রিভিউ : আগামী দিনের সভ্যতা ইসলাম - Agami Diner Sovvota Islam

বই : আগামী দিনের সভ্যতা ইসলাম
লেখক : ড. ইউসুফ আল - কারযাভী
অনুবাদক : মুহসিনা বিনতি মুসলিম, কাজী সালমা বিনতে সলিম
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ২১৯ 
বাইন্ডিং : হার্ড কভার
প্রকাশনী : মক্তব প্রকাশন
মূদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা


◾প্রারম্ভিক কথন-
------------------------------------------
পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সভ্যতা, ভোগবাদী জীবনব্যবস্থা, পুঁজিবাদ নামক রক্তচোষা অর্থব্যবস্থা গোটা বিশ্বকে পরিচালনা করলেও আজ মানবজাতি এর থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে। পাশ্চাত্যের অনেক দার্শনিক ও চিন্তাবিদ আছেন যারা এর থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে মুক্তির উপায় খুঁজেছেন আবার অনেকে নিজের মতো করে তাদের মতামত পেশ করেছেন। কিন্তু, এর থেকে মুক্তির পথ যে ইসলামেই আছে, সেটা তারা কখনো ভেবে দেখেননি। অথচ ইসলামে অনুসন্ধান করলেই সেই মুক্তির পথ পেয়ে যেতেন।

বর্তমান বিশ্বে চলমান সংকট ও বৈষম্য থেকে পরিত্রাণের একমাত্র পথই যে ইসলাম সেটি ড. ইউসুফ আল কারযাভী বেশ দক্ষতার সাথে যৌক্তিকভাবে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন "আগামী দিনের সভ্যতা ইসলাম" নামক বইটিতে। যা বাংলা ভাষায় 'মক্তব প্রকাশন' থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

◾বই কথন-
---------------------------------------------
বইটিকে মোট চারটি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি অধ্যায় আবার কতকগুলো আকর্ষণীয় শিরোনামে সুবিন্যস্ত। 

▪️বইটির প্রথম অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে সভ্যতার চেতনা, পাশ্চাত্য সভ্যতার আদর্শিক ভিত্তি, পাশ্চাত্য মতাদর্শের বৈশিষ্ট্য এবং বিশেষত্ব। 

▪️দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে পাশ্চাত্য সভ্যতার ব্যাধি ও নেতিবাচক প্রভাব, পরিবারের ভাঙন, মনস্তাত্ত্বিক উদ্বিগ্নতা, মানসিক অশান্তি, অপরাধ এবং ভয় ও এর পাশাপাশি পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রযুক্তির ইতিবাচক দিক নিয়েও গঠনমূলক আলোচনা করা হয়েছে।

▪️তৃতীয় অধ্যায়ের আলোচনা করা হয়েছে ১২ টি শিরোনাম নিয়ে। যেখানে, বস্তুবাদের আসন্ন বিপদসমূহ, বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা, বিখ্যাত আলেম ও ইসলামি চিন্তাবিদদের সতর্কবার্তা, বিদ্ধান ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদদের সতর্কবার্তা আলোকপাত করা হয়েছে।

▪️চতুর্থ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সভ্যতার ব্যাপারে কোরআনের রায়, জাতিসমূহ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণ, জাতি ও সভ্যতার উত্থান - পতন ও উত্তরাধিকার এর নীতি, ইসলামি চিন্তাবিদ ও পাশ্চাত্য চিন্তাবিদদের ভাষ্য অনুযায়ী মুক্তির পথ ও অভিমত, মার্কসবাদ ইত্যাদি।
অতঃপর ইহুদী, খ্রিষ্টান, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের অসারতা তুলে ধরা হয়েছে ও এর পাশাপাশি ইসলামে বিজ্ঞান ও বিশ্বাসের সমন্বয় খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। 

