লেখক: সুভাষচন্দ্র বসু
প্রকাশনী: শোভা প্রকাশ
বিষয়: আত্ম উন্নয়ন ও মোটিভেশন
পৃষ্ঠা: 128, কভার: হার্ড কভার
আইএসবিএন: 9789849411246, ভাষা: বাংলা
যৌবনের পূর্ণ জোয়ারে আমরা ভেসে এসেছি সকলকে আনন্দের আস্বাদ দেবার জন্য, কারণ আমরা আনন্দের স্বরূপ। আনন্দের মূর্ত বিগ্রহরূপে আমরা মর্ত্যে বিচরণ করব। নিজের আনন্দে আমরা হাসব-সঙ্গে সঙ্গে জগৎকেও মাতাব। আমরা যেদিকে ফিরব, নিরানন্দের অন্ধকার লজ্জায় পালিয়ে যাবে, আমাদের প্রাণময় স্পর্শের প্রভাবে রোগ, শোক, তাপ দূর হবে।
এই দুঃখ-সঙ্কুল, বেদনাপূর্ণ নরলোকে আমরা আনন্দ-সাগরের বাণ ডেকে আনব।
আশা, উৎসাহ, ত্যাগ ও বীর্য নিয়ে আমরা এসেছি সৃষ্টি করতে, কারণ-সৃষ্টির মধ্যেই আনন্দ। তনু, মন-প্রাণ, বুদ্ধি চালিয়ে দিয়ে আমরা সৃষ্টি করব। নিজের মধ্যে যা কিছু সত্য, যা কিছু সুন্দর, যা কিছু শিব আছে-তা আমরা সৃষ্ট পদার্থের মধ্যে ফুটিয়ে তুলব। আত্মদানের মধ্যে যে আনন্দ সে আনন্দে আমরা বিভোর হব, সেই আনন্দের আস্বাদ পেয়ে পরিবর্তন হবে।
এই দুঃখ-সঙ্কুল, বেদনাপূর্ণ নরলোকে আমরা আনন্দ-সাগরের বাণ ডেকে আনব।
আশা, উৎসাহ, ত্যাগ ও বীর্য নিয়ে আমরা এসেছি সৃষ্টি করতে, কারণ-সৃষ্টির মধ্যেই আনন্দ। তনু, মন-প্রাণ, বুদ্ধি চালিয়ে দিয়ে আমরা সৃষ্টি করব। নিজের মধ্যে যা কিছু সত্য, যা কিছু সুন্দর, যা কিছু শিব আছে-তা আমরা সৃষ্ট পদার্থের মধ্যে ফুটিয়ে তুলব। আত্মদানের মধ্যে যে আনন্দ সে আনন্দে আমরা বিভোর হব, সেই আনন্দের আস্বাদ পেয়ে পরিবর্তন হবে।
কিন্তু আমাদের দেওয়া শেষ নেই, কর্মেরও শেষ নেই কারণ-
“যত দেব প্রাণ বহে যাবে প্রাণ
ফুরাবে না তার প্রাণ;
এত কথা আছে এত প্রাণ আছে
এত প্রাণ আছে মোর
এত সুখ আছে, এত সাধ আছে
প্রাণ হয়ে আছে ভোর।”অনন্ত আশা, অসীম উৎসাহ, অপরিমের তেজ ও অদম্য সাহস নিয়ে আমরা এসেছি-তাই আমাদের জীবনের স্রোত কেউ রোধ করতে পারবে না। অবিশ্বাস ও নৈরাশ্যের পর্বতরাশি সম্মুখে এসে দাঁড়াক অথবা সমবেত মনুষ্য-জাতির প্রতিকূল শক্তি আমাদের আক্রমণ করুক,-আমাদের আনন্দময়ী গতি চিরকাল অক্ষুণ্নই থাকবে।
আমাদের একটা বিশিষ্ট ধর্ম আছে-সেই ধর্মই আমরা অনুসরণ করি। যা নতুন, যা সরস, যা অনাস্বাদিত-তারই উপাসক আমরা। আমরা এনে দিই পুরাতনের মধ্যে নতুনকে, জড়ের মধ্যে চঞ্চলকে, প্রবীণের মধ্যে নবীনকে এবং বন্ধনের মধ্যে অসীমকে। আমরা অতীত ইতিহাসলব্ধ অভিজ্ঞতা সব সময়ে মানতে প্রস্তুত নই। আমরা অনন্ত পথের যাত্রী বটে কিন্তু আমরা অচেনা পথই ভালোবাসি-অজানা ভবিষ্যৎই আমাদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। আমরা চাই “the right to make blunders” অর্থাৎ “ভুল করবার অধিকার”। তাই আমাদের স্বভাবের প্রতি সকলের সহানুভূতি নাই, আমরা অনেকের কাছে সৃষ্টিছাড়া ও লক্ষ্মীছাড়া।
এতেই আমাদের আনন্দ; এখানেই আমাদের গর্ব। যৌবন বর্ষাকালে সর্বদেশে সৃষ্টিছাড়া ও লক্ষ্মীহারা। অতৃপ্ত আকাক্সক্ষার উন্মাদনায় আমরা ছুটে চলি-বিজ্ঞের উপদেশ পর্যন্ত অবসর আমাদের নাই। ভুল করি, ভ্রমে পড়ি, আছাড় খাই, কিন্তু কিছুতেই আমরা উৎসাহ হারাই না বা পশ্চাদপদ হই না। আমাদের তা-ব-লীলার অন্ত নাই, কারণÑআমরা অবিরামগতি।
আমরাই দেশে দেশে মুক্তির ইতিহাস রচনা করে থাকি। আমরা শান্তির জল ছিটাতে এখানে আসি নাই। বিবাদ সৃষ্টি করতে, সংগ্রামের সংবাদ দিতে, প্রলয়ের সূচনা করতে আমরা এসে থাকি। যেখানে বন্ধন, যেখানে গোঁড়ামি, যেখানে কুসংস্কার, যেখানে সঙ্কীর্ণতা-সেখানেই আমরা কুঠার হস্তে উপস্থিত হই। আমাদের একমাত্র ব্যবসায় মুক্তির পথ চিরকাল বণ্টকশূন্য রাখা, যেন সে পথ দিয়ে মুক্তির সেনা অবলীলাক্রমে গমনাগমন করতে পারে।
আত্মনিবেদন
১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের কালে শ্রীসুভাষচন্দ্র বসু, বিলেতে অধ্যয়ন করছিলেন। সে সময় তিনি জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করে দেশসেবা করবার সুযোগ লাভের জন্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের কাছে যে পত্র প্রেরণ করেছিলেন, সেই পত্র দুইটি নিম্নে দেওয়া হলো : TIBE UNION SOCIETY,
Cambridge. ১৬ ফেব্রুয়ারি।
প্রণাম পুরঃসর নিবেদন,
আপনি আমাকে বোধহয় চেনেন না-কিন্তু আমার পরিচয় দিলে বোধহয় চিনতে পারবেন। আপনাকে আমি খুব প্রয়োজনীয় কোনো বিষয়ে এই পত্র লিখছি-কিন্তু কাজের কথা আরম্ভ করবার আগে আমাকে নিজের sincerity আগে প্রমাণ করতে হবে। সেইজন্য প্রথমে নিজের পরিচয় দিচ্ছি।
আমার পিতা শ্রীজানকীনাথ বসু কটকে ওকালতি করেন এবং কয়েক বছর আগে সেখানকার গভর্নমেন্ট প্লিডার ছিলেন। আমার দাদা শ্রীশরৎচন্দ্র বসু কলকাতা হাইকোর্টের Harrister। আপনি আমার পিতাকে চিনলেও চিনতে পারেন এবং আমার দাদাকে নিশ্চয়ই চেনেন।
পাঁচ বছর আগে আমি কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তাম। ১৯১৬ সালের গোলমালের সময়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে expelled হই। দুই বছর নষ্ট হবার পর আমি কলেজে পড়বার অনুমতি পাই। তারপর ১৯১৯ সালে আমি বিএ পাস করি এবং honours-এর প্রথম শ্রেণিতে স্থান পাই।
১৯১৯ সালে অক্টোবর মাসে এখানে এসেছি। ১৯২০ সালে আগস্ট মাসে আমি Civil Service পরীক্ষা পাস করি এবং চতুর্থ স্থান অধিকার করি। এই বছর জুন মাসে আমি Moral Science Tripos পরীক্ষা দেব। সেই মাসে আমি এখানকার B.A. Degree পাব।
এখন কাজের কথা বলি। সরকারি চাকরি করবার আমার মোটেই ইচ্ছা নাই । আমি বাড়িতে লিখেছি বাবাকে এবং দাদাকে যে, আমি চাকরি ছেড়ে দিতে চাই। আমি এখনও উত্তর পাইনি। তাঁদের অনুমতি পেতে হলে, আমাকে দেখাতে হবে আমি চাকরি ছাড়বার পর কি tangible কাজ করতে চাই। আমি অবশ্য জানি যে, চাকরি ছেড়ে আমি যদি কোমর বেধে দেশের কাজে অবতীর্ণ হই তা হলে করবার আমার অনেক আছে—যথা, জাতীয় কলেজে শিক্ষকতা, পুস্তক ও খবর কাগজ প্রণয়ন ও প্রকাশ, গ্রাম্য সমিতি স্থাপন, জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ইত্যাদি। কিন্তু আমি যদি এখন বাড়িতে দেখাতে পারি আমি কি tangible কাজ করতে ইচ্ছা করি-তা হলে বোধহয় চাকরি ছাড়া সম্বন্ধে অনুমতি সহজে পাব। আমি যদি তাঁদের অনুমতি নিয়ে চাকরি ছাড়তে পারি তা হলে বিনা অনুমতিতে কোনো কাজ করবার আবশ্যকতা পাই ।
দেশের অবস্থা সম্বন্ধে আপনি সব চেয়ে ভালো জানেন। শুনলাম আপনারা কলকাতায় এবং ঢাকায় জাতীয় কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং ইংরেজ ও বাংলায় “স্বরাজ” পত্রিকা বের করতে চান। আমি আরও শুনলাম বাংলাদেশের নানা স্থানে গ্রাম্য সমিতি প্রভৃতিও স্থাপন করা হয়েছে।
আমি শুনতে ইচ্ছা করি আপনারা আমাকে এই স্বদেশ সেবার যজ্ঞে কী কাজ দিতে পারেন? আমার বিদ্যাবুদ্ধি কিছুই নাই—কিন্তু আমার বিশ্বাস যে, যৌবনোচিত উৎসাহ আমার আছে। আমি অবিবাহিত।
