লেখক : মাওলানা ইমরান হোসাইন নাঈম
প্রকাশনী : নাশাত
বিষয় : কুরআন বিষয়ক আলোচনা
সম্পাদক : আবদুল্লাহ আল মাসউদ, মাওলানা মুহাম্মদ মাসরুর
পৃষ্ঠা : 560, কভার : হার্ড কভার
ভাষা : বাংলা
স্রষ্টা কি একাধিক হতে পারে? যদি একাধিক হয় তবে কীভাবে এই জগৎ-সংসার বয়ে চলছে অভিন্ন সুরে? কেন টক্কর লাগছে না স্ৰষ্টায় স্রষ্টায়?
একাধিক রাজা থাকলে যেমন অবধারিতভাবেই তাদের মাঝে কোন্দল বাধে, অনুরূপ একাধিক স্রষ্টা থাকলেও তাদের মাঝে বিরোধ বাধা অবশ্যম্ভাবী। এই বিরোধের আভাস মিলবে তাদের কাজকর্মে, তাদের কথাবার্তায় ও আদেশ নিষেধে, এমনকি তাদের পছন্দ ও অপছন্দের মাঝেও দেখা যাবে দুস্তর ব্যবধান।
আমরা বিশ্বাস করি যে, পবিত্র কোরআন মহান স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালার বাণী। তিনি তার বান্দাদের পথনির্দেশ করতে এই বাণীসমূহ নাজিল করেছেন। এই বাণী নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেছেন হজরত জিবরিল আমিন। তিনি তা পৌঁছে দিয়েছেন হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে। অতঃপর রাসুলুল্লাহ কোরআনের আমানত রেখে গেছেন তার উম্মতের মাঝে। গত সাড়ে চৌদ্দশ বছর যাবত এই আমানত বহন করে চলেছে এই উম্মত।
অপর দিকে কোরআনের বিরোধিতাও শুরু হয়েছে ঠিক সেইদিন থেকেই, যেদিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার মানুষদের মাঝে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন, যেদিন তিনি মানুষকে জানিয়েছেন এক ইলাহ বা স্রষ্টার কথা, যেদিন তিনি অস্বীকার করেছেন একাধিক স্রষ্টার ধারণা এবং যেদিন তিনি জনসম্মুখে প্রচার শুরু করেছেন মহান স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালার বাণী। কাফেররা অবাক সুরে বলেছিল :
اجعل الألهة إلها واحدا إن هذا لشيء عجاب بوده و انطلق الملأ منهم أن امشوا و اصبروا على الهتكم إن هذا لشيء يرادة» ما سمعنا بهذا في الملة
الأخرة إن هذا إلا اختلاق
সে কি বহু উপাস্যের পরিবর্তে এক উপাস্য সাব্যস্ত করে দিয়েছে। নিশ্চয় এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। তাদের এক দল চলে যেতে যেতে বলল, তোমরা চলে যাও এবং তোমাদের উপাস্যদের পূজায় অবিচল থাক। নিশ্চয়ই এই বক্তব্য বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমরা সাবেক ধর্মে এই ধরনের কথা শুনিনি। এটা মনগড়া কথা। (সুরা সোয়াদ, ৫-৭)
দিন যত গেছে বিরোধিতা ততই বৃদ্ধি পেয়েছে। বিরোধিতার রীতি ও ধারা সর্বযুগেই ছিল অভিন্ন। বিরোধীদের প্রধান লক্ষ্য ছিল একটাই, মানুষকে কোরআন থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। পবিত্র কোরআন ওদের অভিপ্রায় সম্পর্কে বলছে :
وقال الذين كفروالا تسمعوا لهذا القران و الغوا فيه لعلكم تغيبون আর যারা কুফরি করেছে তারা বলে, তোমরা এই কোরআন শ্রবণ করো না। কোরআনের তেলাওয়াতের সময় হট্টগোল বাধাও; যাতে তোমরা জয়ী হতে পারো। (সুরা হা-মীম সাজদা, ২৬)
মানুষকে কোরআন থেকে দূরে রাখতে তাই তারা কখনো কোরআনকে বলেছে রাসুলের বানানো কথা, রাসুলকে কখনো বলেছে পাগল, যাতে কোরআন হয় পাগলের প্রলাপ; কখনোবা কোরআনকে প্রমাণ করতে চেয়েছে জাদুমন্ত্র, তাই রাসুলকে বলেছে জাদুকর। কখনোবা বলেছে, এই কোরআন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অমুকের কাছ থেকে শুনে লিখেছে।
قال الكفرون إن هذا السحر مبين কাফেররা বলল, নিশ্চয়ই এই কোরআন সুস্পষ্ট জাদু। (সুরা ইউনুস, ২) لام بل افتريه بل هو شاعر بل قالوا أضغاث أحلام বরং ওরা আরও বলল যে, (এই কোরআন) অলীক স্বপ্ন, না বরং সে তা উদ্ভাবন করেছে, না বরং সে একজন কবি। (সুরা আম্বিয়া, ৫)
قالوا يايها الذي نزل عليه الذكر إنك لمجنون » হে অমুক, যার উপর কোরআন অবতীর্ণ হয়, নিশ্চয়ই তুমি পাগল। (সুরা হিজর, ৬)
