রিভিউ | নিখোঁজ কিংবা রয়েছ নয়নে নয়নে লেখকঃ ফারহান আহমেদ

বইঃ নিখোঁজ কিংবা রয়েছ নয়নে নয়নে।
লেখকঃ ফারহান আহমেদ
প্রচ্ছদঃ Maruf Billah
বিষয়ঃ রোমান্টিক।
প্রকাশ কালঃ ২৭ আগস্ট ২০২১।
মুদ্রিত মূল্যঃ ২৫০ টাকা।
বিক্রিত মূল্যঃ ১৭৫ টাকা।
পৃষ্ঠাঃ ১২০।
প্রকাশনীঃ বেনজিন প্রকাশন
পার্সোনাল রেটিংঃ ৪.৫/৫

রিভিউ | নিখোঁজ কিংবা রয়েছ নয়নে নয়নে লেখকঃ ফারহান আহমেদ
ছবি : নিখোঁজ কিংবা রয়েছ নয়নে নয়নে


ফ্ল্যাপ থেকেঃ- “ঠিক তাদের বিয়ের আগের দিন রাতে আবির নিখোঁজ হয়ে গেল। সন্ধ্যার পর থেকে তাকে আর কেউ দেখতে পায়নি। শহরের প্রতিটা অলিগলি খুঁজেও তার সন্ধান পাওয়া গেলো না। রিয়া ছুটতে ছুটতে এয়ারপোর্টের সামনের রাস্তায় এসে পড়লো। আবিরকে শেষবার এখানেই ছেড়ে এসেছিল সে। কিন্তু সেখানেও তাকে পাওয়া গেল না। কেউ তাকে দেখেনি, কেউ তার হদিস দিতে পারেনা। কোনো পার্কের বেঞ্চে তাকে বসে থাকতে দেখা যায়নি। কোনো রাস্তার ধারে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়নি। রিয়া ছুটতে ছুটতে মাহমুদ হাসানের বাসায় হাজির হলো। কিন্তু ১৫ তারিখের পর তিনিও তাকে দেখেনি। তার কোনো বন্ধুদের বাসায়ও তাকে আড্ডায় পাওয়া গেল না। ফোনের পর ফোন করেও আবিরকে আর পাওয়া যায়নি। কোথায় গেল সে? পাখির মতোই যেন হঠাৎ করেই ডানা ঝাপটে উড়ে চলে গেছে সে! নিখোঁজ হয়ে গেছে এই পৃথিবী থেকে!”