লেখাপড়ার মধ্যে আমি Philosophyটা একটু পড়েছি কারণ কলকাতায় আমার ওই বিষয়ে Honours ছিল এবং এখানেও আমি ওই বিষয়ে Tpos পড়েতেছি। Civil Service পরীক্ষার কৃপায় সর্বাঙ্গীণ শিক্ষা কিছুটা হয়েছে—যেমন Economics, Political Science, English and European History, English-Law, Sanirit, Geography ইত্যাদি।
আমি বিশ্বাস করি যে, আমি যদি নিজে এই কাজে নামতে পারি তা হলে আমি এখানকার ২/১ জন বাঙালি বন্ধুকে এই কাজে টানতে পারব কিন্তু আমি নিজে যতক্ষণ এই কাজে না নামছি, ততক্ষণ কাউকে টানতে পারছি না।
এখন আমার দেশে কোন্ কোন্ বিষয়ে কাজ আরম্ভ করবার সুবিধা আছে তা এখান থেকে বুঝতে পারছি না। তবে আমার মনে বলছে যে, দেশে ফিরলে আমি কলেজে অধ্যাপনা এবং পত্রিকার লেখা—এই দুই কাজে হাত দিতে পারব। আমার ইচ্ছা Clear-cut plans নিয়ে চাকরি ছাড়তে। তা করতে পারলে, চাকরি ছাড়ার পর আমাকে চিন্তায় সময় ব্যয় করতে হবে না এবং আমি চাকরি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে নামতে পারব।
আপনি আজ বাংলাদেশে স্বদেশ সেবাযজ্ঞে প্রধা ঋত্বিক—তাই আপনার কাছে এই পত্র লিখছি। আপনারা ভারতবর্ষে যে আন্দোলনের বন্যা তুলেছেন তার তরঙ্গ চিঠি ও খবরকাগজের ভিতর দিয়ে এখানে এসে পৌঁছেছে। এখানেও তাই মাতৃভূমির আহ্বান শুনা গিয়েছে। Oxford থেকে একজন মাদ্রাজি ছাত্র তাঁর লেখাপড়া আপাতত স্থগিত রেখে দেশে ফিরে যাচ্ছে—সেখান গিয়ে কাজ আরম্ভ করবার জন্য। Cambridge এ-পর্যন্ত কাজ কিছু হয়নি যদিও “অসহযোগিতা” সম্বন্ধে আলোচনা খুব বেশি চলছে। আমার বিশ্বাস, যদি কেউ পথ দেখাতে পারে তাহলে সেই পথ অনুসরণ করবার লোক এখানে আছে।
আপনি বাংলাদেশে আমাদের সেবাযজ্ঞের প্রধান ঋত্বিক্-তাই আপনার কাছে আমি কাজ উপস্থিত হয়েছি—আমার সামান্য বিদ্যা, বুদ্ধি, শক্তি ও উৎসাহ নিয়ে। মাতৃভূমির চরণে উৎসর্গ করবার আমার বিশেষ কিছুই নাই—আছে শুধু নিজের মন এবং নিজের এই তুচ্ছ শরীর।
আপনাকে এই পত্র লেখার উদ্দেশ্য— শুধু আপনাকে জিজ্ঞেস করা আপনি আমাকে এই বিপুল সেবাযজ্ঞে কী কাজ দিতে পারেন? আমি তা জানতে পারলে বাড়িতে বাবাকে এবং দাদাকে সেইরূপ লিখতে পারব এবং নিজের মনকেও সেইভাবে প্রস্তুত করতে পারব।
আমি এখন একরকম সরকারি চাকর। কারণ আমি এখন ICS Probationer। আপনাকে চিঠি লিখতে সাহস করলাম না পাছে চিঠি censored হয়! আমার জনৈক বিশ্বাসী বন্ধু শ্রীপ্রমথনাথ সরকারকে আমি এই চিঠি পাঠাচ্ছি—তিনি আপনার হাতে এই চিঠি দিয়ে আসবেন। আমি যখনই আপনাকে পত্র দিব—তখন এইভাবেই দিব। আপনি অবশ্য আমাকে চিঠি লিখতে পারেন কারণ এখানে চিঠি censored হবার ভয় নাই।
আমার এখানকার মতলব সম্বন্ধে আমি কাউকেও জানাইনি—শুধু বাড়িতে বাবাকে এবং দাদাকে লিখেছি। আমি এখন সরকারি চাকর-সুতরাং আশা করি যে, আমি যে-পর্যন্ত চাকরি না ছাড়ছি সে পর্যন্ত আপনি কাউকেও এ বিষয়ে কিছু বলবেন না।
আমার আর কিছু বলবার নাই। আমি আজ প্রস্তুত আপনি শুধু কর্মের আদেশ দিন।
আমার নিজের মনে হয় যে, আপনি যদি “স্বরাজ” পত্রিকা ইংরেজিতে আরম্ভ করেন তা হলে আমি সেই পত্রিকার Subeditorial staff-এ কাজ করতে পারি। তাছাড়া জাতীয় কলেজের নিম্ন শ্রেণিতে অধ্যাপনা করতে পারি।
কংগ্রেসের বিষয়ে আমার মনে অনেক প্রস্তাব আছে। আমার মনে হয় যে, কংগ্রেসের একটা স্থায়ী আড্ডা চাই। তার জন্য একটা বাড়ি করা চাই। সেখানে একদল Research student থাকবেন— যাঁরা আমাদের দেশের ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা নিয়ে গবেষণা করবেন। আমি যতদূর জানি Indian Currency and Exchange সম্বন্ধে আমাদের কংগ্রেসের কোনও definite policy নাই। তারপর native states-দের প্রতি কংগ্রেসের কীরূপ attitude হওয়া উচিত তা বোধহয় স্থির করা হয়নি। Franchise (for men and women) সম্বন্ধে কংগ্রেসের কী রকম মত তাও বোধহয় জানা নাই। তারপর Depressed classes-দের নিয়ে আমাদের কি করা উচিত তাও বোধহয় কংগ্রেস ঠিক করে নাই। এই বিষয়ে (অর্থাৎ Depressed classes সম্বন্ধে ) কোন কাজ না করার দরুন মাদ্রাজে আজ সব non-Brahmin রা Pro-Government এবং anti-nationalist হয়েছে।
আমার নিজের মনে হয় যে Congress-এর একটা Permanent staff রাখা দরকার। তারা এক একটা সমস্যা (Problem) নিয়ে গবেষণা করবে। প্রত্যেকে নিজ নিজ বিষয়ে up-to-date facts and figures সংগ্রহ করবে। এই সব Facts and figures সংগৃহীত হলে Congress Committee প্রত্যেক বিষয়ে (Problem-এ) একটা Policy formulate করবে। আজ অনেক জাতীয় Problem সম্বন্ধে কংগ্রেসের কোনো definite policy নাই। আমার সেই জন্য মনে হয় যে, কংগ্রেসের একটা স্থায়ী বাড়ি চাই এবং Staff of research students চাই।
তাছাড়া Congress-এ একটা Intelligence Department খোলা দরকার। Intelligence Department-এ দেশের সম্বন্ধে Up to-date সব খবর Facts & Figures যাতে পাওয়া যায়, সেইরূপ ব্যবস্থা করতে হবে। Propaganda Depantment থেকে প্রত্যেক প্রাদেশিক ভাষায় ছোট ছোট পুস্তক প্রকাশিত হবে এবং জনসাধারণের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে। এতদ্ব্যতীত জাতীয় জীবনের এক একটা সমস্যা নিয়ে Propaganda department থেকে এক একটি বই প্রকাশিত হবে। সেই পুস্তকে কংগ্রেসের policy বুঝানো হবে এবং কী কী কারণের নিমিত্ত কংগ্রেসের এইরূপ Policy হয়েছে তাও লেখা থাকবে।
আমি অনেক লিখে ফেললাম। আপনার কাছে এসব কথা পুরাতন। আমার কাছে খুব নতুন মনে হচ্ছে বলে আমি না লিখে থাকতে পারলাম না। আমার মনে হচ্ছে যে কংগ্রেস সংক্রান্ত বিপুল কাজ আমাদের সম্মুখে পড়ে আছে। আপনারা ইচ্ছা করলে আমি এ বিষয়েও কিছু বোধহয় করতে পারব।
আপনার মতের জন্য আমি অপেক্ষা করছি। আপনি কী কী কাজে আমাকে নিযুক্ত করতে পারবেন, তা জানবার জন্য আমি ব্যগ্র আছি।
যদি আপনাদের অভিপ্রায় থাকে কাউকেও বিলেতে পাঠাতে Journalism শিখতে তা হলে আমি সে কাজের ভার নিতে পারি। আমাকে যদি সে ভার দেন তা হলে Passage এবং outfit-এর খরচ বেচে যাবে। অবশ্য এ কাজের ভার নেবার আগে আমি চাকরি ত্যাগ করব। অবশ্য আমার থাকা ও পাওয়ার খরচ দিবেন-কারণ চাকরি ছাড়ার পর বাড়ি থেকে টাকা নেওয়া বোধহয় যুক্তিসঙ্গত হবে না।
আমার নিজের ইচ্ছা যে, যদি চাকরি ছাড়ি তা হলে জুন মাসেই রওনা হব। তবে প্রয়োজন হলে আমি নিজের ইচ্ছা পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত আছি। আমার বহুভাষিতা ক্ষমা করবেন। আশা করি যথাশীর্ঘ উত্তর দিবেন। আমার প্রণাম জানবেন।
ইতি—
আমার ঠিকানা— Fitzwilliam Han Cambridge
প্ৰণত শ্রীসুভাষচন্দ্র বসু
TIBE UNION SOCIETY ২ মার্চ, ১৯২১
Cambridge.
