সুন্নাহ প্রতিদিন লেখক : ড. রাগিব সারজানী | Sunnah Protidin By Dr. Ragib Sarjani | ইসলামী বই রিভিউ

বই: সুন্নাহ প্রতিদিন -
লেখক : ড. রাগিব সারজানী
প্রকাশনী : মাকতাবাতুল হাসান
বিষয় : দুআ ও যিকির
পৃষ্ঠা : 609, কভার : হার্ড কভার
ভাষা : বাংলা
সুন্নাহ প্রতিদিন লেখক : ড. রাগিব সারজানী | Sunnah Protidin By Dr. Ragib Sarjani | ইসলামী বই রিভিউ
ছবি : সুন্নাহ প্রতিদিন লেখক : ড. রাগিব সারজানী

সুন্নাহ প্রতিদিন হলো মুসলিমদের জন্য একটি মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এর একটি সুন্নাহ গাইড। এবং এটি রচনা করেছেন জনপ্রিয় ইসলামী লেখক  ড. রাগিব সারজানী। আরবী ক্যালেন্ডারে বছর ৩৫৪ দিন হয়। এই ৩৫৪ দিনে আমরা যদি অন্তত একটি সুন্নাহ আমল করি, তাহলে ৩৫৪ দিনে ৩৫৪টি সুন্নাহ আদায় হয়ে যায়!ড. রাগিব সারজানি এরকম ৩৫৪টি সুন্নাহ নিয়ে সাজিয়েছেন ‘সুন্নাহ প্রতিদিন’ বইটি। প্রতিদিন একটি করে আলোচনা পড়ে আমল করতে পারলে বছর শেষে একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণ সুন্নাহর সঙ্গে পরিচয় ঘটবে, অপরদিকে এসব সুন্নাহর ওপর আমল করে বিপুল সওয়াবও অর্জন করা যাবে ইনশাল্লাহ।

বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ যে পরস্পর বিচ্ছিন্নতা ও মারাত্মক মতবিরোধের সংকটকাল অতিক্রম করছে, বহুকাল পূর্বেই রাসুল এর ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। আজকাল সবাই নিজ নিজ দল ও মতকে হক বলে প্রচার করছে। তাই মানুষ আজ দিশেহারা, তারা কোন পথে যাবে?! কিন্তু এর পরিষ্কার উত্তর রাসুল -এর হাদিসেই আছে। ইরবাজ ইবনে সারিয়া রা. বলেন,

একদিন ফজরের নামাজের পর রাসুল আমাদের উদ্দেশে অত্যন্ত আবেগঘন ভাষণ দেন। সেই ভাষণ শুনে সবার চোখে অশ্রুধারা প্রবাহিত হয়। অন্তর ভীত সন্ত্রস্ত হয়। তখন এক লোক বলে, এ যেন কারও বিদায়ী ভাষণ! অতএব, আপনি আমাদের কী নির্দেশ প্রদান করেন হে আল্লাহর রাসুল? উত্তরে তিনি বলেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতি এবং (শাসকের) আনুগত্যের উপদেশ দিচ্ছি, যদিও সে একজন হাবশি গোলাম হয়। কারণ, তোমাদের মধ্যে যারা জীবিত থাকবে, তারা প্রচুর মতবিরোধ দেখতে পাবে। সাবধান! ধর্মে নব আবিষ্কৃত বিষয় হতে ! কারণ, প্রতিটি নব আবিষ্কার হলো পথভ্রষ্টতা। তোমাদের মধ্যে যে সেই (বিচ্ছিন্নতা ও মতবিরোধের) যুগ পাবে, তার কর্তব্য হচ্ছে আমার সুন্নাহ ও আমার হেদায়েতপ্রাপ্ত খলিফাদের সুন্নাহর অনুসরণ করা। তোমরা মাড়ির দাঁত দিয়ে তা কামড়ে ধরে থাকবে!(১)