⚠️ হালকা স্পয়লার এ্যালার্ট ⚠️

🔷 কাহিনী সংক্ষেপেঃ- গল্পের মূল চরিত্র আবির।সে ২৮ বছরের বেকার এক যুবক।তার বাবা জিয়াউদ্দিন সাহেব প্রতিনিয়ত চাকরির জন্য চাপ দিচ্ছে কারণ তার বাবার রিটায়ার্ড হওয়ার সময় প্রায় হয়ে এসেছে এবং সে এখন থেকে আবিরের আর কোনো ব্যয়ভার নিবে না বলে আবিরকে জানিয়ে দিয়েছে।কিন্তু আবির চায় লেখা লেখি করে একটা পর্যায় যেতে পারলে সেটা তার পেশা ধরে নিয়ে একটা চাকরি করবে।সেটার জন্য সে ‘আলোক পত্র’ নামক প্রকাশনীর প্রকাশক মাহমুদ হাসানের বাড়ি গিয়ে তার কাছে আবিরের লেখা পান্ডুলিপিও জমা দেয়।কিন্তু নতুন লেখক বলে খুব একটা গর্জ দেননি তিনি,বলতে গেলে অনেকটা অপমান করেই তার লেখা পান্ডুলিপি নিয়ে তাকে কথা শুনিয়ে সেটা রেখে যেতে বলে।এই কথাগুলো হওয়ার মাঝে মাহমুদ হাসানের মেয়ে চারুলতা আবিরকে পর্দার আড়াল থেকে দেখছিলো।হয়তো আবিরের মায়ায় পরে গিয়েছিলো।সেদিন প্রকাশকের বাড়ি থেকে বের হয়ে আবিরের প্রেয়সি রিয়া তাকে তাদের বাসায় নিয়ে যায় তার ঠিক করা বিয়ে ভাঙ্গার জন্য।সে তার বাবা-মার একমাত্র ও একরোখা একটা মেয়ে।যেই কথা সেই কাজ রিয়া তার বিয়ে ভেঙে আবিরের সাথে বিয়ে ঠিক করল ২ ডিসেম্বর।ওই দিকে আবিরের বাবা আবিরকে চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না আর আবির তার বিয়ে সম্পর্কে কিছু বলেও নি।তার বাবা রিটায়ার্ড হয়ে গেছে তার কিছুদিনের মধ্যেই কিন্তু তার পেনশনের টাকা তিনি পাননি দূর্নিতী করে চাকরিতে ঢোকার জন্য।আবিরের এবার সত্যি চাকরি দরকার।সে পার্কে বসা বাদাম বিক্রেতা ছদ্মবেশী দালাল দুলু মিয়া এর থেকে ভুয়া পাসপোর্ট আর সার্টিফিকেট দিয়ে একটা চাকরি যোগার করে খুব দূরে একটা দেশ লিবিয়ায় এবং সেখানে যাওয়ার ফ্লাইট ১ ডিসেম্বর।আবির আর রিয়ার বিয়ের ঠিক আগের দিন! আবির কি করবে বুঝতে পারছিলো না। কি ওর কাছে বড় রিয়া না চাকরি? ভালোবাসা না সন্মান? রিয়ার বাবা-মা আবিরের বাবা কে তাদের বিয়ের খবর দেওয়ায় তিনি অসুস্থ হয়ে পরেন।আবিরের ফ্লাইটের ২ দিন আগে আবির তার কাগজ পত্র বুঝে নিতে পার্কে যায় এবং কাগজে গুলো বুঝে নেয় ঠিক তখনই মাহমুদ হাসানের মেয়ে চারুলতা আবিরের পাশে এসে বসে এবং তার লেখা নিয়ে কথা বলে এবং হঠাৎ করেই সে কান্না শুরু করে দেয়।আবিরও হয়তো তার প্রতি মায়া অনুভব করে।এর পরের দিন অর্থাত রিয়া আর আবিরের বিয়ের আগের দিন রিয়ার বাবা মারা যায়।সেইদিনই আবির রিয়ার সাথে তাদের বিয়ের কেনাকাটা করতে যায় এরপর কেনাকাটা এয়ারপোর্ট এর এখানে নেমে যায় রিয়াকে গাড়িয়ে ঘুমে রেখেই।ঘুম থেকে উঠেই রিয়া আবিরে না পেয়ে ফোন করতে গিয়ে একটা মেসেজ পায়,সেটা কে দিয়েছে ও জানে না।সেটা দেখে ও পাগলের মত আবিরকে খুঁজতে থাকে কোথাও পায় না। আবিরকে শেষ দেখেছিলো এয়ারপোর্ট এর সামনে,আবির সেখানেও নেই।কোথায় গেলো আবির?কে দিলো সেই মেসেজ?আবির কি নিখোঁজ হয়ে গেছে? নাকি রয়ে গেছে নয়নে নয়নে?

🔷 পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ- এটা লেখকের প্রথম বই।প্রথম বই হিসেবে বেশ ভালো হয়েছে লেখা।কাহিনী টা বেশ সুন্দর ও বাস্তবতার সাথে মিলে।পড়তে পড়তে একটা সময় মনে হয়েছিলো হুমায়ূন আহমেদ কি জীবিত হয়ে আবার লেখা শুরু করল নাকি ? লেখক ফারহান আহমেদের এই লেখার কিছু কিছু জায়গায় হুমায়ূন আহমেদের লেখার ছোয়া পেয়েছি।আবির চরিত্রটাও অনেকটা হিমু চরিত্রের সাথে মিলে।কিন্তু অবশ্যই ফারহান আহমেদ উনারো লেখার ধরন আছে আলাদা। উনার লেখাও আমার বেশ ভালো লেগেছে।বিশেষ করে বইয়ের ভিতরে সব কয়টা কবিতা আমার বেশ মনে ধরেছে।শেষের দিকে এসে প্রায় কেঁদে দিয়েছিলাম,আবির যখন রিয়ার গাড়ি থেকে নেমে যাচ্ছিলো মনে হচ্ছিলো আমার কলিজা ছিড়ে চলে যাচ্ছে! কারো প্রিয় মানুষ নিখোঁজ হলে না জানি তার কেমন লাগে! 