প্রণাম পুরঃসর নিবেদন,
কয়েকদিন আগে আপনাকে একটি পত্র দিয়েছি আশা করি যথাসময়ে তা পেয়েছেন।
আপনি বোধহয় শুনে খুশি হবেন যে আমি চাকরি ছাড়া সম্বন্ধে একরকম কৃত-সঙ্কল্প হয়েছি। আমি কী কী কাজের জন্য উপযুক্ত হতে পারি তা আপনাকে পূর্বপত্রে জানিয়েছি। দেশে এখন কীরকম কাজের সুবিধা আছে তা এখান হতে ভালো বুঝতে পারছি না। আপনারা এখন কর্মক্ষেত্রের মধ্যে আছেন—সুতরাং আপনারা খুব ভালো রকম জানেন কীরকম কাজের সুবিধা এখন আছে এবং এখন কীরকম কর্মীলোকের দরকার। আমার এই অনুরোধ যে,
যে পর্যন্ত আমার চাকরি ছাড়ার খবর না পাচ্ছেন, সে পর্যন্ত যেন এ বিষয়ে কাউকেও কিছু না বলেন।
চাকরি ছাড়লে আমি জুন মাসের শেষে দেশে ফিরতে ইচ্ছা করি অবশ্য যদি সময় মতো Passage পাই। দেশে ফিরলে কী রকম কাজে হাত দিতে পারব তা জানবার জন্য উৎসুক আছি—কারণ মনটাকে সেইভাবে প্রস্তুত করতে ইচ্ছা করি। তাছাড়া দেশে গিয়ে যে রকম কাজ আরম্ভ করব, তদুপযোগী লেখাপড়া এখানে থাকতে করাও সম্ভব। আশা করি, আপনি যতশীঘ্র পারেন এ বিষয়ে একটা উত্তর দিবেন।
আমার নিজের কতকগুলো মতলব মনে আসছে—আপনাকে তা জানাচ্ছি।
১. “জাতীয় কলেজে” আমি শিক্ষকতা করতে পারি। পাশ্চাত্য দর্শনশাস্ত্র আমার যৎকিঞ্চিৎ পড়া আছে।
২. আপনারা যদি কোনো দৈনিক খবরের কাগজ ইংরেজিতে প্রকাশ করেন, তা হলে আমি Sub Editorial staff এ কাজ করতে পারি।
৩. আপনারা যদি কংগ্রেসের' সংক্রান্ত একটা research department খোলেন, তা হলে আমি তাতেও কাজ করতে পারি। আমার গত পত্রে আমি এ সম্বন্ধে কিছুটা লিখেছি। আমার মনে হয়, একদল research students আমাদের চাই। তারা
জাতীয় জীবনের এক একটা সমস্যা নিয়ে সেই সম্বন্ধে facts সংগ্রহ করবে। 'কংগ্রেস' তারপর একটা Committee নিযুক্ত করবে এই Committee সেই সব facts বিবেচনা করে প্রত্যেক বিষয়ে কংগ্রেসের একটা Policy ঠিক করবে।
Currency and Exchange সম্বন্ধে আমাদের Congress-এর কোন বিশিষ্ট Policy নাই। তারপর labour and factory legislation সম্বন্ধেও ‘কংগ্রেসের কোনো বিশিষ্ট Policy নাই। তারপর Vagrancy and poor Relief সম্বন্ধে আমাদের কংগ্রেসের কোনও বিশিষ্ট policy নাই। তারপর ‘স্বরাজ’ পেলে আমাদের Constitution কী রকম হবে, সে সম্বন্ধেও বোধহয় কংগ্রেসের কোন বিশিষ্ট Policy নাই। আমার নিজের মনে হয় যে, Congress League scheme একেবারে পুরানো হয়ে গেছে। স্বরাজের ভিত্তির উপর আমাদের এখন ভারতের Constitution তৈরি করতে হবে।
আপনি অবশ্য বলতে পারেন যে Congress এখন existing order ভাঙতে ব্যস্ত, সুতরাং ভাঙার কার্য সম্পূর্ণ না হলে Constructive কাজ আরম্ভ করা অসম্ভব, কিন্তু আমার মনে হয় যে, এখন থেকেই ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে সৃষ্টি আরম্ভ করতে হবে। জাতীয় জীবনের যেকোনোও সমস্যা সম্বন্ধে একটা Policy ঠিক করতে গেলে অনেকদিনের চিন্তা এবং গবেষণা চাই। সুতরাং এখন থেকেই গবেষণা আরম্ভ করা দরকার। কংগ্রেস যদি Complete programme প্রস্তুত করতে পারে, তা হলে যেদিন আমরা ‘স্বরাজ’ পাব সেই দিন কোন বিষয়ে কোন policy-র জন্য আমাদের ভাবতে হবে না।
তারপর কংগ্রেসের একটা intelligeune Department চাই—যেখানে দেশের সব খবর পাওয়া যেতে পারে। এই Department থেকে ছোট ছোট বই প্রকাশ করা দরকার। এক একটা বইতে এক একটা বিষয় থাকবে— যথা গত দশ বছরের মধ্যে কত জন্ম এবং কত মৃত্যু হয়েছে এবং কোন্ কোন্ রোগে কত মৃত্যু হয়েছে।
তারপর গত দশ বছরে ভারতবর্ষের অবস্থা আয় ও ব্যয় (Revenue & Expenditure) কত হয়েছে কোন্ কোন্ দিক থেকে আয় হয়েছে এবং কোন্ কোন্ বিষয়ে ব্যয় হয়েছে তা আর একটা বইতে প্রকাশিত হবে। এইরূপ আমাদের জাতীয় জীবনের দিককার খবর ক্ষুদ্র পুস্তকের ভিতর দিয়ে দেশময় প্রচার করতে হবে।
৪. জনসাধারণের মধ্যে বিস্তারের দিক দিয়ে কাজ করবার অনেক সুবিধা আছে। এই কাজের সঙ্গে Co-operative Banks প্রতিষ্ঠা করাও আবশ্যক।
৫. Social service. আমার নিজের মনে হচ্ছে যে, এই কয়টি বিষয়ে কাজ করবার সুবিধা আছে। কিন্তু আপনাকে বিবেচনা করতে হবে, আপনি আমাকে কোন বিভাগে চান। তবে শিক্ষকতা এবং Journalism বোধহয় আমার মনের মত কাজ হবে। এই নিয়ে আমি এখন আরম্ভ করতে পারি, তারপর সুবিধামত অন্য কাজেও হাত দিতে পারি।
আমার পক্ষে চাকরি ছাড়া মানে দারিদ্র্য ব্রত গ্রহণ করা— সুতরাং বেতন সম্বন্ধে
আমি কিছু বলব না, খাওয়া-পরা চললেই আমার যথেষ্ট হবে। আমি যদি বদ্ধপরিকর হয়ে কাজে নামতে পারি, তা হলে আমার বিশ্বাস আমি আমার সঙ্গে এখানকার ২/১ জন বাঙালি বন্ধুকেও এই কাজে টানতে পারব।
স্বদেশসেবার যে মহাযজ্ঞের আয়োজন হচ্ছে আপনি তাতে বঙ্গ দেশের প্রধান পুরোহিত। আমার যা বক্তব্য আমি তা শেষ করেছি-এখন আমি আমাকে আপনার বিপুল কাজের মধ্যে স্থান দিন।
আমি চাকরি ছাড়লেই এখানে পাঁচজনে জিজ্ঞেস করবে আমি দেশে ফিরে কি কাজ করব। সুতরাং নিজের সন্তোষের জন্য এবং পাঁচজনের কাছে Seif justification-এর জন্য আমি জানতে উৎসুক আপনি আমাকে কি কাজ দিতে পারেন।
আশা করি আপনি এসব কথা আপাতত গোপন রাখবেন। আপনি আমার প্রণাম জানিবেন।
ইতি
বিনীত
শ্রীসুভাষচন্দ্র বসু।
তরুণের স্বপ্ন
আমরা এ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছি একটা উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে—একটা বাণী প্রচারের জন্য। আলোকে জগৎ উদ্ভাসিত করবার জন্য যদি গগনে সূর্য উদিত হয়, গন্ধ বিতরণের উদ্দেশ্যে বনমধ্যে কুসুমরাজি যদি বিকশিত হয়, অমৃতময় বারিদান করতে তটিনী যদি সাগরাভিমুখে প্রবাহিত হয়—যৌবনের পূর্ণ আনন্দ ও ভরা প্রাণ নিয়ে আমরাও মর্ত্যলোকে নেমেছি। একটা সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। যে অজ্ঞাত গূঢ় উদ্দেশ্য আমাদের ব্যর্থ জীবনকে সার্থক করে তোলে তা আবিষ্কার করতে হবে ধ্যানের দ্বারা, কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার দ্বারা।
