বই : নৈর্ঋত জাহিদ হোসেন বুক রিভিউ

বই : নৈর্ঋত জাহিদ হোসেন
জনরা : আরবান ফ্যান্টাসি
প্রথম প্রকাশ : মার্চ ২০২২ 
দ্বিতীয় মুদ্রণ : এপ্রিল ২০২২
নামলিপি প্রচ্ছদ : মাহাতাব রশীদ
অলংকরণ : ওয়াসিফ নূর
প্রকাশনা : প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা
মুদ্রিত মূল্য : ৭০০ টাকা মাত্র
পৃষ্ঠা : ৫২০
Review Credit 💕 Peal Roy Partha



স্পয়লার-ফ্রি রিভিউ⚊ ❛নৈর্ঋত❜ 
বি.দ্র. আপনি যদি তিন গোয়েন্দার পাঁড় ভক্ত হয়ে থাকেন তবে বেশি কিছু না ভেবে, বইটি হাতে তুলে নিতে পারেন। এই বই শুধু নস্টালজিয়ায় ভোগাবে না, ভালো একটি কাহিনির পাশাপাশি রহস্যময় এক সত্তার সাথে পরিচিত করাবে আপনাকে। নাম তার—লিজার্ড কিং অ্যান্ড হি কেন ডু অ্যানিথিং... 

কৎচবীলকাড়কৃতাদিলঙচীলাধীঅপৃৎবিকঠৃৎগৃহীবকড়ৎতী...????

জেম ডগলাস মরিসন। সংক্ষিপ্ত বা জনপ্রিয় নাম জিম মরিসন। দ্য লিজার্ড কিং। প্রিয় শহর প্যারিসের রাস্তায় যখন রক গানের সুর ভেসে বেড়ায়, সেই সুরে যে কয়েকটি নাম মিশে থাকে; তাদের একজন জিম মরিসন। ছোটোবেলায় যাঁর বেশির ভাগ সময় কাটত লাইব্রেরিতে। সেখানে তিনি ব্যস্ত থাকতেন ফ্রেডরিখ নিৎসে, অ্যালেন গিন্সবার্গ, ফ্রাঞ্জ কাফকাদের নিয়ে। দ্রোহের আগুনে জ্বলা শুরু ঠিক তখন থেকে। কবিতার মধ্যে খুঁজে পেতেন নিজের উদ্দামতাকে। প্রশ্রয় দিতেন নিজের আগ্রহ ও নেশাকে। মনমালিন্য হতো পিতার সাথে। এইভাবে চলছিল মরিসনের জীবন। 

রক গানের আদিমতায় মত্ত থাকা মরিসন ১৯৬৫ সালের গ্রীষ্মে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু রে মানজারকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ব্যান্ডদল ‘দ্য ডোরস’। জগদ্বিখ্যাত এই ব্যান্ডদলের নাম শুনেনি, এমন সংগীত প্রেমী খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। পরপর দুটো অ্যালবাম শ্রোতা সমাদৃত ও কয়েকটি গান বিলবোর্ড টপ চার্টে উঠে আসায় ব্যান্ডদলটি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৬৮ সালে দ্য ডোরস-এর তৃতীয় অ্যালবাম ‘ওয়েটিং ফর দ্য সান’ মুক্তি পায়। সেই অ্যালবামের স্লিভে (Sleve) জিম মরিসন একটি কবিতা প্রকাশিত হয়; যা তিনি বহু আগে লিখে রেখেছিলেন। ‘দ্য সেলিব্রেশন অব লিজার্ড কিং’ নাম দিয়ে। সেখানে একটি লাইন ছিল— ‘I am the Lizard king, I can do anything. 

লিজার্ড কিং মূলত মিথিক্যাল ক্রিয়েচার। ❛নৈর্ঋত❜ উপন্যাসে এর প্রভাব বেশ গুরুত্ব সহকারে দেখানো হয়। নৈর্ঋত শব্দের বিশেষ্য হচ্ছে—দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকের মধ্যবর্তী কোণ। রাক্ষসবিশেষ। জিম মরিসনকে ট্রিবিউট দিতে লেখক এমন কিছুর সৃষ্টি করেছেন। এই ট্রিবিউট এখানেই সীমাবদ্ধ না। ❛নৈর্ঋত❜ আরবান ফ্যান্টাসি ঘরনায় লেখা হলেও, মিথলজির ছাপ স্পষ্ট। আমাদের প্রিয় গ্রিক মিথলজির খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ উক্ত বইয়ের কাহিনির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ক্যায়োসের মাধ্যমে গ্রিক মিথের যে শুরু তারও পূর্বের কাহিনি এই উপন্যাসে রয়েছে। সাথে আছে প্রমিথিউসকে শাস্তি হিসেবে জিউসের দেওয়া প্যান্ডোরার বাক্স। যে বাক্সে মানব জীবনের সকল সুখ, শান্তি, দুঃখ, কষ্ট, হাসি, কান্না, জরা, ব্যাধি, কৌতূহল ও আশা রয়েছে। সত্যি কি প্যান্ডোরার বাক্সে বা জারে এমন সব উপাদান রয়েছে না-কি অন্য কিছু দিয়ে প্যান্ডোরার হাতে এই বাক্স তুলে দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে? 

