উম্মাহর কিংবদন্তিরা : ইসলামী ব্যক্তিত্বদের জীবনী

উম্মাহর কিংবদন্তিরা
#১০ বেস্টসেলার ইসলামী ব্যক্তিত্ব
প্রকাশনী : সন্দীপন প্রকাশন
বিষয় : ইসলামী ব্যক্তিত্ব
অনুবাদক : মু. আম্মারুল হক
পৃষ্ঠা : 200, কভার : হার্ড কভার

অনুবাদকের কথা

إن الحمد لله نحمده ونستعينه ونستغفره، ونعوذ بالله من شرور أنفسنا ومن سيئات أعمالنا من يهده الله فلا مضل له، ومن يضلل فلا هادي له, وأشهد ألا إله إلا الله وحده لا شريك له, وأشهد أن محمدا عبده ورسوله صلى الله وسلم عليه وعلى آله وصحبه أجمعين

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলার, যিনি আমাকে এই মহৎ কাজ করার তাওফীক দান করেছেন। তিনিই আমাকে ইসলামের বীরদের বীরত্বগাঁথা সংবলিত সিরিজ ‘হিরোজ অব ইসলাম’-এর অনুবাদ সম্পন্ন করার শক্তি ও তাওফীক দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ, সুম্মা আলহামদুলিল্লাহ।

প্রিয় পাঠক, আমাদের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস; আছে বিজয়ের গৌরবগাঁথা। আমরা এমন এক সময় অতিবাহিত করে এসেছি, যখন মুসলিম মায়েরা তাঁদের সন্তানদের ঘুমপাড়ানি গল্পে শোনাতেন খালিদ-মুসান্নার বিজয়ের কথা। আমাদের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে কত ঝড়ঝাপটা, কত দুঃখ। পৃথিবীর ইতিহাসের কত কত ক্ষমতাশালী আমাদের মিটিয়ে দিতে চেয়েছে। কিন্তু তারাই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। আমাদের চিরস্থির মেরুদণ্ড একটুও বেঁকে যায়নি। মরুভূমির ধুলোঝড়ের মাঝে জেগে থাকা চারা যেমন প্রবল বাতাসের ঝাপটায়ও সোজা থাকার প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়, ঠিক তেমনিভাবে আমাদের দুঃসময়ে কিছু বীরের জন্ম হয়েছিল, কোনো ঝড়ের সামনে এতটুকু মাথা নোয়াননি যারা। আমরা আজ তাঁদের শৌর্যবীর্যের গল্প শুনি। দ্বীন, ঈমান, আমল, ইলম, জিহাদ, তাযকিয়া সর্বক্ষেত্রে যারা দ্যুতি ছড়িয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ বহু শতাব্দী আগে গত হয়েছেন। কেউ-বা আমাদের খুব নিকটতম সময়ের।

‘হিরোজ অব ইসলাম’ লেকচার সিরিজ অবলম্বনে। সেলিব্রেটি!
শব্দটি শুনলেই আমাদের মাঝে এক অন্যরকম মোহ কাজ করে। সেলিব্রেটি মানেই যেন বিশেষ কেউ। আজ আমরা ঝলমলে দুনিয়ার টলমলে কিছু মানুষকে সেলিব্রেটি বানিয়ে নিয়েছি, যারা কিনা বেহুদা আর অশ্লীল কাজের একনিষ্ঠ কর্মী ছাড়া কিছুই নয়। জীবনের পদে পদে আমরা তাদের অনুসরণ করি, কায়মনোবাক্যে তাদের-ই মতো হতে চাই। কিন্তু এরা কি সত্যিকারের সেলিব্রেটি?সত্যিকারের সেলিব্রেটি তো তাঁরাই যারা যুগে যুগে ইসলামের ঝাণ্ডা বহন করেছেন, আল্লাহর কালিমাকে বুলন্দ করার জন্য নিজেদের জান ও মাল বিলিয়ে দিয়েছেন। উম্মাহর কিংবদন্তিরা

পাঠক, ইসলামের ইতিহাসে বীরত্বের গল্প ভুরিভুরি। কত নাম না-জানা মর্দে মুমিনরা আল্লাহর জন্য সর্বস্ব দিয়েছে। সবার কথা আলোচনা করতে গিয়ে ইতিহাসবিদরা রচনা করে গেছেন পাতার পর পাতা। আমাদের আয়োজন তাঁদের মধ্য থেকে ক’জনের কর্মময় জীবনের আলোচনা। আমরা তাঁদের সবার কথা জানব, তাঁদের সকলকে ধারণ করব।

