আধুনিক প্রাচ্যবাদের কবলে মুসলিম নারীসমাজ লেখক : হাসসান বিন সাবিত | Adhunik Pracchobader Kobole Muslim Narishomaj | বুক রিভিউ

আধুনিক প্রাচ্যবাদের কবলে মুসলিম নারীসমাজ
লেখক : হাসসান বিন সাবিত
প্রকাশনী : সিজদাহ পাবলিকেশন
বিষয় : ইসলামী জ্ঞান চর্চা, ইসলামে নারী
পৃষ্ঠা : 160, 
কভার : হার্ড কভার, 
সংস্করণ : 1st Published, 2022

আধুনিক প্রাচ্যবাদের কবলে মুসলিম নারীসমাজ লেখক : হাসসান বিন সাবিত প্রকাশনী : সিজদাহ পাবলিকেশন বিষয় : ইসলামী জ্ঞান চর্চা, ইসলামে নারী পৃষ্ঠা : 160,  কভার : হার্ড কভার,  সংস্করণ : 1st Published, 2022
আধুনিক প্রাচ্যবাদের কবলে মুসলিম নারীসমাজ

ঐতিহাসিকভাবেই প্রমাণিত যে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো নারীদেরকে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। মুসলিম-সমাজকে পাশ্চাত্যকরণের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইউরোপীয়ানরা উপনিবেশ আমলে নারী সম্পর্কে পশ্চিমা ধারণা মুসলিমদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল। আর সেই লক্ষ্যে তারা মুসলিমদের ভেতর থেকেই একদল লোক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল, যাদেরকে সংস্কারবাদী হিসেবে ডাকা হতো। বর্তমানে যাদেরকে আমরা মডারেট হিসেবে চিনি।বর্তমান সময়েও নারী-স্বাধীনতা, নারীর ক্ষমতায়ন, নারী-অধিকারের মতো চটকদার স্লোগানগুলো সাম্রাজ্যবাদীদের দখলদারিত্বের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্ব এই স্লোগানগুলোর আড়ালে মূলত মুসলিম বিশ্বের রাজনীতি ও বিধানপ্রণালীতে হস্তক্ষেপ করছে এবং মুসলিমদের উপর পশ্চিমা মতাদর্শ চাপিয়ে দিচ্ছে। এই কারণেই দেখা যায়, আমেরিকার প্রসিদ্ধ থিঙ্কট্যাঙ্কার ও পলিসিমেকার প্রতিষ্ঠান র‍্যান্ড কর্পোরেশনের রিপোর্টসমূহে নারীর পশ্চিমায়ন অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। এমনকি তারা নারী-

অধিকারের ইস্যুকে মুসলিম বিশ্বের সাথে চিন্তাযুদ্ধের প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখ করেছে। সাথে সাথে নারী-অধিকারের পশ্চিমা কন্সেপ্ট মেনে না নেওয়াকে তারা উগ্রবাদীদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে।এজন্যই দেখা যায়, যেসব স্থানেই মুসলিমরা আল্লাহর শরিয়াত বাস্তবায়ন করতে চেয়েছে, সেখানেই তারা নারীর সমতা ও ক্ষমতায়নকে ইসলামি শরিয়ার বিরোধিতা করার জন্য প্রধান নিয়ামক হিসেবে ব্যবহার করছে। প্রায় আন্তর্জাতিক প্রতিটি সংস্থা আজ নারীর প্রতি ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে এক প্রকাশ্য যুদ্ধে লিপ্ত। এই যুদ্ধে তারা মুসলিম নারীদেরকে ইসলামের প্রতিষ্ঠিত কিছু মূল্যবোধের বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছে। যার প্রভাব বর্তমান পুরো মুসলিম-সমাজের ওপর দৃশ্যমান। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, মুসলিম-সমাজ মনস্তাত্ত্বিক এই লড়াই সম্পর্কে পরিপূর্ণ উদাসীন হয়ে আছে। তারা আজ নিজেদের অজান্তেই ইসলামের দাসত্ব থেকে বেরিয়ে ইউরোপের দাসত্ব বরণ করে নিচ্ছে।
মুসলিম নারীদের ওপর পশ্চিমা সভ্যতার এই নির্মম শোষণ, তার প্রক্রিয়া, প্রভাব ও প্রতিকারসহ পুরো একটি প্যাকেজ এই বইটি। যা সচেতন ও অসেচতন প্রতিটি মুসলিম নারীপুরুষের জন্য জানা ও অনুধাবন করা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। নারী-অধিকার, নারীর কর্ম, নারী-নেতৃত্ব, হিজাব, জন্মনিয়িন্ত্রণ, ফ্রি-মিক্সিং ইত্যাদি বিষয়ে র‍্যান্ড কর্পোরেশনসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রম ও প্রস্তাবনার পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়েছে ইসলামি শরিয়া ও বাস্তবতার দৃষ্টিকোণ থেকে। আলোচনা হয়েছে এর প্রতিকারে আমাদের করণীয় ও দায়িত্ব নিয়ে।এক কথায়, পশ্চিমা নারীবাদী প্রজেক্টের স্বরূপ প্রকাশ ও তার প্রতিকার নিয়ে বাংলা ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ একটি সংযোজন হবে এই বইটি ইনশাআল্লাহ।