কাফেররা আরও দাবি করেছিল এই কোরআন রাসুলকে এক লোক শিক্ষা দেয়; আল্লাহ তাদের এই কথারও যুক্তিপূর্ণ জবাব দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন :
ولقد تعلم أنهم يقولون إنما يعلمه بشر لسان الذي يلحدون إليه أعجيئ
وهذا يسان عربي مبين (۱۰۳
আমি তো ভালোভাবেই জানি যে, তারা বলে তাকে জনৈক ব্যক্তি শিক্ষা দেয়। যার দিকে তারা ইঙ্গিত করে, তার ভাষা তো অনারবি। আর এই কোরআন পরিষ্কার আরবি ভাষায়। (সুরা নাহল, ১০৩) তারা যে লোকের দিকে ইঙ্গিত করেছিল, সে ছিল অনারব; আর কোরআন হচ্ছে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায়, তাহলে ঐ লোক কীভাবে এত চমৎকার আরবিতে রাসুলকে শিক্ষা দিচ্ছিল? এই যুক্তির সামনেও কাফেররা লা-জবাব হয়ে যায়।
অর্থাৎ যেভাবেই হোক না কেন কাফেররা এটা দেখাতে চেয়েছে যে, এই কোরআন গোঁজামিলপূর্ণ, এই কোরআনে নেই সামঞ্জস্য, এর মাঝে আছে বিরোধিতা, এই কোরআন বিরোধপূর্ণ। মুহাম্মদ নিজে এই কোরআন বানিয়েছে, সে তো একজন কবি, সে তো জাদুমন্ত্র দিয়ে এগুলো লিখেছে বা এই কোরআনই হচ্ছে জাদুমন্ত্র। ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাদের এহেন ভ্রান্তির জবাবে আল্লাহ তায়ালা গোটা দুনিয়ার সামনেই এক অব্যর্থ যুক্তি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এই কোরআন যে এক স্রষ্টার বাণী, শুধু তা-ই নয়; বরং পবিত্র কোরআন মহান আল্লাহর বাণী, তারই প্রমাণস্বরূপ আল্লাহ তায়ালা যুক্তি দিয়ে বলেছেন :
افلا يتدبرون القران ولو كان من عند غير الله لوجدوا فیہ اختلافا کثیرا ওরা কি কোরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করে দেখে না? যদি তা আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো কাছ থেকে আসত তবে ওরা তাতে অনেক মতানৈক্য দেখতে পেত। (সুরা নিসা, ৮২)
কোরআনের সোজাসাপ্টা যুক্তি, যে যুক্তি একজন বেদুইন বা যেকোনো গ্রাম্য লোকও বুঝবে। উক্ত আয়াতের মধ্য দিয়ে এই কথাটাও বেরিয়ে আসছে যে, স্রষ্টা একজন। পবিত্র কোরআন সেই এক স্রষ্টারই বাণী। যদি স্রষ্টা একাধিক হতো, তবে কোরআনে পাওয়া যেত মতানৈক্য। এমনকি যদি কোরআন কোনো মানুষের রচিত হতো, তাহলেও তাতে থাকত অসঙ্গতি।
তবু প্রশ্ন রয়ে যায়
অনেকেই হয়তো বলবেন, কোরআনে তো নাসেখ-মানসুখ বা বিভিন্ন বিধানের পরিবর্তন আছে; এটা কি মতানৈক্য নয়? একবার এক বিধান তো আরেকবার আরেক বিধান। এটা কি যায় মহান স্রষ্টার সাথে?
বস্তুত, প্রজ্ঞাবান স্রষ্টার সাথেই এমনটা যায়। যার প্রজ্ঞা যত দূরদর্শী, তার সিদ্ধান্তও হয় তত সূক্ষ্ম। মহান রব আল্লাহ তায়ালা যেমন মহান স্রষ্টা, তার প্রজ্ঞাও তেমন অতুলনীয়। তিনি ঠিকই জানেন যে, কোন বিধানটি তার বান্দাদের জন্য ঠিক কতদিন প্রযোজ্য থাকবে। এটা জেনেই তিনি বিধান দিয়েছিলেন। এবং সময় মতো সেই বিধান পরিবর্তনও করেছিলেন। এই পরিবর্তন বান্দাদের দুর্বলতা ও অক্ষমতার বিবেচনায়। আর এই পরিবর্তন প্রমাণ করে যে, মহান কতটা দূরদর্শী এবং কী পরম মমতা তার বান্দাদের প্রতি।
মোটকথা, বান্দাদের দুর্বলতার কথা বিবেচনায় রেখেই করা হয় নাসেখ ও মানসুখ। তবে পরিবর্তিত বিধানও কিন্তু পূর্বের বিধানের চেয়ে তুল্যেমূল্যে কোনো অংশে কম হয় না; বরং হয়তো তা হবে পূর্বের বিধানের চেয়ে উত্তম,
অন্তত সমতুল্য তো হবেই। এই কথাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন এভাবে :
ما ننسخ من اية أو ننسها نأت بخير منها أو مثلها الم تعلم أن الله على كل
شيء قدير ۱۰۶۰
আমি কোনো আয়াত রহিত করলে অথবা তা বিস্মৃত করে দিলে হয়তো তার চেয়ে উত্তম অথবা তার মতোই কোনো আয়াত নিয়ে আসি। আপনি কি জানেন না যে, আল্লাহ তায়ালা সব কিছুর উপর শক্তিমান। (সুরা বাকারা, ১০৬)
কোরআন নিয়ে তবে মুফাসসিরদের মতানৈক্য কেন?
