তিনিই আমার প্রাণের নবি লেখক : শাইখ আলি জাবির আর ফাইফি | Tinii Amar Praner Nobi | বুক রিভিউ

বই : তিনিই আমার প্রাণের নবি
লেখক : শাইখ আলি জাবির আর ফাইফি
ভাষান্তর : উস্তায আবদুল্লাহিল মা'মুন
সম্পাদনা : উস্তায আবদুল্লাহ মাহমুদ ,উস্তায আবুল হাসানাত কাসিম
প্রকাশনী: সমকালীন প্রকাশন
পৃষ্ঠা:১১৮
মুদ্রিত মূল্য:১৮৬
তিনিই আমার প্রাণের নবি লেখক : শাইখ আলি জাবির আর ফাইফি | Tinii Amar Praner Nobi | বুক রিভিউ


আরব দেশ তখন কুসংস্কারে ডুবে ছিল। চারিদিকে অন্যায়- অনাচারের ছড়াছড়ি। জীবন্ত কন্যা সন্তানকে কবর দেওয়া যখন পরিণত হয়েছে তাদের নিত্যস্বভাবে , ঠিক তখনই আগমন ঘটল এক মহা-মানবের।তিনি সকল পাপাচারের অন্ধকারকে রবের আলোকিত বার্তা দিয়ে আলোকময় করেছেন। তিনি সেই মহানবী মুহাম্মদ (স:) । তিনিই আমার প্রাণের নবি।

“ তিনিই আমার প্রাণের নবি” বইটি সীরাত গ্রন্থ। ছোট ছোট শিরোনামে লেখক নবীর জীবনের বিভিন্ন অংশ তুলে ধরেছেন। শিরোনাম সমূহ নিম্নরূপ: শাইখ আলী জাবির আল ফাইফী রচিত এই বইয়ের পরতে পরতে পাঠক নবীজিকে নতুন ভাবে চিনবেন। দেখবেন, তিনি এসেছেন মহানুভুবতা, ভালোবাসা আর বিশ্বস্ততার প্রতীক হয়ে। জানবেন, তার শুভামন ঘটেছে মহান রবের পক্ষ থেকে এক আলো-ঝলমলে বার্তা নিয়ে, যে আলোয় ভেসে যায় সমস্ত অনাচার, মুছে যায় সব মিথ্যে উপাস্যের ঠুনকো অস্তিত্ব। তিনি জানেন ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে। তিনি জানেন সকলের মাঝে ভালোবাসার বীজ বুনে দিতে। বইয়ের প্রতিটি পরিচ্ছেদ পড়ার সময় পাঠকমনে একটি কথাই বার বার প্রতিধ্বনিত হবে: তিনিই আমার নবী, তিনিই আমার প্রাণের নবী, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

১.পড়ো তোমার রবের নামে
২.সবুজ পাতা
৩.ভোলা যায় না
৪.তীব্র সংকট
৫.পবিত্রতম অংশ
৬.তুচ্ছ যে জীবন
৭.নিজেকে ভুলে যাওয়া
৮.সর্বোত্তম পরিধেয়
৯.যেন তিনি সাধারণ কেউ
১০. প্রেরণার বাতিঘর
১১.নিষ্পাপের প্রিয়জন
১২.বৃষ্টির সুবাস
১৩.মদিনায় নেমে আসে ঘোর অন্ধকার

পাঠ প্রতিক্রিয়া

প্রিয় নবিজীর সীরাত মানেই অন্যরকম কিছু । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন জীবন্ত এক কুরআন। কুরআনের ভাঁজে ভাঁজে পবিত্র কথামালার যে সন্নিবেশ আমরা দেখতে পাই, সেসবেরই এক জ্বলজ্বলে প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছে মহানবীর জীবনে। লেখকের রচিত বক্ষ্যমাণ গ্রন্থটি এক অনন্য মাত্রায় অবস্থান করছে। বিষয়বস্তু সীরাত হলেও রাসূলুল্লাহর মানবিক গুণাবলী ও ব্যক্তিজীবন বইটির মূল আলোচ্য বিষয়। বইটিতে লেখকের প্রকাশ ভঙ্গির সাবলীলতা , হৃদয়গ্রাহী ও ভাষাগত সৌন্দর্য আসলেই অতুলনীয়।

প্রশ্নঃ তিনিই আমার প্রাণের নবি বইটি কেন পড়া উচিত?

