়া বানিয়ে সাইদ রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর সামনেই অভিযোগকারীদের বললেন, তোমরা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করো।

তারা বলল, তিনি দুপুর হওয়ার আগে আমাদের কাছে বের হয়ে আসেন না।

উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে তুমি কী বলবে?

সাইদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আল্লাহর কসম! এ বিষয়টি আমি তুলে ধরতে অপছন্দ করছি যে, আমার পরিবারে কোনো খাদেম নেই। তাই আমি নিজেই খামিরা বানাই, এরপর বসে থাকি। খামিরা প্রস্তুত হয়ে গেলে আমি আমার জন্য রুটি বানাই, এরপর অজু করে তাদের কাছে বের হয়ে আসি।

সোনালি যুগের গল্পগুলো-২য় খণ্ড

এক দরবেশের গল্প..
হারেস আল আওলাসি বলেন, কোনো এক বছরের মাঝখানে আমি মক্কা থেকে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। চলতে চলতে এক জায়গায় গিয়ে দেখলাম, তিনজন লোক কোনো এক বিষয়ে আলোচনা করছে। আমি তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম এবং সালাম বিনিময়ের পর বললাম, আমি কি আপনাদের সঙ্গে চলতে পারি?

তারা বললো, আপনার যা ইচ্ছা।

অনুমতি পেয়ে আমি তাদের সঙ্গে পথ চলতে লাগলাম। কিছুদূর গিয়ে আমি এবং তাদের মধ্য থেকে একজন ব্যতীত বাকি সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। আমার সঙ্গে থেকে যাওয়া লোকটি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, যুবক! তোমার গন্তব্য কোথায়?

—আমার গন্তব্য সিরিয়া।

—আমার গন্তব্য 'লাকাম' পর্বত (সিরিয়ার একটি পর্বতের নাম)। চলো তবে একসঙ্গে যা যাক।

লোকটির নাম ছিল ইবরাহিম ইবনু সাদ আলাভী।

আমরা কয়েকদিন একসঙ্গে পথ চললাম। অবশেষে একসময় আমরাও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম এবং আমি আওলাস নগরীতে পৌঁছলাম।

একদিনের ঘটনা, আমি সমুদ্র ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হলাম। হঠাৎ একটি দৃশ্য দেখে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। দেখলাম, সমুদ্রের পানির উপর ভেসে ভেসে এক লোক নগ্ন পায়ে নামাজ আদায় করছে। এ দৃশ্য দেখে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। লোকটির প্রতি আমার ভীষণ ভক্তি জেগে উঠলো।

এদিকে লোকটি আমার আগমন টের পেয়ে তাড়াহুড়া করে নামাজ শেষ করে আমার দিকে ফিরে তাকালো। আমি বিস্ময়ভরা চোখে দেখলাম, লোকটি আর কেউ নন; এ যে আমার সেই সফরসঙ্গী ইবরাহিম ইবনু সাদ আলাভী। তাকে দেখে আমি তৎক্ষণাৎ চিনে ফেললাম।

তিনি আমাকে বললেন, ‘তিনদিন তুমি আমার দৃষ্টির আড়ালে থাকো। এরপর তুমি আমার কাছে এসো।' তার কথামতো আমি তা-ই করলাম। তিনদিন পর আমি সেখানে গিয়ে এবারও তাকে সমুদ্রপৃষ্ঠে নামাজরত অবস্থায় পেলাম। আমার আগমন টের পেয়ে এবারও তিনি নামাজ সংক্ষিপ্ত করলেন। নামাজ শেষে তিনি আমার হাত ধরে আমাকে সমুদ্রের উপর দাঁড় করালেন এবং মুখে বিড়বিড় করে কী যেন পড়তে লাগলেন। আমি তখন মনে মনে বললাম, এখন তিনি যদি পানির উপর দিয়ে হাঁটেন, তবে আমিও তাঁর সঙ্গে হাঁটবো।

একথা ভাবতে না ভাবতেই দেখলাম, বিশালাকৃতির দুটি সাপ সমুদ্রের মধ্য থেকে বের হয়ে আমাদের দিকে তাকালো। এরপর পানি থেকে মাথা উঠিয়ে মুখ হা করে তীব্র বেগে আমাদের দিকে আসতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর অনুভব করলাম, আমি সমুদ্রপৃষ্ঠে তলিয়ে যাচ্ছি।

ইবরাহিম ইবনু সাদ সেখান থেকে আমাকে উদ্ধার করে বললেন, তুমি এখনও এ কাজের (সমুদ্রপৃষ্ঠে হাঁটার) যোগ্য নও। তোমার এখন কর্তব্য হলো, লাগাতার রোযা রাখবে এবং পাহাড়ে গিয়ে একাকী ইবাদত-বন্দেগি করবে এবং যথাসম্ভব নিজেকে মানুষের দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে রাখবে, যেন কোনোকিছু তোমাকে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ রাখতে না পারে। আর তোমার আরেকটি কর্তব্য হলো, দুনিয়াতে যথাসম্ভব অল্পেতুষ্টির অভ্যাস গড়ে তুলবে এবং এ অভ্যাস যেন তোমার মৃত্যু অবধি অব্যাহত থাকে।