সুতরাং রাসুল -এর নির্দেশনা থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, তাঁর সুন্নাহর অনুসরণ ও তাঁর রীতি অনুকরণের পথ ধরেই আসবে মুক্তি। কিন্তু যখন আমরা দেখতে পাই, কেউ না জেনে, আর কেউ অবমূল্যায়ন করে রাসুল -এর সুন্নাহকে বর্জন করছে, তখন সুন্নাহর গুরুত্ব এবং তা পালনের বিশাল দায়িত্বের কথা আমরা আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি। স্বয়ং রাসুল ও এ ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, উম্মাহ এমন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করবে, যখন ‘কুরআনই আমাদের জন্য যথেষ্ট' বলে একশ্রেণির মুসলিম স্বেচ্ছায় রাসুল ঊ-এর সুন্নাহকে বর্জন করবে। অথচ তাদের এ কথা সম্পূর্ণ অলীক ও ভ্রষ্টতা ছাড়া আর কিছু নয়। মিকদাম ইবনে মাদিকারিব রা. বলেন, রাসুল বলেছেন, সাবধান! খুব শীঘ্রই এমন ব্যক্তির আগমন ঘটবে, যে তার গদিতে হেলান দিয়ে বসে থাকবে, তখন তার নিকট আমার কোনো হাদিস পৌঁছলে সে বলবে, আমাদের ও তোমাদের সামনে তো আল্লাহর কিতাবই আছে। আমরা তাতে যা হালাল পাব তা হালাল বলে মেনে নেব, আর যা হারাম পাব তা হারাম বলে মেনে নেব। (কিন্তু মনে রেখো) রাসুল যা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন তা আল্লাহ কর্তৃক হারামকৃত বস্তুর মতোই হারাম!(২)

অতএব, সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন করা যেহেতু দ্বীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে বিবেচিত, তাই কেবল পুণ্য বৃদ্ধির জন্য নয়; বরং সুন্নাহর শিক্ষা অর্জন করা এবং এর পুনর্জাগরণ ঘটানো প্রতিটি মুসলিমের ওপর অবশ্যকর্তব্য। আর সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই বক্ষ্যমাণ বইটির রচনার প্রয়াস।

তবে এই বইয়ে রাসুল -এর সুন্নাহ সংক্রান্ত সকল হাদিস একত্র করা আমার উদ্দেশ্য নয়—তা করতে গেলে বইয়ের কলেবর অনেক বেড়ে যাবে—বরং এখানে আমার লক্ষ্য কেবল সুন্নাহর সিঁড়িতে পা ফেলা। তাই মনস্থ করি, প্রথমে রাসুল -এর সুন্নাহসমূহ থেকে নির্বাচিত ৩৫৪টি সুন্নাহর মাধ্যমে এ কাজ শুরু করা যাক। হিজরি বর্ষের দিন—সংখ্যার সঙ্গে মিল রেখে প্রতিদিন গড়ে যেন একটি করে সুন্নাহর ওপর আমল করা যায়, সেই চিন্তা থেকেই এই বিন্যাস। এরপর এই আমলগুলোর অনুশীলন ও নিয়মিত চর্চার পর আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারব।

এ বইয়ে আমি কেবল সেসব সুন্নাহ ও আমলকে অগ্রাধিকার দিয়েছি, যেগুলোর ব্যাপারে সাধারণত আলেমগণ এবং ফিকহি মতাদর্শগুলোর মাঝে বড় কোনো মতপার্থক্য নেই। এর পেছনে মুসলিমদের ঐক্যের পথ সুগম করা এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করাই আমার প্রধান উদ্দেশ্য।

এখানে আমল প্রমাণের জন্য যেসব হাদিস উল্লেখ করেছি, তার মধ্যে হাদিস বিশারদগণ যেগুলোর সনদগত দুর্বলতার ব্যাপারে একমত, সেগুলো পাশ কেটে কেবল বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হাদিসগুলো উল্লেখের প্রতিই অধিক মনোযোগ দিয়েছি। তবে কিছু হাদিসের বিশুদ্ধতা নিয়ে মতানৈক্য থাকায় কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও স্বীকৃত বিশুদ্ধ হাদিস উল্লেখের মাধ্যমে সেগুলোর বক্তব্য জোরালো করার চেষ্টা করেছি। যেন রাসুল * এসব আমল করেছেন বলে......

