বইঃ তিতিয়া লেখক: আলমাস হোসাইন | Titia by Almas Hossain Saja

বই: তিতিয়া 
মূল্য: ২১০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৯৫
ধরন: উপন্যাস
A Complete Book Review Of বইঃ তিতিয়া (pdf download free no available) লেখক: আলমাস হোসাইন | Titia by Almas Hossain Saja books
Cover image : তিতিয়া - আলমাস হোসাইন

কাহিনি সংক্ষেপ:
বেশ কিছুদিন আগে তরুণ কথাশিল্পী আলমাস হোসাইন শাজা স্যারে’র (উনি আমার গৃহশিক্ষক। স্যারের কাছে আমি প্রাইভেট পড়ি।) ‘তিতিয়া' উপন্যাসটি পড়া শেষ করেছি। উপন্যাসটির শব্দচয়ণ, বাক্যালাপ, উপন্যাসের নায়িকা তিতিয়া'র রূপ বর্ণনা— সবকিছুর মধ্যেই একটা ভিন্ন ধাঁচের ছোঁয়া আছে।

এই উপন্যাস কোনো কাল্পনিক উপন্যাস নয়, এটি লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের একটি বাস্তব ঘটনা। বইটিতে লেখক অসাধারণ দক্ষতায় নিজের জীবনের বাস্তব কাহিনিটি ফুটিয়ে তুলেছেন।

উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র অর্থাৎ উপন্যাসের নায়িকা ‘তিতিয়া' যখন খুব ছোট, তখনই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি (তিতিয়ার বাবা; বজলু মিয়া) মারা যান। যার ফলে পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব এসে পড়ে তিতিয়ার বড়ভাই সজিবের কাঁধে। জীবিকার তাগিদে তেরো-চৌদ্দ বছরের দুরন্ত সজিব তার চাচাতো ভাইয়ের পরামর্শে চট্টগ্রামে একটা কোম্পানিতে কাজ করার উদ্দেশে গৃহত্যাগ করে।

তিতিয়ার অসুন্দর চেহারা নিয়ে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার চেষ্টা ও আমাদের সমাজের কিছু নিকৃষ্ট মন-মানসিকতার মানুষের জন্য নিজের কাছে হেরে গিয়ে তার নির্মম মৃত্যুই মূলত এই উপন্যাসের মোদ্দা কাহিনি। লেখকের ভাষ্যমতে, এই তিতিয়া আমাদের সমাজের বাইরের কেউ নয়। আমাদের সমাজে তিতিয়ার মতো এরকম অনেক অবহেলিত মানুষ রয়েছেন, যাঁরা প্রতিনিয়তই লাঞ্ছনা-অপমানের শিকার হন। মূলত আমাদের সমাজের এরকম হাজারো লাঞ্ছিত-অপমানিত মানুষদেরই একটি কাল্পনিক চরিত্র তিতিয়া।

   তিতিয়া অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করলেও তা কেড়ে নেয় তার নিয়তি। অসুস্থতার কারণে রূপ-লাবণ্য হারানো তিতিয়া একসময় তার পরিবারের সদস্যদের কাছেই বোঝা হয়ে ওঠে। অন্যদিকে উপন্যাসের নায়ক তিয়াসেরও একই অবস্থা। তিয়াসের ভগ্ন চেহারার জন্য সে-ও সমাজে অবহেলিত। কিন্তু সে সমাজের মানুষের কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের আত্মবিশ্বাস ও প্রবল মনের জোরেই জীবনসংগ্রামে টিকে গেছে। একসময় ফেসবুকের সূত্রে তিয়াস ও তিতিয়ার মধ্যে গড়ে ওঠে একটি সম্পর্ক। 