মিথলজি পাশে রেখে একটু আরবান ফ্যান্টাসি নিয়ে আলোকপাত বলি। যেন বইটি পড়ার পর কোনোকিছু অতিরঞ্জিত না লাগে। যদিও ফ্যান্টাসি পুরোটাই কল্পনা বা কাল্পনিক। তা অতিরঞ্জিত লাগাটাও স্বাভাবিক। তবে আপনি যদি স্টিফেন কিংয়ের ‘ইট’ এবং নেটফ্লিক্স সিরিজ ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’-এর একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে থাকেন তাহলে সেগুলো থোড়াই কেয়ার। ❛নৈর্ঋত❜ উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে রহস্য, থ্রিল থাকলেও পুরোটা আরবান ফ্যান্টাসির মোড়কে মোড়ানো। সাধারণত শহরের প্রেক্ষাপটে লেখা গল্প বা কাহিনিকে আরবান ফ্যান্টাসি বলে। যেখানে গোপন প্যাসেজওয়ে, ঘরবাড়ি বা আস্তানা থেকে থাকে। জাদুকরি ক্ষমতা, আধুনিক প্রযুক্তি অধিকন্তু অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারও এখানে ঘটে। পুলিশি তদন্তের দেখা মিলে, যা ❛নৈর্ঋত❜ উপন্যাসেও রয়েছে। যেখানে খুন হয়, খুনিকে ধরার যত ক্রিয়া সবই সম্পাদন করতে দেখা যায়। ক্ষেত্রবিশেষে বিভিন্ন ফোর্সের কার্যকলাপের দেখা মিলে। এই ফ্যান্টাসিতে ম্যাজিক থাকে লুকানো; অর্থাৎ একেবারে দেখা যায় না বললেই চলে। যা শুধু বলা বা হিন্টস দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। অনুমান ও অনুধাবন অবশ্য করা যায়। এই উপন্যাসেও এই রকম ম্যাজিক বা গাট ফিলিং-এর দেখা মিলেছে। গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি আরবান ফ্যান্টাসির আকর্ষণের কারণ তা হচ্ছে পপ কালচার রেফারেন্স প্রচুর থাকে।

❛নৈর্ঋত❜ উপন্যাসে প্রচুর পপ কালচারের দেখা মিলে। মরিসনের লিজার্ড কিংয়ের রেফারেন্স নিয়ে তো ইতোমধ্যে ধারণা দিলাম। বাকি যা-ই কিছু থাকে তার পুরোটা নব্বই দশক থেকে শুরু করে ২০০৩ সাল পর্যন্ত। কারণ গল্পের প্রেক্ষাপট ২০০৩ সালের ঢাকার মহাখালীর। সেই সময়ের তিন গোয়েন্দা, ঘনাদা, টেনিদা, ফেলুদা, টিনটিন, মোস্তফা গেম, ক্রিকেট খেলা নিয়ে উন্মাদনা, শচীন-লারার দৌরাত্ম্য, জর্জ বুশ-লাদেন নিয়ে রাজনীতির খবরাখবর, গ্রামীনফোন-একটেল সিম, সাইবার ক্যাফে-সহ এমন কোনো বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা—বোধহয় বাদ রাখেননি লেখক। যা নস্টালজিয়ায় ডুবে যেতে একপ্রকার বাধ্য করে। সবচেয়ে আকৃষ্ট করেছে তিন গোয়েন্দার রেফারেন্স এবং ফ্লেভার। ইস্টার এগ-ও কমতি ছিল না উপন্যাসে। যা সত্যিকার অর্থে লেখকের লিখনপদ্ধতিতে উঠে এসেছে। এমন অনুভূতি তখনই উৎপীড়ন করে যখন কেউ কঠিন অসুখে পড়ে। আমার মনে হয়, লেখন সে-রকম এক অসুখে পড়েছেন আর সেটা আমাদের মতো পাঠকদের মধ্যে সংক্রমিত করেছেন। ব্রাভো। এমন অসুখে বারবার পড়তে ইচ্ছা করে। 

লেখক যে মাদকতা ❛নৈর্ঋত❜ উপন্যাসের মধ্যে ছড়িয়েছেন, তার আরেকটি কারণ হলো সংগীতের ব্যবহার। ওনার ‘গিলগামেশ’ বইতেও এমন কিছু ছিল, যা খারাপ লাগা অনেক কিছুকে ভালো লাগাতে বাধ্য করেছিল। ❛নৈর্ঋত❜ এর চেয়ে কয়েক গুণ সরেস। আবারও সেই জিম মরিসন, আমাদের লিজার্ড কিং। সেই তৃতীয় অ্যালবাম এবং অ্যালবামের ‘স্প্যানিশ কারাভান’ গান... যার লাইনগুলো অন্য এক ঘোরে নিয়ে যায়। যেখানে শুধু শূন্যতার বিচরণ। যে অনুভূতিকে বলে ভাস্ট এম্পটিনেস অথবা নাথিংনেস... লেখক হয়তো এই শূন্যতাকে পূর্ণ করতে চেয়েছেন। আমিও সেটা স্বীকার করি এবং বলি—ইয়েস, আই নো ইউ ক্যান।

Carry me, caravan, take me away
Take me to Portugal, take me to Spain
Andalucia with fields full of grain
I have to see you again and again
Take me, Spanish caravan
Yes, I know you can