সুনানুত তিরমিজি, ২৬৬৪; আল-মুসতাদরাক লিল হাকিম, ৩৭১
সুনানু আবি দাউদ, ৪৬০৭; সুনানুত তিরমিজি, ২৬৭৬; সুনানু ইবনি মাজাহ, ৪২: আল-মুসনাদ লিল ইমাম আহমাদ, ১৭১৮৪

পাঠক নিশ্চিত হতে পারেন। আমার বিশ্বাস, এই বইয়ে যেসব সুন্নাহর সমাবেশ ঘটেছে, তার অধিকাংশের বিশুদ্ধতার ব্যাপারেই মুসলিমদের মাঝে কোনো মতপার্থক্য নেই। তাই এর মাধ্যমে উম্মাহর ঐক্য সুসংহত হবে, পারস্পরিক বন্ধন মজবুত হবে। ইনশাআল্লাহ।

বইটি পাঠ করার পর আমাদের নিকট সুস্পষ্ট হবে যে, দ্বীনের ব্যাপারে আমাদের পারস্পরিক মতানৈক্যপূর্ণ বিষয়গুলো ঐকমত্যপূর্ণ বিষয়ের তুলনায় নগণ্য। আর রাসুল -এর পুরো জীবনটাই ছিল সুন্দর ও চমৎকার; তাঁর প্রতিটি সুন্নাহ ও আমল মানুষের জীবনকে করে তুলে সুখের, আনন্দের ও তৃপ্তির। আরও সুস্পষ্ট হবে যে, বর্তমানে মুসলিমদের অনেক দুঃখদুর্দশার পেছনে একটাই কারণ, রাসুল -এর সুন্নাহকে বর্জন করা এবং তাঁর উপদেশের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন।

প্রিয় পাঠক, এসব সুন্নাহকে আপনারা পায়ে বাঁধা শিকল, অথবা মাথায় চাপিয়ে দেওয়া বোঝা মনে করবেন না; বরং তা হচ্ছে আলোকদীপ্ত প্রদীপ ও সুউচ্চ মিনারের ন্যায়, যা জীবনের আঁধারগুলো দূর করে এবং পথহারা পথিকদের দিকনির্দেশনা প্রদান করে। আমাদের অন্তর্চক্ষু মেলে অনুধাবন করতে হবে, প্রতিটি সুন্নাহ আমাদেরকে সেই সিরাতে মুস্তাকিমের নিকটবর্তী করে, জান্নাতের সীমানায় গিয়ে যার সমাপ্তি ঘটেছে। বস্তুত সুন্নাহর ব্যাপারে এমন ইতিবাচক অনুভূতি সৃষ্টির জন্যই আমি আল্লাহ তাআলার একটি বাণীকে এই গ্রন্থের প্রতীক নির্ধারণ করেছি—

وإن تطيعوه تهتدوا

তোমরা যদি নবীর আনুগত্য করো, তবে সৎপথপ্রাপ্ত হবে। [সুরা নুর : ৫৪] হায়! এই বাণী যদি আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতীক হতো। আজ অন্ধকারে ছেয়ে গেছে পুরো পৃথিবী। ফেতনায় ভরে গেছে বিশ্বজগৎ। আর এ অমানিশার মুহূর্তে রাসুল -এর সুন্নাহর দিকে ফিরে আসা ছাড়া মানবতার মুক্তির দ্বিতীয় কোনো পথ যে খোলা নেই।

আরেকটি বিষয় না বললেই নয়; রাসুল -এর জীবনবৃত্তান্ত পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জানা এবং তাঁর সুন্নাহগুলো অনুসরণ করার মাধ্যমে সরাসরি আমাদের অন্তরে তাঁর প্রতি ভালোবাসা তৈরি হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, তাঁর প্রতিটি উচ্চারণ, প্রতিটি বিরাম, প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি উপদেশ, প্রতিটি কাজ, প্রতিটি স্বীকৃতি প্রতিনিধিত্ব করে তাঁর অনুপম হৃদয়ের, তাঁর প্রশংসনীয় চরিত্রের, তাঁর নিষ্ঠাপূর্ণ ইবাদতের এবং তাঁর সুদৃঢ় আকিদা ও বিশ্বাসের। তাই রাসুল -এর জীবনবৃত্তান্ত জানার পর নিঃসন্দেহে তাঁর প্রতি আপনার ভালোবাসা আরও বেড়ে যাবে। আর এটা ঈমানের অন্যতম মৌলিক দাবি। আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন, রাসুল বলেছেন,

তোমাদের কেউ (প্রকৃত) মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, তার সন্তান ও সকল মানুষ অপেক্ষা প্রিয়পাত্র হই। (৩) তবে আনন্দের বিষয় এই যে, এই বইটি পাঠ এবং তা বাস্তব জীবনে প্রতিফলনের মাধ্যমে সরাসরি আমরা এই সুফল লাভ করতে পারব। অতএব, কত মহৎ সুফল এটি! কত চমৎকার লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে এতে! আল্লাহ তাআলাই তাওফিকদাতা। তিনিই সরল পথ দেখান।

