অল্প আমল বেশি সাওয়াব , আলী আহমাদ মাবরুর । Olpo Amol Beshi Showab by Ali Ahmad Mabrur.

অল্প আমল বেশি সাওয়াব
লেখক : আলী আহমাদ মাবরুর
প্রকাশনী : দি পাথফাইন্ডার পাবলিকেশন্স
বিষয় : ইবাদত ও আমল
পৃষ্ঠা : 192, কভার : পেপার ব্যাক, সংস্করণ : 1st Published, 2022
ভাষা : বাংলা
Image


বর্তমান সময়ে আমরা অধিকতর ব্যস্ত সময় পার করছি ৷ নানা সঙ্কটে জীবন যাপন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ দিন রাত পরিশ্রম করেও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপন করা সম্ভব হয়ে উঠছে না ৷ গত ২০২০ সাল থেকে শুরু করে ২০২১ সালের প্রথম ক’মাস পর্যন্ত সারাবিশ্বকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল করোনার ভয়াবহতা ৷ যার ফলে অর্থনৈতিকভাবে কম বেশি সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় সাধারণভাবে জীবন যাপনেও দেখা দিয়েছে সীমাহীন সঙ্কট ৷ বাধাগ্রস্থ হয়েছে সকল কর্মকাণ্ড ৷ আগোছালো হয়েছে ধারাবাহিক কার্যক্রম ৷ শত বিপদ আপদ ও ব্যস্ততার পরও একজন মুসলিম হিসেবে আল্লাহ তা’আলার আদেশ মত ইবাদতের মাধ্যমে সুশৃংখল জীবন পরিচালনা করা আমাদের জন্য অপরিহার্য বিষয় ৷জনপ্রিয় লেখক আলী আহমাদ মাবরুরের লেখা “অল্প আমল বেশি সাওয়াব” বইটিতে আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছে শত বিপদ ও ব্যস্ততার মাঝেও অল্প সময়ে কী ধরণের আমল করে আল্লাহর নৈকট্য পাওয়া যেতে পারে ৷ দিন ও রাতের নিয়মিত আমলগুলির অপূর্ব বর্ণনায় লেখা এই বইটি আশাকরি সকল পাঠকের কাছে সময়োপযোগী একটি বহু মূল্যবান বই বলে গণ্য হবে ৷

                      প্রারম্ভিকা

আল্লাহ তা'আলা মানুষকে অনেক বেশি সম্মাননা দিয়েছেন। মানুষকে স্বীকৃতি দিয়েছেন আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে। আমরা এই পৃথিবীতে শেষ নবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর উম্মত হওয়ার সম্মানও লাভ করেছি। শেষ নবির উম্মত হওয়া বিরাট ভাগ্যের বিষয়। আমাদের জন্য রোজ হাশরের দিনেও অনেকগুলো বিশেষ সুবিধা অপেক্ষা করছে। আমরা যদি পার্থিব জীবনে নেক আমল করে যেতে পারি, তাহলে রোজ হাশরের দিনে রাসুলের (সা.) শাফায়াতও আমাদের নসীব হতে পারে।

কিন্তু এই উম্মতের আয়ু অনেক কম। স্বয়ং রাসুল (সা.) এর ওফাত হয়েছে তেষট্টি বছর বয়সে। বর্তমানে চিকিৎসা ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নের পরেও মানুষের গড় আয়ু খুব বেশি বৃদ্ধি পায়নি। অথচ, বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রযাত্রা আমাদের জীবনকে উন্নত ও সহজ করার জন্য যেমন নানা উপকরণ দিয়েছে, তেমনি পাপের ফাঁদে পড়ার মতোও অসংখ্য উপাদান ও উপকরণ যুক্ত হয়েছে। তাই আমরা পাপ করছি অহরহই। আমাদের পাপের ভিন্নতা ও বহুমাত্রিকতা অতীতের অনেক জাতি থেকেই অনেক বেশি। কেননা তখন প্রযুক্তি এতটা অগ্রসর ছিল না। জীবন উপভোগ করার এত সুযোগও বিদ্যমান ছিল না।

