আগুনি : লেখক : মাহবুব আজাদ | Aguni By Mahbub Azad Books

❛আগুনি❜ এক চিরজাগরূক রূপকথা...
  • বই : আগুনি [‘তেজোসৃপ ও তিলোত্তমা’ প্রথম খণ্ড]
  • লেখক : মাহবুব আজাদ
  • জনরা : এপিক ফ্যান্টাসি
  • প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২৯, ২০২১
  • প্রচ্ছদ : সুরঞ্জনা
  • অলংকরণ : লেখক, স্টুডিওসি, সুরঞ্জনা, সজীব ওসমান
  • পরিবেশনা : গল্পদ্রুম
  • মুদ্রিত মূল্য : ঐচ্ছিক
  • পৃষ্ঠা : ১২৯৬
  • Review & Photo Credit 💕 Peal Roy Partha



‘বড়োদেন রূপকথা’ বলা ❛আগুনি❜ যে বঙ্গদেশের সবচেয়ে বিশাল আর সমৃদ্ধে ভরপুর মন ভোলানো এপিক ফ্যান্টাসি সেটা লেখকের শিষ্ট আর কুশলতাসম্পন্ন লেখার মোহে পড়ে এড়িয়ে যেতে পারি না। টানা ছাব্বিশটি দিন আমি এই ❛আগুনি❜ নিয়ে ঘুরপাক খেয়েছি। বিপুল জ্ঞান নিয়েছি, শিখেছি এবং জেনেছি। তাই দিনগুলো কখনও ভুলার না। কখনোই না। বাংলায় এমন অসামান্য ফ্যান্টাসির সাক্ষী যে কখনও হব—তা না দেখেছি স্বপ্নে না ভেবেছি কল্পনায়। দীর্ঘ ছয় থেকে সাত মাস ❛আগুনি❜ পড়তে ব্যাকুল আমি—পইপই করে এধার-ওধার ঘুরে মরেছি। শুধুমাত্র পুরো গ্রন্থটি একটিবার করায়ত্ত করার আশায়। এক পর্যায়ে ভেবে নিয়েছি ❛আগুনি❜ আর পড়া হবে না। কিন্তু মন থেকে চাওয়ার ইচ্ছা প্রবল থাকায় অবশেষে আমিও ❛আগুনি❜ দিতে (পড়তে) পেরে নিজেকে শস্ত্রীর (চরিত্র) মতো কিঞ্চিৎ সৌভাগ্যশালী যে ভাবতে পেরেছি—এই অনেক। যদিও এই শস্ত্রীর আগুনি দিতে ঢের দেরি, হয়তো পরবর্তী কোনো এক খণ্ডে এর কর্মনির্বাহ হবে।




‘তেজোসৃপ ও তিলোত্তমা’ গ্রন্থমালার প্রথম খণ্ড ❛আগুনি❜। ১২৯৬ পৃষ্ঠার এই উপাখ্যানের আখ্যায়িকাকে খণ্ডে খণ্ডিত করে লিখতে গেলে বেলা ফুরোবে কিন্তু লেখা না। অল্প কথার মাঝেও যদি বিস্তারিত টেনে নিয়ে আসি; ক্ষমা করবেন। ❛আগুনি❜ কী বা কী তার কাজ সেই বিষয়ে পরে আলোকপাত করি। এই উপাখ্যানের বিষয়বস্তু নিয়ে যদি সম্যক ধারণা দিতে হয় তবে—জর্জ আর. আর. মার্টিনের ‘আ সং অব আইস অ্যান্ড ফায়ার’-এর মতো অন্যান্য এপিক ফ্যান্টাসি সিরিজের সাথে তুলনা করব! প্রশ্ন আসতে পারে—এক খণ্ড পড়ে এত বড়ো তুলনা কীভাবে দিচ্ছি? —আসলে না দিয়েও পারছি না। আমি যখন এই মহাকাব্যের ৭০০ পৃষ্ঠা অতিক্রম করি তখনই পুরোপুরি বুঝেছি যে, ❛আগুনি❜ উপাখ্যানের ক্ষমতা আছে সেইসব দুনিয়া কাঁপানো ফ্যান্টাসি সিরিজের সাথে টক্কর দেওয়ার। আর থাকবে না-ই বা কেন? এমন এপিক ফ্যান্টাসির বইয়ে আপনি প্রথমে কী খুঁজবেন—একটি জগৎ; যা অবশ্যই লেখকের কল্পনাপ্রসূত। এবং সেই জগৎ আমাদের জগতের মতো প্রাসঙ্গিক কিছু দিকের মিল থাকলেও নতুনত্ব হিসেবে থাকবে দেশ বা নগররাষ্ট্রগুলোর স্বতন্ত্র ভাষা, আচার, রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, খাবার, পোশাক, রাজনীতি, কূটনীতি, ধর্মচর্চা, ঋতু, পতাকা-সহ এমন অনেক বৈশিষ্ট্য যা খুব সহজে আলাদা করা যায়। কোনো দেশ বা রাষ্ট্র কেন আরেকটি রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে চলে, একে অপরকে নিপীড়ন করে এবং ক্ষমতা দিয়ে রাষ্ট্র দখলানোর (দখল করার) প্রচেষ্টাকে যুদ্ধের ময়দানে সামিল করে; এই সবটুকু কারণ এপিক ফ্যান্টাসিতে যেমন আছে তেমনই ❛আগুনি❜-তে রয়েছে।




