আগামী দিনের সভ্যতা ইসলাম - বই পর্যালোচনা : লেখক : ড. ইউসুফ আল কারযাভী | Agami Diner Sovvota Islam

  • আগামী দিনের সভ্যতা ইসলাম
  • লেখক : ড. ইউসুফ আল কারযাভী
  • প্রকাশনী : মক্তব প্রকাশন
  • বিষয় : মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি
  • কভার : হার্ড কভার, সংস্করণ : 1st Published, 2022
  • ভাষা : বাংলা
আগামী দিনের সভ্যতা ইসলাম - বই পর্যালোচনা : লেখক : ড. ইউসুফ আল কারযাভী | Agami Diner Sovvota Islam

আমরা যদি বিশ্বকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখব যে, গোটা দুনিয়ার প্রতি ইঞ্চি জমিন জুলুম-অত্যাচার, হিংসা-বিদ্বেষ, বিশৃঙ্খলা, অশান্তি, নিরাপত্তাহীনতা, আলাদাতহীনতাসহ আরও অসংখ্য সংকটে নিমজ্জিত। মানুষ আজ শান্তি, নিরাপত্তা, আদালত চায়। কিন্তু বর্তমানে বস্তুবাদী পাশ্চাত্য সভ্যতা মানুষের এই চাহিদা পূরণে সম্পূর্ণরূপে অক্ষম। কারণ এই সভ্যতার মূলে রয়েছে ফেরাউনী সভ্যতা, যে সভ্যতা পাশ্চাত্য সভ্যতাকে প্রভাবশালী হতে শিখিয়েছে, শিখিয়েছে অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করতে। এই সভ্যতার শেখানো আধিপত্য বিস্তার মানুষকে আজ আতংকে বসবাস করাচ্ছে, মানুষ আজ পরিবারের সাথে থাকতে পছন্দ করছে না, একাকী জীবন তাদের কাছে বেশি আনন্দের লাগছে, এই সভ্যতা মানুষকে অন্যের উপর কর্তৃত্ব বিস্তার করে শ্রেষ্ঠ হওয়া শেখাচ্ছে, মানুষকে ভুলিয়ে দিচ্ছে যে তারা মানব জাতি তাদের সম্মান মানব হওয়াতেই বিদ্যমান আছে, এই সভ্যতার আধিপত্য বিস্তারের পূর্বে মানুষের মানুষ হিসেবে একটা মর্যাদা ছিল যা এখন আর নেই।

 দুঃখজনক হলেও সত্য, মানুষকে আজ পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এভাবে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্র অশান্তি সৃষ্টি করছে। এই সভ্যতার তথাকথিত সুশীল সন্তান তথা চিন্তাবিদরা এই সভ্যতাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন, তারা গোটা মানবতার আত্মিক এবং দৈহিক প্রশান্তি চায়। তাদের এই প্রশান্তির জন্য নানা ধরণের গবেষণা, পর্যালোচনা চালাচ্ছে কিন্তু ফলস্বরূপ তারা তাদের উদ্বিগ্নতার মুক্তি পাচ্ছে না।

এখন প্রশ্ন হতেই পারে যে, তাদের উদ্বিগ্নতা কি কখনোই কাটবে না? যদি কাটে তবে তাদের উদ্বিগ্নতার কারণ থেকে মুক্তির পন্থা কী?
এই প্রশ্নের উত্তর হলো, ইসলাম।

জ্ঞানসম্রাট আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচ ভাষায়-
  "ইসলাম শুধুমাত্র একটি বিশ্বাসের নাম নয়। ইসলাম এর চেয়েও অনেক বেশি কিছু। ইসলাম কেবলমাত্র মানুষের ব্যক্তিগত জীবনধারাই নয়, বরং একইসাথে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনকেও পরিগ্রহকারী একটি দ্বীন। ইসলাম শুধুমাত্র একটি ধর্মবিশ্বাসের নাম নয়, ইসলাম মানুষের জীবনকে সামগ্রিকভাবে পরিগ্রহকারী একটি ব্যবস্থা।"