আয়ু কম, অথচ পাপ করার স্কোপ অনেক বেশি। এটা আল্লাহর ফায়সালা হতে পারে না। কারণ তিনি রহমানুর রাহীম। তিনি তাঁর সেরা সৃষ্টি মানুষকে অত্যধিক ভালোবাসেন। আর এই উম্মতের জন্য তাঁর নেয়ামত ও সুযোগ সুবিধার মাত্রাও অনেক বেশি। আল্লাহ পাক দয়া করে রাসুল (সা.) এর সম্মানে

এই উম্মতকে বিরাট এ সৌভাগ্য দান করেছেন। আল্লাহ তা'আলা এ উম্মতকে এমন কিছু দিন দিয়েছেন, এমন কিছু রাত দিয়েছেন, এমন মাস দিয়েছেন যা পূর্ববর্তী উম্মতকে দান করেননি। যেসব দিনে ও রাতে এবং মাসে ইবাদত করলে একজন ব্যক্তি হাজার বছরের ইবাদতত্কারীর চেয়ে বেশি সওয়াবের অধিকারী হয়ে যায়। উম্মতে মুহাম্মদীর বড়ো একটি প্রাপ্তি হলো, তারা ইবাদত করবে একদিন কিন্তু সওয়াব হবে সত্তর দিনের। ইবাদত করবে এক রাত, কিন্তু সওয়াব হবে হাজার রাতের। ইবাদত করবে এক মাস কিন্তু সওয়াব হবে সত্তর মাসের। এমন সব বরকতময় দিন-রাতের মহা সুযোগ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ উম্মতকে দান করেছেন।

আলী (রা.) থেকে বর্ণিত। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, 'তোমাদের মাঝে এমন কোনো লোক নেই, যার পরিণাম আল্লাহ তা'আলা জান্নাতে বা জাহান্নামে নির্ধারণ করে রাখেননি এবং সে দুর্ভাগ্যবান হবে নাকি সৌভাগ্যবান হবে, তাও লিপিবদ্ধ করেননি।'

তখন এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! তাহলে আমরা কি আমাদের ভাগ্যলিপির ওপর অটুট থেকে আমল করা ছেড়ে দেবো?

রাসুল (সা.) বললেন, 'যে ব্যক্তি সৌভাগ্যবান, সে সৌভাগ্যবানদের আমলের দিকে ধাবিত হবে। আর যে হতভাগাদের অন্তর্ভুক্ত- সে দুর্ভাগাদের আমলের দিকে ধাবিত হবে।' রাসুল (সা.) আরো বললেন, 'তোমরা আমল করো। প্রত্যেকের পথ সহজ করে দেয়া হয়েছে। অবশ্যই সৌভাগ্যবান লোকদের জন্য সৌভাগ্যের আমল করা সহজ করে দেয়া হয়েছে। হতভাগ্যদের জন্য দুর্ভাগ্যের আমল সহজ করে দেয়া হয়েছে। এরপর তিনি সূরা আল-লাইলের ৫ থেকে ১০ নং আয়াত তিলাওয়াত করলেন যেখানে আল্লাহ পাক বলেছেন:

“সুতরাং যে দান করে ও খোদাভীরু হয় এবং উত্তম বিষয়কে সত্যায়ন করে আমি তাদের জন্য সফলতা-সুখের পথ সুগম করে দেব। আর যে কৃপণতা করে ও বেপরওয়া হয়ে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অমুখাপেক্ষী মনে করে এবং উত্তম বিষয়াবলীকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে, আমি তার জন্যে কঠোর-বিফলতার পথ সহজ করে দেব।' (সূরা আল-লাইল, আয়াত : ৫-১০) (তথ্যসূত্র: মুসলিম, হাদিস : ২৬৪৭; ইসলামিক ফাউন্ডেশন : ৬৪৯০; ইসলামিক সেন্টার : ৬৫৪২) অর্থাৎ আয়ু কম হলেও আমাদের জন্য আমল করার সুযোগ অনেক বেশি রাখা

হয়েছে। আবার অল্প আমলে অনেক অনেক বেশি সাওয়াব দেয়ার পথও খোলা

রাখা হয়েছে। আল্লাহ অল্প আয়ুকে কাজে লাগানোর জন্য যেমন আমল করার সুযোগ রেখেছেন তেমনি আমলের মাধ্যমে হায়াত বৃদ্ধির পথও উম্মুক্ত করে দিয়েছেন। আবার পাপের কারণে আয়ু ও রিজিক কমে যাওয়ার ব্যবস্থাও করে রেখেছেন।