যৌবনের পূর্ণ জোয়ারে আমরা ভেসে এসেছি সকলকে আনন্দের আস্বাদ দেবার জন্য, কারণ আমরা আনন্দের স্বরূপ। আনন্দের মূর্ত বিগ্রহরূপে আমরা মর্ত্যে বিচরণ করব। নিজের আনন্দে আমরা হাসব-সঙ্গে সঙ্গে জগৎকেও মাতাব। আমরা যেদিকে ফিরব, নিরানন্দের অন্ধকার লজ্জায় পালিয়ে যাবে, আমাদের প্রাণময় স্পর্শের প্রভাবে রোগ, শোক, তাপ দূর হবে।
এই দুঃখ-সঙ্কুল, বেদনাপূর্ণ নরলোকে আমরা আনন্দ-সাগরের বাণ ডেকে আনব।
আশা, উৎসাহ, ত্যাগ ও বীর্য নিয়ে আমরা এসেছি সৃষ্টি করতে, কারণ-সৃষ্টির মধ্যেই আনন্দ। তনু, মন-প্রাণ, বুদ্ধি চালিয়ে দিয়ে আমরা সৃষ্টি করব। নিজের মধ্যে যা কিছু সত্য, যা কিছু সুন্দর, যা কিছু শিব আছে-তা আমরা সৃষ্ট পদার্থের মধ্যে ফুটিয়ে তুলব। আত্মদানের মধ্যে যে আনন্দ সে আনন্দে আমরা বিভোর হব, সেই আনন্দের আস্বাদ পেয়ে পরিবর্তন হবে।
কিন্তু আমাদের দেওয়া শেষ নেই, কর্মেরও শেষ নেই কারণ—
“যত দেব প্রাণ বহে যাবে প্রাণ
ফুরাবে না তার প্রাণ;
এত কথা আছে এত প্রাণ আছে এত প্রাণ আছে মোর এত সুখ আছে, এত সাধ আছে প্রাণ হয়ে আছে ভোর।”
অনন্ত আশা, অসীম উৎসাহ, অপরিমের তেজ ও অদম্য সাহস নিয়ে আমরা এসেছি—তাই আমাদের জীবনের স্রোত কেউ রোধ করতে পারবে না। অবিশ্বাস ও নৈরাশ্যের পর্বতরাশি সম্মুখে এসে দাঁড়াক অথবা সমবেত মনুষ্য-জাতির প্রতিকূল শক্তি আমাদের আক্রমণ করুক, আমাদের আনন্দময়ী গতি চিরকাল অক্ষুণ্ণই থাকবে।
আমাদের একটা বিশিষ্ট ধর্ম আছে—সেই ধর্মই আমরা অনুসরণ করি। যা নতুন, যা সরস, যা অনাস্বাদিত-তারই উপাসক আমরা। আমরা এনে দিই পুরাতনের মধ্যে নতুনকে, জড়ের মধ্যে চঞ্চলকে, প্রবীণের মধ্যে নবীনকে এবং বন্ধনের মধ্যে অসীমকে। আমরা অতীত ইতিহাসলব্ধ অভিজ্ঞতা সব সময়ে মানতে প্রস্তুত নই। আমরা অনন্ত পথের যাত্রী বটে কিন্তু আমরা অচেনা পথই ভালোবাসি-অজানা ভবিষ্যৎই আমাদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। আমরা চাই "the right to make blunders" অর্থাৎ “ভুল করবার অধিকার"। তাই আমাদের স্বভাবের প্রতি সকলের সহানুভূতি নাই, আমরা অনেকের কাছে সৃষ্টিছাড়া ও লক্ষ্মীছাড়া।
এতেই আমাদের আনন্দ; এখানেই আমাদের গর্ব। যৌবন বর্ষাকালে সর্বদেশে সৃষ্টিছাড়া ও লক্ষ্মীহারা। অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার উন্মাদনায় আমরা ছুটে চলি-বিজ্ঞের উপদেশ পর্যন্ত অবসর আমাদের নাই। ভুল করি, ভ্রমে পড়ি, আছাড় খাই, কিন্তু কিছুতেই আমরা উৎসাহ হারাই না বা পশ্চাদপদ হই না। আমাদের তাণ্ডব-লীলার অন্ত নাই, কারণ আমরা অবিরামগতি।
আমরাই দেশে দেশে মুক্তির ইতিহাস রচনা করে থাকি। আমরা শান্তির জল ছিটাতে এখানে আসি নাই। বিবাদ সৃষ্টি করতে, সংগ্রামের সংবাদ দিতে, প্রলয়ের সূচনা করতে আমরা এসে থাকি। যেখানে বন্ধন, যেখানে গোঁড়ামি, যেখানে কুসংস্কার, যেখানে সঙ্কীর্ণতা সেখানেই আমরা কুঠার হস্তে উপস্থিত হই। আমাদের একমাত্র ব্যবসায় মুক্তির পথ চিরকাল বণ্টকশূন্য রাখা, যেন সে পথ দিয়ে মুক্তির সেনা অবলীলাক্রমে গমনাগমন করতে পারে।
মনুষ্য জীবন আমাদের কাছে একটা অখণ্ড সত্য। সুতরাং যে স্বাধীনতা আমরা চাই—সে স্বাধীনতা ব্যতীত জীবনধারণই একটা বিড়ম্বনা-যে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুগে যুগে আমরা হাসতে হাসতে রক্তদান করেছি-সে স্বাধীনতা সর্বতোমুখী! জীবনের সকল ক্ষেত্রে সকল দিকে আমরা মুক্তির বাণী প্রচার করবার জন্য এসেছি। কি সমাজনীতি, কি অর্থনীতি, কি রাষ্ট্রনীতি, কি ধর্মনীতি-জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমরা সত্যের আলোক, আনন্দের উচ্ছ্বাস ও উদারতার মৌলিক ভিত্তি নিয়ে আসতে চাই।
অনাদিকাল হতে আমরা মুক্তির সংগীত গেয়ে আসছি। শিশুকাল হতে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আমাদের শিরায় শিরায় প্রবাহিত। জন্মিবামাত্র আমরা যে কাতরকণ্ঠে ক্রন্দন করে উঠি সে ক্রন্দন শুদ্ধ পার্থিব বন্ধনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জানাবার জন্য। শৈশবে ক্রন্দনই আমাদের একমাত্র বল থাকে কিন্তু যৌবনের দ্বারদেশে উপনীত হলে বাহু ও বুদ্ধি আমাদের সহায় হয়। যার এই বুদ্ধি ও বাহুর সাহায্যে আমরা কি না করেছি, ফিনিসিয়া, এসিরিয়া, ব্যাবিলোনিয়া, মিসর, গ্রিস, রোম, তুরস্ক, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, চীন, জাপান, হিন্দুস্তান—যেকোনো দেশের ইতিহাস পড়ে দেখো-দেখবে যে ইতিহাসের প্রত্যেক পৃষ্ঠায় আমাদের কীর্তি অনন্ত অক্ষরে লেখা আছে। আমাদের সাহায্যে সম্রাট সিংহাসনে আরোহন করেছেন, আবার আমাদেরই অঙ্গুলিসঙ্কেতে সভয়ে সিংহাসন ত্যাগ করে তিনি পলায়ন করেছেন।
“যত দেব প্রাণ বহে যাবে প্রাণ
ফুরাবে না তার প্রাণ;
এত কথা আছে এত প্রাণ আছে
এত প্রাণ আছে মোর
এত সুখ আছে, এত সাধ আছে
প্রাণ হয়ে আছে ভোর।”অনন্ত আশা, অসীম উৎসাহ, অপরিমের তেজ ও অদম্য সাহস নিয়ে আমরা এসেছি-তাই আমাদের জীবনের স্রোত কেউ রোধ করতে পারবে না। অবিশ্বাস ও নৈরাশ্যের পর্বতরাশি সম্মুখে এসে দাঁড়াক অথবা সমবেত মনুষ্য-জাতির প্রতিকূল শক্তি আমাদের আক্রমণ করুক,-আমাদের আনন্দময়ী গতি চিরকাল অক্ষুণ্নই থাকবে।