আধুনিক প্রাচ্যবাদের কবলে মুসলিম নারীসমাজ বই রিভিউ

নারীর চাকরির কথা বলতে গেলে যেই বিষয়টি বুঝতে হবে, আধুনিক যুগের চাকরি কাঠামো সম্পূর্ণই নতুন। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ঘরের বাইরে থাকাসহ আরও বিভিন্ন নিয়মনীতি ও বাধ্যবাধকতা পালনের যেই কাঠামো আমরা দেখতে পাই, সেটার সাথে ইসলামের প্রথম যুগের কিছু দৃষ্টান্ত এনে তুলনা করলে ভুল হব। এবং এটা নিজের ও সমাজের সাথে বিশাল প্রতারণা হবে। তখন হয়তো বিচ্ছিন্ন দলিল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারব, কিন্তু এর খারাপ ফলটাকে অনুধাবন করতে পারব না এবং ইসলামের চাহিদাটাও বাস্তবায়ন করতে পারব না।


ইসলাম কখনোই নারীদের ব্যাপকভাবে ঘরের বাইরে কর্মসংস্থানের দিকে ছোটার জন্য উৎসাহিত করে না। আবার নিঃশর্তভাবে তার চাকরির পথকে রুদ্ধও করে দেয়নি। যেন সে প্রয়োজনের মুহূর্তে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারে। ইসলামের ইতিহাসে ব্যাপকভাবে কর্মের প্রতি নারীদের ঝোঁক পরিলক্ষিত হয় না। মূলত এই ঝোঁক এসেছে পশ্চিমা সমাজ থেকে। কারণ পশ্চিমা সমাজে একটা বয়স পার করার পর পুরুষ নারীর অর্থনৈতিক দায় দায়িত্বের বোঝা বহন করতে চায় না। শায়খ মুস্তফা আস সিবায়ি রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমার মতে নারীদের কর্মজীবি হওয়ার মাত্রারিক্ত বাসনা নিছক পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ ছাড়া কিছুই না। এই পথ অবলম্বন করার পর নারীকে সেসব কষ্টকর দায়দায়িত্ব বহন করতেই হবে, যা পাশ্চাত্যের নারীকে করতে হয়। আর এ ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য দর্শনের সকল অনিবার্য কুফলগুলোও তাকে ভোগ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে।

Enamul Haque Masud

আমরা অনেক সময় হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা-এর ব্যবসাকে নারীদের চাকরির পক্ষে দলিল হিসেবে দেখাতে চাই। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা ইসলামে আসার পর ব্যবসার জন্য এক মুহূর্তও ঘরের বাইরে থাকেননি; বরং সমস্ত দায়িত্ব তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ন্যস্ত করে দিয়েছেন। এ ছাড়া আগেও ঘরের অভ্যন্তরে থেকে অন্য লোক দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতেন। এমনকি তিনি ঘরের ভেতরের কোনো কাজের ত্রুটি পর্যন্ত করেননি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা-এর ব্যবসার সময়ে ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেনি। পর্দা, হজ, জিহাদ ইত্যাদি অধিকাংশ বিধান এসেছে মদিনাতে হিজরতের পর। সুতরাং হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার দৃষ্টান্ত দিয়ে নারীদের ব্যাপকহারে ব্যবসা বা চাকরির দিকে ধাবিত করার প্রচেষ্টা ইসলামি শরিয়াহর সাথে পরিপূর্ণ সাংঘর্ষিক।


হ্যাঁ, কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান এমন আছে, যা মহিলাদের দ্বারা খুবই উপকৃত হতে পারে। যেমন হাসপাতাল, শিশুবিদ্যালয়, মহিলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এমন সামাজিক কর্মকাণ্ড যেখানে নারীরাই অধিকতর সফলতা লাভ করতে পারে। আবার নারীদের ভেতর এমন কোনো বিরল প্রতিভাধারী মানুষও থাকতে পারে, যাদের মেধা উম্মাহর কল্যাণে বৃহৎ ভূমিকা রাখতে পারে। এসব ক্ষেত্রে নারীর চাকরি করাটা কেবল চাকরিজীবি নারীদেরই প্রয়োজন পূরণ করে না, এর পাশাপাশি তার এই চাকরিটা সামাজিক প্রয়োজন ও দাবি পূরণেও ভূমিকা রাখে। এইজন্য উলামায়ে কেরাম এসব ক্ষেত্রে (শরীয়ার অন্যান্য বিধান পালনের শর্তে) কিছু নারীর অংশগ্রহণকে ফরজে কিফায়া হিসেবে মত প্রদান করেছেন। ফলে আমাদের উচিত নারীবান্ধব এসব ক্ষেত্রকে নারীদের জন্য উন্মুক্ত করা। এগুলো বিশাল এক ক্ষেত্র, যেখানে আমরা নারীদের আল্লাহপ্রদত্ত প্রতিভা, যোগ্যতা ও বৈশিষ্ট্যকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগাতে পারি।


