Author শাহাদুজ্জামান
Publisher প্রথমা প্রকাশনী এর বই পিডিএফ
Quality পিডিএফ ডাউনলোড ফ্রি
ISBN 9789849140372
Edition 1st Published, 2017
Number of Pages 240
Country বাংলাদেশ
Language বাংলা
File Size 7 MB
Share Link boipaw dot com cloud
কভার ছবি : একজন কমলালেবু pdf |
"বরিশালের নদী, জোনাকি ছেড়ে তাঁকে পা রাখতে হয়েছে আদিম সাপের মতো ছড়িয়ে থাকা ট্রামলাইনের ওপর। পৃথিবীর দিকে তিনি তাকিয়েছেন বিপন্ন বিষ্ময়ে। বলেছেন সন্ধায় সব নদী ঘরে ফিরলে থাকে অন্ধকার এবং মুখোমুখি বসবার নাটোরের এক নারী"
"আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে,
সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়"
কলেজ জীবনের প্রেমিকা মন খারাপের প্রতিষেধক হিসেবে এই কবিতাখানা আহ্লাদে আধখানা হয়ে শোনাতে চাইতো বারবার। কিংবা বনলতা সেন নামের সেই কাল্পনিক প্রেমিকার কবিতা শুনতে চাওয়ার অকৃত্রিম আবদার। এক কমলালেবুর সৃষ্টি কে ঘিরে সমগ্র জনগোষ্ঠীর কী এক অপরিমেয় ভালোবাসার সৃষ্টি!
জীবনানন্দকে আমরা ঠিক যেভাবে শুনে আসছি আসলেই কি সেই জীবনানন্দের জীবন আর আনন্দ পরষ্পর সমার্থক ছিল?
এইকয়দিনে বেশ কয়েকজন কে একটা প্রশ্ন করেছিলাম। সুইসাইডাল একটা মানুষের নাম কীভাবে জীবনানন্দ হয়? অনেকের অনেক যুক্তি। কেউ একজন ভাবনাচিন্তা না করেই উত্তরটা দিয়েছিল ঠিক এভাবে,
"কারন ওনার নাম যিনি রেখেছেন তিনি সুইসাইডাল ছিলেন না, আর তিনি ভাবতেও পারেন নি উনি একদিন এমন হতাশাজনক ভাবে জীবনকে দেখতে শুরু করবেন"
এই উত্তরে আমার শতভাগ সন্তুষ্টি। জীবনানন্দকে নিয়ে যতটুকু জানলাম তাতে এই ব্যাপারটাকে কোনোভাবেই ফেলে দেওয়া যায় না। ছোটোবেলায়( স্কুলজীবনকে হয়তোবা আপনি বড়বেলাও বলতে পারেন) জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ার সময় অদ্ভুত এক ঘোরে থাকতাম। কবিতা বলতে তখন শুধু সেই পাঠ্যবইয়ের সিলেবাসে আবদ্ধ কবিতা। বোটানি পড়ানো সেই শিক্ষক নিজের সর্বোচ্চ মায়া মমতা দিয়ে আমাদের জীবনানন্দের কবিতা পাঠ করে শোনাতেন, বুঝিয়ে দিতেন। সেই কবি পরিচিতির একটা ক্ষুদ্র অংশ শুরু হয়েছিল তাঁর মায়ের পরিচিতির মাধ্যমে। হ্যাঁ! কুসুমকুমারী দাশ। মূলত মায়ের মাধ্যমেই জীবনানন্দের কবিতা লেখায় হাতেখড়ি। সেই সময় থেকে শব্দ অক্ষর আর ছন্দের মায়াজালে আবদ্ধ থাকা মা তাঁর সন্তানকে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন " কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে" উপমার বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে। মায়ের অনুপ্রেরণা আর দুঃসাহসিক অভিযানের কারণেই হয়তোবা আজকের এই জীবনানন্দ দাশ। "দুঃসাহসিক অভিযান " ঠিক কতটা তাৎপর্যপূর্ণ তা আমার পক্ষে লিখে বোঝানো সম্ভব না। সেই সময়ে ডাক্তারের পরামর্শে সবার বিরুদ্ধে গিয়ে ছেলে জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে দিল্লি যাওয়াটা আমার ক্ষেত্রে দুঃসাহসিক অভিযানের চেয়ে বরং বেশি কিছু। বিশ শতকের একজন মহিলা নিজের সন্তানের বন্ধুদের নিয়ে সাহিত্য সভার আয়োজন করে, গতানুগতিক পাঠপদ্ধতির বিরোধিতা করে জীবনকে বুঝতে চাওয়ার যে তাগিদ; সেটাই উপরের উত্তরকে পুরোপুরিভাবে সন্তুষ্ট করে। কুসুমকুমারী দাশ উনুনের পাশে বসে নিড়ানি হাতে নিয়ে শব্দের খেলা করেছেন, জীবনানন্দের কবি হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার জীবনটা কি ঠিক ততটাই সন্তুষ্টিতে ভরপুর ছিল? কিংবা জীবিত অবস্থায় আদৌও কি কবি হিসেবে যতটা পরিচিতি পাওয়ার ততটা পেয়েছিলেন?
"সকল লোকের মাঝে ব’সে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার পথেই শুধু বাধা?"