হযরত সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নেক আমল ছাড়া অন্য কিছুতে আয়ু বৃদ্ধি হয় না। দোয়া ছাড়া তকদির পরিবর্তন হয় না। আর পাপাচারের কারণেই মানুষকে তার জীবিকা থেকে বঞ্চিত করা হয়।' (ইবনে মাজাহ : ৯০)। এ হাদিসটি থেকে আমরা পরিষ্কার বার্তা পাই যে, নেক আমল করলে জীবনে বরকত আসে। যে যত বেশি নেক আমল করবে আল্লাহ পাক সে অনুপাতে তার আয়ু বাড়িয়ে দেবেন। অন্যদিকে, পাপের কারণে ব্যক্তির আখেরাত তো ধ্বংস হবেই, দুনিয়াতেও তার কোন কাজে বরকত হবে না। আমরা এ হাদিসটির মাধ্যমে আরো নিশ্চিত হতে পারি যে, দু'আর মাধ্যমে বান্দার নির্ধারিত ভাগ্যও পরিবর্তন হয়ে যায়। আমরা এও বুঝতে পারি যে, দু’আ না করলে বা নেক আমলের ঘাটতি হলে জীবনের সময়গুলো ফাঁকা থাকে না। গুনাহের কাজ দ্বারা সে শূন্যস্থান পূর্ণ হয়। আর গুনাহ জীবনে অভিশাপ ডেকে আনে। গুনাহের ফলে মানুষের দুনিয়ার জীবন বরবাদ হয়, রিজিকের পরিমাণ কমে যায়, আয়ু বৃদ্ধির পথও রুদ্ধ হয়ে যায়।

স্বল্প এ জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের কাজে লাগানোর চেষ্টা থাকা দরকার। প্রতিটি সময় নেক আমলের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করা দরকার। এ বইতে আমরা এমন কিছু আমলের কথা আলোচনা করবো, যা পালন করা খুবই সহজ। আমলগুলো করতে সময়ও অনেক কম লাগে। কিন্তু এর পুরস্কার অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, উঠতে বসতে অর্থাৎ জীবনের প্রাত্যহিক কাজগুলো করার ফাঁকেই আমরা এ আমলগুলো পালন করতে পারি। তবে, আমলগুলোর চুড়ান্ত ফায়দা হাসিলের জন্য কিছু বিষয় পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচনা করতেই হবে।

প্রথমত আমলগুলো করতে হবে ইখলাসের সাথে। নিয়তে যেন কোনো গাফলতি কিংবা ত্রুটি না থাকে। আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সন্তুষ্ট করা যেন আমাদের উদ্দেশ্য না হয়। দ্বিতীয়ত, আমল যারা করবেন তাদের ভেতরে তাওহীদের চেতনা যেন সুদৃঢ় থাকে। আল্লাহর একত্ববাদের প্রশ্নে যেন কোনো সংশয় না থাকে। শিরকের ছিটেফোঁটাও যেন নিজের মনে আশ্রয় না পায়।

কারণ শিরক এমন এক কবিরা গুনাহ- যা আমাদের আমলগুলোকে নষ্ট করে দেয়। যারা মানুষকে দেখানোর জন্য ইবাদত করবে, তারা গোনাহগার হবে এবং তাদের সব আমল বরবাদ হয়ে যাবে। আল্লাহ এ বান্দাদেরকে মুনাফিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন

‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে প্রতারণা করতে চায়। অথচ তিনিও তাদের সাথে প্রতারণা করতে সক্ষম। যখন তারা নামাজে দাঁড়ায় তখন আলস্যভরে দাঁড়ায়। তারা লোকদের দেখায় যে তারা নামাজ আদায় করছে, কিন্তু আল্লাহকে তারা কমই স্মরণ করে।' (সূরা নিসা : আয়াত ১৪২)