এবার প্রশ্ন হতে পারে তাফসির নিয়ে মুফাসসিরদের মধ্যকার একাধিক মত নিয়ে। দেখা যায় একই আয়াতের তাফসিরে একাধিক অভিমত পাওয়া যায়। তাহলে এতেও কি প্রমাণিত হয় না যে, কোরআনে মতানৈক্য আছে? যার ফলে কোরআন-গবেষকদের মাঝেও দেখা দিচ্ছে মতানৈক্য!
কোরআনে কোনো সন্দেহ নেই, নেই কোনো মতানৈক্য, নেই তার মাঝে কোনো ধন্দ, এটা আল্লাহ তায়ালার কথা। তবে এই কথার অর্থ এই নয় যে, কোরআন বোঝার ক্ষেত্রে মানুষের মাঝেও কোনো ইখতিলাফ বা মতানৈক্য হবে না। প্রত্যেক মানুষের বুঝ-ব্যবস্থায় যেমন পার্থক্য আছে, তেমনি কোরআন থেকে জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রেও তাদের মাঝে পার্থক্য পরিলক্ষিত হবে। এই পার্থক্যের বিভিন্ন কারণ হতে পারে। একটা বড় কারণ ভাষাগত ভিন্নতা। অনেক শব্দের একাধিক অর্থ থাকে। কারো মূলনীতিতে ধরা পড়ে একটা অর্থ তো অন্যজনের মূলনীতে প্রমাণিত হয় ভিন্ন অর্থ।
বিষয়টা শুনতে যতটা সহজ মনে হচ্ছে, ততটা সহজ নয়; বরং তার চেয়েও জটিল। এই মতানৈক্যের সূত্রপাত স্রেফ আরবি শব্দার্থের তারতম্যই নয়, বরং এর পেছনে সক্রিয় আছে উসুল বা মূলনীতি সংক্রান্ত বোঝাপড়ারও ভিন্নতা।
যাই হোক, কোরআনে কোনো ইখতিলাফ বা মতানৈক্য নেই, এর দ্বারা আলেমদের মধ্যকার ইখতিলাফ উদ্দেশ্য নয়; বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে কোরআনের সত্তাগত ইখতিলাফ। মহাগ্রন্থ আল-কোরআন এই ধরনের ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে পবিত্র। কোরআন এক ও অভিন্ন পথে মানুষকে আহ্বান করে, আর সেই পথ হলো সিরাতে মুসতাকিম; আল্লাহ তায়ালার পথ। যেসকল আলেমের মাঝে বিভিন্ন আয়াত নিয়ে মতানৈক্য দেখা যায়, তারাও কোরআনের এই অমঘ পথনির্দেশই মানুষের সামনে উপস্থাপিত করেন।
তাআরুজ বা বাহ্যিক বৈপরীত্য তবে কী?
তবে, যেমনটা আমরা লেখকের কথায়ও বলেছি যে, কোরআন পাঠকালে আমাদের সামনে কিছু কিছু আয়াতের মাঝে বাহ্যত বৈপরীত্য মনে হয় বা হতে পারে। মূলত ওই সকল আয়াত সুস্পষ্ট ও নিপাট। কিন্তু তাফসিরশাস্ত্রের সংশ্লিষ্ট জ্ঞান না থাকার দরুন আমরা প্রাথমিকভাবে সমন্বয়টা বুঝে উঠতে পারি না। এই বোঝা না-বোঝার দায় সম্পূর্ণই আমাদের। তবে কোরআন-বিরোধীরা যাতে এই সুযোগে আমাদের উপর বুদ্ধিবৃত্তিক হামলা চালাতে না পারে, সেই জন্য আমাদের উচিত তাআরুজ বিষয়ে জ্ঞান হাসিল করা।
এই ভূমিকায় আমরা তাআরুজ বা বাহিক্য বৈপরীত্যের বিষয়টা নিয়েই আলাপ করব। আমরা এখানে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজবার চেষ্টা করব—
তাআরুজ শব্দের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ কী?
ইতিহাসে তাআরুজের প্রশ্ন করে উঠল?