সুন্নাহ প্রতিদিন বই থেকে চূড়ান্ত উপকার লাভের পদ্ধতি

এই বইয়ে বর্ণিত আমলগুলোকে হিজরি বর্ষের দিন অনুযায়ী বিন্যস্ত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যেদিন যে আমলের দিন, সেদিন সে আমলটি উল্লেখ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। যেমন রমজান মাসের আমলগুলোকে রমজান মাসের তারিখে বর্ণিত আমলে স্থান দিয়েছি। পাশাপাশি এ পবিত্র মাসে দান-সদকা, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা, পরস্পর দেখাসাক্ষাতের মতো যেসব গুরুত্বপূর্ণ আমল আপনার জানা দরকার, সেগুলোও এ মাসের সঙ্গে যুক্ত করেছি। অর্থাৎ পাঠক যেদিন যে আমলটি পড়বেন, সেদিনই অথবা নিকটবর্তী এক দিনের মাঝে তিনি সেই আমলটি বাস্তবে রূপ দিতে পারবেন। বস্তুত এটি তার জন্য সুন্নাহর অনুসরণে বেশি সহায়ক বলে আমার বিশ্বাস। বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য আরেকটু উদারহরণ দেওয়া যায়। যেমন, ঈদের সুন্নাহগুলো ঈদের দিন এবং এর কয়েক দিন আগে আলোচনা করেছি, যেন পাঠক সময়মতো সেগুলো পালন করতে পারেন। তদ্রূপ, চাঁদ দেখার পর পালনীয় সুন্নাহ, আইয়ামে বিজের রোজা, মহররম মাসে আশুরার রোজা, জিলহজ মাসের প্রথম দশকের আমল, এ সকল সুন্নাহ উল্লেখের ক্ষেত্রে তা পালনের নির্দিষ্ট তারিখ ও মৌসুমের দিকে লক্ষ রেখেছি; যেন যথাসময়ে পাঠ করতে পারলে পাঠক সে আমলগুলো বাস্তবায়ন করতেও সক্ষম হন। প্রতিটি পৃষ্ঠার ওপরে আরবি তারিখ সংযোজনের পেছনে এটাই মূল কারণ। তবে এমন অনেক সুন্নাহ আছে,

যেগুলো নির্দিষ্ট দিনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়; যেমন, মুচকি হাসি, লজ্জা, তাহাজ্জুদ, চিকিৎসা গ্রহণ ইত্যাদি; সেগুলো বছরের অন্যান্য দিনে আলোচনা করেছি। আমি এ সকল সুন্নাহ বিন্যাসের সূচনা করেছি পহেলা রমজান থেকে, আর শেষ করেছি পুরো বছর ঘুরে শাবান মাসের শেষ তারিখে। রমজান মাসের মাধ্যমে আলোচনা শুরুর বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমন,

• বছরের এই শ্রেষ্ঠ ও সুমহান মাসের বরকত লাভ করা।

এ মাসে ঘটে বিশ্বজগতের মধ্যে বিশাল এক পরিবর্তন। যেমন, আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল বলেছেন,

«إذا دخل شهر رمضان فتحت أبواب السماء وغلقت أبواب جهنم وسلسلت

الشياطين»

রমজান মাস শুরু হলে আসমানের (অর্থাৎ জান্নাতের) দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদের শিকলবন্দি করা হয়। (৪)

• বান্দার সারা বছরের আমলগুলো শাবান মাসে আল্লাহর নিকট উপস্থাপন করা হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে রমজানের মাধ্যমে বইয়ের সূচনা মানে প্রকৃত নববর্ষের মাধ্যমে এর সূচনা। উসামা ইবনে যায়েদ রা. বলেন,

«قلت: يا رسول الله، لم أرك تصوم شهرا من الشهور ما تصوم من شعبان، قال: ذلك شهر يغفل الناس عنه بين رجب ورمضان، وهو شهر ترفع فيه الأعمال إلى رب العالمين، فأحب أن يرفع عملي وأنا صائم

আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি শাবান মাসে যে পরিমাণ রোজা রাখেন, অন্য কোনো মাসে তো আপনাকে সে পরিমাণ রোজা রাখতে দেখি না! উত্তরে রাসুল বলেছেন, রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী এ মাস সম্পর্কে লোকেরা উদাসীন হয়ে পড়ে। অথচ এই মাসে বিশ্বজগতের প্রতিপালকের কাছে সকল আমল উপস্থাপন করা হয়। তাই আমি চাই, রোজাদার অবস্থায় আমার আমলগুলো উত্থাপিত হোক। (৫)

• রোজা, কুরআন তেলাওয়াত, দান-সদকা, আত্মীয়দের খোঁজখবর নেওয়া ইত্যাদি যেসব আমল বছরজুড়েই করা দরকার, সেগুলো একজন মুমিন রমজান মাসেই বেশি পালন করে থাকে। সুতরাং এই সুন্নাহগুলো জেনে রমজান মাসে বাস্তবায়ন করলে সারা বছর তা পালনে সহায়ক হবে বলে আমার বিশ্বাস।

• এ মাসে একজন মুসলিমের ঈমানের স্তর সর্বোচ্চ চূড়ায় অবস্থান করে। ফলে পরিমাণে বেশি হলেও এসব সুন্নাহ আদায় তার কাছে কষ্টকর মনে হয় না; বরং আরও বেশি করে পালন করার উৎসাহ পায়।

তবে আমি পাঠককে অনুরোধ করব, রমজানের বদলে অন্য কোনো মাসে যদি বইটি ক্রয় করেন, তবে সেদিনের তারিখের আমল থেকেই বইটি পড়া পাঠ শুরু করবেন। যেমন ধরুন, বইটি রবিউল আওয়াল মাসের পাঁচ তারিখ কেনা হলো, তাহলে বইয়ে উল্লেখিত রবিউল আওয়াল মাসের পাঁচ তারিখের আমল থেকেই অধ্যয়ন শুরু করবেন। কারণ, এর মধ্যে উল্লেখিত অনেক আমল নির্দিষ্ট দিন ও মওসুমের সঙ্গে জড়িত। তাই ক্রয়ের পর এ ধারাবাহিকতা রক্ষা করলে কোনো আমলই সময়মতো পালনের সুযোগ হারাবেন না।

এ বইয়ে আমি হিজরি ১৪৩৫ ও ১৪৩৬ সনকে বর্ষপঞ্জি হিসাবে বেছে নিয়েছি। কারণ, এ বছরগুলোতেই আমি আমার অনলাইন ওয়েব পোর্টাল islamstory.com-এ এই আমলগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা শুরু করি। বছরদুটির মাসগুলোকে চাঁদের ওপর নির্ভর করে কোনো মাস ৩০ আর কোনো মাস ২৯ গণ্য হয়েছে। তাই পরবর্তী বছরগুলোতে তারিখের হিসাবে সেই ধারাবাহিকতায় কিছুটা এদিক-সেদিক হতে পারে। এজন্য পাঠকের উচিত, সেদিকে লক্ষ রেখে মাসের হিসাবে বই পাঠ করা। যেন কোনো আমল তার ছুটে না যায়।

তদ্রূপ ওই দুটি বর্ষপঞ্জিকে সামনে রেখেই সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমলগুলো উল্লেখ করেছি। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি উদাহরণ হলো, জুম দিনের সুন্নাহসমূহ। আমি জুমাসংশ্লিষ্ট সুন্নাহগুলো বছরজুড়ে বিভিন্ন বৃহস্পতিবারের অধীনে উল্লেখ করেছি, যেন সেই সুন্নাহ সম্পর্কে অবগত হয়ে পরের দিন জুমাবারে তা পালন করা যায়। যেমন, পাঠক বিভিন্ন বৃহস্পতিবারে পালনীয় সুন্নাহর আলোচনায় পড়বেন, জুমার দিন আগেভাগে মসজিদে যাওয়া, গোসল করা, মনোযোগ দিয়ে খুতবা শোনা ইত্যাদি। তবে পরবর্তী বছরগুলোতে চন্দ্রমাসে তারতম্যের কারণে দিবসের ধারাবাহিকতায় ভিন্নতা থাকবে, • পাঠক সেদিকে খেয়াল রাখবেন। এ ক্ষেত্রে আপনারা বছরের শুরুতেই বইয়ে উল্লেখিত জুমার দিনের আলোচনাগুলো খুঁজে নির্দিষ্ট করে রাখতে পারেন, এরপর যথাসময়ে তা পাঠ করবেন। একই জটিলতা ও সমাধান বৃহস্পতি ও সোমবারের সুন্নাহগুলোর ব্যাপারেও, যদিও তার পরিমাণ খুবই কম।