জীবনানন্দ তাঁর জীবনের প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছেন দুঃখ-দুর্দশা, অপ্রাপ্তি আর সীমাহীন যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে। ব্যাক্তি কিংবা পারিবারিক জীবনে সুখশান্তি তো ছিলোই না, কবি জীবনের ব্যর্থতা তাঁকে প্রতিনিয়ত বয়ে বেড়াতে হয়েছে।
সবাই যখন সমসাময়িক কবি লেখকদের লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত, ঠিক সে সময়টাতে তিনি আপন সত্তাকে পুরোপুরিভাবে সত্যের মানদন্ডে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর সমসাময়িক রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল কিংবা সত্যেন্দ্রনাথের লেখনশৈলীতে আবদ্ধ না থেকে নিজ কবিসত্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন দুঃসাহস নিয়ে। নানাদিক থেকে আসা তীরের জবাব দিয়েছেন কবিতার মাধ্যমেই। এমন সাদামাটা মানুষটাকে নিয়ে হাস্যরসের শেষ ছিল না কোনোকালেই।
আমারে সে ভালোবাসিয়াছে,
আসিয়াছে কাছে,
উপেক্ষা সে করেছে আমারে,
ঘৃণা ক’রে চ’লে গেছে—যখন ডেকেছি বারে-বারে
ভালোবেসে তারে;
তবুও সাধনা ছিলো একদিন–এই ভালোবাসা;
আমি তার উপেক্ষার ভাষা
আমি তার ঘৃণার আক্রোশ
অবহেলা ক’রে গেছি; যে-নক্ষত্র—নক্ষত্রের দোষ
আমার প্রেমের পথে বার-বার দিয়ে গেছে বাধা
আমি তা’ ভুলিয়া গেছি;
তবু এই ভালোবাসা—ধুলো আর কাদা।
পুরো কবিতার মধ্যে এই অংশটুকু আমার ভীষণ প্রিয়। উপরের পঙক্তিগুলো "বোধ" কবিতা থেকে নেওয়া। আমাদের চিরচেনা সেই কবিতাটা তখন সমসাময়িক কবিদের একজন "গোদ" নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। কি সেই বোধ? আদৌও কি তার সমকক্ষ কেউ ছিল না সেই সময়টাতে জীবনানন্দের "বোধ" নিজের বোধগম্য করতে?
হয়তো ছিলো না! নয়তো ছিল, সন্তপর্ণে পাশ কাটিয়ে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে গিয়েছেন। জীবনানন্দ তার ডায়েরিতে ইউরোপের এক কবির রেফারেন্স টেনে বলেছিলেন "আমি আগামী প্রজন্মের জন্য লিখি না, তার পরের প্রজন্মের জন্য লিখি"।
পাঠ্যবইয়ের কবি পরিচিতিতে পড়েছিলাম,
জীবনানন্দকে অনেকেই নির্জনতার কবি হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ চিত্ররূপময় বলেছিলেন। নির্জনতা জেঁকে বসলেও কবি জীবনানন্দের কবি জীবনটা চিত্ররূপময় যে ছিল না তা অনায়াসেই বোঝা যায়।
পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে যখন তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশ হয় তখন থেকেই নানা বাধা বিপত্তি সৃষ্টি হয়। ব্যক্তিজীবনে কবি অন্তুর্মুখী ছিলেন আজীবনই। মানুষের সঙ্গ তাঁর অসহ্য লাগত। সাহিত্যিক আলাপ আলোচনার মধ্যে অন্যেরা যদি হাজার হাজার কথা বলতেন, জীবনানন্দের মুখ থেকে বেরুতো দু-একটি নিস্পৃহ মন্তব্য। সবাই সাহিত্য আড্ডায় যেতে বললে সে আড্ডা এড়িয়ে যেতেন তিনি। সেই অন্তর্মুখিতা তাঁর কবি জীবনেও প্রভাব ফেলেছে বরাবরই। তাই হয়তো তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা সবেমাত্র ১৬২ টি। তাঁর লিখিত প্রায় আড়াই হাজার কবিতা, বিশটি উপন্যাস ও অজস্র ছোটগল্পের সবটুকু পড়ে ছিল ট্রাঙ্কে। তাঁর মৃত্যুর চল্লিশ বছর পর সেসব প্রকাশের মুখ দেখে।
আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত জীবনানন্দের প্রকাশিত অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্রের ভূমিকার প্রথমাংশ ঠিক এভাবে শুরু " জীবনানন্দ দাশ শুধু আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি নন, চৌদ্দ শো বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের একজন নায়ক। অমলেন্দু বসু বলেছিলেন জীবনানন্দ ইয়েটস এর চেয়েও বড় কবি। প্রচলিত আছে মৃত্যুর আগে কেউ কাউকে ভালো বলে না। জীবনানন্দের ক্ষেত্রে তা শত ভাগ সত্য। লিখেছিলেন
“ আমি বিশিষ্ট বাঙালিদের মধ্যে পড়ি না; আমার বিশ্বাস জীবিত মহত্তর বাঙালিদের প্রশ্রয় পাওয়ার মতনও কেউ নই আমি। কিন্তু আমি সেই মানুষ, যে প্রচুর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রতিটি দ্রব্যকে সোনা বানিয়ে তুলতে চায় অথবা মহৎ কিছু– যা শেষ বিচারে কোনও একটা জিনিসের-মতন-জিনিস– কিন্তু ভাগ্য এমনই যে তার খাদ্য জুটছে না। কিন্তু আশা করি, ভবিষ্যতে খাঁটি মূল্যের যথার্থ ও উপযুক্ত বিচার হবে; আমার ভয় হয়, সেই ভালো দিন দেখতে আমি বেঁচে থাকব না।“
"যাঁরা সাধারণ মানুষ থেকে উচ্চগ্রামে বাস করেন, তাঁদের কাছে জীবনের সীমা এবং সময় স্রোত কেমন একটা সমস্যার মতো দেখা দেয়"।
জীবনানন্দ স্রোতের টানে গা ভাসিয়ে দেওয়ার লোক ছিলেন না। জগতের সমস্ত নিয়ম তাঁর মস্তিষ্কে চিন্তার চাপ ফেলত। সেসময়ের আপেক্ষিক তথ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। এ জায়গাটায় একটা ভুল বুঝাবুঝি অনেকের মধ্যে হতে পারে। অথবা আমি নিজেই ব্যাপারটা ঠিক ততটা সঠিকভাবে নিজের ভেতরে ধারণ করতে পারি নি। এই যে " যাঁরা সাধারণ মানুষ থেকে উঁচু গ্রামে", ঠিক এই ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক কবিতায় নিজেকে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু জীবনানন্দ নিজেকে সেই উঁচু জায়গায় বসিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু নিজ নিজ মতাদর্শের ভিত্তিতে দুজন ঠিক একে অপরের বিপরীতে। সাধারণ হয়েও জীবনানন্দ আজ কত অসাধারণ!