এসব উপদেশ দিয়ে তিনি আমার দৃষ্টিসীমার আড়ালে চলে গেলেন।

মদিনার পথে ইবরাহিম আল খাওয়াস

ইবরাহিম আল খাওয়াস বর্ণনা করেন, একদিন আমি পানিশূন্য এক ভূমিতে চলছিলাম। পানির তৃষ্ণা তখন আমাকে ভীষণভাবে পেয়ে বসলো। কোথাও পানি না পেয়ে পিপাসায় একসময় আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। হঠাৎ কোথা থেকে যেন একফোঁটা পানি এসে আমার মুখের উপর পড়লো। আমি মুখে সেই পানির শীতলতা অনুভব করলাম। এতে আমার ক্লান্তি কিছুটা লাঘব হলে আমি চোখ খুললাম। তখন ধুসরবর্ণের একটি ঘোড়ার উপর অত্যন্ত সুশ্রী মুখমণ্ডলবিশিষ্ট এক লোককে দেখলাম। ইতঃপূর্বে এমন সুন্দর গড়নবিশিষ্ট কোনো মানুষ আমার চোখে পড়েনি। তার পরনে ছিল সবুজ রঙের পোশাক, মাথায় ছিল হলুদ রঙের একটি পাগড়ি এবং হাতে ছিল একটি পানির মটকা।

সেই মটকাটি থেকে তিনি আমাকে পানি পান করালেন, এরপর বললেন, আমার পেছনে আরোহণ করো। আমি তার কথামতো তার পেছনে চড়ে বসলাম।

এরপর তিনি আমাকে নিয়ে চলতে আরম্ভ করলেন। কিছুক্ষণ পর আমাকে

জিজ্ঞেস করলেন, এখন তুমি কী দেখতে পাচ্ছো?

—মদিনা।

—এখন তাহলে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ো। তুমি যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রওজা মুবারক যিয়ারত করবে, তখন তাঁকে আমার সালাম জানাবে এবং বলবে, 'রিদওয়ান ফেরেশতা আপনাকে সালাম জানিয়েছেন। [১]

২৬১. বিজন প্রান্তরে আবু যর গিফারি রাদিয়াল্লাহু আনহু

এর ওফাত

উম্মে যর রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে আমি খুব কাঁদলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, উম্মে যর! তুমি কাঁদছো কেন?

[১] এ ঘটনাটি সুফিদের বানোয়াট কল্পকাহিনির অন্তর্ভুক্ত।

আমি বললাম, কেনই বা কাঁদবো না? এই বিজন প্রান্তরে আমাদের সাহায্য করার মতো কেউ নেই। এছাড়া আমার কাছে কিংবা আপনার কাছে এমন কোনো কাপড়ও নেই যা আপনার কাফনের জন্য যথেষ্ট হবে।

আবু যর বললেন, কেঁদো না। চিন্তার কোনো কারণ নেই; বরং তুমি সুসংবাদ গ্রহণ করো। কারণ আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘যখন কোনো মুসলমানের দুজন কিংবা তিনজন সন্তান মারা যায় আর সে সওয়াবের আশায় ধৈর্যধারণ করে, জাহান্নামের আগুন তাকে স্পর্শ করবে না।

আমি তাকে আরও বলতে শুনেছি, 'তোমাদের মধ্যে এখানকার একজনের মৃত্যু হবে নির্জন মরুভূমিতে। কিন্তু তার মৃত্যুর সময় মুমিনদের একটি দল সেখানে উপস্থিত হবে। [৩]

আমি নিশ্চিত সে ব্যক্তিটি আমিই, কারণ সেদিন আমরা যারা সেখানে উপস্থিত ছিলাম তাদের সবাই মৃত্যুবরণ করেছেন। কেবল আমিই বাকি আছি। তুমি পথের দিকে খেয়াল রাখো। নিশ্চয় আমিও মিথ্যা বলছি না; আল্লাহর রাসুলও মিথ্যা বলেননি।

উম্মে যর বলেন, আমি তখন বললাম, মুমিনদের দল এখানে কীভাবে উপস্থিত হবে? হাজিদের কাফেলা তো চলে গেছে, পথটিও অপ্রচলিত। ব্যাবসায়িক কোনো কাফেলা আসারও কোনো সম্ভাবনা নেই।

তিনি বললেন, তুমি পথের দিকে খেয়াল রেখো।

উম্মে যর বলেন, তার কথামতো আমি কোনো কাফেলার আগমনের অপেক্ষায় পথের দিকে লক্ষ রাখছিলাম। অবশেষে দূরে দেখা গেল ধুলোর ঝড় তুলে একদল লোক এদিকেই আসছে। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আমি একটি কাপড় মাথার উপর তুলে নাড়াতে লাগলাম। ইশারা দেখে দ্রুত কাফেলাটি আমার কাছে উপস্থিত হয়ে জানতে চাইলো, আল্লাহর বান্দি! কী প্রয়োজন তোমার? এ বিজন প্রান্তরে তুমি একাকী কী করছো?