৩. তাআরুজ বিষয়ক আলেমদের রচনাবলি।
তাআরুজের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ
শাব্দিক অর্থ। তাআরুজ আরবি শব্দ। এর একাধিক অর্থ পাওয়া যায়। যেমন মোকাবেলা করা, প্রকাশ বা উদয় হওয়া, বাধা দেওয়া, সমান সমান হওয়া ইত্যাদি। পরস্পর বিরোধী হওয়া, অসঙ্গতি, বৈপরীত্য ইত্যাদি অর্থও করা যায় এই শব্দ দিয়ে। পারিভাষিক অর্থ। তাআরুজ শব্দের পারিভাষিক সংজ্ঞায়নে আলেমগণের বিভিন্ন মত রয়েছে। শাস্ত্রের ভিন্নতায় এই শব্দের পারিভাষিক সংজ্ঞাতেও এসেছে ভিন্নতা। যেমন উসুলবিদদের মতে তাআরুজের পারিভাষিক অর্থ হলো :
التعارض بين الشيئين هو: تقابلهما علي وجه يمنع كل منهما مقتضي صاحبه দুটো বিষয়ের মাঝে তাআরুজ হওয়ার অর্থ উভয়ের মুখোমুখি এমন অবস্থান যে, একে অন্যের দাবি নাকচ করে দেয়।
হাদিসবিশারদদের কাছে তাআরুজের আলোচনা ভিন্ন শব্দে এসেছে। তারা ‘মুখতালাফুল হাদিস' শিরোনাম ব্যবহার করেছেন। মুখতালাফুল হাদিসের সংজ্ঞায়নে তারা বলেন :
الأحاديث التي تتعارض في الظاهر ওইসকল হাদিস, যা বাহ্যিকভাবে বিপরীতমুখী হয় (কিন্তু বাস্তবে তা বিপরীতমুখী নয়। কীভাবে বিপরীতমুখী নয়, তা নিয়ে বিশদ লেখাজোখা করেছেন মুহাদ্দিসগণ)।
ইবনুস সুবকি, আল-ইবহাজ শারহুল মিনহাজ, ২/২৭৩
বৈচিত্র্যময় কোরআন : দৃশ্যমান বৈপরীত্য ও সমাধান
উলুমুল কোরআনের আলেমগণ ভিন্ন শিরোনামে তাআরুজকে পেশ করেন। তারা JABLall ging বা মুহিমুল ইখতিলাফ ওয়াত তানাকুয এই শব্দবন্ধ ও শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। যেমন ইমাম জারকাশি রহ. এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন :
ما يوهم التعارض بين آيات كلام الله، و كلام الله ﷺ منزه عن ذلك যা আল্লাহ তায়ালার কালামের মাঝে তাআরুজ বা বৈপরীত্যের সন্দেহ তৈরি করে, কিন্তু আল্লাহ তায়ালার কালাম তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। (দা'ওয়াত তাআরুজ বাইনা নুসুসিল কোরআনিল কারিম, পৃষ্ঠা ৫৯১। সামি আতা হাসান)
এতক্ষণ যা আলোচনা করা হলো, তার উপর ভিত্তি করে আমাদের আলোচ্য
তাআরুজের একটা সংজ্ঞা আমরা বের করতে পারি। আর তা হলো :
تعارض دلالة آيات مع دلالة آيات أخري في الظاهر
বাহ্যিকভাবে এক আয়াতের অর্থ আরেক আয়াতের অর্থের বিপরীত হওয়া। যেসকল আয়াত বাহ্যিকভাবে পরস্পর বিপরীত, কিন্তু বাস্তবে তার মাঝে কোনো
বৈপরীত্য নেই; তা নিয়েই আমাদের ‘বৈচিত্র্যময় কোরআন' রচিত হয়েছে।
ইতিহাসে তাআরুজের প্রশ্ন
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে কোরআন নিয়ে নানান রকমের প্রশ্ন ও আপত্তি উত্থাপিত হয়েছিল। কাফেররা কোরআনের বিরোধিতা করতে গিয়ে যা নয় তা-ই বলে বেড়াত। যার কিছু কথা ভূমিকার শুরুতেই চলে গিয়েছে। সেখানে আমরা দেখেছি যে, কাফেররা কোরআনকে ভুল প্রমাণ করতে এবং রাসুলুল্লাহর রিসালাত অস্বীকার করতে অপবাদের স্তূপ তৈরি করেছিল। আল্লাহ তায়ালা তাদের সেই অপবাদের সমুচিত জবাবও দিয়েছেন।
কাফেররা কোরআন শুনে বলত যে, আমরাও ইচ্ছা করলে এমন কোরআন রচনা করতে পারি। অর্থাৎ ওরা কোরআন রচনার চ্যালেঞ্জ দিল। পবিত্র কোরআন ওদের কথা প্রকাশ করছে এইভাবে :
و إذا تتلى عليهم ايثنا قالوا قد سمعنا لو نشاء لقلنا مثل هذا إن هذا إلا
أساطير الأولين ۵۳۱۵
তাদরিবুর রাবি, ২/১৯৬, জালালুদ্দীন সুয়ুতি মাজাল্লাতু জামিয়িল আবহাস, খণ্ড ২৪ পৃষ্ঠা ৫৯১
বৈচিত্র্যময় কোরআন : দৃশ্যমান বৈপরীত্য ও সমাধান
আর যখন ওদেরকে আমার আয়াত তেলাওয়াত করে শোনানো হতো তখন ওরা বলত আমরা তো শুনলাম। ইচ্ছা করলে আমরাও এমন (অর্থাৎ কোরআনের মতো) বলতে পারতাম। এগুলো তো পূর্ববর্তীদের ইতিকথা বৈ কিছুই নয়। (সুরা আনফাল, ৩১)