◆ পাঠ প্রতিক্রিয়া ও পর্যালোচনা—

    ❛নৈর্ঋত❜ ডার্ক টোনে সেট করা একটি কিশোর থ্রিলার উপন্যাস। যেখানে সুষ্ঠু ও সুবোধ বালক-বালিকার মুখোশ যেমন থাকে না, তেমনই থাকে না তাদের ক্রিয়াকলাপ। একজন টিনএজ ছেলেমেয়ে ঠিক যেমনটা আচরণ করে, কথাবার্তা বলে, নিষিদ্ধ জিনিস নিয়ে আগ্রহ থাকে—সবকিছু এই উপন্যাসে খুবই সাবলীল এবং যৌক্তিক উপায়ে দেখানো হয়েছে। আরবান ফ্যান্টাসির মিশ্রণ থাকাতে এই কাহিনিকে শুধু গোয়েন্দা উপন্যাস বলে চালিয়ে দিতে পারি না। কিশোর গোয়েন্দা ও পুলিশি তদন্তের যে কম্বিনেশন লক সেট করেছেন লেখক—তা সত্যি দুর্দান্ত। প্রতিটি বাঁকে যে থ্রিল, সাসপেন্স ও ভয়ের আবহ লেখক সংযুক্ত করেছেন—তা আকর্ষণীয় একইসাথে উপভোগ্য। 

কাহিনির শুরুটা উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে শুরু হলেও শেষটা নিয়ে সংকীর্ণ থাকাটা যথোপযুক্ত। তার ওপর জনরায় অনুযায়ী এমন ভয় থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সত্যি বলতে লেখকের ‘গিলগামেশ’ যে হতাশায় ঢেকে দিয়েছিল, তার পরে এমন বইয়ের শেষটা নিয়ে দোদুল্যমান পরিস্থিতিতে থাকাটা বাঞ্ছনীয়। তবে লেখক ❛নৈর্ঋত❜ উপন্যাসে এমন একটা সমাপ্তি দিয়েছেন, যা মনকে শান্ত আর আবেগী করে তোলে। যদিও কিছু প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া সম্বব নয়। লেখক হয়তো, আবারও বলছি হয়তো আরও ভিন্ন কোনো সমাপ্তি দিতে পারতেন; কিন্তু যতটুকু আর যে-ভাবে তিনি দিয়েছেন তাতে আমি সন্তুষ্ট। সবশেষে যে জার্নিটা আমি করেছি তা উপভোগ্য কি-না; এটাই মূল বিষয়। সব জার্নি যে শতভাগ সুখকর হবে তেমনটাও না। জীবনটা অংকের যোগ-বিয়োগের মতো, যেখানে খারাপ লাগা যুক্ত হলে ভালোটা দিয়ে বিয়োগ করতে হবে। কারণ, বেশি ভালো লাগা—খারাপও লাগার কারণও বটে। 

লেখকের লিখনপদ্ধতি নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নেই। ছোটো ছোটো বাক্য দিয়ে পুরো উপন্যাসটি সাজানো। এক বসাতে যা অনেক দূর টেনে নিয়ে যেতে বাধ্য। এমন ধরনের লিখনপদ্ধতি পার্সোনালি আমার পছন্দের। সেই সাথে শব্দের যে খেলা তা যেন উপরি পাওনা। যে-কোনো চিত্রকে চিত্রায়ণ করতে লেখক দারুণ সিদ্ধহস্ত। সব যেন খুব স্পষ্ট হয়ে চোখের সামনে নাচানাচি করে। 

❛নৈর্ঋত❜ উপন্যাসে সাবপ্লটের ছড়াছড়ি। মূল কাহিনির সাথে প্রত্যকটি সাবপ্লটের সামঞ্জস্য রয়েছে। তবে দুয়েকটি বাদ দিয়ে দিলে তেমন কোনো ক্ষতি হতো না। চারটি সাবপ্লটের মধ্যে দুটো অকার্যকর মনে হলো। লেখক হয়তো গল্প বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বলেই এমন কিছু রাখা। মূল কাহিনির মেদ হিসেবে সাবপ্লট দায়ী থাকলেও পড়তে খারাপ লাগেনি। কানেকশনের দিক দিয়ে চিন্তা করলে মাত্রাতিরিক্ত মনে হবে। অর্থাৎ জোর করে ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার মতন। 

কিছু তথ্যের রিপিটেড বিষয়টি যদিও একটু বিরক্ত লেগেছে। ‘গোল্ডেন অ্যাজ’ বা পিওর ডিটেকটিভ ফিকশনে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি বা একই কথা বারবার চরিত্রদের সংলাপের মাধ্যমে তুলে ধরার অর্থ আলাদা করে ধৈর্য শক্তির পরীক্ষা দেওয়ার মতোই। লেখক সসম্ভব তেমন কোনো ভাইব কাহিনিতে রাখতে চেয়েছেন। 

সাবপ্লটগুলো ভালো লাগার পেছনে কারণ হলো পপ কালচার রেফারেন্স। সত্তর, আশি দশকের দিকে যে বিষয়গুলো জনপ্রিয় ছিল সেগুলো লেখক সাবপ্লটের মাধ্যমে উপন্যাসে যুক্ত করেছেন। এখানে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা ঘটনা রাখা যেত বলে মনে করছি। যাহোক, আমার পড়তে ভালোই লেগেছে। 

চরিত্রায়ন এই গল্পে দারুণ শক্তিশালী। ছোটো থেকে বড়ো প্রত্যকটি চরিত্রের যে ডেপথ তা লক্ষণীয়। লেখক বেশ কিছু চরিত্রের জন্ম দিলেও তাদের অনেকে মাঝপথে হারিয়ে যায়, কিছু চরিত্র নতুন করে উদয় হয়। বর্তমানে মূল খুনের কাহিনির সাথে আরও একটি কাহিনির চালিয়ে যাওয়া কিছুটা অযৌক্তিক মনে হলো। বিশেষ করে আত্মহত্যার তদন্তটি। কেঁচো খুঁড়তে এমন সাপ না বের হলে বরং ভালো। এসব উটকো ঝামেলা। 