আমাদের একটা বিশিষ্ট ধর্ম আছে-সেই ধর্মই আমরা অনুসরণ করি। যা নতুন, যা সরস, যা অনাস্বাদিত-তারই উপাসক আমরা। আমরা এনে দিই পুরাতনের মধ্যে নতুনকে, জড়ের মধ্যে চঞ্চলকে, প্রবীণের মধ্যে নবীনকে এবং বন্ধনের মধ্যে অসীমকে। আমরা অতীত ইতিহাসলব্ধ অভিজ্ঞতা সব সময়ে মানতে প্রস্তুত নই। আমরা অনন্ত পথের যাত্রী বটে কিন্তু আমরা অচেনা পথই ভালোবাসি-অজানা ভবিষ্যৎই আমাদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। আমরা চাই “the right to make blunders” অর্থাৎ “ভুল করবার অধিকার”। তাই আমাদের স্বভাবের প্রতি সকলের সহানুভূতি নাই, আমরা অনেকের কাছে সৃষ্টিছাড়া ও লক্ষ্মীছাড়া।
এতেই আমাদের আনন্দ; এখানেই আমাদের গর্ব। যৌবন বর্ষাকালে সর্বদেশে সৃষ্টিছাড়া ও লক্ষ্মীহারা। অতৃপ্ত আকাক্সক্ষার উন্মাদনায় আমরা ছুটে চলি-বিজ্ঞের উপদেশ পর্যন্ত অবসর আমাদের নাই। ভুল করি, ভ্রমে পড়ি, আছাড় খাই, কিন্তু কিছুতেই আমরা উৎসাহ হারাই না বা পশ্চাদপদ হই না। আমাদের তা-ব-লীলার অন্ত নাই, কারণÑআমরা অবিরামগতি।
আমরাই দেশে দেশে মুক্তির ইতিহাস রচনা করে থাকি। আমরা শান্তির জল ছিটাতে এখানে আসি নাই। বিবাদ সৃষ্টি করতে, সংগ্রামের সংবাদ দিতে, প্রলয়ের সূচনা করতে আমরা এসে থাকি। যেখানে বন্ধন, যেখানে গোঁড়ামি, যেখানে কুসংস্কার, যেখানে সঙ্কীর্ণতা-সেখানেই আমরা কুঠার হস্তে উপস্থিত হই। আমাদের একমাত্র ব্যবসায় মুক্তির পথ চিরকাল বণ্টকশূন্য রাখা, যেন সে পথ দিয়ে মুক্তির সেনা অবলীলাক্রমে গমনাগমন করতে পারে।
আত্মনিবেদন
১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের কালে শ্রীসুভাষচন্দ্র বসু, বিলেতে অধ্যয়ন করছিলেন। সে সময় তিনি জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করে দেশসেবা করবার সুযোগ লাভের জন্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের কাছে যে পত্র প্রেরণ করেছিলেন, সেই পত্র দুইটি নিম্নে দেওয়া হলো : TIBE UNION SOCIETY,
Cambridge. ১৬ ফেব্রুয়ারি।
প্রণাম পুরঃসর নিবেদন,
আপনি আমাকে বোধহয় চেনেন না-কিন্তু আমার পরিচয় দিলে বোধহয় চিনতে পারবেন। আপনাকে আমি খুব প্রয়োজনীয় কোনো বিষয়ে এই পত্র লিখছি-কিন্তু কাজের কথা আরম্ভ করবার আগে আমাকে নিজের sincerity আগে প্রমাণ করতে হবে। সেইজন্য প্রথমে নিজের পরিচয় দিচ্ছি।
আমার পিতা শ্রীজানকীনাথ বসু কটকে ওকালতি করেন এবং কয়েক বছর আগে সেখানকার গভর্নমেন্ট প্লিডার ছিলেন। আমার দাদা শ্রীশরৎচন্দ্র বসু কলকাতা হাইকোর্টের Harrister। আপনি আমার পিতাকে চিনলেও চিনতে পারেন এবং আমার দাদাকে নিশ্চয়ই চেনেন।
পাঁচ বছর আগে আমি কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তাম। ১৯১৬ সালের গোলমালের সময়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে expelled হই। দুই বছর নষ্ট হবার পর আমি কলেজে পড়বার অনুমতি পাই। তারপর ১৯১৯ সালে আমি বিএ পাস করি এবং honours-এর প্রথম শ্রেণিতে স্থান পাই।
১৯১৯ সালে অক্টোবর মাসে এখানে এসেছি। ১৯২০ সালে আগস্ট মাসে আমি Civil Service পরীক্ষা পাস করি এবং চতুর্থ স্থান অধিকার করি। এই বছর জুন মাসে আমি Moral Science Tripos পরীক্ষা দেব। সেই মাসে আমি এখানকার B.A. Degree পাব।
এখন কাজের কথা বলি। সরকারি চাকরি করবার আমার মোটেই ইচ্ছা নাই । আমি বাড়িতে লিখেছি বাবাকে এবং দাদাকে যে, আমি চাকরি ছেড়ে দিতে চাই। আমি এখনও উত্তর পাইনি। তাঁদের অনুমতি পেতে হলে, আমাকে দেখাতে হবে আমি চাকরি ছাড়বার পর কি tangible কাজ করতে চাই। আমি অবশ্য জানি যে, চাকরি ছেড়ে আমি যদি কোমর বেধে দেশের কাজে অবতীর্ণ হই তা হলে করবার আমার অনেক আছে—যথা, জাতীয় কলেজে শিক্ষকতা, পুস্তক ও খবর কাগজ প্রণয়ন ও প্রকাশ, গ্রাম্য সমিতি স্থাপন, জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ইত্যাদি। কিন্তু আমি যদি এখন বাড়িতে দেখাতে পারি আমি কি tangible কাজ করতে ইচ্ছা করি-তা হলে বোধহয় চাকরি ছাড়া সম্বন্ধে অনুমতি সহজে পাব। আমি যদি তাঁদের অনুমতি নিয়ে চাকরি ছাড়তে পারি তা হলে বিনা অনুমতিতে কোনো কাজ করবার আবশ্যকতা পাই ।
দেশের অবস্থা সম্বন্ধে আপনি সব চেয়ে ভালো জানেন। শুনলাম আপনারা কলকাতায় এবং ঢাকায় জাতীয় কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং ইংরেজ ও বাংলায় “স্বরাজ” পত্রিকা বের করতে চান। আমি আরও শুনলাম বাংলাদেশের নানা স্থানে গ্রাম্য সমিতি প্রভৃতিও স্থাপন করা হয়েছে।
আমি শুনতে ইচ্ছা করি আপনারা আমাকে এই স্বদেশ সেবার যজ্ঞে কী কাজ দিতে পারেন? আমার বিদ্যাবুদ্ধি কিছুই নাই—কিন্তু আমার বিশ্বাস যে, যৌবনোচিত উৎসাহ আমার আছে। আমি অবিবাহিত।
লেখাপড়ার মধ্যে আমি Philosophyটা একটু পড়েছি কারণ কলকাতায় আমার ওই বিষয়ে Honours ছিল এবং এখানেও আমি ওই বিষয়ে Tpos পড়েতেছি। Civil Service পরীক্ষার কৃপায় সর্বাঙ্গীণ শিক্ষা কিছুটা হয়েছে—যেমন Economics, Political Science, English and European History, English-Law, Sanirit, Geography ইত্যাদি।
আমি বিশ্বাস করি যে, আমি যদি নিজে এই কাজে নামতে পারি তা হলে আমি এখানকার ২/১ জন বাঙালি বন্ধুকে এই কাজে টানতে পারব কিন্তু আমি নিজে যতক্ষণ এই কাজে না নামছি, ততক্ষণ কাউকে টানতে পারছি না।
এখন আমার দেশে কোন্ কোন্ বিষয়ে কাজ আরম্ভ করবার সুবিধা আছে তা এখান থেকে বুঝতে পারছি না। তবে আমার মনে বলছে যে, দেশে ফিরলে আমি কলেজে অধ্যাপনা এবং পত্রিকার লেখা—এই দুই কাজে হাত দিতে পারব। আমার ইচ্ছা Clear-cut plans নিয়ে চাকরি ছাড়তে। তা করতে পারলে, চাকরি ছাড়ার পর আমাকে চিন্তায় সময় ব্যয় করতে হবে না এবং আমি চাকরি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে নামতে পারব।