পৃথিবী গাবে কি গান তোমার বইয়ের পাতা খুলে?
কিংবা যদি গায়,- পৃথিবী যাবে কি তবু ভুলে
একদিন যেই ব্যথা ছিল সত্য তার?
তাঁর কবিতার পৃথিবী আজ ঠিকই গান গাইছে। কিন্তু কি এমন ব্যাথার কথা বলেছিলেন তিনি?
"ভালোবেসে দেখিয়াছি আমি মেয়ে মানুষেরে
অবহেলা করে আমি দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে,
ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে "
জীবনের চরম দুর্দশার মধ্যে লেখা "বোধ" নামের এই কবিতার সমালোচনার মুখে পড়েন বেশ জোরালোভাবে। সজনীকান্ত বলেছিলেন,
"কবি জীবনে সব করিয়াই দেখিয়াছেন, খালি বিবাহ করিয়া মেয়ে মানুষেরে দেখেন নাই। দেখিলে ভালো হইত। গরিব পাঠকেরা বাঁচিত"।
শোভনার প্রেমে মগ্ন থাকা জীবনানন্দ নিজের ভালোবাসার মানুষকে কাছে পান নি। বিয়ে করেছেন তাঁর ঠিক বিপরীত চরিত্রের এক সুর্দশন মেয়েকে। সাংসারিক জীবনের প্রায় পুরোটাজুড়েই তাঁর অসন্তুষ্টি আর অপ্রাপ্তি তে ভর্তি। দু'দণ্ড শান্তি চাইছিলেন কবি। কোথাও একটা পৌঁছাতে চাইছিলেন। স্ত্রী লাবণ্য দাশ কবির সামগ্রিক জীবন নিয়ে কতটা অসন্তুষ্ট সেটা কবির মৃত্যুর পরে লাবণ্য দাশের বক্তব্যে বোঝা যায়।
" জীবনানন্দ বাংলা সাহিত্যের জন্য তো অনেককিছুই রেখে গেলেন, আমার জন্য কী রেখে গেলেন?"
জীবনানন্দ দাশ তাঁর সৃষ্টিকর্মের এক বিশালাংশ জীবিত অবস্থায় প্রকাশ করেন নি। মৃত্যুর পর তাঁর ট্রাঙ্ক থেকে উদ্ধার করে প্রায় চল্লিশ বছর পর সেসব প্রকাশিত হয়।
সৈকত আমিনের এক কবিতার বইয়ে (ভেঙে পড়ে পুলসিরাত) পড়েছিলাম
"কবিতা পাঠ করুন এমন ভাবে-
যেন মৃত্যু পথযাত্রীর কানে শেষবার
কালেমা শোনাচ্ছেন আপনি"
অন্যান্য প্রিয় কবিতার মতো বোধ কবিতাটা আমার কাছে ঠিক তেমনি মনে হয়। অমৃত মনে হয় সামগ্রিক জীবন। অস্তিত্বের রহস্যময়তা ও কালস্রোতে কুটোর মতো ভেসে যাওয়া জীবন নিয়ে লেখা কবিতা আজকাল আমাদের সকলের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জীবনানন্দের চাকুরী জীবনের বিভীষিকা বলে শেষ করা যাবে না। ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে একরকম বাধ্য হয়েই নিয়োজিত করেন। ফলশ্রুতিতে শিক্ষকতা জীবন নিজে তো উপভোগ করেননি, পাশাপাশি ছাত্রদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন বারংবার। চাকুরী জীবনের নিশ্চয়তা ছিল না কোনো বয়সেই। চল্লিশোর্ধ্ব হয়েও চাকুরির আশায় এদিকওদিক ছুটেছেন, অক্লান্তভাবে ক্লান্ত শরীর নিয়ে কলকাতা শহর দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। চাকুরী জীবনের যা আয় রোজগার তা দিয়ে নিজেই চলা দায়, পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিবেন কীভাবে? সন্তান কিংবা নিজের স্ত্রীর প্রতি কোনোদিক থেকেই সুবিচার করতে পারেননি মিলু। মিলু, জীবনানন্দ দাশ নামে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র নামে যাকে আজ আমরা চিনি।
লেখালেখি জীবনে প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হয়েছেন স্রোতের বিপরীতে গিয়ে। সেইসময়কার জনপ্রিয় লেখক বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দের পাশে না দাঁড়ালে হয়তোবা তাঁর কবি জীবনের সমাপ্তি ঘটতো জন্মানোর আগেই। নিজ স্ত্রীর কাছে কখনো নিজের লেখক সত্তার পরিচয় দিতে পারেন নি। একমাত্র নিজের পক্ষে কলম ধরার লোক বুদ্ধদেব বসু, পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে জীবনানন্দের কবিতা প্রকাশে যার সহযোগিতা শতভাগ। কলম হাতে জীবনানন্দের কবিতার সমস্ত সমালোচনার জবাব দিয়েছেন অকপটে। কিন্তু ওই যে, জগতের নিয়ম। সেই বুদ্ধদেব বসুর সাথেও জীবনের শেষ মুহূর্তে দ্বন্দ্ব জড়িয়ে যায়। তিথিডোর নামে এক উপন্যাস সম্ভবত এই ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে লেখা।