আরবান ফ্যান্টাসি পছন্দের জনরা, তিন গোয়েন্দার ডাই হার্ড ফ্যান, সংগীত নিয়ে অবসেশন এবং লেখকের লেখা আর চিন্তাভাবনার সাথে পরিচিত হলে তবেই ❛নৈর্ঋত❜ পড়তে বসুন। এই জার্নিটা পুরোই এপিক; অন্তত আমার মতে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খুব রসিয়ে উপভোগ করেছি। যে আগ্রহ নিয়ে পড়তে বসা তার পুরোটা উসুল হলো। এমন বই বারবার পড়ার সুযোগ হয় না, কালেভদ্রে হয়তো হয়। 

    ● গল্পের শুরু এবং কিছু প্রশ্ন—

মহাখালী এলাকায় বসবাস করা মুনীর শাফাকাত—সদ্য মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করা এক ডানপিটে কিশোর। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরও হাতে যে অফুরন্ত সময়; তা কোনোভাবে উপভোগ করতে পারছে না সে। সে-জন্য একমাত্র দায়ী তার ‘খাড়ুস’ বাপ। বাবা-মা, বোন ও ভাইকে নিয়ে তার বসবাস। কড়া নিয়মে বাধা মুনীরের দৈনন্দিন রুটিন। বাবার মাত্রাতিরিক্ত শাসনে অতিষ্ঠ সে। লুকিয়ে-চুরিয়ে বাইরে যাওয়া-আসা; আপাতত এই কাজ। ওদিকে তিন গোয়েন্দা, ফেলুদা, টেনিনা, ঘনাদা যে পড়বে সেই উপায়ও নেই। সব কাহিনি মুনীরের জানা, কয়েকবার করে পড়ে শেষ করা। নতুন কিছু নেই যে পড়বে। একদিন পুরানো বইয়ের স্তুপ ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে ‘হৈমন্তী’ নামের স্বাক্ষর করা কিছু উপন্যাস আর ইংরেজি কবিতার বই খুঁজে পায় সে। তাদের পরিবারে হৈমন্তী বলে তো কেউ নেই, তবে বইগুলো কার?

অন্য দিকে তার প্রাণের বন্ধু অভিজিৎ কুণ্ডু শুভ্রের ব্যাপার-স্যাপার আলাদা। নেই কোনো কড়া শাসন, আরামের জীবন। দিব্যি ঘুরে-ফিরে, হেসে-খেলে ছুটিটা উপভোগ করছে সে। কোনো খাওয়ারে অরুচি নেই। ভোজন রসিক এক কথায়। চাপার জোর যে-কারও চেয়ে বেশি। তিলকে তাল বানাতে ওস্তাদ। তেমনই একটা ঘটনা মুনীরকে শোনাতে ব্যস্ত সে। কিন্তু একটা ঘটনায় এসে থমকে যায় তাদের আলোচনা! যা আজও রহস্য। 

চট্টগ্রাম থেকে মহাখালীতে স্থানান্তরিত হওয়া আজমিন, ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রী। ক্রিকেট খেলা করেছে রপ্ত। শচীন টেন্ডুলকারের একনিষ্ঠ ভক্ত। খেলেও সারাদিন ক্রিকেট। টমবয় ট্যাগ পাওয়া আজমিন বাস করে ছোটো বোন আমব্রিন আর বাবা-মায়ের সাথে। ‘কুট্টুস’ নামে তার একটি কুকুরও রয়েছে। একমাত্র বান্ধুবী বলতে অরিন। শহরের এক প্রভাবশালী পরিবারের মেয়ে। যার সাথে আজমিনের একেবারে দহরম-মহরম সম্পর্ক। দু’জনে ও লেভেলের শিক্ষার্থী। আজমিনের হারিয়ে যাওয়া এক ডায়ারি খুঁজে বের করতে গিয়ে মুখোমুখি হয় এমন এক ঘটনার, যে ঘটনার সাথে সাদৃশ্য রয়েছে মুনীর-কুণ্ডুদের! 

মহাখালী কলেজ গেট সংলগ্ন বস্তির খালে বস্তাবন্দী একটা লাশ পাওয়া যায়। খন্ডবিখন্ড লাশ। কেউ লাশের হাত-পা-মাথা সুন্দর করে কেটে ট্যাগ দিয়ে রেখেছে। হাতের সাথে হাত লেখা ট্যাগ, পায়ের সাথে পা আর মাথার সাথে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা মাথা। হাত-পা-মাথা সব একসাথে। পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন, সাজানো গুছানো। 

লাশের পরিচয় পাওয়া যায়। মিথিলা ফারজানা। বনানী বিদ্যানিকেতনের ছাত্রী। ক’দিন পরই যার এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা। টুকরা-টাকরা দেহাংশের সাথে পাওয়া যায় ২৯ টা লেজবিহীন টিকটিকি ও একটা ছোট্ট চিরকুট। চিরকুটে লেখা:

লিজার্ড কিং ফিরে এসেছে

মিথিলা ফারজানার ঘাড়ের পিছনে লেজহীন টিকটিকির ট্যাটু এঁকে রাখা, তার পিঠে বড় করে অচেনা ভাষায় একটা শব্দ লেখা:

Πανδώρα

ঘটনাচক্রে জড়িয়ে পড়ে মিথিলা ফারজানার দুই সহপাঠী লম্বু মুনীর শাফকাত ও ভোটকা অভিজিৎ কুন্ডু। জড়িয়ে পড়ে দুই বান্ধবী আজমিন-অরিন ও চারপেয়ে এক জন্তু। কুট্টুস। এই চারমূর্তি কি পারবে মিথিলা ফারজানা হত্যা রহস্য উদঘাটন করতে? অন্ধকার টানেলে আলোর রেখা খুঁজে নিতে? নাকি নিকষ কালো আঁধার গ্রাস করে নিবে ওদের?