নিজের সব কষ্টকে সহ্য করে তিতিয়ার স্বপ্ন ছিলো তার মায়ের সুস্থতা ও ভাইয়ের একটা সুন্দর গোছানো সংসার।
   সবকিছু ঠিকঠাক চললেও ভাই সজিবের বিয়ে হবার পর থেকে তিতিয়ার জীবনে নেমে আসে কঠিন বিপর্যয়। নিজের ভাই ও ভাবির সাথে শুরু হয় মনোমালিন্য। ধীরে ধীরে তিতিয়ার জীবন একসময় হয়ে ওঠে চরম দুর্বিষহ।
যে পরিবারে জন্য তিতিয়া সারাজীবন এতো আত্মত্যাগ করলো, সেই পরিবারেই সে এখন ফেলনা। একসময় তিতিয়া বুঝতে পারে, সে একা; একেবারেই একা। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী— কেউ তার পাশে নেই। ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয়ের পর তার এই নিঃসঙ্গ জীবনে একমাত্র সঙ্গী হয়ে ওঠে তিয়াস। 

লেখক উপন্যাসটির চূড়ান্ত পরিণতি দিয়েছেন অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে। বারবার সমাজের মানুষের কটুকথা আর প্রতিনিয়ত নিজের ভাই-ভাবি ও মায়ের অবহেলা সহ্য করতে না পেরে তিতিয়া শেষপর্যন্ত সুইসাইড করে। 
   মূলত নিজের পছন্দ অনুযায়ী লেখাপড়া না করতে পারা, অসুন্দর চেহারা, অসুস্থতা, উপার্জনহীনতা, প্রত্যাশিত চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া, ভাই-ভাবি-মায়ের অমানবিক ব্যবহার ও তীক্ষ্ণ কথার আঘাত, গ্রামের প্রতিবেশীদের অবহেলা, বিয়ে না হওয়া— এই সব কারণই তিতিয়াকে ঠেলে দেয় আত্মহত্যার মতো অপমৃত্যুর দিকে।
এভাবেই শেষ হয় একটি অবহেলিত মেয়ের জীবন। সারাজীবন রোগ-শোক, দারিদ্র্য, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে না পারার ব্যর্থতায় তিতিয়া নীরব অভিমানে মৃত্যুর অমৃত স্বাদ নেয়।
   অবশেষে তিতিয়ার বিয়ের জন্য কেনা সেই ষাঁড় গরুটাই জবেহ করা হয় তার কুলখানি উপলক্ষে।

   আত্মহত্যা মূলত কোনো সমাধান না। নিজেকে শেষ করে দেবার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই; বরং প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও নিজেকে শক্ত রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু বাস্তবতা পুরোটাই উল্টো। ‘একটা মানুষ কতোটা আঘাত পেলে আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নেয়'— তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে এই উপন্যাসটিকে ধরে নেয়া যেতে পারে।

উপন্যাসটির পছন্দের কিছু লাইন:

(১) ঘুমই যেন মৃত্যু ও মুক্তির পথ।

(২) রাসেল রানা চলে গেলেও পিংকির অপেক্ষার প্রহর অনেক দীর্ঘ।

(৩) সফল মানুষের গল্প সবাই শুনে কিন্তু ব্যর্থ ঘটনার পেছনের হাজারও কষ্টের কথা কেউ আমলে নিতে চায় না।

ব্যক্তিগত মতামত:

এটিই আমার আলমাস হোসাইন শাজা'র পড়া প্রথম উপন্যাস। একটা উপন্যাস পড়েই লেখকের প্রেমে পড়ে গেলাম! খুব ভালো লেগেছে উপন্যাসটি পড়ে।
   বইয়ের প্রচ্ছদ, নামকরণ ও ফ্ল্যাপের লেখাগুলো দেখেই একজন পাঠকের বইটি পড়তে ইচ্ছে করবে।
পাঠকদের উদ্দেশে বলবো— এই উপন্যাসটি অবশ্যই একবার হলেও পড়তে পারেন। আশা করি নিরাশ হবেন না।

#পুনশ্চ_১: হুমায়ূন আহমেদের ‘বাদশাহ নামদার' ও মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘আমি তপু'— এদুটো উপন্যাসের শেষটা পড়ে মন খারাপ হয়েছিলো। ঠিক সেরকম এই ‘তিতিয়া' উপন্যাসের শেষ পরিণতিটি পড়েও মন খারাপ হয়েছে খুব।