যখন তারা কোরআন রচনা করার চ্যালেঞ্জ দিল, তখন আল্লাহ তায়ালাও তাদের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন। শুধু কি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন; বরং তাদেরকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছেন। তাদেরকে তিনি গোটা কোরআনের চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন, ওরা পারেনি। দশ আয়াতের চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন, তবু ওরা পারেনি। অতঃপর তাদের বলেছেন, তোমরা এই কোরআনের মতো যা পারো কিছু একটা রচনা করে নিয়ে এসো। কিন্তু নির্বোধ কাফেররা সেটাও পারেনি। এতকিছুর পরও ওরা যে ওদের গোয়ার্তুমি ছেড়েছে তা কিন্তু নয়; বরং একদেশদর্শিতায় ওরা যেন আরও জেঁকে বসেছিল দিনদিন।
এই গেল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে কোরআন নিয়ে বিরোধিতার কথা। তবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে আমাদের আলোচ্য তাআরুজ সেই অর্থে প্রকাশ পায়নি। মূলত সাহাবিদের যুগ থেকেই তা প্রকাশ পেতে থাকে। ইসলাম যখন দিগন্তের পর দিগন্ত ছাড়িয়ে আবাস গাড়ছিল, যখন কোরআন আরবের অন্যান্যের কাছে পৌঁছতে লাগল। যখন অনারবদের কাছেও পৌঁছে যাচ্ছিল কোরআন, তখন নানান প্রশ্ন আসতে লাগল। কেউ প্রশ্ন করত জানবার আশায় আবার কেউ কেউ প্রশ্ন করত খুঁত ধরবার জন্য।
এই ধরনের কয়েকটি ঘটনা ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে। তার মধ্যে একটা প্রসিদ্ধ ঘটনা উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগের। আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাহিনীতে সবিগ নামক এক লোক ছিল। সে কোরআনের মুতাশাবিহ ও তাআরুজ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করত। তবে তার প্রশ্নে থাকত শ্লেষ। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে ডেকে পাঠিয়ে উচিতশিক্ষা দেন। যার ফলে সারা জীবনের জন্য সে সোজা হয়ে যায়। *
হজরত ইবনে আব্বাস রা.-এর সাথে এই ধরনের কয়েকটা ঘটনা ঘটেছিল। এবং তিনিই তাআরুজ বা মুতাশাবিহ ধরনের আয়াত সম্পর্কে কথা-বলা প্রথম সারির মুফাসসির। এ ধরনের আরও ঘটনা পড়তে দেখুন, সহিহ বুখারি, কিতাবুত তাফসির, সুরা হা-মীম সাজদা। আল-ইতকান ফি উলুমিল কোরআন, ২/২৭। ফাতহুল বারি, ৮/৫৫৫
সুনানে দারেমি, ১/৬৬, সনদ সহিহ এবং ঘটনাটাও বেশ প্রসিদ্ধ। তাফসিরে আদ-দুররুল মানসুর, ২/১৫২, জালালুদ্দনি সুয়ুতি
বৈচিত্র্যময় কোরআন : দৃশ্যমান বৈপরীত্য ও সমাধান
তাআরুজ বিষয়ক রচনাবলি
আলেমগণ এই বিষয়ে বেশ আগে থেকেই, গুরুত্ব সহকারে; লেখালেখি শুরু করেছেন। তাদের রচনাবলির মান ও পরিমাণ দেখলেই বোঝা যায় যে, উক্ত বিষয়ে তাদের মনোযোগ কতখানি গভীর ও সুদূরপ্রসারী ছিল। মুহাদ্দিসগণ এই বিষয়ে প্রচুর লিখেছেন। হাদিসের মধ্যকার তাআরুজ নিয়ে তাদের রচনাবলি এন্তার।
যখন থেকে উলুমুল কোরআন নিয়ে কাজ শুরু হয়, তখন থেকেই কোরআনের তাআরুজ বা বাহ্যিক বৈপরীত্য নিয়ে লেখাজোখা শুরু হয়। তাআরুজ বা বাহিক্য বৈপরীত্যের সুযোগে ইসলাম-বিরোধীরা ও ভ্রান্ত আকিদার লোকেরা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছিল। তাদের সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য আলেমগণ একেকটা আয়াত নিয়ে চুলচেড়া বিশ্লেষণ করতে থাকেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে দুই ধরনের রচনা পাওয়া যায়।
এক. যেসকল গ্রন্থ শুধু তাআরুজ বিষয়েই প্রণীত হয়। সেখানে ওই সকল আয়াত একত্রিত করা হয়েছে, যার মাঝে তাআরুজ বা বাহ্যিক বৈপরীত্য আছে অথবা যেসকল আয়াত নিয়ে মুলহিদরা সংশয় সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালাচ্ছিল।
দুই. যেসকল গ্রন্থ মূলত প্রণীত হয় উলুমুল কোরআন বিষয়ে; তবে আলোচনা
প্রসঙ্গে তাআরুজের বিষয়টাও সেখানে উঠে আসে। এই ধরনের গ্রন্থের মধ্যে
উল্লেখযোগ্য হলো, ১. ইমাম জারকাশি রচিত উলুমুল কোরআন। ২. ইমাম