—এ নির্জন মরুভূমিতে আল্লাহর এক বান্দা মৃত্যুর প্রহর গুণছে। আপনাদের কাছে অনুরোধ, তার মৃত্যুর পর দাফন কাফনের ব্যবস্থা করে তারপর আপনারা যাবেন।

[২] মুসনাদে আহমদ [৩] তাবাকাতে ইবনে সাদ, সহিহ ইবনে হিব্বান, মুসতাদরাকে হাকেম।

—কে সেই লোক?

—আবু যর।

—আল্লাহর রাসুলের সাহাবি আবু যর?

—হ্যাঁ, তিনিই আল্লাহর রাসুলের সাহাবি আবু যর।

—আমাদের পিতা মাতা তার জন্য কুরবান হোক!

একথা বলে দ্রুত তারা আবু যরের কাছে গিয়ে তাকে সালাম করলেন। আবু যরও তাদের অভিবাদন জানালেন এবং আমাকে যা বলেছিলেন, একই কথা তাদেরকেও বললেন, 'আপনারা সুসংবাদ গ্রহণ করুন। কারণ আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, “যখন কোনো মুসলমানের দুজন কিংবা তিনজন সন্তান মারা যায় আর সে সওয়াবের আশায় ধৈর্যধারণ করে, জাহান্নামের আগুন তাকে স্পর্শ করবে না।”

আমি তাকে আরও বলতে শুনেছি, “তোমাদের মধ্যে এখানকার একজনের মৃত্যু হবে নির্জন মরুভূমিতে। কিন্তু তার মৃত্যুর সময় মুমিনদের একটি দল সেখানে উপস্থিত হবে।”

আমি নিশ্চিত সে ব্যক্তিটি আমিই, কারণ সেদিন আমরা যারা সেখানে উপস্থিত ছিলাম তাদের সবাই মৃত্যুবরণ করেছেন। কেবল আমিই বাকি আছি। আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমিও মিথ্যা বলছি না এবং আল্লাহর রাসুলও মিথ্যা বলতে পারেন না। যদি আমার কাছে কিংবা আমার স্ত্রীর কাছে আমার কাফনের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ কাপড় থাকতো, তবে তা দিয়েই আমি নিজের কাফনের ব্যবস্থা করে যেতাম। কিন্তু এ পরিমাণ কাপড়ও আমাদের কাছে না থাকায় আমার আপনাদের সাহায্যের প্রয়োজন। তবে মনে রাখবেন, আপনাদের মধ্যে যদি শাসক, জিম্মাদার ও দায়িত্বশীল কেউ থেকে থাকে, তবে সে যেন আমার কাফনের জন্য কাপড় না দেয়।

দেখা গেল, জনৈক আনসারি লোক ব্যতীত এমন কাউকেই পাওয়া গেল না, যার মধ্যে উপরিউক্ত গুণাবলির কোনোটিই বিদ্যমান নেই। সেই আনসাসী সাহাবি বললেন, আমি আমার গায়ে দেওয়া এ চাদর এবং আমার কাছে থাকা আমার আম্মার হাতে সেলাইকৃত দুটি কাপড় দিয়ে আপনার কাফনের ব্যবস্থা করবো।

আবু যর রাদিয়াল্লাহ আনহু বললেন, আচ্ছা, তবে তুমিই আমার কাফনের কাপড় দিবে।

অতঃপর তিনি ইন্তেকাল করলে এই আনসারি লোকটিই তার কাফনের ব্যবস্থা করলেন এবং উপস্থিত সকলকে সঙ্গে নিয়ে তার দাফনকার্য সম্পন্ন করলেন।

২৬২. বুজুর্গের দোয়ার বরকতে অনাবৃষ্টির অবসান

কাব রাহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন, হজরত মুসা আলাইস সালামের যুগে একবার বনি ইসরাঈলের মধ্যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও অনাবৃষ্টি দেখা দিলে লোকেরা মুসা আলাইহিস সালামের কাছে এসে নিবেদন করলো, হে আল্লাহর নবি! অনাবৃষ্টির কারণে দেশের মানুষ ও জীব-জন্তুগুলো খুব কষ্ট পাচ্ছে। আপনি আল্লাহর দরবারে বৃষ্টির জন্য দোয়া করুন।

মুসা আলাইহিস সালাম তাদের সকলকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ে আল্লাহর কাছে বৃষ্টির জন্য দোয়া করলেন। কিন্তু বৃষ্টি তো হলোই না; বরং আকাশ পূর্বাপেক্ষা আরও পরিষ্কার হয়ে গেল। মুসা আলাইহিস সালাম তখন ঘোষণা করলেন, তোমাদের মধ্যে যারা জীবনে একটি গুনাহ হলেও করেছো, তারা এখান থেকে চলে যাও।

এ ঘোষণা শুনে অর্ধেকের চেয়েও বেশি মানুষ সেখান থেকে চলে গেল। মুসা আলাইহিস সালাম তখন বাকিদের নিয়ে বৃষ্টির জন্য আবার দোয়া করলেন; কিন্তু এবারও বৃষ্টির কোনো দেখা পাওয়া গেল না।

মুসা আলাইহিস সালাম দ্বিতীয়বার ঘোষণা দিয়ে বললেন, তোমাদের মধ্যে এমন লোক এখনও রয়ে গেছে, যারা জীবনে একটি হলেও গুনাহ করেছো। কাজেই এমন যারা রয়েছো, তারা এখান থেকে চলে যাও।

দ্বিতীয় এ ঘোষণা শুনে একজন কানা (একচোখ বিশিষ্ট) লোক ব্যতীত বাকি সবাই চলে গেল। তার নাম ছিল বুরখ। অবাক হয়ে মুসা আলাইহিস সালাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আমার ঘোষণা শুনোনি?