শ্রুতি অনুবাদ, তারপর আবার অনুলিখন কষ্টসাধ্য বটে, তবে চেষ্টার কোনো কমতি রাখা হয়নি। প্রতিটি লেকচারকে সংযোজন-বিয়োজন করে পরিমার্জিত রূপ দেয়া হয়েছে, যেন পাঠকের তৃষ্ণা মেটে। তবুও মানুষের ভুলভ্রান্তি রয়ে যায়। তাই কোনো ভুলভ্রান্তি পরিলক্ষিত হলে দয়া করে আমাদের জানাবেন, সহৃদয় পাঠকের কাছে এই কামনা রইল। আল্লাহ তাআলা সকলের সর্বাঙ্গীন কল্যাণ করুন। আমীন।

অনুবাদক
মুহাম্মাদ আম্মারুল হক

তাঁরাই সত্যিকারের সেলিব্রেটি। তাঁরাই এই উম্মাহর কিংবদন্তি। যদি কাউকে জীবনের আদর্শ বানাতে হয়, যদি কাউকে জীবনের পদে পদে অনুসরণ করতে হয়, তবে তাঁরাই হতে পারেন আমাদের অনুপম আদর্শ।আমরা কি কখনো তাঁদের মতো হতে চেয়েছি? কখনো কি তাঁদের সম্পর্কে একটুখানি জানার চেষ্টা করেছি? তা হলে কীভাবে আমরা তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করব?বিভিন্ন যুগে ইতিহাস রচনা করা উম্মাহর দশ জন কিংবদন্তির জীবনের গল্প নিয়ে এসেছি আমরা। দুনিয়ার সস্তা সেলিব্রেটিদের ভিড়ে আমরা যেন সত্যিকারের সেলিব্রেটি, সত্যিকারের কিংবদন্তিদের আমাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে পারি, সে লক্ষ্যেই সন্দীপন প্রকাশন নিয়ে এসেছে ‘উম্মাহর কিংবদন্তিরা’।

ফিক্বহের দিকপাল

উম্মাহর মাঝে ইলম, যুহদ, কুরবানির কৃতিত্বের বহুমুখী সাক্ষর রেখে গেছেন ইমাম আজম আবূ হানিফা (রহিমাহুল্লাহ)। তিনি হিজরি সনের আশিতম বর্ষে (খ্রিষ্টীয় ৬৯৯ সনে) জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থান ইরাকের কুফা। হানাফি ফিক্বহ আজ গোটা মুসলিম বিশ্বের অর্ধাংশ জুড়ে অনুসৃত হয়।

ইমাম আবূ হানিফার মূল নাম নুমান ইবনু সাবিত। আবূ হানিফা তাঁর কুনিয়াত বা উপাধি। ‘আবূ হানিফা’ শুনে অনেকেই মনে করেন যে, তাঁর কোনো কন্যা সন্তানের নাম হানিফা ছিল। সেখান থেকেই বুঝি আবূ হানিফা এসেছে। আবূ হানিফা অর্থ হানিফার বাবা। কিন্তু আবূ হানিফার এই নামে কোনো সন্তান ছিল না। এটা স্রেফ তাঁর উপাধি। ‘হানিফ’ শব্দের অর্থ হলো একনিষ্ঠ, খাঁটি। যেমন কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,

ثم أوحينا إليك أن اتّبع ملة إبراهيم حنيفا وما كان من المشركين (321 » তারপর আমি আপনার প্রতি ওহি নাযিল করলাম যে, আপনি একনিষ্ঠভাবে

ইবরাহীমের মিল্লাত (আদর্শ) অনুসরণ করুন; এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। (১)

অনারব ইমাম

ইমাম আবূ হানিফার (রহিমাহুল্লাহ) একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তিনি আরব ছিলেন না। তৎকালীন বহু ইসলামি ব্যক্তিত্ব ছিলেন অনারব। কেউ কেউ ছিলেন বাহির থেকে আসা দাস পরিবারের সদস্য। তবে ইমাম আবূ হানিফার ব্যাপারটা আলাদা।

তাঁর পিতা সাবিত ছিলেন খুবই ধনী ব্যক্তি। সাবিতের পিতা ইবরাহিমের সাথে হযরত আলির (রাদিয়াল্লাহু আনহু) খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। কথিত আছে যে, ইবরাহিম তার পুত্রকে আলির কাছে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন,