নিজেকে প্রমাণ করার জন্য, কথিত স্বাধীনতার দৃষ্টান্ত তৈরির জন্য, উইমেন এম্পাওয়ারের (নারীর ক্ষমতায়নের) জন্য কিংবা পুরুষের সাথে সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য চাকরির প্রতি বর্তমান নারীসমাজের যেই অবাধ ঝোঁক তৈরি হয়েছে, এর সাথে শরিয়াহর কোন সম্পর্ক নেই। উম্মাহর বৃহৎ কল্যাণ ও সত্যিকার অর্থেই নিজের প্রয়োজন পূরণের জন্য নির্দিষ্ট কিছু নারী তাদের উপযুক্ত কর্মসংস্থানে আসতে পারে এবং সেটাও ইসলামের অন্য সব বিধিবিধানকে অক্ষুণ্ণ রেখে। কিন্তু মুসলিম নারীদের প্রধান জায়গা তার পরিবার। পরিবারকে ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য দূর্গ হিসেবে প্রস্তুত করার যেই মহান দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা নারী-পুরুষ উভয়কেই দিয়েছেন, সেই দায়িত্ব পালনে পরিবারই তার আসল ক্যারিয়ার, মূল কর্মক্ষেত্র। এখানে অবহেলা ও ত্রুটি করে এবং আল্লাহর শরিয়াহকে লঙ্ঘন করে মুসলিম নারীদের কোনো ক্যারিয়ার থাকতে পারে না। তৈরি হতে পারে না তাদের সফলতা ও উন্নতির কোনো গল্প।

বই: আধুনিক প্রাচ্যবাদের কবলে মুসলিম নারী সমাজ
লেখক: হাসসান বিন সাবিত
প্রকাশনী: সিজদাহ পাবলিকেশন

প্রকাশকের কথা

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লি আলা রাসুলিহিল কারিম। আম্মাবাদ,
১. ‘প্রাচ্যবাদ’ ইসলাম ও মুসলিমদের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। সূচনালগ্ন থেকেই প্রাচ্যবাদের প্রধান আকর্ষণ ও মনোযোগ ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি। খুঁজে খুঁজে ইসলামের খুঁত বের করাই তাদের অন্যতম লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। ইসলামি সভ্যতার খুঁত বের করার অলীক স্বপ্ন যখন ব্যর্থ হয়েছে, তখন প্রাচ্যবাদী সংস্থাগুলো ভিত্তিহীন অভিযোগের তির ইসলামের দিকে ছুড়ে মেরেছে এবং জনমনে মেরুদণ্ডহীন গালগল্প প্রচার করে বেড়িয়েছে। ইসলামের এমন কোনো দিক নেই, যে দিক নিয়ে প্রাচ্যবাদ ভ্রষ্টতা ছড়ায়নি কিংবা আতঙ্কের বোমা ফাটায়নি। ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতি মিটিয়ে দিয়ে পশ্চিমের নোংরা সভ্যতা-সংস্কৃতিতে পৃথিবী সয়লাব করার হীন এজেন্ডা বাস্তবায়নে প্রাচ্যবাদী সংস্থাগুলো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে চলেছে। তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাপী ইউরোপ-আমেরিকার কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব বাস্তবায়নে যে কয়েকটি প্রাচ্যবাদী সংস্থা ধূর্ততার পরিচয় দিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘র‍্যান্ড কর্পোরেশন'। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ-আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ পলিসি মেকার হিসেবে ‘র‍্যান্ড কর্পোরেশন’-এর যাত্রা শুরু হয়। যাত্রা শুরুর পর থেকেই র‍্যান্ড কর্পোরেশন অত্যন্ত চতুরতার সাথে ও সুসংগঠিতভাবে পশ্চিমা-স্বার্থ বাস্তবায়নে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে। এযাবৎকাল পর্যন্ত র‍্যান্ডের প্রত্যেকটা পদক্ষেপই ছিল চোখে পড়ার মতো। তা ছাড়া দুনিয়াব্যাপী পশ্চিমা-আদর্শ পাকাপোক্ত করণে র‍্যান্ড কর্পোরেশন প্রাচ্যবাদী অন্যান্য সংস্থাগুলোকেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে গেছে।

২. সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই বাতিলপন্থিরা ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ‘নারীসমাজ'-কে তাদের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। ইসলামের বিরুদ্ধে জয়ধ্বনি তুলতে বরাবরই তারা নারীদেরকে লেলিয়ে দিয়েছে। পশ্চিমা দাস র‍্যান্ড কর্পোরেশনও এর বাইরে গিয়ে উলটো পথে হাঁটেনি। তারাও ইসলামের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনে পূর্বসূরিদের অনুসরণ করে নারীসমাজকে ব্যবহার করেছে অত্যন্ত চতুরতার সাথে। কথিত নারী-অধিকার, নারী-স্বাধীনতা, নারীমুক্তি ইত্যাদি মুখরোচক স্লোগানের আড়ালে অত্যন্ত কৌশলে তারা প্রশ্ন তুলেছে ইসলামে নারীর অবস্থান নিয়ে। প্রোপাগান্ডার পর প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছে ইসলামের নারী-আইন বিষয়ে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, যা একইসঙ্গে আশ্চর্যেরও বটে, র‍্যান্ড কর্পোরেশন কর্তৃক সৃষ্ট এ সংকট মোকাবিলায় বিদেশি ভাষায় কমবেশ কিছু কাজ হলেও বাংলা ভাষায় র‍্যান্ড কর্পোরেশন ও তার অপতৎপরতা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো কাজ আমাদের চোখে পড়েনি। এ শূন্যতা পূরণে ও র‍্যান্ড কর্পোরেশনের অপতৎপরতার ব্যাপারে বাংলাভাষী পাঠকদেরকে সচেতন করার লক্ষ্যে সিজদাহ পাবলিকেশন বেশকিছু প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। তারই ধারাবাহিকতায় এই বইটি আমাদের প্রথম প্রচেষ্টা, যা ইতিমধ্যে মলাটবদ্ধ হয়ে ‘আধুনিক প্রাচ্যবাদের কবলে মুসলিম নারীসমাজ' নামে প্রকাশিত হয়েছে। ওয়া লিল্লাহিল হামদ।