—হ্যাঁ, শুনেছি।

—তাহলে কি তুমি সারাজীবনে একটি গুনাহও করোনি!?

—আমার এমন কোনো গুনাহের কথা স্মরণে আসছে না। তবে একটি ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছে, যদি সেটা গুনাহের কাজ হয়ে থাকে তাহলে আমি ফিরে যাচ্ছি।


—কী সেই ঘটনা?

—একবার আমি এক রাস্তা ধরে চলছিলাম। হঠাৎ সেখানে একটি দরজা খোলা কামরার প্রতি আমার চোখ পড়ে যায়। তখন কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই কামরায় থাকা এক লোকের উপর আমার যে চোখটি নষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, সেই চোখটির নজর পড়ে। এ চোখের উপর আমার তখন ভীষণ রাগ হলো। তাই আমি চোখটিকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “কোন সাহসে আমার সামনে তুই অন্যায় দৃষ্টি দিতে পারলি! তুই আর আমার সঙ্গে থাকার উপযুক্ত নয়।' একথা বলে আমি নিজের আঙুল দিয়ে চোখটি উপড়ে ফেললাম। হে আল্লাহর নবি মুসা! আমার এ কাজটি যদি পাপ হয়ে থাকে, তবে আমি চলে যাচ্ছি।

মুসা আলাইহিস সালাম বললেন, বুরখ! নিঃসন্দেহে এটা কোনো গুনাহের কাজ নয়। তুমিই বরং আল্লাহর কাছে বৃষ্টির জন্য দোয়া করো। আল্লাহ তোমার দোয়া নিশ্চয় কবুল করবেন।

বুরখ তখন দোয়া আরম্ভ করলেন, ওহে মহাপবিত্র সত্তা আল্লাহ! আপনার ভাণ্ডারের তো কোনো শেষ নেই, তা কখনো ফুরাবার নয়। আর আপনি কৃপণতা করবেন- এমনটিও কল্পনা করা যায় না। আমাদের কষ্ট ও প্রয়োজনের কথাও নিশ্চয় আপনি জানেন। অতএব অতিদ্রুত বৃষ্টি দিয়ে আমাদের সিক্ত করুন।

বর্ণনাকারী বলেন, এ দোয়ার সঙ্গে সঙ্গে এত বেশি পরিমাণে বৃষ্টিপাত হলো যে, রাস্তাঘাট সব কর্দমাক্ত হয়ে গেল।

২৬৩. সাহল রাহিমাহুল্লাহর মূল্যবান উপদেশ

উমর ইবনু ওয়াসেল বর্ণনা করেন, একবার সাহল রাহিমাহুল্লাহকে জিজ্ঞেস করা হলো, কেউ যদি বলে, এক লোক সকালে থাকে বসরায় আর রাতে থাকে মক্কায়, তাহলে তার একথাটি কি যৌক্তিক ও সঠিক হতে পারে?

তিনি বললেন, হ্যাঁ, হতে পারে। কারণ আল্লাহর এমন কিছু বান্দা রয়েছেন, যারা ঘুমানোর সময় এক কাতে ঘুমান, আর মনে মনে ইচ্ছা করেন, মিশর কিংবা (তাদের ইচ্ছানুযায়ী) যেকোনো শহরে যেন আমার পরবর্তী কাত হয়। বাস্তবেও তা-ই হয়।

[৪] অর্থাৎ, তারা তাদের ইচ্ছামতো একস্থান থেকে আরেক স্থানে অবাধ বিচরণ করতে পারেন। অনুবাদক 


সাহল রাহিমাহুল্লাহ একথা বলে কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। এরপর বললেন, দুনিয়াতেও তো আমরা দেখতে পাই, রাজা বাদশাদের ঘনিষ্ঠ এবং কাছের এমন কিছু মন্ত্রী ও প্রতিনিধি থাকেন, যারা বাদশার জন্য কল্যাণকামী এবং সত্যবাদিতা ও পরিশুদ্ধ নিয়তের গুণের অধিকারী হয়। ফলে তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে ও বিশ্বাস করে বাদশাগণ সাম্রাজ্যের ধনভাণ্ডারের চাবি তাদেরকে দিয়ে বলেন, 'তোমাদের যা ইচ্ছা, করো।' ফলে তারা বাদশার ধনভাণ্ডারে ইচ্ছামতো হস্তক্ষেপ করতে পারেন।