শুধু এতেই লেখক পুরো জগৎ নির্মাণ শেষ করেননি। ❛আগুনি❜র মূল আকর্ষণ হচ্ছে বাংলাভাষার সফল ব্যবহার। অর্থাৎ ভাষার খেলা। একটিও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করে যে এমন উপাখ্যান লেখা সম্ভব; তা ❛আগুনি❜ না পড়লে হয়তো জানা হতো না। ভাষার এত সুনিপুণ ব্যবহার আর কারুকার্য আমি যেন বহু বছর পর দেখলাম। ফিরে পেলাম জগদ্‌বিখ্যাত লেখকের শ্রেষ্ঠ সব লেখনশৈলীর স্বাদ। লেখক মঙ্গলকাব্যের ধারায় যে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত তা নামধাতুজ ক্রিয়ার উপযুক্ত ব্যবহার দেখে সহজে আন্দাজ করা যায়। শুধু তাই না, লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজশেখর বসু ও সৈয়দ মুজতবা আলীর আশ্বাসদায়ী প্রবন্ধগুলো থেকে যে অনুপ্রেরণা খুঁজে নিয়েছেন তা ❛আগুনি❜-তে স্পষ্ট। লেখক এ-ও স্বীকার করেছেন এই উপাখ্যান পড়ে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও ননী ভৌমিকের রচনভঙ্গির ছাপ যদি কোনো পাঠক খুঁজে পেয়ে থাকেন—তিনি নিজেকে সার্থক মনে করবেন। আমি এক্ষেত্রে বলব, লেখক শুধু সার্থক নন—সার্থকতার সকল পরীক্ষায় তিনি পাশ মার্ক থেকেও বেশি কিছু করে দেখাতে পেরেছেন। নিজের স্বতন্ত্র লিখনপদ্ধতি দিয়ে পুরো উপখ্যানটিকে যে এমনভাবে ট্রিবিউট দিয়েছেন—তা মনোমুগ্ধকর। মুগ্ধতার পূর্ণ ছাপ ❛আগুনি❜-তে রয়েছে। শুধুমাত্র এই একটি দিক বিবেচনা করলেও বিশ্বের আলোচিত ফ্যান্টাসি সিরিজগুলোর সাথে ❛আগুনি❜ এক ঘাটে জল খেতে সক্ষম। ভাবতে পারেন কেন এত তুলনা টেনে লিখছি? —শুধুমাত্র বোঝানোর জন্য এত এত উদাহরণ টানতে বাধ্য হচ্ছি এ-ই। ❛আগুনি❜ এক এবং অদ্বিতীয়। বাংলায় এমন কাজ না আগে কখনও হয়েছে আর না ভবিষ্যতে হবে। এখন পর্যন্ত আমার পড়া বাংলা ফ্যান্টাসি হিসেবে ❛আগুনি❜ সেরার সর্বোচ্চ সিংহাসনে শোভিত হবে। যারা ইতোমধ্যে ❛আগুনি❜ পড়েছে আর যারা পড়বে; দুই-ই গোষ্ঠী সমান সৌভাগ্যবান। যারা পড়তে পারেননি ধৈর্য ধরুন—ধৈর্যের ফল সব সময় মিষ্টি হয়।