সুরঞ্জনা, শ্যামলী, সুদর্শনা, সবিতা, সুচেতনা, বিনতা, কল্যাণী, বিভা থেকে শুরু করে নীহারিকা মিত্র, অরুণিমা সান্যাল এবং বনলতা সেন এত এত কাল্পনিক চরিত্রের ভিড়ে আমরা জীবনানন্দের কবিতার মমার্থ বোঝার বৃথা চেষ্টা করছি বলে আমার মনে হয়। ভিন্ন সূত্র মতে জীবনানন্দ দাশের প্রথম প্রেম মনিয়া। তাঁর সারাজীবনের সমস্ত লেখা এই মনিয়ার উজ্জ্বল উদ্ধার। তবে শুরুতেই অবদমন। মনিয়া বাড়ির পরিচারিকার মেয়ে। জীবনানন্দ যে নীলনয়না মনিয়ার সঙ্গে মিলিত হবেন তাতে নিশ্চয় সমাজের স্বীকৃতি ছিল না। নিজের জীবনের প্রায় পুরোটাই অন্যের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিলেন তিনি। একজন কমলালেবু অনুযায়ী প্রথম কাব্যগ্রন্থ "ঝরা পালক" উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর একমাত্র ভালোবাসার মানুষ শুভনা কে, যাকে ঘিরে ভাবনায় মগ্ন থাকতেন লাবণ্য দাশকে বিয়ের পরও। এক আকাশ সমান অপ্রাপ্তি তাঁর জীবনে। সেই অপ্রাপ্তি ছড়িয়ে ছিল ব্যক্তি, পারিবারিক এবং লেখালেখির জীবনেও।
আত্নহত্যা?
মৃত্যু?
হত্যা?
সামগ্রিক বিবেচনায় বলা যায় আত্নহত্যা। জীবনানন্দ তাঁর ডায়েরিতে আত্নহত্যার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন বেশ কয়েকবার। এছাড়াও মৃত্যুর বেশ কয়েকদিন আগ থেকে প্রতিনিয়ত তিনি ট্রাম দুর্ঘটনার কথা অবচেতনভাবে সবাইকে বলতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত সেই ট্রামের চাপে সাতদিন হসপিটালে যন্ত্রনাভোগের পর মৃত্যু হয় তাঁর। কিন্তু ঠোঁট এবং চোখ নীল হয়ে যাওয়ায় অনেকেই ধরে নেন বিষপানে মৃত্যু হয়েছে তাঁর, নাকি হত্যা? মৃত্যুর ঠিক আগে তিনি কমলালেবু খেতে চেয়েছিলেন। জীবনানন্দ কমলালেবু ভালোবাসতেন। মৃত্যুর পর রোগীর পথ্য একটি কমলালেবু হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসতে চাওয়ার আকুতিভরা একটি কবিতা রয়েছে তাঁর। তাই হয়তো বইয়ের এই নাম।
আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশ এক স্বতন্ত্র কবি। লিখেছিলেন, ‘আমার মতন কেউ নেই আর।
কোনো এক কবিতা পড়ে ইচ্ছে হয়েছিল পাখি হবো। মুক্ত আকাশে উড়বো। তুলনামূলক বিশ্লেষনে ফড়িঙ হয়ে আছি। ফড়িঙ আমার কাছে আশ্চর্য সুন্দর সৃষ্টি মনে হয়। তাই হয়তো মানুষের দেখা পাই না,
‘যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের, মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা ...’
বাংলা সাহিত্যের প্রহেলিকাময় মানুষ জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে এক নিবিড় বোঝাপড়ায় লিপ্ত হয়েছেন বর্তমান সময়ের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান। জীবনানন্দের জীবনের এই রহস্য যেভাবে নিজ শব্দশৈলী দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন তা যে কাউকে মুগ্ধ করবে। আমার পড়া শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের তালিকায় নতুন নাম যুক্ত হলো আজ।
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ Protive Nitol
একজন কমলালেবু বই রিভিউ ২
Author শাহাদুজ্জামান
জীবনানন্দ দাসকে নিয়ে একটি গােটা উপন্যাস! আমি এটাকে উপন্যাস না বলে বলব জীবনালেখ্য। কী পরিমাণ গবেষণা করে ডা. শাহাদুজ্জামান এ বই লিখেছেন, তা অপরিমেয় হলেও অনুমেয়। জীবনানন্দের নিরানন্দ জীবন, প্রেমে ব্যর্থতা, চাকরিবিহীন কপর্দকহীন যৌবনের দীর্ঘ ৫ বছর, স্ত্রীর সাথে বন্ধনহীন দাম্পত্য আর কবিগুরু সহ বিদগ্ধ সমাজের অনেকের কাছে তীব্র অপমান সহ্য করা- এসব। একে একে যাদুকরের টুপির ভেতর থেকে কবুতর বের করার মতাে করে পাঠকের সামনে প্রামাণিক। দলিলসহ উপস্থাপন করেছেন তিনি। শুধু কবি নন, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক জীবনানন্দ দাশের সাথে পরিচয় করিয়েছেন আমাকে।
পাখির নীড়ের মতাে চোখ ছিল বনলতা সেনের। নাটোরের সেই নারী গণিকা ছিলেন, না বৃটিশবিরােধী। বিপ্লবী ছিলেন, তানিয়ে আমি ভাবিত নই। তাঁর চোখ নীড়ের মতাে কেন, তানিয়ে আমার ছিল সবিস্ময় কৌতূহল। জানলাম, নীড় নয়, নীড়ত্ব, অর্থাৎ আশ্রয় বােঝাতে এই উপমা ব্যবহার করেছিলেন জীবনানন্দ!!!