আল্লাহ আরো বলেন,

“(হে নবি) আপনাকে এবং আপনার আগে আসা সকল নবিকেই এ আদেশই দেয়া হয়েছিল যে, যদি আল্লাহর সাথে শরীক করা হয়, তাহলে আপনার কর্ম নিষ্ফল হবে এবং আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের একজন হবেন।” (সূরা আয যুমার: আয়াত ৬৫)

সুতরাং আমল করতে হবে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। আল্লাহর খুশি ছাড়া যারা আত্মপ্রচার ও নিজেদের সুনাম বৃদ্ধির জন্য আমল করবে তারা কখনোই প্রকৃত আমলদার নয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মানুষকে শুনানোর জন্য কাজ করে আল্লাহ তার বদলে তাকে (কেয়ামতের দিন) শুনিয়ে দেবেন। আর যে ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য কাজ করে আল্লাহ তার বদলে তাকে ( কেয়ামতের দিন) দেখিয়ে দেবেন।' (বুখারি ও মুসলিম) হাদিসে কুদসিতে এসেছে

হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, 'আমি শিরক থেকে সব অংশীদারের তুলনায় বেশী মুখাপেক্ষীহীন। যে কেউ কোনো আমল করে এবং তাতে অন্যকে আমার সাথে শরিক করে, আমি তাকে ও তার আমল উভয়ই বর্জন করি।' (মুসলিম)

শিরক যেমন উপাসনায়, সিজদায় তথা কাজকর্মের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হতে পারে আবার চিন্তা চেতনাতেও শিরকের প্রকাশ ঘটতে পারে। আল্লাহর নির্ধারিত আইনের চেয়ে অন্য কোনো আইন বা বিধানকে অগ্রাধিকার দেয়াও শিরক হিসেবে গণ্য হতে পারে। কারণ, আল্লাহ তা'আলা আর কাউকে

মানবতার জন্য বিধান বা আদর্শ প্রণয়নের সুযোগ দেননি। মোটা দাগে বলতে গেলে, যে বিষয়গুলো কেবলমাত্র এবং শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই প্রযোজ্য তার সাথে যদি অপর কাউকে মেলানো হয়, তুলনা করা হয়, তাহলে তাই হলো শিরক। শিরক নিয়ে আমাদের অনেকের মাঝেই সচেতনতা কম। যেহেতু আমরা মূর্তিপুজা বা সাধারণ অর্থে অন্য কোনো উপাসনাকেই কেবল শিরক হিসেবে বিবেচনা করি, তাই অন্যান্য যে পন্থায় বা পরোক্ষ উপায়ে শিরক সংঘটিত হতে পারে তা নিয়ে আমাদের অবহেলা থেকেই যায়। অথচ, শিরক নিয়ে সর্বোচ্চ পরিমান সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কারণ কোনো ব্যক্তি শিরকের মতো অপরাধের সাথে যুক্ত থাকলে তার কোনো ইবাদত বা আমল আল্লাহ গ্রহণ করেন না। এটাই তাওহীদি চেতনার দাবি। আল্লাহ মানুষের যে কোনো অপরাধ ক্ষমা করে দেন, তবে শিরকের অপরাধ মাফ করেন না। তাই যেকোনো আমল করার আগে বা আমল সম্বন্ধে জানার আগে তাওহীদকে মনে, চিন্তায় ও মস্তিষ্কে শতভাগ গেঁথে নেয়া অপরিহার্য।

আল্লাহ তা'আলার একটি নাম হলো আশ-শাকুর। ইমাম গাজ্জালি (র.) এই নামের ব্যাখ্যায় বলেন, “আশ-শাকুর হলেন সেই মহান সত্ত্বা যিনি অল্প পরিমান কাজের বিনিময়ে অনেক বেশি পুরস্কার দিতে পারেন। অল্প কয়েকদিনের কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে অনেক দীর্ঘ সময় সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বস্তি প্রদান করতে পারেন।” ইবনে হাজর (র.) বলেন, “একজন মুমিনের ন্যূনতম নেক আমলের সুযোগও অবহেলা করা উচিত নয় আবার ন্যূনতম পাপের বিষয়েও ছাড় দেয়া উচিত নয়। কেননা, মানুষ হিসেবে আমরা জানি না যে, কোন ক্ষুদ্র আমলটি আল্লাহকে অনেক বেশি সন্তুষ্ট করবে আর কোন সামান্য পাপটি আমাদেরকে খোদার রাগ ও ক্রোধের সীমানায় এনে ফেলবে।”