ডঃ মুহাম্মদ হামীদুল্লাহ এই সম্পর্কে এভাবে বলেন-

 "ইসলাম মানুষের আত্মিক ও বস্তুগত উভয় বিষয়ের উপর যথাযথ গুরুত্বারোপ করে। ইসলামের দৃষ্টিতে এদুটি অবিভাজ্য এবং একটিকে উত্তরণের আশায় অপরটিকে পরিত্যাগ করা উচিত নয়।"

দেখাই যাচ্ছে যে, তাদের যেসব চাহিদা রয়েছে সেগুলো শুধুমাত্র ইসলামেই পাওয়া যাবে, এটাই চিরন্তন সত্য। আর এই চিরন্তন সত্যকে মানুষের সামনে যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেছেন বর্তমান সময়ের অন্যতম যুগ শ্রেষ্ঠ আলেম, মুতাফাক্কির ড. ইউসুফ আল কারযাভী তার الاسلام حضارة الغد নামক গ্রন্থে, যা বাংলাভাষায় ❝আগামী দিনের সভ্যতা ইসলাম❞ নামে অনুবাদ হয়েছে।

এই গ্রন্থ চারটি অধ্যায়ের সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। এই চারটি অধ্যায়ের বিন্যাস সম্পূরক, যা এই গ্রন্থকে অনন্যতা প্রদান করেছে। 

• প্রথম অধ্যায়- ❝সমসাময়িক সভ্যতার চেতনা এবং এর মতাদর্শ❞
আমরা প্রতিটি সভ্যতাকে একটি জীবন্ত দেহের সাথে তুলনা করতে পারি। জীবন্ত দেহের যেমন দেহ এবং রূহ নিয়ে তৈরি হয়ে থাকে ঠিক তেমনিভাবে সভ্যতা দেহ এবং রূহ নিয়ে তৈরি হয়ে থাকে। আজ গোটা দুনিয়াকে যারা নিয়ন্ত্রণ করছে সেই পাশ্চাত্য সভ্যতা দেহকে ক্রমশ উন্নত করলেও রূহকে উন্নত করার কথা প্রয়োজন মনেই করছে না। যার দরুন এই সভ্যতা হয়ে উঠেছে বস্তুবাদী এক সভ্যতা। এই সভ্যতা বস্তুবাদী হওয়ায় মানুষকে হাসাতে পারছে কিন্তু মানসিক প্রশান্তি দিতে সক্ষম না। পাশ্চাত্য সভ্যতা বস্তুবাদী হওয়ার পিছনের তাদের আদর্শিক, ধর্মতাত্ত্বিক মতাদর্শ সম্পূর্ণ দায়ী, যেগুলোকে নির্ণয় করে গোছালো আকারে গ্রন্থকার এই পাঠে আলোচনা করেছেন।

• দ্বিতীয় অধ্যায়- ❝সমসাময়িক সভ্যতার ব্যাধিসমূহ এবং মানবজীবনে এর প্রভাব❞

পাশ্চাত্য সভ্যতা শুধু নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে তৈরি নয়, এই সভ্যতা দেহ কেন্দ্রিক হওয়াতে দেহকে অনেক উন্নত করেছে, যা নিঃসন্দেহে এই সভ্যতার ইতিবাচক দিক। তবে, এই সভ্যতার ইতিবাচক দিকের থেকে নেতিবাচক প্রভাব অনেক বেশি, বাহ্যিক দিক থেকে এই সভ্যতার চাকচিক্যময় জীবন ধারা দেখে আমরা এই সভ্যতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাই। কিন্তু এর রূহ (ভিতর)যখন আমরা দেখব মূলত তখনই আমরা এই সভ্যতার সীমাবদ্ধতা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারব। এই নেতিবাচক দিক যারা উপলব্ধি করতে পারেনি তারা পরবর্তীতে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে। এই সভ্যতার সীমাবদ্ধতা যাদেরকে গ্রাস করেছে সেখানে শুধুমাত্র তথাকথিত নিচু জাতিই নয়! বরং সেখানে অসংখ্য এলিট শ্রেণিও রয়েছে। গ্রন্থকার এই পাঠকে সেসব বিষয় নিয়েই সাজিয়েছেন যা এই সভ্যতাকে রূহবিহীন এক সভ্যতায় পরিবর্তন করেছে।