আজ থেকে ১১ বছর আগে আমার বাবার রহস্যঘন মৃত্যুর পর থেকে "আট বছর আগের এক দিন" কবিতাটি আমার বড় প্রিয়। "যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ" শিরােনামে আমি ৩ কিস্তির প্রবন্ধ লিখেছিলাম আব্দুর ৩ টি মৃত্যু দিবসে। কবিতাটা পড়লেই আমি চোখ খুলেও দেখতে পেতাম লাশকাটা ঘরে আলু চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের 'পরে! আমি প্রায়ই ভাবতাম, জীবনানন্দ এই কবিতা কাকে নিয়ে লিখেছিলেন? অথচ কী আশ্চর্য, এ কবিতা তিনি তাঁর নিজের আট বছর আগের তাঁকে নিয়েই লিখেছিলেন! তাঁর কবিতায় তিনি একদিকে যেমন তাঁর বেকারত্ব আর হতাশায় মুহ্যমান হয়ে আত্মহত্যাপ্রবণ নিজের সত্তাকে তুলে এনে তার মুখ দিয়ে বুলিয়েছেন, জীবনে সব পার্থিব কিছু পাওয়া হয়ে গেলেও জীবন। অর্থহীন লাগে, মরে যেতে ইচ্ছে হয়; অন্যদিকে সেই সত্তাকে বেঁচে থাকতে অনুপ্রাণিত করেছেন, খেলে যাওয়া ব্যাংএর বাঁচতে চাওয়া আর অন্ধ পেঁচারও ইদুর ধরার বাসনার কথা বলে, পিতামহীর সাথে। জীবনের ভাঁড়ারের শেষ উপভােগ্য উপাচার নি:শেষ করে বেঁচে থাকার আনন্দ উদ্যাপন করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। কী অদম্য তাঁর সেই জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার স্পৃহা! কবিতার এই ব্যাখ্যা পড়ে আমি নিজেও ভীষণ উজ্জীবিত।
শােভনা আর লাবণ্যকে ছাপিয়ে আমাকে বিমুগ্ধ করেন বুদ্ধদেব বসু আর ভূমেন্দ্র গুহ, যারা না থাকলে জীবনবাবুর কবি জীবনানন্দ দাস হওয়া হতাে না। অধ্যাপনা ছেড়ে যিনি আর কোন পেশাতেই যােগ দিতে পারেন নি, জীবনের সুখের সময় যিনি বাংলার প্রকৃতি বন্দনা করেছেন, কষ্টের সময়ও যিনি কবিতা আর গল্পেই খুঁজে পেয়েছেন দু'দন্ড শান্তি, তিনি যেন আমারই আগের জন্মের আমি! মিলু নামের সেই ছােট্ট মাতৃভক্ত ছেলেটির ভেতর, শােভনার ব্যর্থ প্রেমিকের ভেতর, লাবণ্যের অকর্মণ্য স্বামীর ভেতরে আমি আমার এক অদৃশ্য ছায়া খুঁজে পাই।
জীবনানন্দ পরিশেষে স্বেচ্ছায় ট্রামের তলায় চাপা পড়লেন, নাকি নিছক দুর্ঘটনা? সেও আমার পিতৃমৃত্যুর মতােই এক প্রহেলিকা!
(এখনাে আমার পড়া শেষ হয়নি.। বইটার কয়েকটারিভিউ বই কেনার আগেই পড়েছি। আমার এই রিভিউ ঠিক রিভিউ নয়, অনেকটা আত্মকথন হয়েই না হয় রয়ে যাক অন্তর্জালের কোন অজানা জটে...