#পুনশ্চ_২: সব মিলিয়ে গল্পটা অবশ্যই চমৎকার হয়েছে। থিমটা দারুণ! তবে শেষে তিতিয়ার করুণ পরিণতিটা আমি মেনে নিতে পারছি না। ঘটনাটি অন্যভাবেও সাজানো যেতো। আমাদের সমাজে তিতিয়ার মতো মেয়েদের সকল অপমান-লাঞ্ছনাকে উপেক্ষা করে ঘুরে দাঁড়ানোর প্লট নিয়ে ঘটনাটি সাজানো যেতো। তিতিয়াদের মতো মানুষেরা সবাই এভাবে হেরে যাবে কেন?

#পুনশ্চ_৩: লেখক উপন্যাসটির ইতি টেনেছেন নির্মমভাবে; তাই হয়তো এই উপন্যাসটি একজন পাঠকের হৃদয়ের মণিকোঠায় আজীবন থাকবে। মূলত এখানেই একজন লেখকের প্রকৃত সার্থকতা।

Review Credit 💕
২৪.০৩.২২

...মু্ন্নী আক্তার মীম
         বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ(মাস্টার্স);
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

লেখক আলমাস হোসাইন শাজা’র "তিতিয়া” উপন্যাসটি পড়ে শেষ করলাম। একবারের জন্যও মনে হয়নি কোন নবীন লেখকের বই পড়েছি। কাঁদিনি তবে কাঁদার বাকিও রাখিনি কারণ যে কষ্টকর অনুভুতি হয়েছে তা কান্নার চেয়েও গভীর। হয়তো আমি একটু বেশিই কঠিন তাই, অন্য কেউ হলে অঝোরে কেঁদেই ভাসাতো। না কাঁদায় খারাপ লাগাটা ভিতরে আটকে আছে জানিনা কতদিন আটকে থাকবে, হয়তো সারাজীবনই কারণ এই তিতিয়া কোন একক তিতিয়া নয় আমাদের আশপাশে এমন অনেক তিতিয়াই আছে যারা এমন মানসিক চাপে থেকে রোজই আত্মহত্যা করতে চায়। প্রচ্ছদের নারীমূর্তিটি তিতিয়ার সর্বোৎকৃষ্ট পরিচয় বলে মনে করি যা তিয়াসের মনের মণিকোঠায় আজীবন এভাবেই অক্ষত থাকবে। এই উপন্যাস কোন কল্পিত কাহিনি নয়, লেখকের ব্যক্তিগত জীবনে বাস্তবিক কাহিনি আর এই তিতিয়াও এক্সিস্টস্। বাস্তবিক কাহিনি হওয়ায়ই হয়তোবা এর প্রতিটি লাইন আমাদের ভাবায়। যাই হোক লেখক তাঁর এই উপন্যাসের পরতে পরতে আমাদের সমাজের, সমাজের মানুষের মানসিকতার ও কর্মকাণ্ডের দোষত্রুটি খুবই কৌশলে পরোক্ষভাবে উপস্থাপন করেছেন। যেমন, উপন্যাসের প্রথমেই ভাঙা চেয়ার এর উদাহরণ টেনে সংসারের উপার্জনহীন মানুষের অবস্থান বুঝিয়েছেন এভাবে "জড়বস্তুর জীবন মানে জীবের সাগ্রহে প্রয়োজন মোতাবেক এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরিপাটি হাবভাব।"