এ দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে সামনে রেখে আমরা এ বইতে আমাদের মহান রব তথা আশ-শাকুরের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই কুরআন ও হাদিসের আলোকে এমন কিছু সংক্ষিপ্ত আমলের কথা আলোচনা করার চেষ্টা করবো, যা বাস্তবায়ন করতে হয়তো বেশি সময় লাগবে না, বেশি শ্রমও দিতে হবে না। অথচ আমলগুলো করে আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বেশি উত্তম পুরস্কার অর্জন করে নিতে পারবো। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে এ আমলগুলো নিয়মিতভাবে পালন করার তাওফিক দিন। আমিন।

       মাত্র ৮ সেকেন্ড সময়ে যে আমল                   আপনি করতে পারেন

এই আলোচনাগুলো বারবারই প্রমাণ করবে যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কত মহান, কত উদার। তিনি আমাদের ওপর কতটা রহম করেছেন। আমাদেরকে কত বেশি সুযোগ দিয়েছেন। তিনি আমাদের কতটা ভালোবাসেন। আমাদের জন্য কত বেশি মঙ্গল কামনা করেন।

যদি আমাদেরকে প্রশ্ন করা হয়, এ পৃথিবীতে আমরা আছি, ভালো ভালো কাজ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু এর উদ্দেশ্য কী? তাহলে আমাদের অধিকাংশের উত্তরই হবে, “আমরা জান্নাতে যেতে চাই, জাহান্নামের কঠিন আগুন থেকে মুক্তি পেতে চাই।” সেই জান্নাত যা আল্লাহ তাঁর প্রিয় ও নেককার বান্দাদের জন্য বানিয়ে রেখেছেন তাই-ই আমাদের একমাত্র গন্তব্য।

আমাদের মধ্যে যে মানুষটি পাপ করে, আকন্ঠ গুনাহতে নিমজ্জিত হয়ে থাকে, সেও কিন্তু জান্নাতে যেতে চায়। সমাজে আমরা যাকে খারাপ মানুষ বলে জানি, তার জানাজায়ও তাকে ভালো মানুষ হিসেবে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য সবার চেষ্টা চোখে পড়ে। কারণ আমরা দুনিয়াকে স্থায়ী ঠিকানা মনে না করলেও

দুনিয়ার মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারি না। আবার পরকালকে স্থায়ী ঠিকানা জানলেও পরকালের চিন্তায় সবসময় নিজেদেরকে আবিষ্ট রাখতে পারি না। তেমনটা অবশ্য বাস্তবসম্মতও নয়। সবচেয়ে বড়ো কথা, আমরা পরকালের জন্য কষ্ট করতে রাজি না থাকলেও পরকালীন জীবনে পুরস্কার হিসেবে জান্নাত পেতে আগ্রহী। একটা মানুষও পাওয়া যাবে না, যে জাহান্নামে যেতে চায়। সবারই দু’আ ও চাওয়ার কেন্দ্রবিন্দুই হলো জান্নাত।

সেই জান্নাত, যা তৈরি হয়েছে সোনারুপার ইট দিয়ে। একটি রুপার ইট, তারপর একটি সোনার ইট, এভাবে গাঁথা হয়েছে। এর গাঁথুনির উপকরণ সুগন্ধি মৃগনাভি এবং কঙ্করসমূহ মণি-মুক্তার ও মাটি হলো জাফরান। জান্নাতে প্রবেশকারী লোক অত্যন্ত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবে, কোনো দুঃখ-কষ্ট ও অভাব-অনটন তাকে স্পর্শ করবে না। সে অনন্তকাল এতে অবস্থান করবে, আর মৃত্যুবরণ করবে না। না তার পরনের পোশাক পুরাতন হবে আর না তার যৌবনকাল শেষ হবে। (সহিহাহ, ২/৬৯২-৬৯৩; গাইয়াতুল মারাম, ৩৭৩)