বিনীত কাজী মিতুল)
একজন কমলালেবু ভিডিও রিভিউ
‘ একজন কমলালেবু' বইয়ের ফ্ল্যাপের কথাঃ
বরিশালের নদী, জোনাকি ছেড়ে তাঁকে পা রাখতে হয়েছে আদিম সাপের মতাে ছড়িয়ে। থাকা কলকাতার ট্রামলাইনের ওপর । পৃথিবীর দিকে তিনি তাকিয়েছেন বিপন্ন বিস্ময়ে । বলেছেন সন্ধ্যায় সব নদী ঘরে ফিরলে থাকে অন্ধকার এবং মুখােমুখি। বসবার নাটোরের এক নারী। জানিয়ে দিয়েছেন জ্যোৎস্নায় ঘাই হরিণীর ডাকে ছুটে আসা, শিকারির গুলিতে নিহত হরিণের। মতাে আমরা সবাই। সস্তা বাের্ডিংয়ে।উপার্জনহীনভাবে দিনের পর দিন কুঁচো চিংড়ি খেয়ে থেকেছেন। তবু পশ্চিমের মেঘে দেখেছেন সােনার সিংহ। পিপড়ার মতাে গুটি গুটি অক্ষরে। হাজার হাজার পৃষ্ঠা। ভরেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ডায়েরি লিখে। সেগুলাের সামান্য শুধু জনসমক্ষে এনেছেন জাদুকরের রুমালের মতাে, বাকিটা গােপনে তালাবন্দী করে রেখেছেন কালাে ট্রাঙ্কে। বাংলা সাহিত্যের প্রহেলিকাময় এই মানুষ জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে এক নিবিড় বােঝাপড়ায় লিপ্ত হয়েছেন এ সময়ের। শক্তিমান কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান তার। একজন কমলালেবু উপন্যাসে।
লেখক পরিচিতি
শাহাদুজ্জামান শাহাদুজ্জামানের জন্ম ১৯৬০ সালে ঢাকায়। পড়াশােনা মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। নেদারল্যান্ডসের আমস্টার্ডাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানে। পেশাগত ভাবে তিনি চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের গ্রামীণ স্বাস্থ্য প্রকল্পে, পরে অধ্যাপনা করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যের গ্লাসগাে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও অধ্যাপনায় যুক্ত আছেন। গল্প, উপন্যাস ছাড়াও প্রবন্ধ, অনুবাদ, ভ্রমণ ও গবেষণার ক্ষেত্রে রয়েছে তাঁর উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ। মাওলা ব্রাদার্স আয়ােজিত কথাসাহিত্যের পাণ্ডুলিপি প্রতিযােগিতায় শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়ে প্রকাশিত। হয় তার প্রথম গল্পগ্রন্থ কয়েকটি বিহ্বল গল্প (১৯৯৬)। কথাসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। Email : zshahaduz@gmail.com প্রচ্ছদ : সব্যসাচী হাজরা
শাহাদুজ্জামান সমসাময়িক বাংলা কথাসাহিত্যে মননশীল সাহিত্যিক হিসেবে শাহাদুজ্জামানের অবস্থান অনন্য ও অগ্রণী। গল্প, উপন্যাসেই বেশি পরিচিত হলেও শাহাদুজ্জামানের উল্লেখযােগ্য কাজ রয়েছে প্রবন্ধ, অনুবাদ, ভ্রমণ এবং গবেষণার ক্ষেত্রেও। লেখকের মতে, তিনি আল বেরুনীর মতাে দীর্ঘ নয়, বরং বিস্তৃত জীবনের আকাঙ্ক্ষা করেন। ১৯৬০ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন কথাশিল্পী শাহাদুজ্জামান। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশােনা শেষ করেন মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে। এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের গ্রামীণ স্বাস্থ্য প্রকল্পে। উচ্চতর শিক্ষার জন্য পরবর্তীতে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং নেদারল্যান্ডসের আমস্টার্ডাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে শাহাদুজ্জামান দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ বিভাগে। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যের গ্লাসগাে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও গবেষণা কাজের সাথে যুক্ত রয়েছেন। পারিবারিকভাবে সাহিত্যের যে ঘাের শৈশবেই আচ্ছন্ন করেছিলাে তা-ই শাহাদুজ্জামানের সাহিত্যিক হয়ে ওঠার পাথেয় হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৯৬ সালে মাওলা ব্রাদার্স আয়ােজিত কথাসাহিত্যের পান্ডুলিপি প্রতিযােগিতায় শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়ে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম ও ছােটগল্পগ্রন্থ ‘কয়েকটি বিহ্বল পাখি’। শাহাদুজ্জামান এর বই সমূহ ঠিক প্রচলিত উপন্যাসের গৎবাঁধা আঙ্গিকে ধরা যায় না। অনেক সাহিত্যবােদ্ধা তাই তাঁর লেখাকে ফিকশন-নন ফিকশন, পদ্য-কথাসাহিত্য, সবকিছুর মিশেলে ‘ডকু ফিকশান', আবার অনেকে মেটাফিকশান’ বলে রায় দিয়ে থাকেন। শাহাদুজ্জামান এর বই সমগ্র এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য ক্রাচের কর্নেল, আধাে ঘুমে ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে, একটি হাসপাতাল একজন নৃবিজ্ঞানী কয়েকটি ভাঙ্গা হাড়, ক্যাঙ্গারু দেখার শ্রেষ্ঠ দিন এবং অন্যান্য অনুবাদ গল্প, কয়েকটি বিহ্বল গল্প, মামলার সাক্ষী ময়নাপাখি, কাগজের নৌকায় আগুনের নদী, এবং কবি জীবনানন্দ দাশের উপরে লেখা উপন্যাস একজন কমলালেবু'। কমলা রকেটসহ বেশ কিছু চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও রচনা করেছেন শাহাদুজ্জামান। ২০১৬ সালে বাংলা কথাসাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পান বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার।
একজন কমলালেবু বই রিভিউ ৩
লেখক: শাহাদুজ্জামান
বইটি জীবনানন্দের জীবনী বলা চলে কিন্তু এমন ভাবে জীবনীটি লিখা হয়েছে যে "জীবনী"র মতাে মনে হবে না।
শাহাদুজ্জামানের লিখা নিয়ে অতিরিক্ত কিছু বলার নেই, তার লিখা যতই পড়ছি ততই তার কঠিন ভক্ত হয়ে যাচ্ছি।
বইটির প্রচ্ছদ খুবই সুন্দর, সেখানে দুটি চোখ দেখা যাচ্ছে। যা দেখলেই বুঝা যায় যে চোখ দুটো জীবনানন্দের। এই নাম শুনেনি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর এবং তার একটিও কবিতা পড়েননি এইরকম মানুষ পাওয়া ও দুষ্কর। নিজ থেকে না পড়লেও স্কুলের বইতে আমরা কমবেশি সবাই তার কবিতা পড়েছি।
আমার বাসায় "জীবনানন্দ কবিতা সমগ্র আছে, কবিতা পড়ার খুব অভ্যাস নেই তাই নিয়মিত পড়ানা। হলেও মাঝে মাঝে পড়তাম, ভালােই লাগতাে কিন্তু এখন বইটি শেষ করে তার কবিতা পড়তে আরও বেশি ভালাে লাগছে। এখন তার কবিতা পড়লে মনে হয় "আরে এই কবিকে তাে আমি খুব ভালাে করে চিনি। তখন পড়ার মধ্যে অন্য এক আনন্দ পাওয়া যায়।
নামের মধ্যে তার আনন্দ থাকলেও জীবনে তার আনন্দ খুব কমই ছিল। নানান সংগ্রাম করে জীবন কাটিয়েছেন।
বইটির নাম "একজন কমলালেবু" এটা দেখে আমার মতাে অনেকের মনেই প্রশ্ন আসে যে ।
জীবনানন্দের সাথে আবার "কমলালেবুর কি সম্পর্ক? জানতে চান, কি সম্পর্ক? তাহলে সময় এবং সুযােগ বুঝে পড়ে ফেলুন বইটি। সব প্রশ্নের উওর পেয়ে যাবেন।
বইটির প্রতি আপনাদের আগ্রহী করার জন্য "জীবনানন্দে"র কিছু তথ্য আপনাদের জন্য পেশ করছি।
১. তার কবিতার মধ্যে নজরুলের ছাপ পাওয়া যেত
২. দলবেঁধে আড্ডা দেওয়া তার কখনােই পছন্দ ছিল না
৩, ১৯২৭ সালে তিনি নিজের টাকায় প্রথম কবিতার বই প্রকাশ করেন
৪, ২০ বছর বয়সে তার প্রথম কবিতা ছাপা হয়। কোনাে এক নববর্ষের সংখ্যার প্রথম পাতায় কবিতাটি ছাপা হয়।
৫. বাসরঘরে তিনি তার স্ত্রীকে আবদার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের জীবন মরণ" গান গাইতে।
৬. বুদ্ধদেব বসুর "প্রগতি" পত্রিকাতে তার অনেক কবিতা প্রকাশ পেয়েছে
৭. সবাই যখন জীবনানন্দের বিপক্ষে ছিলেন তখন বুদ্ধদেব বসু নিজেই স্বার্থহীন ভাষায় বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ" নামে তার পক্ষে লিখেন।
৮, বইটিতে "শােভনা" নামে একটি চরিত্র আছে যাকে জীবনানন্দ পছন্দ করতেন। তার ডায়েরিরতে তিনি তাকে সংক্ষেপে BY নামে লিখতেন কারণ তার নাম ছিল বেবি
৯, তিনি সরাসরি পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন। তখন তার মা তাকে বলেছিলেন " শুধু স্কুলে পরিক্ষা পাসকরলে হবে না বাবা, চোখ কান খােলা রাখতে হবে। ভাবতে শিখতে হবে
১০. ধারণা করা হয়, তার প্রকাশিত - অপ্রকাশিত লিখা যােগ করলে প্রায় আড়াই হাজার কবিতা, ২০টি উপন্যাস, শতাধিক গল্প, ৫০ প্রবন্ধ, ৪০০০ পৃষ্ঠার ডায়েরি তিনি লিখেছিলেন।
এই ছিলাে বই নিয়ে আমার মতামত..
আসুন নিজে বই পড়ি অন্যকেও পড়তে বলি। পড়বে সারা দেশ,তাহলেইতাে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