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষের মৃত্যুতে অন্য সদস্যদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন কীভাবে মুহূর্তে ধুলিস্যাৎ হয়ে যায় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ সজিব। উপন্যাসের ভাষ্য অনুযায়ী "সবাই যখন হাসিখুশি মনে স্কুল ব্যগ নিয়ে বাড়ি ফিরছে সজিব তখন প্রবেশ করছে জীবন যুদ্ধে, অন্তর্জালা নিয়ে চলে যাচ্ছে দূরের পথে।" উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র পিংকির ভগ্ন চেহারা নিয়ে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার লড়াই ও শেষ পর্যন্ত পারিপার্শ্বিকতার চাপে পড়ে হেরে যাওয়াই এ উপন্যাসের মূল কাহিনি। যে বারবার হেরে গিয়েও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। সর্বপ্রথম ধোঁকা দেয় তাকে তার নিয়তি, অপরুপ সৌন্দর্য দিয়েও তা কেড়ে নেয় যার ফলস্বরূপ মৃত্যুর আগ অবধি শুনে যেতে হয় গঞ্জনা। এই এক ভগ্ন চেহারার জন্য সে বঞ্চিত হয় জীবনের সকল পাওয়া থেকে।
"রাসেল রানা চলে গেলেও পিংকির অপেক্ষার প্রহর অনেক দীর্ঘ"-এই একটি লাইন দ্বারা লেখক পিংকির দীর্ঘ কষ্টের আভাস দিয়েছেন। সমাজের মানুষের বাহ্যিক বিচারের কাছে মানুষের অন্তঃস্তলের আবেদন কতটা ঠুনকো তা লেখক বুঝিয়েছেন এভাবে "সাদা-কালো চামড়ায় ঘেরা প্রতিটি হৃদযন্ত্রের অনুভুতিই এক। কিন্তু কেউ তা বুঝে আর কেউ তা বুঝতে চায় না।"
অন্যদিকে তিয়াসের জীবনযুদ্ধ ও প্রায় একই, একই ভগ্ন চেহারার অধিকারী সে নিজেও, পার্থক্য এতটুকুই সে ছেলে আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে শহরে থাকার সুযোগ পাওয়ার নিজস্ব ইনকামের মাধ্যমে ভাগ্যের চাকা অনেকটাই ঘুরাতে পেরেছিল যা তিতিয়ার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্ত তাই বলে তিয়াসও সামাজিক বৈষম্যের বলি হওয়া থেকে বাদ যায়নি। গঞ্জনা সেও কম শোনেনি কিন্ত তার অদম্য মনের জোরই তাকে শেষ অবধি টিকিয়ে রেখেছে, রাখবে। মেয়ে হওয়ায় তিতিয়ার তিয়াসের সমান স্বাধীনতা ও সুযোগ না থাকায় মনের জোরও তাকে টিকতে দেয়নি। অনেকে বলতে পারে তিতিয়া, তিয়াসের সাথে চলে গিয়ে নিজের ভাগ্য বদলাতে পারতো কিন্ত বাস্তবতা বড়ই কঠিন কারণ একটা ছেলের তুলনায় মেয়ের শিকড় অনেক বেশি গভীরে থাকে যা সে চাইলেই উপড়ে নিয়ে নিজের পথ দেখতে পারে না সবাইকে ছেড়ে। সমাজের ভাষায় কুৎসিত এই তিয়াস-তিতিয়াও নিজেদের ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করতে চায়। কিন্ত তা ও সমাজ মেনে নিতে চায় না যার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ তিতিয়ার ভাইয়ের তিয়াসকে অবহেলা আর তার মায়ের তিরষ্কার "তাড়াতাড়ি ছ্যাড়াডারে খাবার খাইয়ে বিদায় কর।"
তবুও তিয়াসের তিতিয়ার প্রতি ভালবাসা কমার বদলে আরো বেড়ে যায়। অসুস্থতার কারণে রুপ-লাবণ্য হারানো পরিবারের কাছে বোঝা হলেও তিয়াসের কাছে সে সাক্ষাৎ রাণীমূর্তি। তার কাছে তিতিয়ার রুপ নয় মানসিকতাই বড়, ঠিক তেমনি তিতিয়ার কাছেও তিয়াসের মানসিকতা। তিয়াসের মতে "দৃশ্যত কালো আর শ্যামলা। স্পর্শত একই রকম উষ্ণ। ব্লাড গ্রুপ বা Rh ফ্যাক্টর ভিন্ন হতে পারে। চুল পরিমাণ প্রশস্তের চামড়া পেরোলেই একই রং – লাল। বাহ্যিকভাবে মানানসই বা বেমানান ভাবনাটাই অমূলক।" কি সুন্দর উপলব্ধি!
উপন্যাসে লেখক ব্যবহার্য বিভিন্ন নগন্য জড়বস্তুর সাথে তিতিয়ার জীবনকে তুলনা করেছে যেমন ভাঙ্গা চেয়ার, হারিকেন ইত্যাদি। "রিক্সার নিচে রক্ষিত নিভু নিভু হারিকেনের আলোর মত তিতিয়ার জীবনও যেন নিমজ্জমান" কথাটির দ্বারা লেখক তিতিয়ার অসহায় শেষ সময়কে উপস্থাপন করেছেন অসাধারণ উপমার মাধ্যমে।
তিতিয়ার অনুধাবনে "আমি যেন এসিডদগ্ধ মেয়ের চাইতেও পরিবার-পরিজনের কাছে বরবাদ হয়ে গেছি।" কি পরিমাণ অসহায়ত্ব থেকে তার এমন অনুধাবন তা আর বুঝার অপেক্ষা রাখে না। যে পরিবারের জন্য সে এত ভাবল! এত কিছু করল! সেই পরিবারেই সে আজ উদ্বাস্তু। কেউ কিছু মনে রাখেনি। পছন্দসই লেখাপড়া না করতে পারা ,ভগ্ন চেহারা, অসুখ, উপার্জনহীনতা, চাকরিতে না টিকা, ভাই-ভাবী-মায়ের তীক্ষ্ণ কথার বাণ, আশেপাশের মানুষের অবহেলা, বিয়ে না হওয়া -এই সব কারণই তিতিয়াকে ঠেলে দেয় অকালমৃত্যর পথে। অবশেষে তিতিয়ার বিয়ের জন্য কেনা ষাঁড়টাই ব্যবহার হয় তার কুলখানীর আয়োজনে, হায়রে ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। হয়তো এইভাবে অবেলায় শেষ হয় হাজারো তিতিয়ার গল্প। তিতিয়াদের অবহেলা নয় বরং একটা ভরসার হাত আর একটুখানি ভালবাসায় পারে তিতিয়াদের বাঁচিয়ে রাখতে। আত্মহত্যা যেন আর কোনো তিতিয়ার মুক্তির পথ না হয়। আসুন তিতিয়াদের ভালবাসতে শিখি।
ভাষাশৈলী, বাস্তবতা, উপমা, প্রকাশভঙ্গী, কাহিনি-সব মিলিয়ে অনবদ্য একটি উপন্যাস এটি। হতে পারে এই একটিমাত্র উপন্যাসই লেখককে তার যোগ্য অবস্থানে পৌঁছে দেবে ইনশাআল্লাহ।