রহস্যময় এ খুনের দায়িত্ব পায় গুলশান থানার চৌকস অফিসার ফজলে নূর। তদন্তে বেরিয়ে পড়ে একই ধাঁচে খুন হয়েছে আগেও। খন্ড-বিখন্ড লাশ মিলেছে, চিরকুট মিলেছে। মিলেছে অচেনা ভাষার ঐ লেখাটাও:

Πανδώρα

কথাটার মানে কী? কী চায় এই খুনী? কেইবা এই লিজার্ড কিং? 

────────────────

উপন্যাসের শুরুতে বস্তাবন্দি লাশের বিবরণ। এর পরে লেখক সরাসরি চলে যায় ক্যারেক্টর বিল্ডাপে। শুরুটা হয় মুনীরকে দিয়ে। তার দৈনন্দিন জীবন, ভালো লাগা-খারাপ লাগা ইত্যাদি নিয়ে। উঠে আসে তার পরিবারের আদ্যোপান্ত। গল্পের মোড় এর পরে একে একে ঘুরতে থাকে কুণ্ডু, আজমিন-অরিনদের ঘিরে। কীভাবে তারা সবাই এক জোট হলো সেই কাহিনি সুন্দর করে সাজানো। চৌকস অফিসার ফজলে নূরের তদন্ত নিয়ে অগ্রগতি এবং করণীয় কাজের সাথে নিজের জীবনের টানাপোড়েনের যে অবস্থা তাও তুলে ধরা হলো। এর পরে কীভাবে চার মূর্তি আর ফজলে নূর একই সরলরেখায় মিলিত হয়ে তদন্ত পরিচালনা করতে থাকে—সেই কাহিনি বেশ রোমাঞ্চকরভাবে উপস্থাপন করা হয়। 

    ● গল্প বুনট » লিখনপদ্ধতি » বর্ণনা শৈলী—

লেখকের গল্প বুননের কৌশল দারুণ। অতীত-বর্তমান নিয়ে দারুণ খেলা করতে পারেন। ওনার সাবপ্লটগুলো হচ্ছে মূল অস্ত্র। বর্তমান কাহিনির উত্তর খুঁজতে সাবপ্লটে চোখ রাখাটা বাঞ্ছনীয়। খুবই ধীরে ধীরে কাহিনি এগিয়ে নিলেও, পড়তে কিন্তু ততটা সময় ব্যয় হয় না। তরতর করে পড়ে নেওয়া যায়। প্রতি অধ্যায় বা পর্ব শেষে, পরের পর্ব নিয়ে যে রহস্য লেখক রেখে দেন—তার জন্য নিজেকে থামিয়ে রাখা কষ্টকর। গল্প বলাতে লেখক অতুলনীয়। 

লিখনপদ্ধতিতে লেখকের নিজস্ব একটা প্যাটার্ন ফলো করেন। সেখানে সাবলীলভাব আছে, স্বকীয়তা আছে। সবকিছুর মিশ্রণ থাকলে, কোনটা ডাল আর কোনটা চাল; তা বেছে বেছে আলাদা করা যায়। পপ কালচার রেফারেন্স, ইস্টার এগ, মূল কাহিনি, অতীতের কাহিনি, সংলাপ, চরিত্র বিল্ডাপ সব যেন তুড়ি দিয়ে যথাস্থানে বসিয়ে দেন তিনি। প্রত্যকটি বিষয়, ঘটনা উপলব্দি করার মতো শব্দ চয়ন ও বাক্য গঠনে লেখক অপ্রতিরোধ্য। এমন লেখার প্রশংসা না করে পারা যায় না। যদি এই উপন্যাসে পিওর সাহিত্য শব্দ আর বাক্যের সংমিলিত প্রয়োগ ঘটত, নিশ্চিত বলতে পারি ৮০০+ পৃষ্ঠা অনায়াসে অতিক্রম করত। বিস্তারিত যে একেবারে ছিল না তেমনও না, কিন্তু লেখক খুব যত্নে কাটছাঁট করে প্রতিটা শব্দ আর বাক্য বাছাই করে লিখেছেন। 

প্রত্যকটি ঘটনা যখন মস্তিষ্কের কোষ ঘুরে কল্পনার ঘরে জমা হচ্ছে, তা উপলব্ধি করার আনন্দ অন্য রকম। যে হিউমার লেখক সংলাপের মাধ্যমে দিচ্ছেন, যে ঘটনা উল্লেখ করছেন—সবকিছুর সাথে খুব সহজে নিজেকে কানেক্ট করে নিতে পেরেছি। যেন আমিও ওই উপন্যাসের চার মূর্তির একজন। আমি সেখানে ছিলাম, দেখেছি তাদের কথা বলা, উদ্‌বিগ্নতায় ডুবে থাকা। যে দৃশ্যায়ন বা স্থানের বিবরণ লেখক দিয়েছেন, নিমেষে যেন সেখানে নিজেকে হারিয়ে বসে আছি। এমন সবকিছু সম্ভব হয়েছে লেখকের মাপা বর্ণনা শৈলীর জন্য। যে-কেউ, অর্থাৎ যে-কোনো বয়সের পাঠক এই উপন্যাসের সাথে একাত্মতা জুড়ে দিতে সক্ষম।  