উত্তরঃ সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন গড়তে হলে নবিজীর সীরাত সবারই পড়া উচিত । এই বইটিতে নবিজীর কিছু অপ্রধান কিন্তু চিত্তাকর্ষক গুণাবলি লেখক তুলে ধরেছেন ,যা বড় সীরাত পড়ার সময়‌ এত মনোযোগ দিয়ে অনুধাবন করা হয় না । এই বইটি পড়লে নবিজীর প্রতি অন্যরকম ভালোবাসার জন্ম নিবে ইন শা আল্লাহ।

ফিরে যাই সাড়ে চৌদ্দ শ বছর আগের পৃথিবীতে। মক্কার কোনো এক কর্মব্যস্ত ও প্রাণচঞ্চল বাজার।

ইয়েমেন থেকে কেনা কাপড়ের টুকরো বিক্রি করছে একজন। দাম ধরেছে অনেক

বেশি, যাতে হাজিদের থেকে ভালো একটা অর্থ উপার্জন করা যায়। এই দিয়ে সে

জীবিকার মান উন্নীত করবে।

আরেকজন দোকান সাজিয়েছে ভারতীয় তরবারি ও ঢাল দিয়ে। লোকে দাঁড়িয়ে দেখছে কত নিঁখুত অস্ত্রগুলো।

এরই মাঝে এক মহিলা পানি পান করাচ্ছে সবাইকে। ভিড় জমেছে বাজারে প্রবেশের পথে। ঘোড়া-বিক্রেতাকে ঘিরে ধরেছে একদল ক্রেতা। লোকটা চিৎকার করে ভালো জাতের ঘোড়ার বর্ণনা দিচ্ছে। দাবি করছে—অন্য সব ঘোড়ার মাঝে তার ঘোড়াটাই শ্রেষ্ঠ।

দোকানে মহিলারা প্রবেশ করছে শালীনভাবে। নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি কিনে ফিরে যাচ্ছে সলজ্জ ভঙ্গিতে।

অদূরে গাছের নিচে বসে আছেন এক যুবক। নাম তার মুহাম্মাদ। শান্ত স্বভাব, মধ্যম গড়ন। বাজারের অন্যান্য মানুষের মতো তার সামনেও পণ্য ছড়ানো। তবে অন্য বিক্রেতাদের মতো তিনি শুধু পণ্যের ভালো দিকটাই বলছেন না, সমস্যাটাও জানিয়ে দিচ্ছেন। পণ্যের ত্রুটি শুনেও কোনো ক্রেতার আগ্রহ কমছে না; বিক্রেতা যে খুব বিশ্বস্ত একজন!

বাজারের সবগুলো মানুষের চোখে জীবন কেবল দীনার দিরহামে সীমাবদ্ধ। শোরগোলের মাঝে তাদের মনে ঘুরতে থাকে আরও বেশি পাওয়ার চিন্তা। অবাক হওয়ার কিছু নেই, এটা বাজার। অবাক তখনই লাগে, যখন এমন বাজারে কেউ নিজের পণ্যের দোষ জানিয়ে বিক্রি করে।

আরও অবাক করা বিষয় হলো সে যুবকটিকে ঘিরে আছে মূল্যবোধের বেষ্টনী; যে কারণে তার কাছে দীনার দিরহামের গুরুত্ব ছিল অল্প। তিনি যেন বাজারে কিছু বিক্রি করতে আসেননি, এসেছেন বিনামূল্যে নিজের মূল্যবোধ ও বিশ্বাস ছড়িয়ে দিতে।

মক্কার উপত্যকায়, বাজারের অলিগলিতে মানুষের মুখ দিয়ে যে মিথ্যাগুলো বের হতো, সেসব তিনি শুনতেন। আর সেগুলোকে তিনি প্রতিহত করতেন সত্য দ্বারা। যেন কল্পনা করতেন—সত্যগুলো মিথ্যার মৃত স্তূপের ওপর সদর্পে বিচরণ করছে।

তার চোখে যেন প্রশ্নেরা জ্বলজ্বল করত, ‘সত্য ছাড়া এ জীবনের মূল্য কোথায়? বিশ্বস্ততা ছাড়া বেঁচে থাকার কী মানে হয়? মাহাত্ম্য ছাড়া জীবিত থেকে কোনো লাভ আছে কি?'