এমনইভাবে পূর্বে উল্লেখিত দু-বছরের বর্ষপঞ্জি অনুযায়ীই বর্ষাকালের বৃষ্টি ও ঝড়তুফানের সময়ে পালনীয় সুন্নাহগুলোর কথা আলোচনা করেছি। যেন পাঠক সেগুলো পাঠ করে যথাসময়ে আমল করতে পারেন।

সুতরাং উল্লিখিত নিয়মে বইটি পাঠ করলে তা থেকে সর্বোত্তমরূপে উপকার লাভ করা যাবে। আমলের নির্দিষ্ট সময়ে দৈনিক একটি করে সুন্নাহ পাঠ, আর সঙ্গে সঙ্গে তা কাজে পরিণত করার উদ্যোগ! এই উদ্যোগ পুরো পরিবারকে সঙ্গে নিয়েও করা যেতে পারে। এভাবে স্বামী-স্ত্রী, সন্তানসন্ততি, বাবা-মা সকলে মিলে আমলগুলো বাস্তবায়নে যত্নবান হবে। ফলে সকলের জন্য আমলগুলোতে উদ্দীপনা থাকবে এবং তার ওপর অবিচল থাকা সহজ হবে। ইনশাআল্লাহ।

এর সাথে সেই পরিবারটি যদি দৈনন্দিন পালনীয় আমলের পরিধিকে বন্ধুবান্ধব, পাড়াপ্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারে, তাহলে বড় পরিসরে সুন্নাহর সম্প্রসারণ ঘটবে। নিঃসন্দেহে এর মাধ্যমে পুণ্যও বেড়ে যাবে বহুগুণ। যেমন, জারির ইবনে আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল বলেছেন,

«من سن في الإسلام سنة حسنة، فعمل بها بعده، كتب له مثل أجر من عمل بها، ولا ينقص من أجورهم شيء، ومن سن في الإسلام سنة سيئة، فعمل بها بعده، كتب عليه مثل وزر من عمل بها، ولا ينقص من أوزارهم شيء»

যে ব্যক্তি ইসলামে কোনো উত্তম পন্থা চালু করল এবং পরবর্তীকালে সে অনুযায়ী আমল করা হলো, তাহলে আমলকারীদের প্রতিদানের সমান প্রতিদান তার জন্যও লিখিত হবে; তবে এতে তাদের প্রতিদানে কোনো ঘাটটি হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামে কোনো মন্দ পন্থা চালু করল এবং তারপর সে অনুযায়ী আমল করা হলো, তাহলে ওই আমলকারীদের কুকর্মের সমান গুনাহ তার জন্যও লিখিত হবে; এতেও তাদের কারও পাপে সামান্য ঘাটতি হবে না। (৬)

আমি মনে করি, দৈনিক শুধু একটি আমল বাস্তবায়নের ওপর সীমিত থাকা যথেষ্ট, যদিও অন্য একটি আমল বৃদ্ধির মাধ্যমে বিপুল কল্যাণ অর্জন করা যেত। কিন্তু ধীরে ধীরে ও পর্যায়ক্রমে আমলগুলো বাস্তবায়ন করলে দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। আয়েশা রা. বলেন, রাসুল বলেছেন,

«يا أيها الناس، خذوا من الأعمال ما تطيقون، فإن الله لا يمل حتى تملوا، وإن أحب الأعمال إلى الله ما دام وإن قل»

হে লোকসকল, যতটুকু তোমাদের সাধ্য আছে ততটুকু আমল করো; নিশ্চয় তোমরা ক্লান্ত হয়ে (আমল ত্যাগ করা পর্যন্ত) আল্লাহ তাআলা তার সওয়াব প্রদান বন্ধ করেন না। (মনে রেখো) আল্লাহর কাছে সবচেয়ে পছন্দের আমল হলো যা অবিরত পালন করা হয়; হোক তা পরিমাণে অল্প । (৭)