❛আগুনি❜-তে আকর্ষণের কমতি নেই। ভাষার ব্যবহারের রং ছড়িয়েছে সংলাপে। বাংলা শুদ্ধ ও আঞ্চলিক ভাষা থেকে পশ্চিমবঙ্গের ভাষা পর্যন্ত লেখক সংলাপে কৌশলে ব্যবহার করে রাষ্ট্রের পার্থক্যগুলো গড়ে দিয়েছেন। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের নাম নিয়ে বললে—অং, বং, হিং, টিং, চং ইত্যাদি ভূখণ্ডের নাম আসবে। একটু সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে দেখবেন বং মানে বংদেশ (বঙ্গদেশ)। বংদেশের ভাষা বংবুলি। লেখক ভাষাকে এখানে ‘বুলি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ভাষার নিপুণতার সাথে শব্দের খেলার জন্য ❛আগুনি❜ বিখ্যাত (একদিন অবশ্যই হবে)। শব্দ নিয়ে খেলা লেখকের অসামান্য গুণ। অল্পপ্রচলিত বা অচর্চিত শব্দের আধিক্য এই উপাখ্যানে ভরপুর। তাই যারা ‘শব্দখোর’ অর্থাৎ শব্দের খেলা দেখতে পছন্দ করে এবং নতুন নতুন শব্দ জানার ও শেখার চেষ্টা করছেন—তাদের জন্য ❛আগুনি❜ পছন্দের শিরোমণি হয়ে থাকবে। পর্তুগিস, ফরাসি, ইতালীয়, চৈনিক থেকে বাংলায় আগত যত শব্দের প্রয়োগ করা যায় লেখক তা করে দেখিয়েছেন। উপাখ্যানের শেষে এই শব্দ নিয়ে আলাদা ছোটোখাটো একটি অভিধানও রয়েছে। যা কি-না শুরুতে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন বা হতাশার কথা বললে একটি মানচিত্রের অভাব খুব বেশি ভুগিয়েছে। রাষ্ট্রের পার্থক্য আর সমুদ্রপথের রেখা আর দিকনির্দেশনার জন্য যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।




❛আগুনি❜র প্রেক্ষাপট যে শুধু স্থলের ব্যবহার রয়েছে এমন নয়। লেখক সমুদ্র আর জলদস্যুর মেলবন্ধনে এই উপাখ্যান হয়েছে আরও জীবন্ত। যতটা কাহিনি স্থলের—ততটা জলেরও। সমুদ্র এখানে ‘সায়র’ হিসেবে পরিচিত। যেমন লালাসায়র, সবুজসায়র। আর নগররাষ্ট্রের নামগুলো বেশ মজাদার। এই যেমন—জাঙিয়ার জংদ্বীপ, হিং ভূখণ্ডের শুক্তি, বহমিকা, গহীনটিং, গুলঘোর দ্বীপপুঞ্জ, চিরু, নাগিস্থান, ঝিনুয়া, বংদেশের গাংডুমুর ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে হাস্যজনক হলো চরিত্রদের নাম। লেখকের মুনশিয়ানার এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে এমন নামকরণের জন্য। সাধারণত বাংলা ফ্যান্টাসি বইগুলোতে নামের খটমটতার কারণে অনেক পাঠক অনাগ্রহ প্রকাশ করে বইগুলো পড়তে। শুধু নামগুলো জানা আর তাদের করণীয় কাজগুলো দেখার জন্য হলেও ❛আগুনি❜ পড়া উচিত।




বংদেশের শস্ত্রী বীর যে কি-না আগুনি দিতে বেরিয়েছে অজানার উদ্দেশ্যে। আগুনি হচ্ছে একটি পরীক্ষা। অনেকটা অগ্নিপরীক্ষার মতোই। তবে এই পরীক্ষায় কতল করতে হয় তেজোসৃপ-কে! তেজোসৃপ কী? —তেজোসৃপের পরিচয় যদি এক নামে দিতে হয় তা হলো—ড্রাগন অথবা কাল্পনিক Draco বর্গভুক্ত অগ্ন্যুদ্‌গারী খেচর সরীসৃপবিশেষ। এখানে লেখক এই তেজোসৃপের কয়েকটি প্রজাতি এবং তাদের কাজ এত বিস্তারিতভাবে দেখিয়েছেন যে অবাক হতে বাধ্য। বাংলায় যা আগে কেউ কখনও এত বিস্তারিত ভাবে দেখাতে পারেনি। যাহোক, এই তেজোসৃপ বধের সংকল্পকে ❛আগুনি❜ বলা হয়। অজানার এই পথে বীর সঙ্গী হিসেবে পায় দুরন্ত আর বিচক্ষণ উকিল মধুদামাদকে (নামটা মজার না?)। লক্ষ্য পূরণ করতে হলে সায়র পার হওয়া জরুরি। সেই সায়র পার হতে গিয়ে ঘটনাচক্রে পরিচয় ঘটে সারেং চাবুকমারুও (জাহাজের কাপ্তান নয় কিন্তু তবুও কাপ্তান) সাথে। একইভাবে সাক্ষাৎ হয় সকল ভাষার পারদর্শী ভিনবোন বাবাবতুতা এবং হাত দেখে ভবিষৎ বলা সত্য কথক গণকের সাথে। কথায় কথায় বীর জানতে পারে আগুনি দিতে হলে যেতে হবে শুক্তি নগরীতে!