সেদিনের সূর্য ডুবছে প্রায়। প্রত্যেক বিক্রেতা নিজেদের ঝুলি খুলছে। চামড়ার থলে খুলে গুনে দেখছে দীনার দিরহাম, যেগুলো তারা উপার্জন করেছে ডাহা মিথ্যা বলে। লাত-উজ্জার শপথ করে তারা দাবি করেছে, এগুলোই সবচেয়ে ভালো পণ্য। অন্যদিকে মুহাম্মাদ চলে যাচ্ছেন তার স্ত্রী খাদিজার গৃহে। তাদের নিয়ে ভাবছেন, যারা লাভ করার জন্য মিথ্যাচারকেই বানিয়েছে একমাত্র অবলম্বন, যারা মনে করে, কৃত্রিমতা ও প্রতারণা ছাড়া জীবন চলবে না।

ঘরে পৌঁছুলেন তিনি। স্ত্রীর দিকে থলেটা বাড়িয়ে দিলেন। খাদিজা তার জন্য খাবার তৈরি করে রেখেছিলেন। সেই খাবার হাতে নিয়ে চলে গেলেন এমন স্থানে, যেখানে অনাচার দেখা চোখ দুটো শীতল হয়, বিক্ষিপ্ত মন শান্ত হয়। 

গুহার পথে

তিনি পথ চলেছেন একাকী। চলতি পথের গাছ আর পাথর যেন তার উপস্থিতি টের পায়, শ্রদ্ধার এক আবেশ ঘিরে ধরে ওদের। তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন মেশকের সুরভি ছড়ায়। যে পাহাড়গুলোর দিকে তিনি তাকিয়ে থাকেন, যে পাহাড়গুলো তার দিকে চেয়ে আছে—উভয়ের সৌরভ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

কেন বেছে নিলেন একাকিত্বকে?

মানুষের অবস্থা তাকে ক্লান্ত করে দিয়েছে। অনুভূতি ও বিশ্বাসকে ঘিরে তাদের ক্রমাগত মিথ্যাচারে তিনি পরিশ্রান্ত। চারিদিকে সবকিছুতে যেন অবিশ্বাসের বিষবাষ্প। মিথ্যা আর কৃত্রিমতার কত রং! অথচ তিনি একটা শুভ্র রংই ধারণ করেছেন, হৃদয়ে জ্বেলেছেন সত্যের মশাল।

ওরা সবাই সিজদা করে মূর্তির। এ মূর্তিগুলো তার ভালো লাগে না কোনোভাবেই!

এরা জবাই করে মূর্তির জন্য, শপথ করে লাত-উজ্জার নামে, লিপ্ত হয় ব্যভিচারে, ধোঁকাবাজি করে, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, কবর দেয় জ্যান্ত কন্যা সন্তানকে! একটামাত্র উট চুরি হলে কিংবা একটামাত্র কথার জের ধরে যুদ্ধ বাধিয়ে ফেলে। এমন কোনো খারাপ কাজটা নেই, যা তারা করেনি। যত অন্ধকার, যত অমানিশা—সব হয়ে গেছে তাদের স্বভাব। এসবের জন্যই তারা সংগ্রাম করে, শোরগোলে মাতে!