🔷 চরিত্রায়নঃ- গল্পটি বেশ কয়েকটা চরিত্র নিয়েই গঠিত হয়েছে।এটির মূল চরিত্র আবির,তার প্রেয়সী রিয়া,তার বাবা-মা,খালা-খালু,রিয়ার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়া ভদ্রলোক ফরহাদ ও তার বাবা-মা,প্রকাশক মাহমুদ হাসান,তার মেয়ে চারুলতা,ছদ্মবেশী দালাল দুলু মিয়া।এই কয়েকটা চরিত্র নিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে নিখোঁজ।এর মধ্যে দুলু মিয়া চরিত্রটা বেশ মজার ছিলো, তার কথাগুলো বেশ মজার।লেখক প্রতিটা চরিত্রই খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছে।

🔷 নামকরণের স্বার্থকতাঃ- ‘নিখোঁজ কিংবা রয়েছো নয়নে নয়নে’ নামকরণটি বেশ ভালোভাবে স্বার্থক হয়েছে।কেনো না এখানে আবির তার ভালোবাসা ও তার সম্মান নিয়ে দ্বিধায় ছিলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে বাস্তবতা মেনে নিয়ে তার প্রেয়সী ও তার মায়ায় আবধ্য চারুলতার কাছে নিখোঁজ হয়ে যায়।আবির কোথায় গেছে কেমন আছে নাকি সে তাদেরই আশেপাশে আছে তারা জানে না।তাই আমার মনে হয় বইটির নামকরণ স্বার্থক।

🔷 নেগেটিভ সাইডঃ- বইটির তেমন একটা নেগেটিভ সাইড আমি দেখিনি বা পাইনি।২,৩ টা বানান ভুল চোখে পরেছে কিন্তু সেটার জন্য খুব একটা সমস্যা হয়নি। কিন্তু গল্পের কিছু কিছু জায়গায় এসে মনে হয়েছে সম্পূর্ণ অবাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে লেখক যেমন তার প্রেয়সীকেই সে সামান্য সানগ্লাসে চিনতে পারেনি,নিজের বাবার মৃত্যুর সংবাদ শুনে সে কাঁদেনি উলটা জানাযা না পরেই তার বিয়ের কেনাকাটা করতে চলে যায়।এইটুকু পরে মনে হয়েছে এটা একদমই অবাস্তব চিত্র।আমি গল্প পড়তে পড়তে সেটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে কিন্তু এই অংশ টুকু ভেসে উঠতেও কটু লেগেছে আমার কাছে।আর আবিরের খোঁজ টা বইয়ের একদমে শুরুতে না দিলেই মনে হয় বেশি ভালো হতো,একটু বেশি সাস্পেন্স থাকতো পাঠকদের কাছে,তাও পড়তে তেমন একটা খারাপ লাগেনি।এছাড়া তেমন কোনো নেগেটিভ সাইড পাইনি আমি পুরা গল্পে।