৩. প্রিয় পাঠক! আপনাদের হাতে থাকা বইটি প্রস্তুত করার কর্মযজ্ঞ আমাদের জন্য মোটেই সহজ ছিল না। উপরন্তু কাজটা ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। তা সত্ত্বেও এতটুকু বলতে দ্বিধা নেই, মুহতারাম লেখক তাঁর বিস্তৃত অধ্যয়ন ও অভিজ্ঞার আলোকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ চ্যালেঞ্জিং কাজ আনজাম দিয়েছেন। র‍্যান্ড কর্পোরেশনের ভ্রান্তিনামার অসারতা প্রমাণের পাশাপাশি যুক্তি ও তথ্য-তত্ত্বের সংমিশ্রণে জায়গায় জায়গায় প্রশ্ন তুলেছেন খোদ পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতি নিয়ে। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি তুলে ধরেছেন পশ্চিমাদের ডাবলস্ট্যান্ডবাজি ও পশ্চিমা-সমাজের করুণ অবস্থার ফিরিস্তি। তিনি একে একে আলোকপাত করেছেন কথিত নারী-অধিকার, নারী-স্বাধীনতা, নারীমুক্তি আন্দোলন, ফ্রি মিক্সিং ইত্যাদি নিয়ে। এসব বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণের পাশাপাশি বাতলে দিয়েছেন আমাদের করণীয়-বর্জনীয়—সবটাই। অনন্তর সব শ্রেণির পাঠকের কথা লক্ষ রেখে লেখকের শব্দ চয়ন, বর্ণনাভঙ্গিও ছিল অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল। কাজেই সার্বিক বিবেচনায় এ কথা বলাই যায় যে, এ কাজটি বাংলাভাষী পাঠকদের জন্য লেখকের তরফ থেকে এক অনন্য উপহার। যা বাংলাভাষায় অনন্য সংযোজন ও বটে। আল্লাহ লেখককে উম্মাতে মুসলিমার পক্ষ থেকে উত্তম বদলা দান করুন। তাঁর ইলমে-আমলে বারাকাহ নসিব করুন। সাথে সাথে যারা এই বইয়ের পেছনে শ্রম দিয়েছেন, আমরা দিল থেকে তাদের শুকরিয়া আদায় করছি এবং দুআ করছি, আল্লাহ যেন তাদের প্রত্যেকের খেদমত কবুল করে নিয়ে উত্তম বদলা দান করেন। আমিন।
৪. আমরা আশা করছি, এ বইটি পাঠকদের মনে নতুন নতুন অনেক ফিকির তৈরিতে বিরাট ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি যেসকল পাঠক এখনো পর্যন্ত পশ্চিমাদের নারীবাদী এজেন্ডা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখে না, তাদের জন্যও এই বইটি আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে ইনশাআল্লাহ। পরিশেষে বলব, মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়; যদি কোনো ভুলত্রুটি বিজ্ঞ পাঠকের নজরে আসে, তাহলে আমাদেরকে জানানোর আকুল আবেদন রইল। আমরা পরবর্তী সংস্করণে অবশ্যই তা শুধরে নেব ইনশাআল্লাহ।