এই অন্ধকার জীবন মুহাম্মাদের জন্য না। তিনি যতই চেষ্টা করেন জীবনের ক্যানভাস থেকে কালো রং মুছে দিতে, ততই ধুলোর আস্তর পড়ে যায়। জীবনে সাদা রং যোগ করা বড় কঠিন হয়ে গেছে। তাই তো তিনি অজ্ঞতা-অনাচারকে ঠেলে দিয়েছেন পেছনে। যখনই সুযোগ পান, চলে যান সুদূর পাহাড়ের চূড়ায়। সে পাহাড়গুলো কি চুপিসারে কিছু বলে, যা তিনি কান পেতে শোনেন, কিন্তু বোধগম্য হয় না? যেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে চায় ওরা। যেন কিছু একটা জানান দিতে চায়, যেটা তিনি এখনো বুঝে উঠতে পারেননি।

তিনি পৌঁছে যান পাহাড়গুলোর প্রান্তে। যে অনুভূতি তার মনে আসে, তা সমগ্র মক্কাবাসীর জন্য বোঝা কঠিন। সে অনুভূতির সামনে জীবনটা সামান্য হয়ে আসে, তুচ্ছ মনে হয়।

তিনি দেখতে পান সেই গুহা, কেমন যেন একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে এর সাথে। উঠে যান মাঝারি আকারের পাথর ডিঙিয়ে। প্রবেশ করেন গুহায়। যেন মিলিত হয় দুটি আলো— একটি আলো তার থেকে বিকীর্ণ হয়, অন্যটি তার ভেতরে প্রবেশ করে।

থলেটা গুহার কোনো এক পাশে নামিয়ে রাখেন তিনি। বিছানা পেতে পরিষ্কার হয়ে বসে পড়েন ইবাদতে। এই সেই ধর্মপরায়ণতা, যেটা তার জীবনের চালিকাশক্তি, তার চলার পথে সঙ্গী। সেখানে তিনি ঘোষণা করে চলেন সৃষ্টিকর্তার পবিত্রতা। চারিদিকের মানুষ এ স্রষ্টাকে ছেড়ে পাথর, গাছ, সূর্য, চাঁদ, প্রবৃত্তি-সহ আর যা কিছুর ইবাদত করে, তা থেকে তিনি পবিত্র। তারা খেজুর, চর্বি, ইট, মাটির তৈরি প্রভুর সিজদায় লুটিয়ে পড়েছে। তারা ছেড়ে দিয়েছে সাত আসমান ও জমিনের রব আল্লাহকে, যিনি মহান আরশের রব।

কে জানে, মুহাম্মাদের হৃদয়ে কোথা থেকে সেই আলো এসে পড়ল! তার অন্তরে কোন উপায়ে সেই জ্যোতির্বলয় খাপ খাইয়ে নিল?

সাদ গোত্রের গিরিপথে তার বুক চিরে ফেলার ঘটনাই কি শুরু? যখন ৪ বছর বয়সে তিনি বাচ্চাদের সাথে খেলছিলেন, অপরিচিত দুজন লোক এসেছিলেন। তিনি ছাড়া সবাই পালিয়ে গিয়েছিল তখন। তারা তাকে মাটিতে শুইয়ে বুক চিরে কালো একটা রক্তপিণ্ড বের করে নেয়। একজন অন্যজনকে বলে, ‘এটা তার ভেতরে শয়তানের অংশ।'

শয়তানের অংশ বের করে ফেলেছিলেন দুজন। ফলে তিনি হয়েছিলেন এমন মানুষ, যার মাঝে শয়তানের কোনো কুমন্ত্রণা কাজ করত না।

তারা তার হৃদয় ভরে দিয়েছিলেন আলোতে। ধুয়েছেন পবিত্র পানিতে। তারপর তা ফিরিয়ে দিয়েছেন যথাস্থানে। সবশেষে এঁটে দিয়েছেন বুকের চিড়।

এই ঘটনাই কি তবে এ মানুষটার হৃদয়ে আলোর সূচনা? নাকি এর আগেও ভিন্ন কিছু হয়েছে? সীরাতগ্রন্থগুলো তো অন্য কথা বলে। যেদিন তার মা তাকে ভূমিষ্ঠ করেছেন, সেদিনই অনুভূত হয়েছিল ভিন্ন কিছু। যেন জীবনের প্রথম দিন থেকেই তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন মাহাত্ম্য ও পরিশুদ্ধতার।