তিতিয়া তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক বা রোমান্টিক প্রেমের উপন্যাস নয়। তার ভিতরের কাহিনীও তেমন রূপ, রস, ছন্দ, অলংকার বা উপমায় উৎপ্রেক্ষায় সাজানো নয়। তবে হ্যাঁ আমাদের তথাকথিত নারী সমাজের বাস্তবিক প্রাত্যহিক জীবনের আলোকচিত্র এ উপন্যাসে লেখক নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের শুরুতেই পিংকির বাবার মৃত্যু পাঠকের পাঠের নেশা বাড়িয়ে তুলবে। ছোট্ট পিংকি, ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া সজিব, মা ললিতা বেগমের পরবর্তী জীবন কেমন হবে? এটা জানার আগ্রহ পাঠক মনে সাড়া জাগাবে।

যাই হোক, তিতিয়া উপন্যাসটি হাতে পাওয়ার প্রায় এক বছর পর গতকাল মাগরিবের আযানের পর থেকে এশার নামাজের পর পর্যন্ত এক বসাতেই পড়ে শেষ করি। যাকে বলে এক চুমুকেই গ্লাসের সবটুকু পানি পান করে ফেলা। এই সময়ের মাঝে আমার কাব্য, দিব্য কতশত বার যে বই টানাটানি করেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। প্রশ্নও করেছে মামণি কার বই? বললাম-শাজা আংকেলের। 
তিতিয়ার আলোকচিত্রটা দুই ছেলেই বারবার হাতে নাড়িয়ে ছাড়িয়ে দেখেছে।