🔷 পজিটিভ সাইডঃ- আমি গল্প পড়তে পড়তে গল্পে ঢুকে গিয়েছিলাম।অনেক বাস্তবতাই উপলব্ধি করেছি।ভালোবাসা, আবেগ,প্রিয় মানুষ এগুলা থাকা সত্ত্বেও সমাজ,মান-সম্মান এগুলা থেকে পালানো যায় না।বাস্তবতা আর কাল্পনিক জগতের মধ্যে অনেক পার্থক্য।আমরা জীবন যেভাবে কল্পনা করি জীবন আসলে ওইরকম না।জীবনটা আরো কঠিন বাস্তবতা আরো কঠিন,সেটা এই গল্প পরে খুব ভালো ভাবেই বোঝা গেছে।আর এই মেসেজ টা আমার কাছে ভালো লেগেছে খুব।লেখক গল্পটা শেষও করেছে খুব সুন্দর ভাবে গুছিয়ে।বইটা পড়ে অন্যরকম তৃপ্তি কাজ করেছে।

🔷 বইটি কেনো পড়বো/কাদের জন্যঃ- যারা সাধারণত রোমান্টিক জনরার উপন্যাস পড়তে পছন্দ করেন তারা এটা পড়তে পারেন খুবই ভালো একটি বই।এখান থেকে আপনি বাস্তবতার কঠিন রূপ দেখতে পারবেন,আবেগ ও বাস্তবতা কখন কিভাবে আমাদের কোথায় নিয়ে যায় সেটা বোঝা মুশকিল।কিন্তু এখানে লেখক অনেকটাই তুলে ধরেছে।তাই আমার মনে হয় যারা রোমান্টিক উপন্যাস পছন্দ করেন তাদের পড়া উচিৎ এবং যারা রোমান্টিক উপন্যাস পড়েন না তারাও এটা পড়ে দেখতে পারেন আশা করি ভালো লাগবে।

🔷 প্রিয় বাক্যঃ- ১. কিন্তু পর্থিবীর সব হিসাব একটু গোলমাল আছে।সব হিসাবেই!
                    ২. পৃথিবীর প্রাণীগুলোকে শুদু পেটেভাতে বেঁচে থাকতেই কত কষ্ট করতে হয়। একবেলার খাবারের শক্তি অন্যবেলার খাবার খুঁজেই ব্যয় করে দিতে হয়।
                   ৩. অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর,আর অধিক্য শোকে পাগল।
                
🔷 প্রিয় কবিতাঃ- গল্পের ভিতরে সবগুলো কবিতাই আমার মনে ধরেছে কিন্তু এটা এতোই ভালো লেগেছে যে না লিখলেই না-
         তোমার চোখের নালিশে দেখো ডুবছে এই শহর
         আমার জন্যে কাঁদছো তবুও জাগছো রাত-প্রহর
                      স্রতের চাদরে ঢাকছে সড়ক
                      নিয়ন বাতির রঙিন মোড়ক
        চোখের সামনে তলিয়ে যাচ্ছে রাত্রির নিশাচর।
                      তবুও অশ্রু ঝরাও অঝোরে
                      আমি নেই তাই মনের বিচারে
        আমার চেয়েও ছোট্ট হয়ত নিশাচর এই শহর।
                     এরপর আমায় তলানো শহরে 
                     রাত শেষ হলে ভোর প্রহরে
                            অশ্রু ফুরোলে
        আলোয় ভিজে খুঁজবে তোমার কাজল দৃষ্টি বহর।

🔷 ব্যক্তিগত মতামতঃ- বইটা আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে পড়ে সব মিলিয়ে।লেখকের লেখার ধরণ কাহিনী সবই ভালো ছিলো।এই বইটির কাজ মানে বই বাইন্ডিং,পৃষ্ঠার কাগজ,প্রচ্ছদ সব কিছুই অনেক ভালো ছিলো।
লেখক ও প্রকাশনী দুই দিকের কাজ দেখেই আমি সন্তুষ্ট। লেখক এবং প্রকাশনীর সবার জন্য অনেক শুভকামনা রইলো।আশা করি সামনে তাদের আরো ভালো ভালো বই পড়ার সৌভাগ্য হবে।

[বি.দ্র.-উপরের সব লেখা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত মতামত।কাওকে কষ্ট বা আঘাত করার উদ্দেশ্যে কিছু বলা হয়নি।কোনো ভুল হলে আশা করি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন😇]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