তার জন্মের আগে থেকেই আভাস পাওয়া যাচ্ছিল, দুনিয়ায় খুব মহিমান্বিত কেউ আসছেন। সূর্যের আলো যেমন পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এই মানুষটিও তেমন। তিনি এসে আলোকিত করবেন সমগ্র পৃথিবী। তার চিন্তা-ভাবনার উৎস হবে আসমান।

তার মা আমিনা বিনতু ওয়াহাব দেখতে পান, একটি আলো ছড়িয়ে পড়ল, যে আলোয় আলোকিত হলো শামের সুবিশাল প্রাসাদগুলো!

যেন সমগ্র পৃথিবী তার অপেক্ষায় ছিল। আল্লাহ এ মানুষটার মাধ্যমে অবসান ঘটিয়েছেন অন্ধকারাচ্ছন্ন মানবতার। তার হাত ধরেই থেমে গেছে মেকিত্বের প্রসার, উত্তাল পাপাচার।

পরিবর্তন

তিনি আপন যিকির-তাসবিহতে মগ্ন। হঠাৎ এক অপরিচিত আগন্তুক ঢুকে পড়ল গুহার ভেতরে।

মুহাম্মাদ দাঁড়িয়ে গেলেন। মুখোমুখি হলেন সেই আগন্তুকের। তার শরীরে

আলাদা একটা ঘ্রাণ পেলেন। ঠিক সেই দুজনের মতো, যারা ছোটবেলায় তার

বক্ষ বিদারণ করেছিল।

আগন্তুক এগিয়ে আসছেন, যেন আসমান তার দিকে এগিয়ে আসছে, নিয়ে আসছে সপ্ত-আকাশের সুরভি। তিনি যে অনুভূতির সঞ্চার করছেন, তা আর যা-ই হোক, পার্থিব কিছু নয়।

তিনি যে জিবরিল, মহান ফেরেশতা! তিনি এসেছেন এই মানুষটিকে আল্লাহর কাছ থেকে এক বিশেষ বার্তা দিতে।

মুহাম্মাদ তো শুদ্ধতায় ভরপুর একজন মানুষ। তার ভেতরটা আলোয় পরিপূর্ণ। মনের গভীরে যে জগৎ, তাতে রয়েছে পরিচ্ছন্নতার ছাপ। এমন হৃদয়ে সর্বোত্তম বার্তা অবতীর্ণ হবে না তো আর কোথায় হবে! এ বার্তা গ্রহণে যে সুউচ্চ পর্বতমালাও অক্ষম! যদি এ বার্তা নাজিল হতো পর্বতের ওপর, তবে তা আল্লাহর ভয়ে বিদীর্ণ হয়ে যেত তখনই![১]
[১] সুরা হাশর, আয়াত : ২১

মুহাম্মাদ আজ প্রস্তুত। ছোট্ট পাহাড়ের গুহায় আজ তিনি পাহাড়ের চেয়েও দৃঢ়তা নিয়ে প্রস্তুত। জগতের পবিত্রতম পানির চেয়েও তিনি বেশি পবিত্র। ছায়াপথের যত নক্ষত্র আছে, তার চেয়েও বেশি আলোকিত।

জিবরিল কাছে এলেন। মুহাম্মাদের মনে বিস্ময়। হাজারো প্রশ্ন ভিড় করছে জিজ্ঞাসু মানসপটে। হঠাৎ জিবরিলের আওয়াজে গমগম করে উঠল গুহার প্রতিটি দেয়াল।

‘পড়ুন!’

একটা মহান কিছু তার ওপর নাজিল হচ্ছে। এর মাহাত্ম্য হলো একে পড়তে হয়। কয়েক মুহূর্তের মাঝে তার হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে আল্লাহর পবিত্রতম বাণীর প্রথম শব্দগুলো। তার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে শরীরের প্রতিটি কোষ।

‘পড়ুন!’