আপনি আজ বাংলাদেশে স্বদেশ সেবাযজ্ঞে প্রধা ঋত্বিক—তাই আপনার কাছে এই পত্র লিখছি। আপনারা ভারতবর্ষে যে আন্দোলনের বন্যা তুলেছেন তার তরঙ্গ চিঠি ও খবরকাগজের ভিতর দিয়ে এখানে এসে পৌঁছেছে। এখানেও তাই মাতৃভূমির আহ্বান শুনা গিয়েছে। Oxford থেকে একজন মাদ্রাজি ছাত্র তাঁর লেখাপড়া আপাতত স্থগিত রেখে দেশে ফিরে যাচ্ছে—সেখান গিয়ে কাজ আরম্ভ করবার জন্য। Cambridge এ-পর্যন্ত কাজ কিছু হয়নি যদিও “অসহযোগিতা” সম্বন্ধে আলোচনা খুব বেশি চলছে। আমার বিশ্বাস, যদি কেউ পথ দেখাতে পারে তাহলে সেই পথ অনুসরণ করবার লোক এখানে আছে।
আপনি বাংলাদেশে আমাদের সেবাযজ্ঞের প্রধান ঋত্বিক্-তাই আপনার কাছে আমি কাজ উপস্থিত হয়েছি—আমার সামান্য বিদ্যা, বুদ্ধি, শক্তি ও উৎসাহ নিয়ে। মাতৃভূমির চরণে উৎসর্গ করবার আমার বিশেষ কিছুই নাই—আছে শুধু নিজের মন এবং নিজের এই তুচ্ছ শরীর।
আপনাকে এই পত্র লেখার উদ্দেশ্য— শুধু আপনাকে জিজ্ঞেস করা আপনি আমাকে এই বিপুল সেবাযজ্ঞে কী কাজ দিতে পারেন? আমি তা জানতে পারলে বাড়িতে বাবাকে এবং দাদাকে সেইরূপ লিখতে পারব এবং নিজের মনকেও সেইভাবে প্রস্তুত করতে পারব।
আমি এখন একরকম সরকারি চাকর। কারণ আমি এখন ICS Probationer। আপনাকে চিঠি লিখতে সাহস করলাম না পাছে চিঠি censored হয়! আমার জনৈক বিশ্বাসী বন্ধু শ্রীপ্রমথনাথ সরকারকে আমি এই চিঠি পাঠাচ্ছি—তিনি আপনার হাতে এই চিঠি দিয়ে আসবেন। আমি যখনই আপনাকে পত্র দিব—তখন এইভাবেই দিব। আপনি অবশ্য আমাকে চিঠি লিখতে পারেন কারণ এখানে চিঠি censored হবার ভয় নাই।
আমার এখানকার মতলব সম্বন্ধে আমি কাউকেও জানাইনি—শুধু বাড়িতে বাবাকে এবং দাদাকে লিখেছি। আমি এখন সরকারি চাকর-সুতরাং আশা করি যে, আমি যে-পর্যন্ত চাকরি না ছাড়ছি সে পর্যন্ত আপনি কাউকেও এ বিষয়ে কিছু বলবেন না।
আমার আর কিছু বলবার নাই। আমি আজ প্রস্তুত আপনি শুধু কর্মের আদেশ দিন।
আমার নিজের মনে হয় যে, আপনি যদি “স্বরাজ” পত্রিকা ইংরেজিতে আরম্ভ করেন তা হলে আমি সেই পত্রিকার Subeditorial staff-এ কাজ করতে পারি। তাছাড়া জাতীয় কলেজের নিম্ন শ্রেণিতে অধ্যাপনা করতে পারি।
কংগ্রেসের বিষয়ে আমার মনে অনেক প্রস্তাব আছে। আমার মনে হয় যে, কংগ্রেসের একটা স্থায়ী আড্ডা চাই। তার জন্য একটা বাড়ি করা চাই। সেখানে একদল Research student থাকবেন— যাঁরা আমাদের দেশের ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা নিয়ে গবেষণা করবেন। আমি যতদূর জানি Indian Currency and Exchange সম্বন্ধে আমাদের কংগ্রেসের কোনও definite policy নাই। তারপর native states-দের প্রতি কংগ্রেসের কীরূপ attitude হওয়া উচিত তা বোধহয় স্থির করা হয়নি। Franchise (for men and women) সম্বন্ধে কংগ্রেসের কী রকম মত তাও বোধহয় জানা নাই। তারপর Depressed classes-দের নিয়ে আমাদের কি করা উচিত তাও বোধহয় কংগ্রেস ঠিক করে নাই। এই বিষয়ে (অর্থাৎ Depressed classes সম্বন্ধে ) কোন কাজ না করার দরুন মাদ্রাজে আজ সব non-Brahmin রা Pro-Government এবং anti-nationalist হয়েছে।
আমার নিজের মনে হয় যে Congress-এর একটা Permanent staff রাখা দরকার। তারা এক একটা সমস্যা (Problem) নিয়ে গবেষণা করবে। প্রত্যেকে নিজ নিজ বিষয়ে up-to-date facts and figures সংগ্রহ করবে। এই সব Facts and figures সংগৃহীত হলে Congress Committee প্রত্যেক বিষয়ে (Problem-এ) একটা Policy formulate করবে। আজ অনেক জাতীয় Problem সম্বন্ধে কংগ্রেসের কোনো definite policy নাই। আমার সেই জন্য মনে হয় যে, কংগ্রেসের একটা স্থায়ী বাড়ি চাই এবং Staff of research students চাই।
তাছাড়া Congress-এ একটা Intelligence Department খোলা দরকার। Intelligence Department-এ দেশের সম্বন্ধে Up to-date সব খবর Facts & Figures যাতে পাওয়া যায়, সেইরূপ ব্যবস্থা করতে হবে। Propaganda Depantment থেকে প্রত্যেক প্রাদেশিক ভাষায় ছোট ছোট পুস্তক প্রকাশিত হবে এবং জনসাধারণের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে। এতদ্ব্যতীত জাতীয় জীবনের এক একটা সমস্যা নিয়ে Propaganda department থেকে এক একটি বই প্রকাশিত হবে। সেই পুস্তকে কংগ্রেসের policy বুঝানো হবে এবং কী কী কারণের নিমিত্ত কংগ্রেসের এইরূপ Policy হয়েছে তাও লেখা থাকবে।
আমি অনেক লিখে ফেললাম। আপনার কাছে এসব কথা পুরাতন। আমার কাছে খুব নতুন মনে হচ্ছে বলে আমি না লিখে থাকতে পারলাম না। আমার মনে হচ্ছে যে কংগ্রেস সংক্রান্ত বিপুল কাজ আমাদের সম্মুখে পড়ে আছে। আপনারা ইচ্ছা করলে আমি এ বিষয়েও কিছু বোধহয় করতে পারব।
আপনার মতের জন্য আমি অপেক্ষা করছি। আপনি কী কী কাজে আমাকে নিযুক্ত করতে পারবেন, তা জানবার জন্য আমি ব্যগ্র আছি।
যদি আপনাদের অভিপ্রায় থাকে কাউকেও বিলেতে পাঠাতে Journalism শিখতে তা হলে আমি সে কাজের ভার নিতে পারি। আমাকে যদি সে ভার দেন তা হলে Passage এবং outfit-এর খরচ বেচে যাবে। অবশ্য এ কাজের ভার নেবার আগে আমি চাকরি ত্যাগ করব। অবশ্য আমার থাকা ও পাওয়ার খরচ দিবেন-কারণ চাকরি ছাড়ার পর বাড়ি থেকে টাকা নেওয়া বোধহয় যুক্তিসঙ্গত হবে না।
আমার নিজের ইচ্ছা যে, যদি চাকরি ছাড়ি তা হলে জুন মাসেই রওনা হব। তবে প্রয়োজন হলে আমি নিজের ইচ্ছা পরিত্যাগ করতে প্রস্তুত আছি। আমার বহুভাষিতা ক্ষমা করবেন। আশা করি যথাশীর্ঘ উত্তর দিবেন। আমার প্রণাম জানবেন।
ইতি—
আমার ঠিকানা— Fitzwilliam Han Cambridge
প্ৰণত শ্রীসুভাষচন্দ্র বসু
TIBE UNION SOCIETY ২ মার্চ, ১৯২১
Cambridge.