ঠিক তেমনিভাবে আল্লাহর কোনো বান্দা যখন তাঁর আদেশ-নিষেধ পরিপূর্ণভাবে মেনে চলে এবং তাঁর নৈকট্য লাভের জন্য যা যা প্রয়োজন তা ঠিকঠাকভাবে পালন করে, তখন আল্লাহও তাদেরকে পুরো পৃথিবীর যেখানে ইচ্ছা সেখানে যথেচ্ছা বিচরণের স্বাধীনতা দিয়ে দেন।

এরপর সাহল রাহিমাহুল্লাহ বলেন, দুনিয়া তোমাদের থেকে চলে যাচ্ছে আর তোমরা ধীরে ধীরে পরকালের দিকে ধাবিত হচ্ছো, অথচ এরপরও তোমরা উদাসীন। অতএব সময় থাকতে (উদাসীনতার) এ ঘুম থেকে জেগে উঠো। [e]

২৬৬. জনৈক দরবেশের ইন্তেকাল

আবু বকর কাত্তানিসহ একদল মাশায়েখ বর্ণনা করেন, আবু জাফর দিনওয়ারি রাহিমাহুল্লাহর এক ভাই সিরিয়ায় বসবাস করতেন। তার অভ্যাস ছিল, তিনি কোনো গ্রাম কিংবা শহরে গেলে একদিন একরাতের বেশি সেখানে অবস্থান করতেন না।

একবার তিনি এক গ্রামে গিয়ে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এ রোগ নিয়ে তিনি সেখানে সাতদিন কাটিয়ে দিলেন। এ সময়ের মধ্যে তাকে খাদ্য ও পানীয় দেওয়ার মতো কেউ ছিলো না, এমনকি কেউ তার সঙ্গে কথাও বললো না। এভাবে সাতদিন অসুস্থতার তীব্র যাতনা ভোগ করে অবশেষে তিনি ইন্তেকাল করলেন। অষ্টম দিন সকালে গ্রামবাসী দেখলো, তিনি মরে পড়ে আছেন। ফলে তারা তাকে

গোসল করালো, কাফনের কাপড় পরালো এবং তার জানাযা আদায় করে

[৫] ২৬৪ এবং ২৬৫, এ গল্প দুটি মূল বইয়ে পাওয়া যায়নি। তাই আমরাও অনুবাদে বাদ দিতে বাধ্য হয়েছি।


দাফনের উদ্দেশ্যে কবরস্থানে নিয়ে গেল। তখন তারা দেখলো, বিভিন্ন গ্রাম থেকে লোকেরা লোকটির মৃতদেহের কাছে এসে জড়ো হচ্ছে।

গ্রামবাসী অবাক হয়ে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তার বললো, আজ সকালে আমরা কাকে যেন চিৎকার করে ঘোষণা করতে শুনলাম, “তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহর কোনো ওলির জানাযায় শরিক হতে ইচ্ছুক, তারা যেন অমুক গ্রামে চলে যায়।’ ঘোষকের এই ঘোষণা শুনেই আমরা এখানে এসেছি।

বর্ণনাকারী বলেন, এরপর সকলে মিলে পুনরায় লোকটির জানাযা আদায় করলো এবং জানাযা শেষে দাফন করে দিলো।

পরদিন সকালে সেই গ্রামবাসী লক্ষ করলো, যে কাফনের কাপড় ও সুগন্ধি দিয়ে তারা লোকটিকে দাফন করেছিল, সে কাপড় ও সুগন্ধি তাদের মসজিদের মেহরাবের উপর পড়ে আছে। আর তার সঙ্গে এক টুকরা কাগজও রয়েছে। কাগজটিতে লেখা ছিল—

“তোমাদের এই কাফনের কাপড়ের প্রয়োজন আমাদের নেই। তোমাদের মাঝে আল্লাহর একজন ওলি অসুস্থ হয়ে সাতদিন অবস্থান করলেন, অথচ তোমরা তাকে দেখতে গেলে না, তার রোগ নিরাময়ের ব্যবস্থা করলে না, তাকে পানাহার করালে না, এমনকি তার সঙ্গে কথাও বললে না!?”

ঘটনাটির বর্ণনাকারী আবু বকর কাত্তানি বলেন, এ ঘটনার পর সেই গ্রামবাসী অতিথিদের জন্য একটি বাড়ি নির্মাণ করে, যেন অতিথিবৃন্দ সেখানে এসে স্বাচ্ছন্দে অবস্থান করতে পারেন।

২৬৭. মৃত্যুর পূর্বে জুনায়েদ বাগদাদির দৃঢ়তা

আবু বকর আত্তার রাহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন, আমি এবং আমার কয়েকজন সঙ্গী মিলে জুনায়েদ বাগদাদি রাহিমাহুল্লাহর মৃত্যুর সময় তার কাছে উপস্থিত হলাম। গিয়ে দেখলাম, তিনি বসে বসে নামাজ আদায় করছেন এবং রুকু সিজদা করার সময় প্রয়োজন অনুপাতে পা ভাঁজ করছেন। পা ভাঁজ করে রাখতে তখন তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। এরপরও তিনি জোর করে এমনটি করছিলেন। একপর্যায়ে তার পা দুটি অকেজো হয়ে গেল। নড়াচড়া করার শক্তিও আর পায়ে অবশিষ্ট রইলো না। তার পা দুটি তখন ফুলে উঠেছিল। এ অবস্থায়ই তিনি পা দুটিকে ছড়িয়ে দিলেন। সেখানে উপস্থিত তারই এক বন্ধু এ দৃশ্য দেখে বলে উঠলেন, আবুল কাসিম! কেন আপনি এত কষ্ট করছেন!?