জালালুদ্দীন সুয়ুতি প্রণীত আল-ইতকান ফি উলুমিল কোরআন।
স্রেফ তাআরুজ নিয়ে রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে অনেকগুলোই মাখতুত বা পাণ্ডুলিপি আকারেই রয়ে গেছে। তবে প্রকাশ পাওয়া গ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়।
বিশ্বের নানান প্রান্তে বিভিন্ন লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত থাকা পাণ্ডুলিপির সংখ্যা এতো অধিক যে, তা উল্লেখ করাই দুষ্কর।
আলেমগণকে আল্লাহ তায়ালা জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন। দীনকে মাহফুজ রাখতে এবং বাতিলপন্থিদের থেকে আমাদের ঈমান ও আমল হেফাজত রাখতে তারা শুধু জীবদ্দশাতেই সংগ্রাম ও মেহনত করেননি; বরং তারা রেখে গেছেন এমন অমূল্য রত্ন, যা যুগ যুগ ধরে দীনের খেদমত করে যাচ্ছে এবং আমাদেরকে নিরাপদ রাখছে সুযোগসন্ধানীদের বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণ থেকে।
ইমরান হোসাইন নাঈম
১/৪/২০২২
শুক্রবার। সকাল ১১টা বেজে ২৪ মিনিট।
উজিরপুর, বরিশাল।
কোরআন কার জন্য হেদায়েত?
الم و ذلك الكتب لا ريب فيه هدى للمتقين (১) আলিফ লাম মিম। এই কিতাবে কোনো সন্দেহ নেই। তা মুত্তাকিদের জন্য হেদায়েতস্বরূপ। (সুরা বাকারা, আয়াত ১, ২)
هدی و رحمة للمحسنين الم فان تلك ايت الكتب الحكيم (২) আলিফ লাম মিম। ওগুলো প্রজ্ঞাবান কিতাবের আয়াতসমূহ। সৎকর্মশীলদের জন্য তা হেদায়েত ও রহমতস্বরূপ। (সুরা লুকমান, ১-৩) يايها الناس قد جاءتكم موعظة من ربكم وشفاء لما في الصدور
وهدى ورحمة للمؤمنين
(৩) হে মানুষেরা, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে উপদেশ এসেছে, এবং অন্তরের রোগের নিরাময় এবং মুমিনদের জন্য হেদায়েত ও রহমত। (সুরা ইউনুস, ৫৭)
شهر رمضان الذي أنزل فيه القران هدى للناس ۱۸۵۰ (৪) রমজান মাস, যে মাসে নাজিল হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত। (সুরা বাকারা, ১৮৫)
বৈপরীত্য কোথায়?
পবিত্র কোরআন হেদায়েতের জন্য নাজিল হয়েছে। কিন্তু পবিত্র কোরআন কার জন্য হেদায়েত? এটা কি সকল মানুষের জন্যই হেদায়েত, না বিশেষ কিছু লোকের জন্য? হেদায়েত সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বেশকিছু আয়াত আছে; কিন্তু সেই আয়াতগুলো থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হয় না যে, কোরআন ঠিক কার জন্য হেদায়েত। উপরে আয়াত নম্বর ১ ও ২ থেকে বোঝা যায়, হেদায়েত হচ্ছে বিশেষ লোকদের জন্য, সকল মুমিনও যার অন্তর্ভুক্ত নয়; বরং মুত্তাকিগণ, যারা বিশেষ লোক; কেবল তারাই কোরআন থেকে হেদায়েত গ্রহণ করতে পারবে। কিন্তু ৩ নং আয়াত থেকে বোঝা যায়, হেদায়েত সকল মুমিনের জন্য। অথচ ৪ নং আয়াত থেকে মনে হচ্ছে কোরআনের হেদায়েত বেশ ব্যাপক। তা কেবলই মুত্তাকি বা মুমিনদের জন্য নয়; বরং তা সকল মানুষের জন্যই। সকল মানুষ বললে মুমিন মুত্তাকি ও কাফের-মুশরিক সকলেই এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
সমাধান
প্রথম কথা হলো কোরআনের হেদায়েত বিশেষভাবে নির্দিষ্ট কারো জন্য নয়; বরং কোরআনের হেদায়েত সবার জন্য আম বা ব্যাপক। এই হেদায়েতের আলো সকল মানুষকেই ব্যাপৃত করে। যে লোকই হেদায়েত গ্রহণের লক্ষ্যে কোরআনের ছায়ায় আসবে, কোরআন পাঠ করবে, কোরআনের হেদায়েতের উপর আমল করবে, সে-ই হেদায়েতের আলোয় উদ্ভাসিত হবে। তবে কোরআনের এই হেদায়েত কিছু বিশেষ মানুষের জন্য বেশি কার্যকর। আর তারা হলেন মুত্তাকি, মুমিন ও মুহসিন বা যারা সৎকর্মশীল মানুষ। যারা তাকওয়ার পথ অবলম্বন করেছেন, যারা খাঁটি ঈমান গ্রহণ করেছেন, যারা সৎকর্ম করেন, তাদের অন্তর কোরআনি হেদায়েত গ্রহণে অধিক শক্তিশালী।
অথবা কোরআনুল কারিমে হেদায়েতের সাথে মুত্তাকি-মুমিন লোকদের কথা উল্লেখ করে ওই সকল লোকের সম্মান বৃদ্ধি করা হয়েছে। সম্মান বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে কোরআন বলছে