প্রকাশক
সিজদাহ পাবলিকেশন।

ফিরে দেখা

ইসলামপূর্ব পৃথিবীতে নারীদের অবস্থান পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তৎকালীন প্রতিটি জাতির ভেতর নারীদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। আরব সমাজের কথাই ধরা যাক। সেখানে নারীদের না ছিল কোনো উত্তরাধিকার, না ছিল স্বামীর কাছে কোনো অধিকার, আর না ছিল তালাক ও বিয়ের কোনো সীমা। ছিল না তার নিজের প্রিয় মানুষটিকে পছন্দ করার অধিকার। কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়াকে তারা ভীষণ অশুভ ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করত। মেয়ে সন্তান জন্ম নেওয়াকে আভিজাত্যের কলঙ্ক ভেবে তাকে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে ফেলত। রোমান ও গ্রিক সাম্রাজ্যেও নারীদের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা বা অধিকার ছিল না।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স যখন ১৭ বছর, ৫৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সে তখন একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনের আলোচ্য বিষয় ছিল নারীকে কী হিসেবে বিবেচনা করা হবে? মানুষ হিসেবে না-কি অমানুষ হিসেবে? সবশেষে স্থির হয়, সে মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবে বটে, তবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে কেবল পুরুষদের সেবার জন্য। পাশ্চাত্যবাসীর পক্ষ থেকে নারীর প্রতি এই অবজ্ঞা মধ্যযুগ পর্যন্ত বহাল ছিল। উক্ত সম্মেলনের সিদ্ধান্ত যা-ই হোক, সম্মেলনের বিষয়বস্তুটিই নারীসত্তার প্রতি চরম অবজ্ঞা। পশ্চিমা বিশ্ব তখন এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছতে পারেনি যে, নারীরা মানুষ না-কি অমানুষ। এরপর যখন তারা নারীকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখল, তখন তাদের সে ভাবাটাও ছিল নারীর অধিকার চরমভাবে লঙ্ঘন করে। নারীর প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি কতটা জঘন্য ছিল, তা কল্পনা করার মতো না। ১৮০৫ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ আইনে স্ত্রীকে বিক্রি করে দেওয়ার অধিকার স্বামীর জন্য সংরক্ষিত ছিল। এই সময় স্ত্রীর মূল্য বেধে দেওয়া হয়েছিল ছয় পেনস। তখনকার ইউরোপের পুরুষরা ঋণ পরিশোধ না করতে পারলে পাওনাদারের কাছে নিজের স্ত্রীকে বন্ধক হিসেবেও রাখত। তাদেরকে বাজারে তুলত বিক্রির জন্য। এমনকি নারীদের বিক্রির জন্য আলাদা বাজারব্যবস্থাও ছিল।

সপ্তম শতাব্দীর শুরুতে যখন বিশ্বের সকল অঞ্চল ও সমাজে নারী-জীবন ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন, ঠিক তখনই আরবের বুকে মক্কা নগরীতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন ঘটে। নবুওয়াতপ্রাপ্তির মাধ্যমে তার পবিত্র জবানে ইসলামের ঐশী বাণীর আবির্ভাব হয়েছে এই পৃথিবীতে। ইসলাম এসে নারীকে দিয়েছে সর্বকালের সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ ও সম্মানজনক অবস্থান। এই অবস্থান একই সাথে নারীকে তার যথার্থ অধিকার ও দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে এবং সমস্ত পাশবিকতা ও অনিরাপত্তার বলয় থেকে তাকে মুক্ত করেছে।

নারী-অধিকার প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইসলামের সুন্দরতম দিক হলো, এখানে নারীর স্বভাব-প্রকৃতির ওপর পরিপূর্ণ লক্ষ রাখা হয়েছে এবং নারী-পুরুষকে এক সত্তা হিসেবে বিবেচনা না করে তাদের মাঝে বণ্টননীতির ভিত্তিতে দায়িত্ব ও অধিকার নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু এই ভারসাম্য পশ্চিমা নারী অধিকারে রক্ষা করা হয়নি; বরং সেখানে নারীর নারীত্বের প্রতি শোষণ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং নারী-পুরুষকে একে অপরের সহযোগী বানানোর পরিবর্তে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
মূলত ইসলাম আগমনের পর থেকেই পৃথিবীর বুকে নারীর প্রকৃত অধিকার বাস্তবায়নের ধারা শুরু হয়েছে। মুসলিম বিশ্বে নারী-অধিকারের প্রসঙ্গ কোনো সংকটের বিষয় ছিল না। নারীরা তাদের অধিকারপ্রাপ্তির জন্য পশ্চিমাদের মতো ফেমিনিস্ট (নারীবাদী) আন্দোলনের মুখাপেক্ষীও ছিল না। নারীদের কোনো আবদার ও আন্দোলন ছাড়াই ইসলাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের যথার্থ অধিকার বুঝিয়ে দিয়েছে।

৬. আল মারআতু বাইনাল ফিকহি ওয়াল কানুন, পৃষ্ঠা ১৭ নারীকে বিক্রি করার দৃশ্য দেখার জন্য নেটে wife selling লিখে সার্চ করলেই অনেক প্রামাণ্যচিত্র পেয়ে যাবেন। আমরা ইসলামি ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখব, মুসলিম দেশগুলোতে ইউরোপীয় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত নারীসমাজের চিত্র ছিল প্রায় একইরকম। খোলামেলা পোশাক পরিধান, ফ্রি মিক্সিং, নাটক, সিনেমা, অভিনয়, নারীদের রাজনৈতিক তৎপরতা, কর্মসংস্থানের প্রতি ব্যাপক ঝোঁক ইত্যাদি ছিল না। বিচ্ছিন্ন কিছু দৃষ্টান্ত থাকলেও এটাই ছিল স্বাভাবিক চিত্র। নারীরা পরিবার ও প্রজন্ম গড়ে তোলার দায়িত্বকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করত। তবে শিক্ষাকার্যক্রম, গৃহশিল্প ও চিকিৎসাবিদ্যা—এই তিন সেক্টরে মুসলিম নারীদের বিরাট ভূমিকা আছে। তথাপি মুসলিম নারীদের মূল মনোযোগ ছিল পরিবার ও প্রজন্ম গঠন। রাজনৈতিক সক্রিয়তা কিংবা পাইকারি হারে কর্মক্ষেত্রে বিচরণের যে সংস্কৃতি ও নিঃশর্ত দাবি বর্তমান সমাজে দেখা যায়, তখনকার যুগে এটা ছিল কল্পনাতীত বিষয়।