জীবন আর আনন্দ- এই দুটি শব্দের সহযােগে গঠিত তাঁর নাম হলেও আদতে এই ব্যক্তিটির জীবনে যে আনন্দের ছিটেফোঁটাও ছিলাে না সেটা বললে অত্যুক্তি হবে না বলেই আমার বিশ্বাস। তিনি জীবনানন্দ দাশ। বরিশালের সর্বানন্দ ভবনে জন্ম তাঁর। বাবা সত্যানন্দ দাশ, মাকুসুমকুমারী দাশ.. এই বিষয়ে আর না এগুই। এগুলাে মােটামুটি জীবনানন্দপ্রেমী সবার কাছেই বিদিত। যে বিষয়টি প্রায় সকলেরই অবিদিত ও অগােচর তা হলাে তার যাবিক্ষুদ্ধ যাপিত জীবন, তাঁর প্রতিকূল পরিবেশে সাহিত্যচর্চা। যে 'বনলতা সেন', 'আবার আসিব ফিরে' পড়ে আজ আমরা মােহাবিষ্ট হয়ে হাততালি দিই তখনকার সময়ে এগুলাে মােটেও এমন সমাদৃত ছিল না, বরংকুড়িয়েছে একের পর এক সমালােচনার গ্লানি। 'বনলতা সেন' পড়ে সজনীকান্ত নামে এক সমালােচক জীবনানন্দের কট্টর সমালােচনা করেন। অনেক কানাঘুষা হয় এ নিয়ে। একের পর এক বিষবাণেবিদ্ধ হতে থাকেন। জীবনানন্দের সবচেয়ে বড় পাপ বােধহয় এই ছিল যে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, কাজী নজরুল ইসলামের সময়ে তাঁর লেখনী ধরেছিলেন। এই গুণী ব্যক্তিদের কাছ থেকে তিনি একমুহূর্তের জন্যেও কোনাে উৎসাহব্যঞ্জক কথা শােনেননি। প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঝরা পালক' প্রকাশিত হবার পর সেটার একখানা কপি তিনি স্বউদ্যোগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ডাকযােগে পাঠিয়ে মন্তব্য আশাকরলে রবীন্দ্রনাথ দায়সারা কয়েকটি বাক্যে তার প্রত্যওর দেন-যাতে মন্তব্যের চেয়ে অবহেলাই বেশি ছিল। কাজী নজরুল তাঁকে কবির কাতারে ফেলতে গিয়ে দ্বিধান্বিত হয়েছেন, প্রমথ চৌধুরী সময় করে পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখবেন বলেও শেষমেশ লিখেননি। একপ্রকার বাধ্য হয়েই 'ঝরা পালক 'নিয়ে তিনি দ্বারস্থ হয়েছেন সেসময়কার দাপুটে সমালােচক ধূর্জটিপ্রসাদের কাছে। ধূর্জটিবাবুও তাঁকে হতাশ করে একপ্রকার প্রকাশ্যেই। কবিতা অন্তপ্রাণ এই লােকটার যাপিত জীবন মােটেও নিরুদ্বেগ ছিল না। ব্রাহ্ম সমাজের মেয়ে লাবণ্য দশকে বিয়ে করার পরপরই রামযশ কলেজের চাকরিটা চলে যায় তাঁর। চাকরি হারানাের সাথে সাথে জীবনের খেইও যেন হারিয়ে ফেলেন তিনি। বেড়ে যায় দাম্পত্য দুরত্ব। এইসময় তাঁর রচিত সকল । উপন্যাস ও গল্পতেই এর সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। জীবন প্রণালী উপন্যাস, বাসর রাত, চাকরি নেই, বত্রিশ বছর পর, আঘ্রাণের শীত, প্রেমিক স্বামী-সব গল্পেরই সারকথা হলাে চাকরি হারিয়ে দিকভ্রান্ত পুরুষের মানসিক পীড়ন এবং স্ত্রীসঙ্গের অভাব। এমন অসামান্য প্রতিভাধর ব্যক্তিটির প্রতিভার স্বীকারােক্তি খুব কমসংখ্যক মানুষের কাছ থেকেই। পাওয়া হলাে। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখার পরেও সেগুলি ছাপাখানায় না গিয়ে স্থান পেলাে তাঁর কালাে ট্রাঝে। নিদারণ হতাশায় পড়ে একেকসময় আত্মহত্যার কথাও চিন্তা করলেন তিনি। বিভিন্ন কবিতায় উঠে এলাে। আত্মহত্যার প্রসঙ্গ। যথারীতি সমালােচিত হলেন তিনি। সেসময় কারাে লেখনীতে আত্মহত্যার এমান। জোরালাে সমর্থন পাওয়া যায়নি কিনা! তিনি একেক সময় একেক পদ্ধতি অবলম্বন করে মরতে চাইলেন। কখনও গলায় দড়ি দিয়ে, কখনওবা সপরিবারের সমুদ্রের জলে ডুবে। কী অদ্ভুত, তাই না? তারপর এলাে সেই দিন। ১৪ অক্টোবর ১৯৫৪ সাল। এই অভিমানী, নির্জন মানুষটা জ্ঞানত কিম্বা। অজ্ঞাতসারেই ট্রাম চাপা পড়লেন। ট্রামের ক্যাচারের ভেতর থেকে যখন তাঁকে বের করে আনা হলাে তখন তাঁর অবস্থা সুবিধাজনক না। "আমার নাম জীবনানন্দ দাশ, ওই ল্যান্সডাউন রােডে থাকি, ১৮৩ নাম্বার বাড়ি" বলেই এলিয়ে পড়লেন রাস্তায়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলাে তাঁকে। মৃত্যুপথযাত্রী জীবনানন্দ শুভাকাঙ্ক্ষী ও বন্ধু সঞ্জয়ের কাছে আবদার করলেন কমলালেবু খাবেন বলে। কমলালেবু নিয়ে তিনি একবার একটা কবিতাও লিখেছিলেন: "একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে? আবার যেন ফিরে আসি। কোনাে এক শীতের রাতে। একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে কোনাে এক পরিচিত মুমূর্ষের বিছানার কিনারে, কী ভয়ানকরকমের সাযুজ্য! আটদিন অসহ্য যন্ত্রণা ভােগের পর ২২ অক্টোবর নীরবে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আর আমরা হারিয়ে ফেললাম একজন উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ব্যক্তিকে.. পুরাে বইটা পড়তে আমার দারুণ সময় লেগেছে। এই বইটি না পড়লে জীবনানন্দ নামক ব্যক্তিটি সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানা হতাে না আমার। সত্যি বলতে বইটি পড়তে গিয়ে প্রচুর হােচট খেয়েছি। লােকটা এত দুঃখী ছিল! এত কষ্ট আর উপেক্ষা সহ্য করে বেঁচে থাকতে হয়েছিল তাঁকে! পরিশেষে 'একজন কমলালেবু' এক আশ্চর্য রহস্যভেদী বই। গােটা জীবনানন্দকে জানতে গেলে এই পড়ার বিকল্প নেই ।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....