هدى للمتقين، هدى ورحمة للمحسنين. وهدى ورحمة للمؤمنين القرآن كما أنه هدى للمتقين ودلالة لهم على وجود الصانع، وعلى دينه وصدق رسوله، فهو أيضا دلالة الكافرين إلا أن الله تعالى ذكر المتقين مدعا
ليبين أنهم هم الذين اهتدوا وانتفعوا به
কোরআন যেমন মুত্তাকিদের জন্য হেদায়েত, স্রষ্টার অস্তিত্ব, তার দীন ও তার রাসুলের সত্যতা বুঝতে তাদের দলিল, তেমনই তার অস্বীকারকারীদের জন্যও দলিল। তবে আল্লাহ তায়ালা মুত্তাকিদের কথা উল্লেখ করেছেন প্রশংসাস্বরূপ; এটা জানাতে যে, হেদায়েতপ্রাপ্তি ও হেদায়েত হতে উপকৃত হওয়ার মাঝে তারা হলেন শক্তিশালী।
॥২॥ হেদায়েতের দুই অর্থ। এক. ইরাআতুত তরিক (jglall alj1) অর্থাৎ কেবল সত্যের রাস্তাটি দেখিয়ে দেওয়া। এই পথ ধরে পথচারী ব্যক্তি গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে কি না তা ধর্তব্য নয়। হেদায়েতের দ্বিতীয় অর্থ ঈসাল ইলাল মাতলুব, (eglhali J! Jhaal) অর্থাৎ কেবল রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া নয়; বরং সেই রাস্তা ধরে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়াও উদ্দেশ্য।
* তাফসিরে কাবির ২/২৬৮; দারু ইহইয়া বৈরুত
কোরআনুল কারিমের আয়াতে ‘হেদায়েত’ শব্দটি দুই অর্থেই এসেছে। কোরআনে দুই ধরনের হেদায়েতই বিদ্যমান। ‘ইরাআতুত তরিক’ এ ধরনের হেদায়েত সকল মানুষের সামনে সত্য ও অসত্যের রাস্তা স্পষ্ট করে রাখে। ঈমান ও কুফর উভয় পথই কোরআন সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছে। এই পথের সন্ধান মুমিন-কাফের নির্বিশেষ সকলেই লাভ করতে পারবে। সেই কথা বোঝাতেই কোরআন বলছে, ‘হুদান লিন নাস' বা মানুষের জন্য হেদায়েত। হিন্দু-বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সকলের জন্যই এই হিসেবে কোরআন হেদায়েত।
কিন্তু এই পথ ধরে আসল গন্তব্যে পৌঁছতে হলে, হেদায়েতের আলোয় উদ্ভাসিত হতে হলে; অর্জন করতে হবে ঈমান, চলতে হবে তাকওয়ার পথে। সৎকর্মশীল হতে হবে কোরআনের হেদায়েতের পথ ধরে এগুতে চাইলে। অনেক কাফের-মুশরিকই কোরআন পাঠ করে। তাদের অনেকেই কোরআন রিসার্চ ও গবেষণা করে; কিন্তু এই গবেষণা ও সত্যপথের পরিচয় তাদেরকে গন্তব্যে পৌঁছায় না, হেদায়েতের আলোয় উদ্ভাসিত করে না। কারণ তাদের গবেষণার উদ্দেশ্য হচ্ছে কোরআন বিকৃত করে মুসলমানদের ধোঁকায় ফেলা, যেমনটা প্রাচ্যবিদরা করে থাকে। অসৎ উদ্দেশ্যের কারণে কোরআনের প্রভূত জ্ঞান অর্জন করা সত্ত্বেও তারা কোরআনের হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হয়।
পক্ষান্তরে এমন অজস্র মানুষের কথা আমরা শুনতে পাই, যারা হিন্দু থেকে বা খ্রিষ্টান থেকে মুসলমান হয়েছে, আর তাদের হেদায়েতের উসিলা হয়েছে কোরআনুল কারিম। তারা হৃদয়ের তৃষ্ণা নিয়ে কোরআন হাতে তুলে নিয়েছিল, কোরআন থেকে অমৃত সুধা পান করার লক্ষ্যে তারা তেলাওয়াত করেছে, কোরআনের অর্থ ও তাফসির জেনেছে। হেদায়েতের পথের সন্ধান পেয়েই তারা ক্ষান্ত থাকেনি। সেই পথে কদমও বাড়িয়েছে। যার একপর্যায়ে তারা ধন্য হয়েছে হেদায়েত পেয়ে। ঈমান গ্রহণ করে তারা হাসিল করতে পেরেছে উভয় জাহানের সাফল্য।
ঈমান লাভ করার পর সেই পথে অবিচল থেকে মুত্তাকি হওয়ার জন্যও কোরআনে হেদায়েত বিদ্যমান আছে। সেই হেদায়েতকেই কোরআন বলছে এভাবে :
الم ماه ذلك الكتب لا ريب فيه هدى للمتقين
আলিফ লাম মিম। এই কিতাবে কোনো সন্দেহ নেই। তা মুত্তাকিদের জন্য হেদায়েতস্বরূপ। (সুরা বাকারা, ১, ২) প্রশ্ন হতে পারে, আয়াত বলছে কোরআন মুত্তাকিদের জন্য হেদায়েত; অথচ আমরা জানি—তাদেরকেই মুত্তাকি বলা হয় যারা হেদায়েতপ্রাপ্ত এবং হেদায়েতের
উপর অবিচল আছে। তবে তাদের জন্যও আবার কোন ধরনের হেদায়েত?