এছাড়াও ইসলামি সমাজের আদর্শগত দিকগুলো, মানবজীবনের প্রধান লক্ষ্যসমূহ, পশ্চিমাদের ইসলাম গ্রহণের পথে প্রতিবন্ধকতাসমূহ, পশ্চিমা দাম্ভিকতা, ক্রুসেড চেতনা, ইসলামফোবিয়া, ধূর্ত ইহুদীবাদ ছাড়াও আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা হয়েছে।

◾বইটির প্রয়োজনীয়তা-
-------------------------------------------------
মুসলমানদের কি নেই? সম্পদ, জ্ঞান সবই রয়েছে। শুধু নেই একজন আদর্শ নেতা ও যোগ্য নেতৃত্ব। কিন্তু বিরাজমান সংকট ও সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতা থেকে বিশ্বকে ইসলামের আলোয় আলোকিত করতে হলে ও সভ্যতার পুননির্মান করতে হলে আগে মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসলামী পুনর্জাগরণ তৈরী করতে হবে। আর এই ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আর এজন্য দরকার প্রয়োজনীয় যথোপযুক্ত দিকনির্দেশনা। যার সকল উপাদান লেখক তাঁর বইতে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করেছেন।

বইটি অধ্যয়নের মাধ্যমে একদিকে যারা পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ ও তাদের সভ্যতার প্রসংসায় পঞ্চমুখ থাকতো তাদের হৃদয়ের দুয়ার খুলে দেবে আবার অন্যদিকে চোখের সামনে থাকা বস্তুবাদের চাকচিক্যের পর্দাও টেনে খুলে দেবে এবং সূর্যের আলোর মতো দৃশ্যমান হবে পাশ্চাত্য মতাদর্শের অসারতা। অন্যান্য ধর্ম বা মনুষ্যসৃষ্ট কোন ভ্রান্ত মতবাদ নয় বরং সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ইসলামই সকল সংকট সমাধানে সক্ষম তা পাঠক বইটি অধ্যয়নের সময় প্রতিটি পাতায় পাতায় এর মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারবে।

◾বইটির বিশেষত্ব-
-------------------------------------
বইটির বিশেষত্ব হলো - বইটিতে ইসলামী স্কলারদের, ইতিহাসবিদদের বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে অভিমত, মন্তব্য, তথ্য উপাত্ত তুলে ধরার পাশাপাশি গঠনমূলক আলোচনা করা হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন বিদ্বান ব্যক্তিদের বই থেকেও তাদের মতামত, ধ্যানধারণা গুলোকে এনে জড়ো করা হয়েছে। যারা পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী চিন্তাধারা থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে চিন্তা করেছেন। 

এছাড়াও বইটিতে সকল সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে কোরআনের আয়াতকে সামনে রেখে ব্যাখা করা হয়েছে। যার সৌন্দর্য যে কাউকে অনুপ্রাণিত করবে।

◾বইটি থেকে পছন্দের কিছু উক্তি-
---------------------------------------------------
▪"️মূলত বিশ্বাসই (ঈমান) মানুষের মনকে পঁচন ও পতনের হাত থেকে রক্ষা করে ; বিজ্ঞান নয়।’’

▪️"বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বিপজ্জনক নয়, কিন্তু যখন এটির অপ্রতিরোধ্য সৌন্দর্য আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে এবং আমাদের চিন্তার রাজ্যে তার কালো ছায়া ফেলতে শুরু করে, তখনি তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।’’

▪"️দর্শনের কোন অস্তিত্ব নেই, কারণ এটি প্রথমে কোনো ধারণা বা মতামতকে সমর্থন করে, আবার পরে এটিকেই আক্রমণ করে।’’

▪️''পাশ্চাত্য সভ্যতা প্রকাশ্যে এবং দৃঢ়ভাবে স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে না, কিন্তু এটি তার সমসাময়িক আদর্শিক পদ্ধতিতে স্রষ্টার মূল্য উপলব্ধি করতে পারে না।’’