টিনএজ বয়সের যে আবেগ, ভয়, উদ্দীপনা, কড়া শাসন; প্রতিটি অনুভূতি নতুন করে আবারও আবিষ্কার করেছি। সেই সময়, সেই শৈশব, সেই কৈশোর। পুরাই নস্টালজিয়া।

    ● যেমন ছিল গল্পের চরিত্ররা—

এই চরিত্র নিয়ে বিস্তারিত বলতে গেলে, ছোটো একটা গল্প লেখা লাগে। এমন দারুণ আর রিয়েলিস্টিক সব চরিত্রের মেলা। বিশেষ করে মুনীর, কুণ্ডু, আজমিন, অরিন তো আছেই। সাথে আমব্রিন, অর্ঘ্য আর কুট্টুসের কথা আলাদা করে বলতে হয়। তিন গোয়েন্দার যে স্বাদ লেখক দিতে চেয়েছেন তা এই চরিত্রগুলোর মধ্যে পরিলক্ষিত। জিনার সাথে আজমিনের মিল, মুসার সাথে কুণ্ডু, রবিনের সাথে অরিন আর কিশোরের সাথে মুনীর। এমনকি আজমিনের বোন আমব্রিনের সাথে মুসার খালাতো বোন ফারিহার মিল পাওয়া। রাফিয়ানের মতো কুট্টুসের আচরণ, বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার কারণ; দারুণ লেগেছে। যদিও এখানে নির্দিষ্টভাবে চরিত্রগুলোর স্বভাব গঠন করা হয়নি, তবে ফ্লেভার একই ছিল। 

যেমন মুনীরের মধ্যে কিশোরের ছাপ আবার আজমিনের মধ্যেও ওই একই ছাপ লক্ষণীয়। অরিনের মধ্যেও একই স্বভাবের কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। ব্যতিক্রম ধরতে গেলে কুণ্ডু। স্বকীয়তা আছে। যাহোক, আমার চরিত্রগুলো এক কথায় দারুণ লেগেছে। পুরোনো কিশোর-মুসা-রবিনকে যেন ❛নৈর্ঋত❜-এর মধ্যে দিয়ে ফিরে পেলাম। 

বাদবাকি চরিত্রদের মধ্যে অফিসার ফজলে নূরকে দারুণ পছন্দ হয়েছে। ভেবেছি তিনি ফগর‍্যাম্পারকট-এর মতো তেমন কিছু হবেন; কিন্তু না! এই অফিসারের আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা খুবই বাস্তবিক লেগেছে। এ-ছাড়া মুনীরের পরিবার এই গল্পের দারুণ প্রভাব বিস্তার করেছে। আজমিনের পরিবারও রয়েছে। বাদবাকিদের অ্যাপিয়ারেন্স গল্পের প্রয়োজনে যথেষ্ট ছিল। 

মুনীর-কুণ্ডুর আরও কিছু বন্ধু রয়েছে, যাদের মধ্যে পিয়াল-কে দারুণ পছন্দ হয়েছে। নিজের নামের সাথে মিল দেখে এমনটা মনে হতেও পারে। অনেকটা নিজেকে যেন খুঁজে পেলাম। যদিও কিছু অভ্যাস পুরোপুরি উলটো। সব মিলিয়ে পার্শ্বচরিত্রগুলো ভালো লাগার মতো।

প্রভাবশালী বেশ কিছু চরিত্র রয়েছে, যা মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলেও চালিয়ে নেওয়ার মতো। উপন্যাসের গল্পটা পারিবারিক কেন্দ্রিক বেশি মনে হয়েছে। 

    ● শেষের গল্প বলা প্রয়োজন—

গল্পের শেষ পৃষ্ঠায় এমন একটা চিঠি আছে যা পড়ে ভেতর থেকে দলা পাকানো মিশ্র এক অনুভূতি উঠে আসে। খুব চেপেচুপে তা সহ্য করতে হয়। স্প্যানিশ কারাভানর সাথে আজমিনের লেখা চিঠিটার এত যোগসাজশ যা মন্ত্রমুগ্ধের পাশাপাশি আবেগী করে তোলে। এই চিঠির মাহাত্ম্য উপন্যাস শেষ করার পর শুধু অনুধাবন করা সম্ভব। 

শেষটা নিয়ে ‘গিমগামেশ’-এর মতো একগাদা সমালোচনা করব না। বলার মতো খুব বেশি কিছু না থাকলেও, নাটকীয়তা আছে। তবে সবই পূর্ব নির্ধারিত। অর্থাৎ পরবর্তী অধ্যায়ের নাট্যমঞ্চ কেমন হবে তার স্ক্রিপ্ট লেখক পূর্বের অধ্যায়গুলোতে বিভিন্ন ক্লু দিয়ে বলে দিয়েছেন। হুটহাট করে কিছু হয়নি। সবকিছু পূর্বপরিকল্পিত। খারাপ লাগা যদিও নেই, তবে সাবপ্লটের দুটো ঘটনার প্রয়োজনীয়তা আছে কি নেই তা ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি।