এর উত্তর হলো, এখানে মুত্তাকি বলতে মূলত ওই সকল লোককে বোঝানো হয়েছে, যারা তাকওয়ার পথে চলছে। যারা সকল রকম পাপ কাজ ত্যাগ করে এবং সাওয়াবের কাজ আঁকড়ে ধরে তাকওয়ার চর্চা করছে। ঈমানের সাথে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কোনো মানুষই আশঙ্কামুক্ত নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে কত পির-বুজুর্গ গোমরাহ হয়ে গিয়েছিলেন; অথচ তাদের হাত ধরে ঈমান ও তাকওয়ার পথে উঠে এসেছিলেন হাজার হাজার মানুষ। সুতরাং তাকওয়ার পথে অবিচল থাকার জন্য কোরআন থেকে প্রতিনিয়ত রসদ সংগ্রহ করা কর্তব্য। সেই রসদের দিকেই ইঙ্গিত দিয়ে কোরআন বলছে matull sb অর্থাৎ তা মুত্তাকিদের জন্য হেদায়েতস্বরূপ। (সুরা বাকারা, আয়াত ২)
বিশেষ দ্রষ্টব্য
অনেক মুসলমানও কোরআনের হেদায়েত লাভ করতে পারে না। কেননা তারা কোরআন থেকে হেদায়েত গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নয়। কোরআন তারা পাঠ করে ঠিকই, এর অর্থও তারা পড়ে, এবং তাফসির বা ব্যাখ্যাও তারা অধ্যয়ন করে; কিন্তু তাদের মনে বাসা বেধে থাকে ভিন্ন চিন্তা, দর্শন ও বিশ্বাস। তারা কেউ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, কেউবা পুঁজিবাদের ধ্বজাধারী। তাদের দর্শন ও বিশ্বাসে কোরআন বিরোধী ধ্যানধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে। যার ফলে মুসলিম হয়েও তারা কোরআনের হেদায়েত গ্রহণ করতে পারছে না। তারা কেবল ইরাআতুত তরিক বা রাস্তাটা দেখছে। কিন্তু ঈসাল ইলাল মাতলুব বা সেই পথে চলার জন্য তারা প্রস্তুত নয়।
এদের অনেকেই প্রথমে একটা বিশ্বাস মাথায় গেঁথে নেন। তারপর কোরআন হাদিস পড়ে দেখেন যে, তাদের বিশ্বাসের সাথে হাদিস-কোরআন মিলছে কি না। যতটুকু তারা মিল পান, ততটুকু মানেন আর যেখানে তাদের বিশ্বাসের সাথে তৈরি হয় সংঘর্ষ, সেখানে তারা কোরআন পরিত্যাগ করেন। এহেন লোকজনদের উদ্দেশ্যেই কোরআন বলছে
افتؤمنون ببعض الكتب وتكفرون ببعض فما جزاء من يفعل ذلك منكم إلا جزئ في الحيوة الدنيا ويوم القيمة يردون إلى اشد العذاب وما الله بغافل عما تعملون ۸۵۰ » তোমরা কি কোরআনের কিছু মানবে আর কিছু মানবে না? তোমাদের যারা এমন করবে তাদের শাস্তি তো দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা, এবং কেয়ামত দিবসে তাদের কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। আর আল্লাহ তোমাদের কাজ সম্পর্কে গাফেল নন। (সুরা বাকারা, ৮৫)
সুতরাং কোরআন থেকে হেদায়েত গ্রহণ করার জন্য প্রথমেই আমাদেরকে সব ধরনের বাতিল বিশ্বাস থেকে মুক্ত হতে হবে। সকল তন্ত্রমন্ত্র থেকে আমাদের মস্তিষ্ক পরিষ্কার করতে হবে। এর সাথে কোরআনের পুরোটাই মানার মতো মানসিকতা তৈরি করতে হবে। অন্যথায় আমরা কেবল হেদায়েতের পথই দেখে যাব; কিন্তু সেই পথে চলার সৌভাগ্য আর হাসিল হবে না।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা আমাদের ‘কোরআনি হেদায়েত’ গ্রহণ করার মানসিকতা দান করুন। আমিন।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....