জুনায়েদ বাগদাদি রাহিমাহুল্লাহ বললেন, আমি বসে নামাজ আদায় করতে পারছি, পা ভাঁজ করতে পারছি, নিঃসন্দেহে এগুলো আল্লাহর নেয়ামত। কাজেই যতক্ষণ আমার দেহে প্রাণ থাকবে, আমি চেষ্টা করে যাবো। আল্লাহু আকবার!

এরপর তিনি যখন নামাজ পুরোপুরিভাবে শেষ করলেন, তখন আবু মুহাম্মদ হারিরি তাকে বললেন, আবুল কাসিম! যদি আপনি কষ্ট করে না বসে চিৎ হয়ে শুয়ে ইশারায় নামাজ আদায় করতেন, তাহলে আপনার কষ্ট কিছুটা কম হতো।

উত্তরে তিনি বললেন, আবু মুহাম্মদ! শুনে রাখো, এসময়টুকুর জন্যও আমাকে আল্লাহর কাছে হিসাব দিতে হবে। (অতএব, শক্তি থাকার পরও যদি আমি ইশারায় নামাজ আদায় করি, তবে আল্লাহর কাছে আমি কী জবাব দিবো?) আল্লাহু আকবার!

অতঃপর মৃত্যু পর্যন্ত এ-ই ছিলো তার অবস্থা।

২৬৮. শাকিক বলখি ও ইবরাহিম ইবনু আদহামের

কথোপকথন

হুযায়ফা আল মারাশী বর্ণনা করেন, একবার শাকিক বলখি রাহিমাহুল্লাহ মক্কায় আগমন করলেন। ইবরাহিম ইবনু আদহাম রাহিমাহুল্লাহও তখন মক্কায় ছিলেন। লোকেরা তখন একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলো, শাকিক বলখি ও ইবরাহিম ইবনু আদহামকে নিয়ে একটি সভা আয়োজিত হবে, যেখানে তারা উভয়ই পরস্পর মতবিনিময় করবেন।

সিদ্ধান্ত মোতাবেক মসজিদুল হারামে তারা উভয়ে একত্র হলেন। ইবরাহিম ইবনু আদহাম তখন শাকিক বলখিকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের রীতিনীতি কীসের উপর প্রতিষ্ঠিত?

শাকিক: আমাদের নীতি হলো, আমরা রিজিকপ্রাপ্ত হলে খাই, আর রিজিকের ব্যবস্থা না হলে ধৈর্য ধারণ করি।

ইবরাহিম: বলখের কুকুরগুলোরও তো তাহলে একই রীতি। কারণ তারাও খাবার পেলে খায়, আর না পেলে ধৈর্য ধরে থাকে।

শাকিক: এবার তাহলে বলুন, আপনাদের রীতিনীতি কীসের উপর প্রতিষ্ঠিত?

ইবরাহিম: আমাদের নীতি হলো, আমাদের সামনে যখন খাবার আসে তখন আমরা নিজেরা না খেয়ে অন্যদেরকে প্রাধান্য দেই, আর যখন খাবার না পাই তখন আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি।

একথা শুনে শাকিক বলখি নিজের জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং ইবরাহিম ইবনু আদহামের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বললেন, আবু ইসহাক! এখন থেকে আপনি আমাদের উস্তাদ, আর আমরা আপনার শাগরেদ।

269. আবদুল্লাহ ইবনু আবি শাইবার মসজিদে রাত্রিযাপন

আবু আবদুল্লাহ ইবনু আবি শায়বা বর্ণনা করেন, একদিন আমি বায়তুল মুকাদ্দাসে অবস্থান করছিলাম। সে সময়টায় আমি মসজিদে রাত্রিযাপন করতে খুব পছন্দ করতাম। কিন্তু সেখানে সহসা আমাকে রাত্রিযাপনের অনুমতি দেওয়া হতো না।

একদিনের ঘটনা, আমি মসজিদের বারান্দায় একটি খুঁটি দেখতে পেলাম। মনে মনে ভাবলাম, ‘এর পেছনে লুকিয়ে থাকলে কেউ আমাকে দেখতে পাবে না। পরবর্তীতে সকল মুসল্লিগণ চলে গেলে আমি মসজিদে রাত্রিযাপন করবো।”

পরিকল্পনামতো আমি ইমামের পেছনে ইশার নামাজ আদায় করে সেই খুঁটির পেছনে লুকিয়ে গেলাম। অতঃপর মসজিদের সকল মুসল্লি বিদায় নিলে আমি খুঁটির পেছন থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। এরপর মসজিদের দরজা বন্ধের আওয়াজ আমার কানে এলে মেহরাবের প্রতি আমার নজর পড়ে। বিস্ফারিত নেত্রে আমি দেখলাম, মেহরাবটি ফেঁটে গেল এবং সেখান দিয়ে একজন দুজন করে মোট সাতজন লোক প্রবেশ করলো। এরপর তারা সারিবদ্ধ হয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল।