‘আমার এবং আমার ছেলের জন্য দুআ করে দিন।'

তা-ই করেন হযরত আলি (রাদিয়াল্লাহু আনহু)। ইবরাহীমের পরিবারের জন্য বারাকাহ’র দুআ করেন। এও কথিত আছে যে, ইবরাহীমের বংশে ইমাম আবূ হানিফার জন্ম আসলে হযরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর দুআর ফসল।

সাহাবি-সান্নিধ্য

প্রজন্মের দিক দিয়ে ইমাম আবূ হানিফা একজন তাবিয়ি। তাবিয়ি বলা হয় তাঁদেরকে, যারা অন্তত একজন সাহাবির সরাসরি সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। ইমাম আবূ হানিফার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল আনাস ইবনু মালিকের (রাদিয়াল্লাহু আনহু)। তিনি হিজরি ৯৩ সনে ইন্তিকাল করেন।

বালক বয়সেই আনাসের সাক্ষাৎ পান আবূ হানিফা। হযরত আনাস ইবনু মালিক ছিলেন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাদেম। তাঁকে ‘খাদিমু রাসুলিল্লাহ' বলা হয়। যখন আল্লাহর রাসুল মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় আসেন, তখন আনাস দশ বছরের ছোট্ট বালক। তাঁর মা তাঁকে রাসুলুল্লাহর কাছে খাদেম হিসেবে দিয়ে এসেছিলেন।

সেইসাথে আনাস ইবনু মালিক (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হাদীস বর্ণনাকারীদের মধ্যেও অন্যতম। কারণ, তিনি দীর্ঘ হায়াত লাভ করেছেন। একশ বছরেরও বেশি। তিনি নিজের সম্পর্কে বলতেন,

‘এই মুহূর্তে জীবিত ব্যক্তিদের মধ্যে একমাত্র আমিই আছি, যে দুই কিবলা সামনে নিয়ে সালাত পড়তে পেরেছে।'

দুই কিবলা মানে মাসজিদুল আকসা ও মাসজিদুল হারাম। সাহাবিদের মধ্যে যারা দুনিয়া থেকে একদম শেষে বিদায় নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে তিনিও একজন। এছাড়াও আল্লাহর রাসুল -এর দুআর বারাকাহ লাভের কারণে একশজনের অধিক সন্তানসন্ততি ছিল তাঁর। যেহেতু তিনি দীর্ঘ হায়াত পেয়েছেন, তাই বহু তাবিয়ি তাঁর কাছ থেকে ইলম শিখেছেন, হাদীস নিয়েছেন। দুই হাজারের অধিক হাদীস বর্ণনা করেছেন তিনি। মানুষকে প্রায়ই বলতেন,

يا بني ! قيدوا العلم بالكتاب

‘বাবারা, কিতাবের মধ্যে ইলমকে লিখে রেখো।

এভাবেই তিনি গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে ইলম সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্ব দিতেন। ইমাম আবূ হানিফার ক্ষেত্রেও তা-ই করেছেন তিনি।

আসলে আমাদের সালাফগণ এমনই সচেতন ছিলেন। শুনে শুনে শেখার সময় সবই লিখতে হবে তা নয়, কিন্তু মূলকথাগুলো লিখে নেয়াই উচিত। এটি ভালো করে জানতেন তাঁরা। লিখে নেয়ার উদ্দেশ্য হলো জ্ঞানকে সংরক্ষণ করা। পরবর্তী সময়ে মুখস্থ করাও সহজ হয় তাতে।

লোকে যারে ভালো বলে

ইদানীং কেউ কেউ ইমাম আবূ হানিফার (রহিমাহুল্লাহ) প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। তাঁকে নিয়ে ভুল ধারণাও আছে অনেকের। এটি ঠিক যে, বহু সালাফ ইমাম আবূ হানিফার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য রাখতেন। কিন্তু ইমামের ফিকহি পাণ্ডিত্য সম্পর্কে উঁচু ধারণা ছিল সবারই।

সুফিয়ান আস সাওরী (রহিমাহুল্লাহ) ছিলেন ইমাম আবূ হানিফার সমসাময়িক। তিনিও কুফায় বসবাস করতেন। তো একবার তাঁর এক শাগরেদকে কোথাও থেকে

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