• তৃতীয় অধ্যায়- "পশ্চিমা জ্ঞানীগণ কর্তৃক প্রদত্ত সতর্কবার্তা❞
বস্তুবাদী পাশ্চাত্য সভ্যতার যান্ত্রিক আলো আজ নিভু নিভু করছে। যারা নিজেদেরকে এই সভ্যতার কারিগর হিসেবে উপস্থাপন করেছেন তারাই আজ এই সভ্যতাকে নিয়ে চিন্তিত। প্রথম অবস্থায় বিজ্ঞ মানুষের কাছে এই সভ্যতার আশংকাজনক দিক উপলব্ধি হয়,কিন্তু পরবর্তী থেকে আজ পর্যন্ত সাধারণ জনগণ সহ প্রায় সকলেই এর আশংকাজনক দিক উপলব্ধি করতে পারছে। গ্রন্থের শুরু থেকে এই অধ্যায়ের পূর্ববর্তী অধ্যায় পর্যন্ত পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক মতাদর্শ এবং এই সভ্যতার নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই বিষয়গুলো এলিট শ্রেণীর উপর কি কি প্রভাব বিস্তার করেছে সেগুলো নিয়ে এই অধ্যায়কে সাজানো হয়েছে।

• চতুর্থ অধ্যায়- ❝পৃথিবী যে সভ্যতার আকাঙ্ক্ষী❞

পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে আজ অবধি বিভিন্ন ধর্ম ও বিভিন্ন মতবাদের উপর ভিত্তি করে পৃথিবী শাসিত হয়েছে। কিন্তু ইসলাম ব্যতিত কোনো ধর্ম এবং কোনো মতবাদ মানুষের সকল চাহিদাগুলোকে সম্পূর্ণভাবে পূরণ করতে পারিনি এবং পৃথিবীর শেষলগ্ন পর্যন্তও চেষ্টা করলেও সম্ভব হবে না। 
ইসলাম ব্যতিত বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালী আরও যে দুটি ধর্ম আছে অর্থাৎ খ্রিস্টান এবং ইহুদি ধর্ম এগুলো মানুষের কাঙ্ক্ষিত ধর্ম হতে পারে না। কারণ যে ধর্ম বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগে এসে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না সে কীভাবে ধর্মের সাথে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকে সাথে নিয়ে চলবে? এটাই হলো খ্রিস্টান ধর্মের ভিতরের কথা। যদি ইহুদি ধর্মের ব্যাপারে বলি তবে এক কথায় একে বলা যায় এই ধর্মের মানুষ নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে এবং অন্যদের গোলাম মনে করে। এই চিন্তাকে লালন করে যে ধর্ম প্রতিষ্ঠা হবে সে শুধু শোষণ করতে পারবে, ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। 

শুধুমাত্র ইসলাম মানুষের মুক্তিগামী, বিজ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত, আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত এবং সৃষ্টিকুলের কল্যাণের জন্য যা কিছু প্রয়োজন সব কিছুই এই ইসলামে রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পরবর্তী সময়ে জায়োনিস্ট মুভমেন্ট মানুষ হতে ইসলামকে যতই দূরে সরিয়ে রাখতে চাইবে ততই ব্যর্থ হবে। কারণ, মানুষ যে নিজের অজান্তেই আগামী দিনের সভ্যতা ইসলামের আকাঙ্ক্ষী!

• ভাবপ্রকাশঃ ইসলাম এবং পাশ্চাত্য সভ্যতাকে নিয়ে এটি অন্য সব গ্রন্থের থেকে আলাদা। কারণ, এই গ্রন্থটির ধারাবাহিকতা ছিল অসাধারণ যা পাঠক হিসেবে খুবই সহজেই উপলব্ধি করা যায়। 

নিঃসন্দেহে ❝আগামী দিনের সভ্যতা ইসলাম❞ গ্রন্থটি বাংলা অঞ্চলের মানুষের জন্য অনেক বড় একটি উপহার।

লিখেছেনঃ নাঈম খান

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