এ দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে আমি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লাম। এদিক সেদিক একপা নাড়ানোর ক্ষমতাও আমার বাকি রইলো না। ফলে সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত একভাবেই আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। অতঃপর ফজরের সময় হয়ে গেলে ওই লোকগুলো যেখান দিয়ে প্রবেশ করেছিলো, সেখান দিয়েই আবার ফিরে চলে গেল।[৬]

270. যুবকবেশে খিজির আলাইহিস সালাম

শাকিক ইবনু ইবরাহিম বর্ণনা করেন, একরাতে আমি মক্কায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্মস্থানের নিকটে ইবরাহিম ইবনু আদহামকে দেখতে পেলাম। তিনি তখন একা একা পথের ধারে বসে কাঁদছিলেন। আমি তখন গিয়ে তার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম, আবু ইসহাক! এ পূণ্যভূমিতে বসে কান্না করছেন কেন?

তিনি বললেন, ‘খায়র।' একথা বলে তিনি আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইলেন।

অতঃপর আমি অন্যত্র চলে গেলাম এবং ঘুরে ঘুরে দুই তিনবার সেখানে এসে তাকে একই অবস্থায় কান্নারত দেখলাম। শেষবার তিনি আমাকে বললেন, শাকিক! আগে আমাকে বলুন, আমি যদি আপনাকে সবকিছু খুলে বলি, তবে আপনি তা সবার কাছে প্রচার করবেন নাকি নিজের মধ্যেই রাখবেন?

আমি বললাম, আপনি যা বলবেন, আমি তা-ই করবো।

আমার কথায় আশ্বস্ত হয়ে তিনি বলতে আরম্ভ করলেন, দীর্ঘ ত্রিশবছর যাবত আমার মন সিকবাজ (গোশত ও সিরকা দ্বারা তৈরি একপ্রকার ঝোল) খাওয়ার জন্য ছটফট করে যাচ্ছিলো। আমি বহু কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু গতরাতে আমার সঙ্গে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। আমি বসে ছিলাম, এ অবস্থায় আমার কিছুটা তন্দ্রাভাব চলে আসে। তখন আমার মনে হলো, এক যুবক একটি সবুজ রঙের পাত্র হাতে আমার কাছে আগমন করলেন। পাত্রটি থেকে তখন সিকবাজের ভাপ ও সুঘ্রাণ ভেসে আসছিলো। যুবকটি আমার কাছে এসে বললেন, ইবরাহিম! এখান থেকে আপনার ইচ্ছেমতো খেতে শুরু করুন।

আমি বললাম, যে জিনিসকে আমি আল্লাহর জন্য বর্জন করেছি, তা খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

[৬] এ ঘটনাটি সুফিদের বানোয়াট কল্পকাহিনির অন্তর্ভুক্ত। হতে পারে, এ ঘটনার বর্ণনাকারীর মতিভ্রম হয়েছিল। তাই তিনি এমন অতিপ্রাকৃত কিছু দেখেছেন। একজন সচেতন পাঠকের কাছে এ ঘটনার জাল ও বানোয়াট হওয়ার বিষয়টি অস্পষ্ট থাকার কথা নয়।

তিনি বললেন, যদি স্বয়ং আল্লাহ আপনাকে খাওয়ান, তবুও কি আপনি খাবেন না? তার একথার কোনো উত্তর আমার কাছে ছিলো না; দুচোখ ছাপিয়ে শুধু অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

আমাকে কাঁদতে দেখে তিনি বললেন, আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন! নিন এবার কান্না থামিয়ে খেতে শুরু করুন।

আমি বললাম, কোনো খাবার আমাদের সামনে এলে, সেটা কোথা থেকে এসেছে তা না জেনে আমাদের সেই খাবার খেতে নিষেধ করা হয়েছে।

তিনি বললেন, শুনুন তাহলে, এই খাবার আমার কাছে দিয়ে আমাকে বলা হলো, ‘হে খিজির! আপনি এ খাবারগুলো নিয়ে ইবরাহিমের কাছে যান। এরপর এর দ্বারা তার নফসকে পরিতৃপ্ত করুন। কারণ দীর্ঘদিন যাবত সে তার নফসকে এ খাবার থেকে বিরত রেখে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছে।' ইবরাহিম! জেনে রাখুন, আমি ফেরেশতাগণকে বলতে শুনেছি, ‘কোনো ব্যক্তিকে বিনা প্রার্থনায় কিছু দেওয়ার পর সে যদি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে তবে তার পরিণতি এই হবে যে, পরে সে ওই জিনিস প্রার্থনা করলেও তা তাকে দেওয়া হবে না।' অতএব নিঃসংকোচে আপনি এ খাবার গ্রহণ করুন।

তার একথা শুনে আমি বললাম, যদি আপনার কথা সত্যও হয়ে থাকে, তবুও নিজ হাতে আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

