একাওরের দিনগুলি pdf download - জাহানারা ইমাম। Ekattarera dinaguli by Jahanara Imam.

একাওরের দিনগুলি । পিডএফ ডাউনলোড
জাহানারা ইমাম এর বই । 


ভূমিকা : দুর্বল রাজনৈতিক ভিত নিয়ে ১৯৪৭ সা

লে পাকিস্তানের সৃষ্টি ।
তার রাজনীতিবিদ ও নেতৃবৃন্দ ধর্মকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ঐক্যের একমাত্র বন্ধন হিসেবে বিবেচনা করতে থাকেন । নতুন এ রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকে পশ্চিম - পকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা যেভাবেই হোক ক্ষমতা হস্তগত করে নেন এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাঙালীদের ন্যায্য অধিকারকে অস্বীকার করে চলতে থাকেন । 

ফলে ১৯৪৭-৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালী সংস্কৃতিকেও দমিয়ে রাখতে অব্যাহত প্রয়াস চালিয়েছে পাকিস্তানী শাসকবর্গ 
 তাদের এই সুপরিকল্পিত হামলার প্রথম শিকার বাংলা ভাষা । এছাড়া আরো বিভিন্ন সূক্ষ্ম পন্থায় তারা বাঙালী সংস্কৃতিকে অবদমনের চেষ্টা চালাতে থাকে । যেমন পূর্ব - বাংলার দীর্ঘদিনের নাম পরিবর্তন করে পূর্ব - পাকিস্তান করেন , অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের পূর্বনাম বহাল রাখা হয় ।

 বহু বাঙালী কবি ও সাহিত্যিক এবং তাদের লেখাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এই অজুহাতে যে তারা পাকিস্তানী নন তাদের আদর্শিক ভিত্তি বা ধর্মীয় বিশ্বাস পাকিস্তানী মুসমানদের চাইতে ভিন্ন । পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঞ্জাবী , গুরুমুখী , গুজরাটী বা উর্দু কোন সাহিত্যিক , কবি অথবা তাদের রচনার বিরুদ্ধে এ ধরনের কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি । সার্বজনীন আবেদন থাকা সত্ত্বেও রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় ।

 পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা পূর্ব পাকিস্তানীদের পোশাক  ও আচার - আচরণেরও বিরূপ সমালোচনা করতে
 থাকে । আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে এই হামলা আরো প্রকট আকার ধারণ করে । রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘ ২৩ বছরের সহ - অবস্থানের পর একটি কথাই প্রমাণিত হয়েছে যে , এই বসবাস পারস্পরিক স্বার্থ - সংশ্লিষ্ট ও সমমর্যাদাপূর্ণ ছিল না । বাঙালীদেরকে তাদের ১২ শতাংশ জনগণের ভোটাধিকার হরণসহ তাবৎ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে এবং পরবর্তীতে দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতায় তাদের অংশ গ্রহণের অধিকারকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হয়েছে । পক্ষান্তরে পূর্ব পাকিস্তানীদের মতো কোন ত্যাগ পশ্চিম পাকিস্তানীদেরকে স্বীকার করতে হয়নি । ২৩ বছরে এটাও স্পষ্ট হয়ে উঠে যে , যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ব্যাপারে বাঙালীরা সবসময় গভীরভাবে আগ্রহী ছিল সেই গণতন্ত্রের পথ পশ্চিম পাকিস্তান বরাবরই রুদ্ধ করে রেখেছিল । 

প্রতিরক্ষা বিভাগের সদস্য ও রাজনীতিকরা এই প্রবণতাকে বাধা তো দেয়নি বরং কৌশলে উৎসাহিত করেছেন । ফলে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে , এই দু’পৃথক অঞ্চলের মধ্যে।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব শুধু মুখের ভাষায় নয় , রাজনৈতিক ভাষায়ও কোন মিল ছিল না । ভাষা ও সাংস্কৃতিক অধীনতা চাপিয়ে দেয়ার প্রয়াস , অর্থনৈতিক শোষণের প্রকৃতি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারকে অগ্রাহ্য করার প্রবণতা দেখে পূর্ব পাকিস্তানের জনমনে পাকিস্তান আন্দোলনের স্মৃতি ভেসে ওঠে । ভারতের হিন্দু ও মুসলমান মিলে যেমন জাতি গঠিত হতে পারেনি , তেমনি পাকিস্তান আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণের পূর্ববর্তী ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও জাতিসত্তার স্থায়ী বাঁধন গড়ে ওঠেনি । ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বৈরিতার প্রেক্ষাপটে দু'অঞ্চলের লোকদের মধ্যকার ধর্মীয় ঐক্য পাকিস্তানীদের জোটবদ্ধ করেছিল কিন্তু বৃটিশ - ভারত বিভক্তির পর এই নেতিবাচক কারণ দু'অঞ্চলের পাকিস্তানীদের ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য যথেষ্ট বা পর্যাপ্ত ছিল না । 

ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর অনুকূলে চলে গেলে এই প্রত্যাশাও বৃদ্ধি পায় যে হয়তো বা দেশে একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া গড়ে উঠবে এবং দেয়া - নেয়া ও বৃহত্তর সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি হবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে , সমস্যার সর্বোত্তম সমাধান হচ্ছে সংঘাতের ক্ষেত্র সংকোচিত করা এবং যোগাযোগ বৃদ্ধি । ফলে ব্যাপক ভিত্তিক আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী ভিত্তি লাভ করে । পাকিস্তানের দশ বছর পূর্তিতে বাঙালীদের অবস্থান সম্পর্কে কিন্তু ক্যালার্ড - এর উক্তি প্রণিধানযোগ্য । পরবর্তী তের বছর শুধুমাত্র সেই ধারণা নির্দেশিত পরিণতি নিশ্চিত করেছে । 
      “ বাঙালীদের ব্যর্থতা কিংবা তাদের প্রতিপক্ষের      ম্যাকিয়াভেলী ধাঁচের চাতুরির কারণে বাঙালীদের প্রভাব কখনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি । নাজিমুদ্দিন গভর্নর জেনারেল হয়েছিলেন কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা ছিল লিয়াকত আলী খানের কাছে । নাজিমুদিন প্রধানমন্ত্রী হন কিন্তু তার দৃঢ়তার অভাব ছিল এবং শেষ পর্যন্ত তিনি পাঞ্জাবী গভর্নর জেনারেল কর্তৃক বরখাস্ত  হন । প্রধানমন্ত্রী পদে বগুড়ার মুহাম্মদ আলীকে আনা হয় কিন্তু একজন বাঙালী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতের ক্রীড়নক এবং পশ্চিম পাকিস্তানীরাই ছিল তার সরকারের মূল চালিকা শক্তি । বাঙালী সদস্যরা তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার শক্তি কাজে লাগিয়ে গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা খর্ব করতে চেয়েছিলেন কিন্তু উল্টো নিজেরাই ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পড়েন ।

 পূর্ব বাংলার নির্বাচকমন্ডলী মুসলমানদের ভাষা ত্যাগ করে , ফল . হিসেবে তাদের উপর এক বছরেরও বেশী সময়ের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী আমলাদের শাসন চেপে বসে । সশস্ত্র বাহিনী ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী , জাতীয় সিভিল সার্ভিসেও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রাধান্য এবং ব্যবসা - বাণিজ্য , শিল্প - কারখানাও ছিল অনেকাংশে অবাঙালীদের হাতে । সংক্ষেপে বলা যায় , বাঙালীরা ছিল পাকিস্তানের প্রথম দশ বছরের ইতিহাসের নীরব দর্শক । 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