সা'আদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যদি জান্নাতের কোনো জিনিসের এক চিমটি পরিমাণও (পৃথিবীতে) আসতে পারতো, তা হলে আসমান-জমিনের সকল স্থান আলোকিত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে যেত। কোনো জান্নাতি যদি দুনিয়াতে উঁকি দিত এবং তার হাতের অলংকার প্রকাশিত হয়ে পড়ত, তা হলে তা সূর্যের আলোকমালা ম্লান করে দিত, যেভাবে সূর্যের আলো নক্ষত্র সমূহের আলো ম্লান করে দেয়। (মিশকাতুল মাসাবিহ, ৫৬৩৭) আর বিপরীতে জাহান্নাম হলো সেই ভয়ংকর শাস্তির স্থান যেখানে আমরা কেউ যেতে চাই না।

মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় সৌভাগ্যবান তারা, যারা মরণের পর জান্নাত লাভ করবে। আর সবচেয়ে হতভাগ্য তারাই, যারা মরণের পর জাহান্নামে যাবে। জান্নাত এক অনাবিল শান্তির জায়গা। আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের ধৈর্যের বিনিময়ে তাদেরকে জান্নাত দান করবেন, রেশমী পোশাক পরিধান করাবেন। সেখানে তারা তাদের উচ্চ আসন সমূহে ঠেস দিয়ে বসবে। তারা সেখানে সূর্যের তাপ পাবে না, শীতের প্রকোপও অনুভব করবে না। জান্নাতের গাছের ছায়া তাদের উপর অবনত থাকবে। আর ফলমূল তাদের অধীনে থাকবে, তারা ইচ্ছেমত তা পাড়তে পারবে। তাদের সামনে রৌপ্য নির্মিত পাত্র ও কাঁচের পিয়ালা পরিবেশন করা হবে। সে কাঁচ পাত্রও রৌপ্য জাতীয় হবে।

আর সে পানপাত্রগুলি জান্নাতের সেবক চির বালকেরা পরিমাণমত ভর্তি করে রাখবে। তাদেরকে সেখানে এমন সূরাপাত্র পরিবেশন করা হবে, যাতে শুকনো আদার সংমিশ্রণ থাকবে। এ হবে জান্নাতের একটি ঝর্ণা যাকে সালসাবীলও বলা হয়। তাদের সেবার জন্য এমন সব বালক ছুটাছুটি করতে থাকবে, যারা চিরকালই বালক থাকবে। তোমরা তাদেরকে দেখলে মনে করবে এরা যেন ছড়িয়ে দেয়া মুক্তা। তোমরা সেখানে যেদিকেই দেখবে শুধু নিয়ামত আর নিয়ামত দেখতে পাবে। দেখতে পাবে এক বিরাট সাম্রাজ্যের সাজ-সরঞ্জাম, তাদের উপর চিকন রেশমের সবুজ পোশাক এবং মখমলের কাপড় থাকবে। তাদেরকে রৌপ্যের কংকন পরানো হবে এবং তাদেরকে তাদের প্রতিপালক পবিত্র পরিচ্ছন্ন শরাব পান করাবেন' (সূরা দাহর/ইনসান আয়াত ১২-২১)

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তা'আলা বলেন, আমি আমার নেক বান্দাদের জন্য এমন পুরস্কার প্রস্তুত করে রেখেছি, যা কখনও কোন চক্ষু দেখেনি, কোন কান শুনেনি এবং কোন অন্তর কখনও কল্পনাও করেনি (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৩৭১)। এই হাদীসের স্পষ্ট বিবরণ দেওয়া খুব কঠিন। কারণ আল্লাহ তা'আলা জান্নাতে মানুষের ভোগ-বিলাস আরাম-আয়েশের জন্য এমন কিছু ব্যবস্থা করে রেখেছেন যা মানুষের চোখ কোনোদিন দেখেনি। অথচ মানুষ পৃথিবীর অনেক কিছু দেখেছে। মানুষের কান কোনোদিন শুনেনি। অথচ মানুষের কান অনেক নতুন পুরাতন রাজাধিরাজের ভোগ-বিলাসের কাহিনী শুনেছে। মানুষের অন্তর কোনোদিন পরিকল্পনা করেনি। অথচ মানুষের অন্তরে অনেক কিছুরই পরিকল্পনা হয়। জান্নাত এ সকল পরিকল্পনার চেয়েও একেবারেই আলাদা।