▪"️আমেরিকার সমস্যা হলো তাদের সম্পদ। তাদের অনেক কিছুই রয়েছে কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণে নৈতিক শিক্ষা নেই।’’

◾পাঠ্যানুভূতি-
------------------------------------
পুরো বইটি পড়ে খুবই ভালো লেগেছে। অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরেছি। বিশেষকরে বইটিতে ইসলামি ও পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদদের মতামত গুলো আলাদাভাবে নজর কেড়েছে। পশ্চিমারা যে চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে মুসলমানদের বিজ্ঞানকে ঘষেমেজে আবার মুসলমানদেরকেই ফিরিয়ে দিয়েছে সেটা বেশ স্বচ্ছভাবেই লেখক তুলে ধরেছেন।

মূল বইয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে অনুবাদ করায় বইটির অনুবাদের মান বেশ ঝরঝরে, সাবলীল ও প্রাণবন্ত মনে হয়েছে। যার ফলে বইটি পড়তে গিয়ে পাঠক কোথাও বিরক্তবোধ করবে না। বইটির রচনাশৈলী এবং শব্দ চয়ন খুবই চমৎকার লেগেছে। তথ্য-উপাত্তের ব্যাপারেও আলাদা নজর দেয়া হয়েছে যা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা 'মক্তব প্রকাশনী'র প্রতিটি কাজই অসাধারণ। অনুবাদের মান, সম্পাদনার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় পেয়েছি। পৃষ্ঠাগুলো পড়ার সময় একবারের জন্যেও মনে হয়নি যে, কোন অনূদিত বইয়ের পৃষ্ঠা পড়ছি। রেফারেন্স হিসেবে বইটির প্রতিটি পাতায় কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করা হয়েছে। যা সত্যিই অনন্য। 

বিষয়বস্তুর সঙ্গে প্রচ্ছদটা বেশ মানানসই মনে হয়েছে। তাছাড়া বইটির বাইন্ডিং, পৃষ্ঠামান যেকোন পাঠককে আকর্ষণ করবে।

সবমিলিয়ে বলা যায়, সংগ্রহে রাখার মতো একটি বই।

◾সমালোচনা-
-----------------------------------
বইটি পড়ার সময় কয়েক জায়গায় মুদ্রণজনিত বানান ভুল চোখে পড়েছে। যদিও তা যৎকিঞ্চিত। আশাকরছি, পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন হয়ে আসবে।

◾শিক্ষণীয় বিষয়-
------------------------------------------
১) বইটি অধ্যয়নের মাধ্যমে পাঠকের চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করবে।

২) সৃজনশীলতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করবে এবং ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শিক্ষা লাভ করবে।

৩) পরাজিত মানসিকতা থেকে তরুণদেরকে বের করে আনবে।

৪) পাশ্চাত্যের কাল্পনিক মতবাদ ও ধ্যানধারণা সম্বন্ধে অবগত হতে পারবে।

৫) ইসলামী সভ্যতার সঙ্গে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সভ্যতার পার্থক্য করতে পারবে।

◾অভিমত-
-------------------------------------
আমার মতো যারা তরুণ আছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলবো যে, বইটি একবারের জন্যে হলেও পড়ুন। অনেক অজানাকে জানতে পারবেন। 

◾লেখক পরিচিতি-
----------------------------------------------
ড. ইউসুফ আল - কারযাভী ৯-ই সেপ্টেম্বর ১৯২৬ সালে মিশরের গারবিয়্যা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমান সময়ের ইসলামী চিন্তাবিদ, বিদগ্ধ আলেম। তিনি পড়াশোনা করেছেন মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তাঁর লেখা শতাধিক গ্রন্থ রয়েছে। সবগুলোই পাঠক মহলে ব্যাপক সমাদৃত।  

বর্তমানে তিনি কাতারে নির্বাসিত জীবনযাপন করেছেন। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