প্রণাম পুরঃসর নিবেদন,
কয়েকদিন আগে আপনাকে একটি পত্র দিয়েছি আশা করি যথাসময়ে তা পেয়েছেন।
আপনি বোধহয় শুনে খুশি হবেন যে আমি চাকরি ছাড়া সম্বন্ধে একরকম কৃত-সঙ্কল্প হয়েছি। আমি কী কী কাজের জন্য উপযুক্ত হতে পারি তা আপনাকে পূর্বপত্রে জানিয়েছি। দেশে এখন কীরকম কাজের সুবিধা আছে তা এখান হতে ভালো বুঝতে পারছি না। আপনারা এখন কর্মক্ষেত্রের মধ্যে আছেন—সুতরাং আপনারা খুব ভালো রকম জানেন কীরকম কাজের সুবিধা এখন আছে এবং এখন কীরকম কর্মীলোকের দরকার। আমার এই অনুরোধ যে,
যে পর্যন্ত আমার চাকরি ছাড়ার খবর না পাচ্ছেন, সে পর্যন্ত যেন এ বিষয়ে কাউকেও কিছু না বলেন।
চাকরি ছাড়লে আমি জুন মাসের শেষে দেশে ফিরতে ইচ্ছা করি অবশ্য যদি সময় মতো Passage পাই। দেশে ফিরলে কী রকম কাজে হাত দিতে পারব তা জানবার জন্য উৎসুক আছি—কারণ মনটাকে সেইভাবে প্রস্তুত করতে ইচ্ছা করি। তাছাড়া দেশে গিয়ে যে রকম কাজ আরম্ভ করব, তদুপযোগী লেখাপড়া এখানে থাকতে করাও সম্ভব। আশা করি, আপনি যতশীঘ্র পারেন এ বিষয়ে একটা উত্তর দিবেন।
আমার নিজের কতকগুলো মতলব মনে আসছে—আপনাকে তা জানাচ্ছি।
১. “জাতীয় কলেজে” আমি শিক্ষকতা করতে পারি। পাশ্চাত্য দর্শনশাস্ত্র আমার যৎকিঞ্চিৎ পড়া আছে।
২. আপনারা যদি কোনো দৈনিক খবরের কাগজ ইংরেজিতে প্রকাশ করেন, তা হলে আমি Sub Editorial staff এ কাজ করতে পারি।
৩. আপনারা যদি কংগ্রেসের' সংক্রান্ত একটা research department খোলেন, তা হলে আমি তাতেও কাজ করতে পারি। আমার গত পত্রে আমি এ সম্বন্ধে কিছুটা লিখেছি। আমার মনে হয়, একদল research students আমাদের চাই। তারা
জাতীয় জীবনের এক একটা সমস্যা নিয়ে সেই সম্বন্ধে facts সংগ্রহ করবে। 'কংগ্রেস' তারপর একটা Committee নিযুক্ত করবে এই Committee সেই সব facts বিবেচনা করে প্রত্যেক বিষয়ে কংগ্রেসের একটা Policy ঠিক করবে।
Currency and Exchange সম্বন্ধে আমাদের Congress-এর কোন বিশিষ্ট Policy নাই। তারপর labour and factory legislation সম্বন্ধেও ‘কংগ্রেসের কোনো বিশিষ্ট Policy নাই। তারপর Vagrancy and poor Relief সম্বন্ধে আমাদের কংগ্রেসের কোনও বিশিষ্ট policy নাই। তারপর ‘স্বরাজ’ পেলে আমাদের Constitution কী রকম হবে, সে সম্বন্ধেও বোধহয় কংগ্রেসের কোন বিশিষ্ট Policy নাই। আমার নিজের মনে হয় যে, Congress League scheme একেবারে পুরানো হয়ে গেছে। স্বরাজের ভিত্তির উপর আমাদের এখন ভারতের Constitution তৈরি করতে হবে।
আপনি অবশ্য বলতে পারেন যে Congress এখন existing order ভাঙতে ব্যস্ত, সুতরাং ভাঙার কার্য সম্পূর্ণ না হলে Constructive কাজ আরম্ভ করা অসম্ভব, কিন্তু আমার মনে হয় যে, এখন থেকেই ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে সৃষ্টি আরম্ভ করতে হবে। জাতীয় জীবনের যেকোনোও সমস্যা সম্বন্ধে একটা Policy ঠিক করতে গেলে অনেকদিনের চিন্তা এবং গবেষণা চাই। সুতরাং এখন থেকেই গবেষণা আরম্ভ করা দরকার। কংগ্রেস যদি Complete programme প্রস্তুত করতে পারে, তা হলে যেদিন আমরা ‘স্বরাজ’ পাব সেই দিন কোন বিষয়ে কোন policy-র জন্য আমাদের ভাবতে হবে না।
তারপর কংগ্রেসের একটা intelligeune Department চাই—যেখানে দেশের সব খবর পাওয়া যেতে পারে। এই Department থেকে ছোট ছোট বই প্রকাশ করা দরকার। এক একটা বইতে এক একটা বিষয় থাকবে— যথা গত দশ বছরের মধ্যে কত জন্ম এবং কত মৃত্যু হয়েছে এবং কোন্ কোন্ রোগে কত মৃত্যু হয়েছে।
তারপর গত দশ বছরে ভারতবর্ষের অবস্থা আয় ও ব্যয় (Revenue & Expenditure) কত হয়েছে কোন্ কোন্ দিক থেকে আয় হয়েছে এবং কোন্ কোন্ বিষয়ে ব্যয় হয়েছে তা আর একটা বইতে প্রকাশিত হবে। এইরূপ আমাদের জাতীয় জীবনের দিককার খবর ক্ষুদ্র পুস্তকের ভিতর দিয়ে দেশময় প্রচার করতে হবে।
৪. জনসাধারণের মধ্যে বিস্তারের দিক দিয়ে কাজ করবার অনেক সুবিধা আছে। এই কাজের সঙ্গে Co-operative Banks প্রতিষ্ঠা করাও আবশ্যক।
৫. Social service. আমার নিজের মনে হচ্ছে যে, এই কয়টি বিষয়ে কাজ করবার সুবিধা আছে। কিন্তু আপনাকে বিবেচনা করতে হবে, আপনি আমাকে কোন বিভাগে চান। তবে শিক্ষকতা এবং Journalism বোধহয় আমার মনের মত কাজ হবে। এই নিয়ে আমি এখন আরম্ভ করতে পারি, তারপর সুবিধামত অন্য কাজেও হাত দিতে পারি।
আমার পক্ষে চাকরি ছাড়া মানে দারিদ্র্য ব্রত গ্রহণ করা— সুতরাং বেতন সম্বন্ধে
আমি কিছু বলব না, খাওয়া-পরা চললেই আমার যথেষ্ট হবে। আমি যদি বদ্ধপরিকর হয়ে কাজে নামতে পারি, তা হলে আমার বিশ্বাস আমি আমার সঙ্গে এখানকার ২/১ জন বাঙালি বন্ধুকেও এই কাজে টানতে পারব।
স্বদেশসেবার যে মহাযজ্ঞের আয়োজন হচ্ছে আপনি তাতে বঙ্গ দেশের প্রধান পুরোহিত। আমার যা বক্তব্য আমি তা শেষ করেছি-এখন আমি আমাকে আপনার বিপুল কাজের মধ্যে স্থান দিন।
আমি চাকরি ছাড়লেই এখানে পাঁচজনে জিজ্ঞেস করবে আমি দেশে ফিরে কি কাজ করব। সুতরাং নিজের সন্তোষের জন্য এবং পাঁচজনের কাছে Seif justification-এর জন্য আমি জানতে উৎসুক আপনি আমাকে কি কাজ দিতে পারেন।
আশা করি আপনি এসব কথা আপাতত গোপন রাখবেন। আপনি আমার প্রণাম জানিবেন।
ইতি
বিনীত
শ্রীসুভাষচন্দ্র বসু।
তরুণের স্বপ্ন
আমরা এ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছি একটা উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে—একটা বাণী প্রচারের জন্য। আলোকে জগৎ উদ্ভাসিত করবার জন্য যদি গগনে সূর্য উদিত হয়, গন্ধ বিতরণের উদ্দেশ্যে বনমধ্যে কুসুমরাজি যদি বিকশিত হয়, অমৃতময় বারিদান করতে তটিনী যদি সাগরাভিমুখে প্রবাহিত হয়—যৌবনের পূর্ণ আনন্দ ও ভরা প্রাণ নিয়ে আমরাও মর্ত্যলোকে নেমেছি। একটা সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। যে অজ্ঞাত গূঢ় উদ্দেশ্য আমাদের ব্যর্থ জীবনকে সার্থক করে তোলে তা আবিষ্কার করতে হবে ধ্যানের দ্বারা, কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার দ্বারা।
যৌবনের পূর্ণ জোয়ারে আমরা ভেসে এসেছি সকলকে আনন্দের আস্বাদ দেবার জন্য, কারণ আমরা আনন্দের স্বরূপ। আনন্দের মূর্ত বিগ্রহরূপে আমরা মর্ত্যে বিচরণ করব। নিজের আনন্দে আমরা হাসব-সঙ্গে সঙ্গে জগৎকেও মাতাব। আমরা যেদিকে ফিরব, নিরানন্দের অন্ধকার লজ্জায় পালিয়ে যাবে, আমাদের প্রাণময় স্পর্শের প্রভাবে রোগ, শোক, তাপ দূর হবে।