ত্রাস সৃষ্টি করা চরিত্র নিয়ে যে ভয় আর আলোচনা, তার উপস্থিতি এত সীমিত দেখে নিছক মন খারাপ হয়েছে বটে। আরেকটু, মানে আরেকটু বেশি টাইম দিলে কী হতো? খুব লাইটলি যেন ঘটানাটির সমাপ্তি টানা হয়েছে; সেটা অস্বীকার না করে পারলাম না। যেমন ক্লাইম্যাক্স আশা করেছি, তা মনঃপূত হয়নি। হয়তো পূর্বের ঘটনা, স্বপ্নের মাধ্যমে বিভ্রম ঘটানো ইত্যাদি মিলিয়ে এমন সমাপ্তি বেছে নেওয়া হয়েছে। তারপরেও ব্যাপ্তিটা বড্ড কম হয়ে গেল। 

শুরুর মতো শেষটাও অবশ্য আগ্রহ ধরে রাখতে সক্ষম। আরবান ফ্যান্টাসির যে স্বাদ তা পুরোপুরি পেলাম। তবে, অনেক পাঠক কিছু বিষয়ের ব্যাখা খুঁজতে চাইবেন! পূর্বেও বলেছি, এসব গল্পে ব্যাখা হলো কল্পনাতীত। পুরোটা উপভোগ করার মতো। যদিও পুলিশি কিছু তদন্তের বিষয় আছে। ফরেনসিক কাগজ-পত্র থাকে। তবুও তাদের বলতে চাই, সব তদন্তের কি সমাধান আসলে হয়? যেগুলোর হয় না, সেই রসহ্যের কূলকিনারা ঠিক কেন হয় না? উত্তর আছে কি? সব তদন্তে কি রাজনীতির নোংরা খেলা থাকে? অতিপ্রাকৃত বলতে কিছু থাকে না? 

পুলিশি তদন্তের বিষয়গুলো বাদ দিলে, মূল ঘটনার সূত্রপাত নতুন করে ভাবনার জন্ম দেয়। যদিও মিথলজি অনুযায়ী এমন সত্যতা যাচাই করা সম্ভব নয়। শেষ ৭০-৮০ পৃষ্ঠা আরেকটু দীর্ঘায়িত করা গেলে মন্দ হতো না। 

    ● খুচরা আলাপ—

❛নৈর্ঋত❜ উপন্যাসে উপলব্ধি করার মতো যে বিষয়টি আছে তা খুবই কমন। পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা, দ্বন্দ্ব, লোভ, পরকীয়া ইত্যাদি। অনেকটা সেভেন ডেডলি সিন্স বা ষড়্‌রিপু’র আদলে গড়া। কোনো অতিপ্রাকৃত সত্তার উপস্থিতি এই দুনিয়ার বেহুদা হয় না। নিশ্চয় কোনো যৌক্তিক কারণ অথবা কোনো গূঢ় রহস্যও থাকে। কোনো মানুষ দায়ী থাকে সকল অনর্থ বা অনিষ্টের মূলে। যা খুঁজে বের করা সময়সাপেক্ষ হলেও অসম্ভব নয়। কারণ, সত্য কখনও চাপা থাকে না। 

কালো জাদু, ব্ল্যাক ম্যাজিক, মন্ত্র-তন্ত্র, ভুডু যেমন জনপ্রিয় তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় এখন বিভিন্ন সংঘ, কাল্ট ও কমিউনিটি। যাদের কাজ থাকে অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া। ধর্মের নামে করা এসব মানুষগুলো যে আসলেই ধর্মবিরোধী; এই সত্যতা কেউ যাচাই করে না। আমরা নাস্তিকদের ঘৃণা করি, তাদের মানুষ বলে গণ্য করি না। কিন্তু এক পরিবারে থেকে যখন কোনো মানুষ এমন কিছু করে তখন সে-যে নাস্তিক থেকেও নিকৃষ্ট হতে পারে; ওইটুকু উপলব্ধি আর করা হয় না আমাদের।

❝আমার মনে হয়, ধার্মিক হওয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষ হওয়া। একজন ভালো মানুষ হওয়া।❞

❛নৈর্ঋত❜ উপন্যাসে একটি কাল্টের কার্যক্রম আছে। যা লেখক জিম মরিসনের সাথে কানেক্ট করেছেন। কাহিনিতে ডার্ক হিউমার, গালাগালি, যৌন বিষয়ক কথাবার্তা রয়েছে যা গল্পের সাথে যা সামঞ্জস্য। এসব ছাড়া আজমিন-অরিন, মুনীর আর কুণ্ডুকে ‘লুজার’ বলে সম্বোধন করা যা ‘ইট’ উপন্যাসের ‘দ্য লুজারস ক্লাব’-কে ট্রিবিউট দেওয়ার মতো অনেক ইস্টার এগের ছড়াছড়ি উক্ত উপন্যাসে রয়েছে; যা উপভোগ করার মতো।

◆ লেখক নিয়ে কিছু কথা—

   লেখকের দ্বিতীয় কোনো বই পড়া। গত বছর থেকে এই বইটির জন্য অপেক্ষা। বইমেলার আকাঙ্ক্ষিত বইয়ের একটি। অপেক্ষা দীর্ঘ হলেও আশা কিন্তু নিরাশায় পরিণত হয়নি। রূদ্ধশ্বাসে পুরো বইটি শেষ করেছি। শেষ করার পর যে শূন্যতা অনুভব করেছি তা প্রকাশ করার অনুভূতি আপাতত জানা নেই। যদিও বিশাল এক লেখা লিখে ফেলেছি। তারপরেও... জানা নেই।