শুক্তি নগরী হিং ভূখণ্ডের মধ্যভাগের বন্দর ও নগররাষ্ট্র। বংদেশের সীমানা পেরিয়ে সোপ্পার, লালসায়র, চেরু, সবুজসায়রের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আসতে হয় শুক্তি নগরে। বীরের এখন একমাত্র উপায় চাবুকমারুর সাথে ‘মিষ্টি কুমির’-এ (জাহাজ) চড়ে বসা। শুক্তি নগরে ঋজুকদম নগরপাল হলেও সেখানে চলে বণিকচক্রের ভরপুর বাণিজ্য ব্যাবসা। আছে রক্ষাচক্র এবং আড়ালে থাকা জাদুচক্র। শুক্তির সেনাপতি নাপো হচ্ছে এই উপাখ্যানের অন্যতম একটি চরিত্র। পাশাপাশি গণিতবাগীশ জালিলিও জলিলির (গ্যালিলিও ও জলিল মামুর অসামান্য মিশ্রন) দারুণ সব গবেষণা শুক্তি নগরের গুরুত্বপূর্ণ সম্বল। এই গবেষণার মধ্যে ‘তেজোসৃপের চোখ’ অথবা ‘আকাশে-উড্ডীয়মান-তেজোসৃপের-দৃশ্য-চক্ষুর-সম্মুখে-আনয়নপূর্বক-ভূমি-হতে-পর্যবেক্ষণের-যন্ত্র’ জলিলির অসামান্য আবিষ্কারের একটি। এ-যে দূরবীক্ষণ যন্ত্র আশা করি বলে দিতে হবে না। এমন একটা তেজোসৃপের চোখ প্রয়োজন শস্ত্রী বীরের যা ব্যতীত আগুনি দেওয়া সম্ভব না। শুধু চোখ না প্রয়োজন আরও অনেক কিছু; যা বীরকে খুঁজে নিতে হবে বিভিন্ন নগররাষ্ট্র থেকে। শুক্তি নগরে দেখা যায় রাজনীতি আর কূটনীতির জবরদস্ত খেলা। ঘরের শত্রু বিভীষণের প্রবাদ এই উপাখ্যানে দারুণ খাটে। এর বাইরে শুক্তির সাথে বহমিকার শীতল যুদ্ধে বণিকচক্রের এক চক্র—লবণ চক্রের ফেঁসে যাওয়া নিয়ে নগরপালের সাথে দ্বন্দ্ব, সেনাপতি নাপোর সাথে নগরপালের নাখোশ সম্পর্ক, জলিলির আবিষ্কারে কিয়াকনের ধর্মগুরুর প্রতিবাদ সব মিলিয়ে শুক্তির বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা পদে পদে যে রোমাঞ্চকর অনুভূতি জাগ্রত করবে সে-কথা বলে দিতে হবে না। পড়তে বসলে শুক্তির কুয়াশা আপনা‌-আপনি হাড় কাঁপিয়ে দিবে।




ধর্মের বিস্তারিত আখ্যান ❛আগুনি❜-তে বিদ্যমান। বিভিন্ন দেশের দেব-দেবীও ভিন্ন ভিন্ন। তাদের উপাসনার আচারেও রয়েছে ভিন্নত্ব। শুক্তি নগরে দাউদাউ দেবীর আবাসস্থল, বংদেশে সুজ্জি ও চান্নি ঠাকুর। অন্য কোনো দেশে আছে বাতাসের দেবী হুহু।