এই দুঃখ-সঙ্কুল, বেদনাপূর্ণ নরলোকে আমরা আনন্দ-সাগরের বাণ ডেকে আনব।
আশা, উৎসাহ, ত্যাগ ও বীর্য নিয়ে আমরা এসেছি সৃষ্টি করতে, কারণ-সৃষ্টির মধ্যেই আনন্দ। তনু, মন-প্রাণ, বুদ্ধি চালিয়ে দিয়ে আমরা সৃষ্টি করব। নিজের মধ্যে যা কিছু সত্য, যা কিছু সুন্দর, যা কিছু শিব আছে-তা আমরা সৃষ্ট পদার্থের মধ্যে ফুটিয়ে তুলব। আত্মদানের মধ্যে যে আনন্দ সে আনন্দে আমরা বিভোর হব, সেই আনন্দের আস্বাদ পেয়ে পরিবর্তন হবে।
কিন্তু আমাদের দেওয়া শেষ নেই, কর্মেরও শেষ নেই কারণ—
“যত দেব প্রাণ বহে যাবে প্রাণ
ফুরাবে না তার প্রাণ;
এত কথা আছে এত প্রাণ আছে এত প্রাণ আছে মোর এত সুখ আছে, এত সাধ আছে প্রাণ হয়ে আছে ভোর।”
অনন্ত আশা, অসীম উৎসাহ, অপরিমের তেজ ও অদম্য সাহস নিয়ে আমরা এসেছি—তাই আমাদের জীবনের স্রোত কেউ রোধ করতে পারবে না। অবিশ্বাস ও নৈরাশ্যের পর্বতরাশি সম্মুখে এসে দাঁড়াক অথবা সমবেত মনুষ্য-জাতির প্রতিকূল শক্তি আমাদের আক্রমণ করুক, আমাদের আনন্দময়ী গতি চিরকাল অক্ষুণ্ণই থাকবে।
আমাদের একটা বিশিষ্ট ধর্ম আছে—সেই ধর্মই আমরা অনুসরণ করি। যা নতুন, যা সরস, যা অনাস্বাদিত-তারই উপাসক আমরা। আমরা এনে দিই পুরাতনের মধ্যে নতুনকে, জড়ের মধ্যে চঞ্চলকে, প্রবীণের মধ্যে নবীনকে এবং বন্ধনের মধ্যে অসীমকে। আমরা অতীত ইতিহাসলব্ধ অভিজ্ঞতা সব সময়ে মানতে প্রস্তুত নই। আমরা অনন্ত পথের যাত্রী বটে কিন্তু আমরা অচেনা পথই ভালোবাসি-অজানা ভবিষ্যৎই আমাদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। আমরা চাই "the right to make blunders" অর্থাৎ “ভুল করবার অধিকার"। তাই আমাদের স্বভাবের প্রতি সকলের সহানুভূতি নাই, আমরা অনেকের কাছে সৃষ্টিছাড়া ও লক্ষ্মীছাড়া।
এতেই আমাদের আনন্দ; এখানেই আমাদের গর্ব। যৌবন বর্ষাকালে সর্বদেশে সৃষ্টিছাড়া ও লক্ষ্মীহারা। অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার উন্মাদনায় আমরা ছুটে চলি-বিজ্ঞের উপদেশ পর্যন্ত অবসর আমাদের নাই। ভুল করি, ভ্রমে পড়ি, আছাড় খাই, কিন্তু কিছুতেই আমরা উৎসাহ হারাই না বা পশ্চাদপদ হই না। আমাদের তাণ্ডব-লীলার অন্ত নাই, কারণ আমরা অবিরামগতি।
আমরাই দেশে দেশে মুক্তির ইতিহাস রচনা করে থাকি। আমরা শান্তির জল ছিটাতে এখানে আসি নাই। বিবাদ সৃষ্টি করতে, সংগ্রামের সংবাদ দিতে, প্রলয়ের সূচনা করতে আমরা এসে থাকি। যেখানে বন্ধন, যেখানে গোঁড়ামি, যেখানে কুসংস্কার, যেখানে সঙ্কীর্ণতা সেখানেই আমরা কুঠার হস্তে উপস্থিত হই। আমাদের একমাত্র ব্যবসায় মুক্তির পথ চিরকাল বণ্টকশূন্য রাখা, যেন সে পথ দিয়ে মুক্তির সেনা অবলীলাক্রমে গমনাগমন করতে পারে।
মনুষ্য জীবন আমাদের কাছে একটা অখণ্ড সত্য। সুতরাং যে স্বাধীনতা আমরা চাই—সে স্বাধীনতা ব্যতীত জীবনধারণই একটা বিড়ম্বনা-যে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুগে যুগে আমরা হাসতে হাসতে রক্তদান করেছি-সে স্বাধীনতা সর্বতোমুখী! জীবনের সকল ক্ষেত্রে সকল দিকে আমরা মুক্তির বাণী প্রচার করবার জন্য এসেছি। কি সমাজনীতি, কি অর্থনীতি, কি রাষ্ট্রনীতি, কি ধর্মনীতি-জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমরা সত্যের আলোক, আনন্দের উচ্ছ্বাস ও উদারতার মৌলিক ভিত্তি নিয়ে আসতে চাই।
অনাদিকাল হতে আমরা মুক্তির সংগীত গেয়ে আসছি। শিশুকাল হতে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আমাদের শিরায় শিরায় প্রবাহিত। জন্মিবামাত্র আমরা যে কাতরকণ্ঠে ক্রন্দন করে উঠি সে ক্রন্দন শুদ্ধ পার্থিব বন্ধনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জানাবার জন্য। শৈশবে ক্রন্দনই আমাদের একমাত্র বল থাকে কিন্তু যৌবনের দ্বারদেশে উপনীত হলে বাহু ও বুদ্ধি আমাদের সহায় হয়। যার এই বুদ্ধি ও বাহুর সাহায্যে আমরা কি না করেছি, ফিনিসিয়া, এসিরিয়া, ব্যাবিলোনিয়া, মিসর, গ্রিস, রোম, তুরস্ক, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, চীন, জাপান, হিন্দুস্তান—যেকোনো দেশের ইতিহাস পড়ে দেখো-দেখবে যে ইতিহাসের প্রত্যেক পৃষ্ঠায় আমাদের কীর্তি অনন্ত অক্ষরে লেখা আছে। আমাদের সাহায্যে সম্রাট সিংহাসনে আরোহন করেছেন, আবার আমাদেরই অঙ্গুলিসঙ্কেতে সভয়ে সিংহাসন ত্যাগ করে তিনি পলায়ন করেছেন।
আমরা একদিকে প্রস্তরীভুত প্রেমাক্ররূপী তাজমহল যেমন নির্মাণ করেছি, অপর দিকে রক্তস্রোতে ধরণীবক্ষ রঞ্জিত করেছি। আমাদের সমবেত শক্তি নিয়ে সমাজ, রাষ্ট্র, সাহিত্য, কলা বিজ্ঞান যুগে যুগে দেশে দেশে গড়ে উঠেছে; আবার রুদ্র করালমূর্তি ধারণ করে আমরা যখন তাণ্ডব নৃত্য আরম্ভ করেছি তখন সেই তাণ্ডব নৃত্যের একটা পদবিক্ষেপের সঙ্গে কত সমাজ, কত সাম্রাজ্য ধুলায় মিশে গেছে।
এতদিন পরে নিজের শক্তি আমরা বুঝেছি, নিজের ধর্ম চিনেছি। এখন আমাদের শাসন-শোষণ করে কে? এই নবজাগরণের মধ্যে সব চেয়ে বড়ো কথা সব চেয়ে বড়ো আশা-তরুণের আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ। তরুণের প্রভূত আত্মা যখন জাগরিত হয়েছে তখন জীবনের মধ্যে সকল দিকে সকল ক্ষেত্রে যৌবনের রক্তিমরাগ আবার দেখা দেবে।
এতদিন পরে নিজের শক্তি আমরা বুঝেছি, নিজের ধর্ম চিনেছি। এখন আমাদের শাসন-শোষণ করে কে? এই নবজাগরণের মধ্যে সব চেয়ে বড়ো কথা সব চেয়ে বড়ো আশা-তরুণের আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ। তরুণের প্রভূত আত্মা যখন জাগরিত হয়েছে তখন জীবনের মধ্যে সকল দিকে সকল ক্ষেত্রে যৌবনের রক্তিমরাগ আবার দেখা দেবে।
এই যে তরুণের আন্দোলন-এটা যেমন সর্বতোমুখী তেমনই বিশ্বব্যাপী। আজ পৃথিবীর সকল দেশে বিশেষ যেখানে বার্ধক্যের শীতল ছায়া দেখা দিয়েছে, তরুণসম্প্রদায় মাথা তুলে প্রকৃতিস্থ হয়ে সদর্পে সেখানে দণ্ডায়মান হয়েছে। কোন্ দিব্য আলোকে পৃথিবীকে এরা উদ্ভাসিত করবে তা কে বলতে পারে? ওগো আমরা তরুণ জীবনের দল, তোমরা ওঠো, জাগো উষার কিরণ যে দেখা দিয়েছে!
২ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩০
বই ম্যাসেজ ফর ইয়ংগার লেখক : সুভাষচন্দ্র বসু | Massage For Younger By Subhash Chandra Bosu book review
২ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩০
বই ম্যাসেজ ফর ইয়ংগার লেখক : সুভাষচন্দ্র বসু | Massage For Younger By Subhash Chandra Bosu book review
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....