মুহাম্মাদের উত্তর, ‘আমি পড়তে পারি না।'

নিরক্ষর । মুহাম্মাদ হতবিহ্বল। তিনি কীভাবে পড়বেন!

জিবরিল সজোরে চেপে ধরলেন তাকে। সে চাপের মাঝে ছিল অসীম শক্তি, ছিল তীব্রতা! মুহাম্মাদের মনে হলো যেন মৃত্যু এসে গেছে।

“নিশ্চয় আমি আপনার ওপর নাজিল করব গুরুভার বাণী। [১]

সেই ভারী বক্তব্যকে বোঝার জন্যই তো এত প্রস্তুতি। তীব্র সেই বার্তা পৌঁছানোর জন্যই তো এই চাপ, এই আলিঙ্গন। এভাবেই জানিয়ে দেওয়া হলো, আসমানের কোনো এক মহান জিনিস তার হৃদয়ের আলো স্পর্শ করবে। সে আলো কেবল মক্কায় নয়, ছড়িয়ে পড়বে সাতটি মহাদেশে। অবসান ঘটবে গভীর অমানিশায় নিমজ্জিত এক যুগের।

জিবরিল তাকে ছেড়ে দিলেন। আবার বললেন, ‘পড়ুন!’
সেই একই উত্তর, ‘আমি পড়তে পারি না।'
[১] সুরা মুযযাম্মিল, আয়াত : ৫

জিবরিল আবারও তাকে জড়িয়ে ধরলেন। যে বার্তা নাজিল হবে, তা কতটা ভারী, কতটা মহান, কাজটা কত কঠিন—তা বোঝানোর জন্যই।

তাকে ছেড়ে দিলেন জিবরিল। আবারও বললেন, ‘পড়ুন!’

আবারও মুহাম্মাদের উত্তর, ‘আমি পড়তে পারি না।'

আবারও সেই চাপ, যার তীব্রতা মৃত্যুর সমান। যার মাহাত্ম্য জীবনের সমান। একই আলিঙ্গনে জীবন-মৃত্যুর সমন্বয় ঘটেছিল যেন। যেন সূচনা হয়েছিল আলোকিত জীবনের, ঘটেছিল পৌত্তলিকতার মৃত্যু!

সমগ্র বিশ্বজগৎ কান পেতে শোনে, আসমান থেকে জমিনে অবতীর্ণ হওয়া বার্তার প্রথমাংশ। আকাশের সুউচ্চ দরজা থেকে যেন নেমে আসে অপার্থিব আলোকচ্ছটার সুতো—

اقرأ باسم ربك الذي خلق و خلق الإنسان من علق © اقرأ وربك الأكرم ن الذي علم بالقلم ( علم الإنسان ما لم يعلم ©

পড়ুন, আপনার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাটবাঁধা রক্ত থেকে। পড়ুন, আর আপনার রব মহিমান্বিত। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানত না।

এমনটাই বলেছিলেন জিবরিল। তা-ই শুনে অবনত হয়েছিল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেহের প্রতিটি কোষ। বিশ্ব চরাচরের প্রতিটা অণু যেন আন্দোলিত হয়েছিল সুসংবাদে। সে মুহূর্তেই কুরাইশের যুবক মুহাম্মাদ ইবনু আব্দিল্লাহ ইবনি আব্দিল মুত্তালিব ইবনি হাশিম পরিণত হন নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে। সৎ, সত্যবাদী, বিশ্বস্ত ব্যক্তিটা হয়ে গেলেন মহান এক নবি। বিশ্ববাসীর একজন সাধারণ সদস্য থেকে আবির্ভূত হলেন বিশ্বজগতের জন্য রহমতরূপে।

কিছুক্ষণ আগেও যে মানুষটা ছিলেন সাধারণ এক ব্যক্তি, ওহি নাজিলের পর পরিণত হলেন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বে। হলেন সৃষ্টিকুলের মাঝে সর্বোত্তম মানুষ। তাকে সামান্য জ্ঞান দান করার কোনো সুযোগ নেই। তার ব্যক্তিত্ব তখন পাহাড় থেকে ভারী, আসমান থেকে বিশাল, বিশ্বজগতের সৃষ্টিসমূহের মাঝে সবচেয়ে বিস্ময়কর! সে ব্যক্তিত্বের প্রভাব সূর্য-কিরণ থেকেও অনেক অনেক বেশি।

হেরা গুহায় যা ঘটেছিল, তা কোনো ভাষার কোনো কথামালা দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সেটা যে ছিল নবুওয়াত, রিসালাত ও মনোনয়নের প্রথম মুহূর্ত!