আমার বিবাহিত জীবনের চার বছর। এই দীর্ঘ সময়ে আমার একটা দুইটা কবিতা ছাড়া তেমন কোনো লেখা পড়া হয়নি। গতকালই প্রথম শাজা ভাইয়ার 'তিতিয়া' উপন্যাসটি পড়লাম। আর পরশু পড়েছিলাম ভাইয়ার 'সিকি প্রেমের পদ্য' কাব্যগ্রন্থটি। 
পিংকি/তিতিয়া আমি/আমাদের মধ্যেই কারো কারো প্রতিচ্ছবি। রাসেল রানা, তিয়াস, সজিব, রাজন, আহম্মেদ, এখলাস স্যার-আমাদের পুরুষ সমাজেরই কেউ না কেউ।
তিতিয়ার জন্য প্রবল কষ্ট লেগেছে, হৃদয়ে মায়া জেগেছে, তিয়াসের জন্য ভালোবাসার একটা তাজা গোলাপ হৃদয় থেকে খসে পড়েছে। তিয়াস, তিতিয়া দু'জনের জন্যই অশ্রু জমেছে অনেক। গতকাল রাত প্রায় দু'টা অবধি প্রচন্ড মাথাটা ব্যথা করেছে। পুরোটা সময় জুড়ে তিতিয়ার একটা সিনেমা যেনো চোখের সামনে ভাসছিল। শাজা ভাইয়ার পাঠক ধরে রাখার অদ্ভুত রকম লেখনী শক্তি আছে। 

তিতিয়া উপন্যাসের প্রেক্ষিতে লেখকের উক্তি--"জনম যখন বৃথা, মরণ যেন তখন মহাপ্রাপ্তির।"
"নিস্তব্ধতায় ছড়িয়ে গেছে যেন ঘুমের মিতালী। বজলু মিয়া ঘুমায় সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে আর সবাই চৌকি, পাটি ও চটের বিছানায়। ঘুমই যেন মৃত্যু ও মুক্তির পথ।"

উপন্যাসের শেষে পিংকি তথা তিতিয়ার গলায় ফাঁস দিয়ে মৃত্যু। তিয়াসের চাকুরী পাওয়া ও তিতিয়ার বাড়িতে খোঁজ নিতে যাওয়া; সব মিলিয়ে হৃদয় নাড়ানো একটি ট্র্যাজেডি উপন্যাস(আমার কাছে)।
সজিব, ললিতা বেগম বেঁচে থেকেও মৃত্যুর স্বাদ পাচ্ছে আর তিতিয়া মরে। 

কলমের একটি দু'টি টানে লিখা এ উপন্যাসটি সহজ সরল ভাষায় রচিত সাধারণের মাঝে অসাধারণ একটি মনোরম উপন্যাস। এ উপন্যাসের বর্ণনায় স্থান পেয়েছে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের' তিথির নীল তোয়ালে' উপন্যাস, হেলাল হাফিজের 'যে জলে আগুন জ্বলে' কাব্য, হুমায়ুন আজাদের লাল নীল দীপাবলী। আরো আছেন-
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান, আতাউর রহমানের গান, অনুপ ঘোষালের কণ্ঠে গীতিকার প্রণব রায়ের গান। 

পাঠক হিসেবে আমার ভাবনা থেকে বলবো--
কোনো কোনো পিংকি মরে গিয়ে তিতিয়া আর কেউ বেঁচে থেকে তিতিয়া।
এই উপন্যাসের প্রেক্ষিতে বিস্তরভাবে বর্ণনা না করলেও পাঠকের কাছে খুব সহজে অনুমেয় হবে যে, মানুষের চেয়ে পশুর ভালোবাসা অনন্ত ও অক্ষয়। নিজের অবস্থান উপলব্ধি করার জন্য হলেও অন্তত একবার উপন্যাসটি পড়তে পারেন, নিজেকে খুঁজে পেতে পারেন তিতিয়ার দর্পনে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