একথা বলে আমি পাশ ফিরতেই আরেকজন যুবককে দেখতে পেলাম। তিনি পূর্বের যুবককে সম্বোধন করে বললেন, 'খিজির! সে নিশ্চয় নিজ হাতে এ খাবার গ্রহণ করবে না। অতএব তুমিই তাকে তোমার হাত দিয়ে খাইয়ে দাও।”

এরপর সেই যুবক তার হাত দিয়ে আমার মুখে একের পর এক লোকমা তুলে দিতে লাগলো। একপর্যায়ে আমি পরিতৃপ্ত হয়ে গেলাম।

এতটুকুই ছিলো আমার স্বপ্ন। অতঃপর আমার তন্দ্রাভাব কেটে গেলে দেখলাম,

খাবারের স্বাদ তখনও আমার মুখে লেগে আছে।

বর্ণনাকারী শাকিক বলেন, পুরো ঘটনা শুনে আমি ইবরাহিম ইবনু আদহামকে বললাম, ইবরাহিম! দয়া করে আমাকে আপনার হাত দেখান। অতঃপর আমি তার হাতে চুম্বন করে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানালাম, 'হে মহান সত্তা, যিনি তাঁর

[৭] এ ঘটনাটিও সুফিদের কল্পকাহিনির অন্তর্ভুক্ত, তাদের মিথ্যা ও বানোয়াট কিচ্ছা কাহিনির শামিল।


প্রিয় বান্দাদের মনের বাসনা পূরণ করেন এবং নিজ ভালোবাসা দিয়ে তাঁদের অন্তরকে সিক্ত করেন! আপনার কাছে কি এ অভাগা শাকিকের কোনো মূল্য নেই?’ এরপর আমি ইবরাহিম ইবনু আদহামের হাত দুটি আসমানের দিকে উঁচু করে ফরিয়াদ জানালাম, “হে আমার রব! এ হাত এবং তার মালিকের উসিলা করে হলেও আপনি আপনার এই অভাগা বান্দা শাকিকের উপর আপনার দয়া ও অনুগ্রহ বর্ষণ করুন, যদিও এ বান্দা আপনার দয়া ও অনুগ্রহের উপযুক্ত নয়।”

বর্ণনাকারী বলেন, এরপর ইবরাহিম ইবনু আদহাম সেখান থেকে উঠে গেলেন এবং আমরা একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে মসজিদে হারামে গিয়ে প্রবেশ করলাম।

২৭১. আবদুল্লাহ ইবনু সালেহের ঘটনা

আবদুল আজিজ আহওয়াযি বর্ণনা করেন, সাহল ইবনু আবদুল্লাহ একদিন আমাকে বললেন, মানুষদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করা একজন আল্লাহর ওলির জন্য অপমান ও লাঞ্ছনার বিষয়। নির্জনে একাকী থাকার মাঝেই তার সম্মান নিহিত। এমন আল্লাহর ওলি খুব কমই তোমার নজরে পড়বে, যারা মানুষের দৃষ্টিসীমার বাইরে গিয়ে নির্জনে একাকী অবস্থান করে না। জেনে রাখো, আবদুল্লাহ ইবনু সালেহ মর্যাদাসম্পন্ন ও তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী একজন মানুষ ছিলেন। তিনি সর্বদা লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে পছন্দ করতেন, আর এজন্য তিনি এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়াতেন।

এভাবে ঘুরতে ঘুরতে একবার তিনি মক্কায় গিয়ে পৌঁছেন এবং দীর্ঘদিন সেখানে অবস্থান করেন। আমি তখন তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি তো সচরাচর এক স্থানে বেশিদিন অবস্থান করেন না; কিন্তু মক্কায় এসেছেন দীর্ঘদিন হলো, অথচ এখনো প্রস্থান করছেন না যে?

তিনি বললেন, আমি কেনই বা এখানে অবস্থান করবো না, অথচ ইতঃপূর্বে যত দেশে ভ্রমণ করেছি, কোনো দেশেই আল্লাহ তাআলার রহমত ও বরকত এত বেশি নাযিল হতে দেখিনি যতটা এখানে দেখেছি। এখানে ফেরেশতাগণ সকাল সন্ধ্যা প্রতিনিয়ত রহমত ও বরকতের বার্তা নিয়ে আগমন করে থাকেন। তাই

[৮] ইসলামি শরিয়তে এভাবে কোনো মানুষের উসিলা গ্রহণ করে আল্লাহর কাছে দোয়া করা বৈধ নয়। কাজেই এ কাজ সহিহ ইসলামি আকিদার পরিপন্থি।

আরো পড়তে অথবা দেখতে :- অনুগ্রহ করে Hardcopy ক্রয় করুন। 

অনুরোধঃ- বই :  সোনালি যুগের গল্পগুলো এর প্রি অর্ডার চলছে ... তাই সোনালি যুগের গল্পগুলো বইটি PDF Free Download চাহিয়া লেখকদের নিরুৎসাহিত করিবেন না।
We Respect Every Author Hardwork - boipaw.com™

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