লেখকের রিভেঞ্জ থ্রিলার সিরিজ এবং ডার্ক সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার আলোচিত-সমালোচিত ‘দুধ চা খেয়ে তোকে গুলি করে দিব’ যদিও এখনও পড়া হয়নি; তবে শীঘ্রই পড়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা থাকবে। পূর্বের পড়া ‘গিলগামেশ’ থেকে ❛নৈর্ঋত❜ বেশ কিছু জায়গায় এগিয়ে থাকবে। অন্তত আমি রাখব। লেখক সেই হিসাবনিকাশ করে যেন কাহিনিটির নীল নকশা এঁকেছেন। ভূমিকায় তিনি এ-ও বলেছেন, জীবনের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ একটি সময় উপন্যাসটি লিখেছেন। পাক্কা দু’বছরের শ্রমের বিনিময় আজকের ❛নৈর্ঋত❜। লেখকের উত্থান-পতনের ছাপও যেন এই উপন্যাসের পাতায় পাতায় সাঁটানো। 

    ● বানান ও সম্পাদনা—

বানান ভুল ছিল সামান্য, গিলগামেশের মতো বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা যে এই বইতে ঘটেনি; তার জন্য আমি দারুণ খুশি। টুকটাক যা-ই কিছু রয়েছে, তা এড়িয়ে যাওয়ার মতো। 

সম্পাদনায় অনেক ভুল লক্ষ করেছি। কিছু ভুলবশত করা ভুল। যা এত বড়ো উপন্যাসের তুলনায় সামান্য। এই যেমন চা খেতে খেতে কফি হয়ে যাওয়া, বুকডনে ৬৯+২১ = ১০০ হওয়া, ঈশান কোণের বদলে নৈর্ঋত কোণে তাকিয়ে কোনো একটা কাজ সম্পূর্ণ করা; এমন আরও টুকটাক সম্পাদনার অভাব লক্ষণীয়। 

কাহিনির ক্ষেত্রে কিছু বিষয় আর রিপিটেড সংলাপ আরেকটু কাটছাঁট করা যেত বলে মনে করছি। অসামান্য ভুল নিয়ে বলতে গেলে কিছুটা ‘স্পয়লার ডিসকাশন’ করতে হয়। তাই সেটা একেবারে শেষের জন্য তোলা রাখলাম। 

    ● প্রচ্ছদ » নামলিপি » অলংকরণ—

বছরের অন্যতম সেরা পছন্দের প্রচ্ছদ এখন ❛নৈর্ঋত❜। মাহাতাব রশীদ এমন দুর্দান্ত কাজ উপহার দিয়েছেন যে প্রশংসা যত বেশি করব তত কম করা হবে। নামলিপি যদিও আরেকটু বড়ো করে দেখালে ভালো হতো। দুটো প্রচ্ছদের মধ্যে কমলাটা সুন্দর। সাদাটাও কোনো অংশে কম না। 

অন্য দিকে বইয়ের ভেতরে বেশকিছু ইলাস্ট্রেশন রয়েছে যা এঁকেছেন ওয়াসিফ ভাই। ভালোই লেগেছে সেগুলো। 

    ● মলাট » বাঁধাই » পৃষ্ঠা—

দামি বইয়ের প্রোডাকশন দামি হওয়া দরকার। তবে সে-দিকটা দেখলে মলাট আর বাঁধাই শক্তপোক্ত হলেও, স্পাইনে দুর্বল মনে হলো। ৪০০ পৃষ্ঠা অতিক্রম করতে গিয়ে দেখি স্পাইন নড়বড় করছে। যদিও কোনো সমস্যা হয়নি। পৃষ্ঠার মানও ভালো। কনটেন্ট অনুযায়ী বলব, প্রোডাকশন ঠিকঠাক। 



❎ স্পয়লর ডিসকাশন:

১. লিজার্ড কিংয়ের দৈহিক গঠনের সাথে, খুনগুলোর কোনো সামঞ্জস্য খুঁজে পেলাম না। সাপের অবয়বে লিজার্ড কিং! মানে কোথায় টিকটিকি আর কোথায় সাপ! লিজার্ড কিং কেন সার্পেন্ট কিং? আবার সার্পেন্ট কিং কেন লিজার্ড হিসেবে পরিচিত? এই বিষয়টি ঠিক বোধগম্য হলো না। 

২. সার্পেন্টের সাথে লিজার্ড কিং তত্ত্ব ঠিক কোথায় যেন খাপ খেল না বলে মনে হলো। 

৩. ২৯টি খণ্ড লিজার্ড কিং কি লেজ দিয়ে করে না কীভাবে করে তা নিয়ে খোলাসা করা হয়নি। 

৪. আফরোজা সুলতানা যে কারণে লিজার্ড কিংয়ের শরণাপন্ন হোন, সেই কারণগুলোর মধ্যে কয়েকটি কারণ কৌতুকে মনে হয়েছে। তার ওপর তিন বার লিজার্ড কিংকে ডেকে এনে ছয়টি খুনের বলি দেওয়াটা ঠিক হজম হলো। বিশেষ করে কিটলু আর আবিদের বিষয়টি। 

এমন আরও কিছু প্রশ্ন উপন্যাস শেষ করার পরও থেকে গেল। যার উত্তর আমারও অজানা। তারপরেও ❛নৈর্ঋত❜ শৈশবকে রাঙানো এক মহাকাব্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