সামগ্রিকভাবে এই চিত্রে পরিবর্তন ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম দেশগুলোতে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে। যদিও প্রাচ্যবাদের সূচনা হয়েছিল উপনিবেশ আমলের আগেই। কিন্তু তখনকার সময় ইউরোপের লোকেরা প্রাচ্যকে পাঠ করত কেবল জ্ঞানতাত্ত্বিক জায়গা থেকে। কিংবা বলা যায়, গুটিকয়েক প্রাচ্যবিদ ইসলামি শরিয়াহর ওপর বিভিন্ন সংশয় ও বিকৃতি আরোপ করলে সেটা তখনকার সমাজে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি; বরং ইসলামি জ্ঞানশাস্ত্রের মাধ্যমেই তৎকালীন অনেক প্রাচ্যবিদ প্রভাবিত হয়েছে। কেউ কেউ তো ইসলাম ও গ্রহণ করেছে।

প্রাচ্যবাদে এক নতুন মোড় ও শক্তি আসে উপনিবেশ আমল থেকে। তখন একদিকে জ্ঞানতাত্ত্বিক উদ্দেশ্য ছাড়াও অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, উপনিবেশবাদী বিভিন্ন স্বার্থ প্রাচ্যবাদের সাথে জুড়ে যায়। অন্যদিকে মুসলিম দেশগুলোতে তাদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত থাকায় তারা মুসলিম সমাজকে প্রভাবিত করতেও সক্ষম হয়। উপনিবেশবাদী শক্তিগুলো মুসলিম সমাজের মধ্য থেকে নারীদের বেছে নেয় ইসলামি শরিয়াহর সাথে তাদের আদর্শিক যুদ্ধের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে।

সেই সূচনাকাল থেকেই কেন পশ্চিমারা মুসলিম সমাজকে ধ্বংস করার জন্য মুসলিম তরুণীদের টার্গেট করেছে, এর কারণটা ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহর বিখ্যাত উক্তির মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি বলেছেন, 'উম্মাহর অর্ধেক হচ্ছে নারী, আর বাকি অর্ধেককেও জন্ম দিয়েছে নারী। তাই বলা যায়, পুরো উম্মাহই হলো নারী।” মুসলিম সমাজ গঠনে নারীরা মৌলিক ভূমিকা পালন করে। ইসলাম একজন নারীকে সে অবস্থান ও ক্ষমতা দিয়েছে। একদিকে তারা মুসলিম-সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠী, অন্যদিকে বাকি অর্ধেক জনগোষ্ঠীও তাদের ওপর নির্ভরশীল। উপরন্তু তাদের গড়ে তোলা ও প্রভাবিত করার বিরাট ক্ষমতা নারীর হাতে বিদ্যমান। এজন্য পশ্চিমা বিশ্ব সেই উপনিবেশকাল থেকেই মুসলিম নারীদের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করার অপচেষ্টা করেছে। কারণ, তাদের মতে নারীসমাজকে আদর্শিক ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রভাবিত করা মানে পুরো মুসলিম সমাজকেই প্রভাবিত করা।

১৮ শতকের ফ্রান্স কর্তৃক আলজেরিয়ার কলোনাইজেশনের প্রক্রিয়ায় আলজেরীয় নারীদেরকে সে প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা হয়। মুসলিম নারীর বোরকাকে উপস্থাপন করা হয় দাসত্বের প্রতীক হিসেবে। বিখ্যাত মার্তিনিকান দার্শনিক ফ্রাঞ্জ ফানো (Frantz Fanon) [১৯২৫-১৯৬১] Unveiling Algeria প্রবন্ধে লেখেন, ‘যদি আমরা আলজেরীয় সমাজ ও এর প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙে দিতে চাই, তাহলে অবশ্যই তাদের নারীদের ওপর আমাদের বিজয়ী হতে হবে। পর্দার অন্তরাল থেকে ও সেসব বাড়িঘর থেকে তাদের খুঁজে বের করতে হবে, যেখানে তারা নিজেদের লুকিয়ে রাখে এবং পুরুষরা তাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকে।”

তারা বোঝে পরিবার ও সমাজ গঠন করা এবং তাকে নষ্ট করার ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা কতটা কার্যকর। আর সেই থেকেই তারা মুসলিম নারীদের মুক্ত করার আন্দোলন শুরু করে। মুসলিম নারীদের বিভ্রান্ত করার জন্য উপনিবেশবাদীরা বিশেষ কিছু ক্ষেত্রকে ব্যবহার করে থাকে।

এর মধ্যে প্রধান ক্ষেত্র হলো ‘মুসলিমদের শিক্ষাব্যবস্থা’। উপনিবেশবাদীরা স্থানীয় শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়ে মুসলিম দেশগুলোতে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে এবং তাদের অধীনে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে বসে। এসব প্রতিষ্ঠানে তারা মুসলিমদের পাশ্চাত্য আদর্শে গড়ে তোলে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মাত্র কয়েক

৭. তুহফাতুল মাওলুদ ফি আহকামিল মাওলুদ, পৃষ্ঠা ১৬

৮. (নেইল ম্যাকমাস্টার Burning the veil: The Algerian war and the 'emancipation' of Muslim women)

https://www.theguardian.com/world/2002/sep/21/gender.usa ৯. আজনিহাতুল মাকরিস সালাসাহ,  