‘আল্লাহই ভালো জানেন তিনি কোথায় তাঁর বার্তা পাঠাবেন।' তিনিই তো তাঁর বার্তাকে এমন হৃদয়ে অবতীর্ণ করতে পারেন, যে হৃদয় সেই বার্তা সম্পর্কে কিছুই জানে না, বার্তা আগমনের ব্যাপারে উদ্বেলিতও নয়।

‘আপনি তো ইতঃপূর্বে ছিলেন অজ্ঞাতদের একজন।

তাই জিবরিল যখন গুহা থেকে বের হন, বেরিয়ে পড়েন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও। তিনি তখন ভীত-সন্ত্রস্ত। বিস্ময়ে হতবাক। কিংকর্তব্যবিমূঢ়। শরীরটা ক্রমশ কাঁপছে। যেন এই মুহূর্তে কোনো ভূমিকম্প থেকে বেরিয়ে এলেন। অথবা কোনো বিস্ফোরণ থেকে; যে বিস্ময়ের সূত্রপাত তার আলোকিত হৃদয়ে।

কাঁপতে কাঁপতে তিনি চলে এলেন প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজার কাছে। বললেন, 'আমাকে চাদরে ঢেকে দাও। আমাকে চাদরে ঢেকে দাও।' একজন মানুষের পক্ষে যতটা শীত অনুভূত হতে পারে, তার সবটাই যেন অনুভব করছিলেন তিনি। এ শীতলতা তখনই আসে, যখন একজন মানুষ সাধারণ জীবনযাপনের ঊর্ধ্বে উঠে যান, পরিণত হন এমন মানুষে, যার কাছে সকাল-সন্ধ্যা আসমান থেকে প্রত্যাদেশ আসে।

খাদিজা তার বাড়িতে থাকা সমস্ত পোশাক দিয়ে তাকে ঢেকে দিলেন। শান্ত হলেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। খাদিজা জানতে চাইলেন কিছু হয়েছে কি না। তিনি যা দেখলেন, যা অনুভব করলেন, যা শুনতে পেলেন তার সবটুকু জানালেন স্ত্রীকে। খাদিজা বললেন, ‘কক্ষনো না! আল্লাহ কখনো আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না!

খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহার সেই উক্তিটি ছিল এই মহান মানুষটির জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ের সারসংক্ষেপ। তিনি সারাটি জীবনে কখনো লাঞ্ছিত হননি, সর্বদা আল্লাহকে পেয়েছেন তার পরম সাহায্যকারী হিসেবে, একমাত্র পৃষ্ঠপোষক হিসেবে। দিন কেটে যায়। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়ে নবুওয়াত। তার বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়; যারা তার পথ ও পদ্ধতি অনুসরণ করে। আবার কিছু শত্রুও জুটে যায়; যারা তার বিরুদ্ধে সব ধরনের শত্রুতা জারি রাখে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হয়ে গেলেন সকলের আলোচ্য বিষয়। বিশ্ববাসীর জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে আবির্ভাব ঘটল তার। তিনি এমন এক জীবনপদ্ধতির বার্তাবাহক, যা অনুসরণীয়।

তিনি হলেন মহানুভবতা, ভালোবাসা আর বিশ্বস্ততার প্রতীক। এ বইয়ে আমরা সময় কাটাব তার গুণাবলির সাথে, তার ঐশী প্রেরণার সাথে। তার মহত্তম চরিত্র ও গুণাবলি হবে আমাদের চলার পাথেয়।
[১] সুরা আলাক, আয়াত : ১–৫

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