তাই পাঠককে আমি পুরো বই একদফায় পড়ে শেষ করে ফেলার কথা বলব না। কারণ, কথা যত বেশি, ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনাও তত বেশি। তাই প্রতিদিন নতুন একটি করে আমলের আলোচনা পড়া, পাশাপাশি তার সাথে পেছনের আমলগুলোতেও নজর বুলিয়ে নেওয়া অথবা দৈনিক যেই আমলগুলো করতে হয়, সেগুলো পুনরায় দেখে নেওয়াই অধিক উপযোগী। তাহলে পাঠকের ওপর চাপ হবে না। অন্যথায় অনেক আমল একসাথে চালিয়ে যেতে না পেরে ক্লান্ত হয়ে সে সবগুলোই পরিত্যাগ করবে।

আমি পাঠককে উৎসাহিত করতে প্রতিটি আমলের সঙ্গে তার সওয়াব ও পুরস্কারের কথা উল্লেখ করেছি। তাই পাঠক যখন পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সেই আমলের আলোচনা করবেন, তখন শুধু আমলের প্রসঙ্গ বলে তার পুরস্কারের কথা এড়িয়ে যাবেন না। বরং সওয়াবের কথাও তাদের সামনে তুলে ধরবেন, যেন তারা আরও বেশি হয়। এভাবে যেমন সকলের উপকারিতা বাড়বে, তেমনই সুন্নাহর প্রচার-প্রসারও ঘটবে।

বইয়ের শেষদিকে আমি নতুন পরিচ্ছেদে কিছু সুন্নাহর পুনরুল্লেখ করেছি, যেন নির্দিষ্ট বিষয়ের বেশ কিছু সুন্নাহর ওপর তিনি একসঙ্গে আমল করে নিতে পারেন। যেমন, বইয়ে আলোচিত সকাল-সন্ধ্যার দোয়া ও জিকির, জুমার দিনের সুন্নাহসমূহ, চিকিৎসা গ্রহণের সুন্নাহসমূহ। জরুরি প্রয়োজনের সময় পাঠক এসব সুন্নাহকে একসঙ্গে পেয়ে সহজে সেগুলো পড়ে নিতে পারবেন, যা নিশ্চয় তার জন্য অত্যন্ত উপকারী বিবেচিত হবে।

ভূমিকার শেষে পাঠকদের উদ্দেশে আমি বলব, আমি আমার ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা ও পদ্ধতির মাধ্যমে সুন্নাহ প্রসারের জন্য এই প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছি। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এগুলো ছাড়াও আরও অনেক পথ-পদ্ধতি আছে রাসুল =-এর আমল ও সুন্নাহগুলো জীবিত করার। আমি আশা করব, প্রতিটি পাঠক নিজ নিজ চিন্তা ও গবেষণার আলোকে ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে রাসুল -এর সুন্নাহগুলো পুনর্জীবিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করুন। কারণ, এর মাঝেই নিহিত মুক্তি ও সফলতা, এটাই উপায় আল্লাহর ভালোবাসা ও মাগফেরাত লাভের। আল্লাহ তাআলা বলেন,

..وقل إن كنتم تحبون الله فاتبعوني يحببكم الله ويغفر لكم ذنوبكم والله

(হে নবী) বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমার অনুসরণ করো, এতে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপগুলো মার্জনা করবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

[সুরা আলে ইমরান : ৩১]

আল্লাহর কাছে আমরা আমলের মধ্যে ইখলাস ও তা কবুলের প্রার্থনা জানাই। আমাদের এই প্রতীক ভুলবেন না :

وإن تطيعوة تهتدواء

তোমরা যদি নবীর আনুগত্য করো, তবে সৎপথপ্রাপ্ত হবে।

[সুরা নুর : ৫৪]

সহিহ মুসলিম, ১০১৭ সহিহ বুখারি, ৫৫২৩; সহিহ মুসলিম, ৭৮২
সুনানুন নাসায়ি, ১০৭৯; আল-মুসনাদ লিল ইমাম আহমাদ, ২১৮০১
সহিহ বুখারি, ১৮০০; সহিহ মুসলিম, ১০৭৯
সহিহ বুখারি, ১৫; সহিহ মুসলিম, ৪৪

আরো পড়তে অথবা দেখতে অনুগ্রহ করে Wafilife থেকে Hardcopy ক্রয় করুন

🤚এই বইটির প্রি অর্ডার চলছে তাই দয়াকরে সুন্নাহ প্রতিদিন : লেখক : ড. রাগিব সারজানী বইটি PDF Download Free চাহিয়া লেখককে নিরুৎসাহিত করবেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