বছরের মধ্যেই তারা নারী শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করায় যে, পশ্চিমা বিশ্বের নারীরা তোমাদের আদর্শ হওয়া উচিত। এজন্য তোমাদেরকে তাদের মতো পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে হবে, রাস্তায় সৌন্দর্য প্রদর্শন করে নিজেকে প্রকাশ করে চলতে হবে। এটাই প্রগতিশীলতা। কিন্তু ইসলাম তোমাদের এই উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ইসলাম চায় তোমাদেরেকে ঘর-বন্দি করে রাখতে। এজন্য ইসলাম প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তোমাদের ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতে হবে।

নারীদের নষ্ট করার জন্য তাদের প্রয়োগকৃত দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি হলো, নতুন নতুন বিভিন্ন শাস্ত্র ও অঙ্গন মুসলিম দেশগুলোতে আমদানি করা। যেমন : ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি, বিউটি ইন্ডাস্ট্রি, বিউটি কম্পিটিশন, ফ্যাশন ম্যাগাজিন ইত্যাদি বিষয়গুলো তারা মুসলিমদের মাঝে আমদানি করে, যা ইতিপূর্বে মুসলিম বিশ্বে ছিল না। এসব পাশ্চাত্য পশু-সংস্কৃতি মুসলিম বিশ্বে আমদানির কারণে মুসলিম নারী-পুরুষ ভুলে যেতে থাকে পর্দার বিধান, ছুঁড়ে ফেলে ফ্রি-মিক্সিংয়ের ব্যাপারে মহান আল্লাহ তাআলার কঠোর নিষেধাজ্ঞা। দেহ প্রদর্শনের উন্মুক্ত বাজারে তারাও উন্মাদনায় লিপ্ত হয়ে যায়।

মিশরে ব্রিটিশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৮৯৪ সালে মার্ক ফাহমি (১৮৭০ ১৯৫৫) আল মারআতু ফিশ শিরকি নামে একটি বই লেখে। মার্ক ফাহমি ছিল উপনিবেশবাদী, বিশেষত লর্ড ক্রোমারের আস্থাভাজন লোক। তার বইয়ে মুসলিম নারীদের নিয়ে উপনিবেশবাদীদের কর্মপন্থা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। বইটিতে সে মৌলিকভাবে পাঁচটি দাবি তোলে—

১. ইসলামি হিজাবকে নিষিদ্ধ করা।

২. গাইরে মাহরাম পুরুষদের সাথে ফ্রি-মিক্সিংয়ের বৈধতা দেওয়া।

৩. তালাককে শর্তযুক্ত করা এবং তা কেবল কাজির সামনে কার্যকর হওয়ার বিধান জারি করা।

১০ আজনিহাতুল মাকরিস সালাসাহ, পৃষ্ঠা ৪১২-৪১৪

১১. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪১৩, ৪২২

১২. ১৮৮২ সালে ব্রিটিশরা মিশর দখল করে। দখলের পর থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত বৃটিশরা নিজেদের প্রতিনিধি নিয়োগ করে মিশরকে শাসন করতে থাকে। এর মধ্যে ক্রোমার অন্যতম। সে ১৮৮২ থেকে ১৯০৭ পর্যন্ত মিশরের ক্ষমতায় অধিষ্ট ছিল। মূলত তার নেতৃত্বেই মুসলিম সমাজের ভেতর পশ্চিমা চিন্তাধারার বক্তিত্ব তৈরির কার্যক্রম পরিচালিত হতো। 

৪. একাধিক বিয়ে নিষিদ্ধ করা।

৫. অমুসলিমদের সাথে বিয়ের বৈধতা দেওয়া।১৩

এটাই ছিল মুসলিম নারীদের নিয়ে উপনিবেশবাদী পরিকল্পনার প্রথম বীজ, যেই বীজ তারা মুসলিমদের অভ্যন্তরে অঙ্কুরিত করতে পেরেছিল। কাসিম আমিন ও হুদা শারাওয়ী-এর নারী-মুক্তি আন্দোলন এই বীজেরই ফসল। কাসিম আমিনের তাহরিরুল মারআহ” ও আল মারআতুল জাদিদাহ বইদুটি উপনিবেশবাদী স্বার্থ বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখে। মিশরে লিখিত এসব বই ব্রিটিশ সরকারের তত্ত্বাবধানে অনূদিত হয়ে ভারতবর্ষেও বিস্তার লাভ করে। এখান থেকেই শুরু হয় নারী অধিকার কিংবা নারী-মুক্তির নামে মুসলিম নারীদের পশ্চিমা ধর্মে ধর্মান্তরিত করা এবং সেই দোহাই দিয়ে শরিয়াহকে সংস্কার করার মিশন। যেই মিশন লর্ড ক্রোমারের নেতৃত্বে শুরু হয়ে আজ শেরল বেনার্ড এর মতো ব্যক্তিত্বদের মাধ্যমে চলমান আছে।