ইবনে শাদ্দাদ (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি আল্লাহর কসম! পরকালের তুলনায় দুনিয়ার উদাহরণ হলো, যেমন তোমাদের কেউ সাগরের মধ্যে নিজের একটি আঙ্গুল ডুবানোর পর লক্ষ্য করে দেখুক আঙ্গুল কী পরিমাণ পানি নিয়ে আসল (মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৫৬)। এই হাদীসে বোঝানো হয়েছে আঙ্গুলের পানি এবং সাগরের পানি কম-বেশী হওয়ার

ব্যাপারে তুলনা যেমন, ইহকাল ও জান্নাতের তুলনাও তেমন। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি জান্নাতে সর্বাপেক্ষা নিম্নমানের হবে, তাকে বলা হবে তুমি  তোমার

আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করো। তখন সে তার আশা-আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করবে, আরও আশা-আকাঙ্খা ব্যক্ত করবে অর্থাৎ বারবার অনেক অনেক আশা প্রকাশ করবে। তখন আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন, কী তোমার আশা-আকাঙ্খা শেষ হয়েছে? সে বলবে হ্যাঁ। অতঃপর আল্লাহ বলবেন, তুমি যা আশা করেছো তা দেওয়া হলো এবং তার সমপরিমাণ দ্বিগুণ দেওয়া হলো (মুসলিম, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৫৩৮৫)।

এবার আমলের আলোচনায় যাওয়া যাক। আপনি জানেন কি? প্রতিদিন মাত্র ৮-সেকেন্ডের আমল একদিকে আপনাকে যেমন জাহান্নামের আগুন থেকে হেফাজত করবে অন্যদিকে জান্নাতে যাওয়ার পথও অনেকটা সুগম করে দিবে! এই আমলটি দিনে আমরা অনেকবার করতে পারি। যতবারই করি, হয়তো ৮-১০ সেকেন্ডের বেশি লাগবে না। এ আমলের সন্ধান আমরা পাই রাসুল (সা.) এর হাদিসে যা সংকলিত হয়েছে বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থ নাসাঈ, ইবনে মাজাহ ও তিরমিজি শরীফে।

আনাস ইবনু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ কোনো ব্যক্তি জান্নাতের জন্য আল্লাহ্ তা'আলার নিকট তিনবার দু'আ করলে জান্নাত তখন বলে, হে আল্লাহ্! তাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিন। আর কোনো লোক তিনবার জাহান্নাম হতে পানাহ (আশ্রয়) চাইলে জাহান্নাম তখন আল্লাহ তা'আলার নিকট বলে, হে আল্লাহ! তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিন। (তিরমিজি: ২৫৭২, নাসায়ী ৫৫২১, সহীহ ইবনু হিববান ১০৩৪, সহীহ আল জামি ৬২৭৫)। এক্ষেত্রে জান্নাতে যাওয়ার জন্য বলতে হবে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল জান্নাহ - যা বলতে মাত্র আট সেকেন্ড সময় লাগে। আবার জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্যেও তিনবার এই বলে দু’আ করতে হবে যে, “আল্লাহুম্মা আজিরনি মিনান নার।

প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় এ দু’আ গুলো পড়তে পারেন। নামাজের সিজদায় এ দু'আ পড়তে পারেন। রাতে ঘুমানোর আগেও এ দুটি দু’আ পড়তে পারেন। কল্পনা করা যায়, এই একটি দু’আর বদৌলতে জান্নাত আমাদের পাওয়ার জন্য সুপারিশ করবে, জাহান্নাম আমাদেরকে পানাহ দেয়ার জন্য সুপারিশ করবে। আল্লাহু আকবার। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সবাইকে এ দু'আটি করার, নিয়মিত আমল করার তাওফিক দিন। অন্যদেরকেও এ হাদিসটি জানিয়ে দিন এবং আমল করার সুযোগ করে দিন। আমিন।

আরো পড়তে অথবা দেখতে Hardcopy ক্রয় করুন।we Respect Every Author Hardwork-boipaw team

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