ক্রোমার তার Modern egypt বইতে মিশরকে পশ্চিমাকরণের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলে, 'কেবল মোহাম্মাদান (মুসলিম) নীতিমালা আর প্রাচ্যীয় ধ্যানধারণার ভিত্তিতে গড়া সরকারকে ইউরোপ মেনে নিবে এমন ধারণা করাই হাস্যকর। মুসলিম দেশগুলোতে নারীর সামাজিক অবস্থান ইউরোপীয় ধ্যানধারণা প্রচারের ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। নতুন প্রজন্মের মিশরীয়দের বুঝিয়েসুঝিয়ে কিংবা প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করে পশ্চিমা সভ্যতার মূল চেতনা ধারণ করাতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশবাদীরা শারিরীকভাবে মুসলিম দেশগুলো থেকে বিদায় নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাদের উপনিবেশ শেষ হয়ে যায়নি; বরং তারা মুসলিমদের ভেতর থেকে তাদের সভ্যতার ধারকবাহক এক শ্রেণির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে যায় এবং উপনিবেশের পূর্বে মুসলিম দেশগুলোতে যে শরিয়াহব্যবস্থা

১৩. হারাকাতু তাহরিরুল মারআতি, আনোয়ার আল জুন্দি, পৃষ্ঠা ২৬

১৪ বলা হয়, কাসিম আমিনের তাহরিরুল মারআহ বইটির কিছু অধ্যায় মুহাম্মাদ আবদুহুর লেখা কিংবা বইটির সম্পাদনা তার হাতেই করা। মোটকথা, তাহরিরুল মারআহ বইটির সাথে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে।

5.https://ia802606.us.archive.org/7/items/modernegypt00crom/ modernegypt00crom.pdf

প্রতিষ্ঠিত ছিল, সেটাকে ধ্বংস করে দিয়ে নিজেদের শাসনব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করে যায়। রেখে যাওয়া এই ব্যবস্থা ও ব্যক্তিদের মাধ্যমে তারা মুসলিম সমাজের ওপর আজও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপনিবেশ কায়েম করে রেখেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তারা মুসলিম দেশগুলোতে বুদ্ধিবৃত্তিক উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন নামে ও রঙে যে পলিসি গ্রহণ করেছে, সেখান থেকেই শুরু হয়েছে আধুনিক প্রাচ্যবাদ।

আধুনিক এই প্রাচ্যবাদের সময়কালকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথম কাল হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ৯/১১ পর্যন্ত; দ্বিতীয় কাল ৯/১১ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত। ৯/১১ এর পর থেকে আধুনিক উপনিবেশবাদ ও প্রাচ্যবাদ নতুন মোড় লাভ করে। এই ঘটনার পর তারা বিশাল এক ধাক্কা অনুভব করে। ভেঙে চুরমার হয়ে যায় তাদের দাম্ভিকতার ঠুনকো দেয়াল। ফলে তারা হিংস্র কুকুরের মতো আফগানে আক্রমণ করে সেখানকার ইসলামি সরকারকে উৎখাত করে এবং সেই জায়গায় তাদের মদদপুষ্ট সরকারকে প্রতিষ্ঠা করে। এই ঘটনার পর তারা ইসলামকে সংস্কার করে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে অসাংঘর্ষিক একটি ধর্মে রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টাকে জোরদার করে। কারণ তারা জানে, ইসলাম যদি তার আদি অবস্থার ওপর অবিচল থাকে, তাহলে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে এর সংঘর্ষ নিশ্চিত এবং ভবিষ্যতে তারা ইসলামি বিশ্বের পক্ষ থেকে আরও বড় ধরনের আঘাতের সম্মুখীন হতে পারে। এজন্যই আমরা দেখি, মুসলিম সমাজ নিয়ে আদর্শিক দিক থেকে র‍্যান্ড কর্পোরেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টগুলো ৯/১১ এর পর তৈরি।

প্রাচ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের দীর্ঘ এই পরিক্রমায় বর্তমান সময়ে এসে একটি ভয়াবহ পার্থক্য আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। সেটা হলো, আগের প্রাচ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের সময় অধিকাংশ মুসলিম এটা অনুভব করতে পেরেছিল যে, আমাদের ওপর কেউ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে। যারা আমাদের দীন ও দেশের জন্য হুমকি। কিন্তু আধুনিক সময়ের প্রাচ্যবাদ ও উপনিবেশবাদকে মুসলিমরা অনুভব করতে পারছে না; বরং তারা এই উপনিবেশকে নিজেদের জন্য আশির্বাদ মনে করে বসে আছে। আধুনিক উপনিবেশের চাপিয়ে দেওয়া আদর্শকে তারা প্রগতি ও উন্নতির সোপান মনে করছে।

কিন্তু আধুনিক উপনিবেশ আমাদের দীন ও শরিয়াহকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে আমাদের বিন্দুমাত্র ভাবনা নেই। হারিয়ে যাওয়া সেই ভাবনা ও অস্থিরতাকে জাগরূক করতেই আপনাদের সামনে আধুনিক প্রাচ্যবাদের একটি দিক তুলে ধরছি। যে দিকটা এই উম্মাহর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ নারীসমাজের সাথে সংশ্লিষ্ট।

আরো পড়তে অথবা দেখতে অনুগ্রহ করে Hardcopy ক্রয় করুন।

আধুনিক প্রাচ্যবাদের কবলে মুসলিম নারীসমাজ বইটি PDF Download Free চাহিয়া লেখককে নিরুৎসাহিত করবেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