চরিত্রের দিক নিয়ে আরেকটু আলোচনা করলে উঠে আসবে বিশেষ তিনটি চরিত্র। পুরো উপন্যাসে ত্রাস সৃষ্টি করা নাত্থু, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী চরিত্র ইরারি এবং শুক্তি নগরের ঘুম হারাম করা সুন্দরী মৃগতনু। এই তিনটি চরিত্র পুরো উপাখ্যানের অন্যান্য চরিত্রদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একইসাথে কাহিনিকে দারুণ প্রভাবিত করতে এদের ভূমিকা অসামান্য। ❛আগুনি❜ উপাখ্যানে প্রত্যকটি চরিত্রের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। একে ওপরের সাথে মিল খুব কমই খুঁজে পাবেন। লেখকের এমন চরিত্রসৃষ্টির জন্য কুর্নিশ অবশ্যই জানাতে হয়। বইটি পড়া বন্ধ করলে চরিত্রগুলো মানসপটে ঘুরপাক খেতে থাকে আর ঘুমালে বাস্তবে চলাচল শুরু করে। তারা যেন আমাকেও টেনে নিয়ে যেতে চায় ওই লালসায়রে; যে আকাশে দুটো তেজোসৃপ মিষ্টি কুমিরকে পোড়ানোর ফন্দি আঁটে। এ-এক অদ্ভুত ভালোলাগা। যা ভাষায় প্রকাশ করেও কূল করা যাবে না।




আগুনি চরিত্র পুরুষপ্রধান হলেও দুই নারী চরিত্র আলাদাভাবে নজর কাড়ে। আগামীতে মিস্ত্রিদিদি হিসেবে পরিচিত ইরারি ও মৃগতনু যে কাহিনিতে ভালো প্রভাব ফেলবে তা অনুমেয়।




❛আগুনি❜-তে রয়েছে কবিতার ছড়াছড়ি। কবিতা-কে এখানে বলা হয় ‘কোবতে’। বাবাবতুতা একজন কবি, জংদ্বীপে কবিতা প্রতিযোগিতার আসর বসে। এই কবিতার ক্ষমতাও অনেক। বলতে পারেন রীতিমতো জাদুকরী ক্ষমতা আছে। জাদুর কথা যখন এসেছে এই নিয়ে বলি। এই মহাকাব্যে জাদুর প্রয়োগ খুবই সীমিত হলেও কার্যকারিতা অনেক বেশি। ‘আগুন’ জাদুর কিছু খণ্ড চিত্র দেখা গেলেও বাকি জাদুগুলোর ভোজবাজি হয়তো আগামী খণ্ডগুলোতে দেখা যাবে। তেজোসৃপের পাশাপাশি এই উপাখ্যানে আছে কুহকিনী। রক্তচোষা তার কাজ।




যুদ্ধ কৌশল বা সমরনীতি নিয়ে বললে, এমন কিছু নেই যা লেখক বর্ণনা করতে ভুলেননি। যুদ্ধের অস্ত্র থেকে শস্ত্র সবকিছুর উদাহরণ টেনেছেন সুনিপুণ ভাবে। ক্যাল্টাপুলের নাম হয়েছে এখানে ‘ঝপাং’; যা দিয়ে গোলা নিক্ষেপ করা হয়। এই কাজ করে গোলন্দাজরা। সেই সাথে ধনুকীর কাজের নমুনা সুচারুভাবে লেখা রয়েছে। বুদ্ধির খেলা যেমন এই উপাখ্যানে আছে তেমনই আছে হাস্যরসের মেলা। লেখকের আরও একটি অসাধারণ গুণ যে তিনি খুব সহজে পাঠককে হাসাতে পারেন। আমি নিজেও ক্ষণে ক্ষণে হেসে ওঠেছি। এমন রসবোধের বই সত্য বলছি—বহুদিন পড়িনি। তাও আবার ফ্যান্টাসিতে। ফ্যান্টাসি মানে শুধু জাদু নিয়ে মারামারি, কূটনীতি নির্ভর আর ষড়যন্ত্রের ফাঁদে ফেলে রাজ্য দখল অথবা আক্রমণী কাজকারবার না; তা লেখক অক্ষরে অক্ষরে বুঝিয়ে দিয়েছেন। ❛আগুনি❜ অবশ্যই প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য। আবার শুধু প্রাপ্ত বয়স্ক হলে হবে না, বাংলা ভাষা ও শব্দ নিয়ে অগাধ জ্ঞান না থাকলে এই উপন্যাস শতভাগ পাংশে লাগবে। লেখক যে ধৈর্য আর অধ্যবসায় নিয়ে বিশাল আখ্যানটি লিখেছেন তার রস পুরোপুরি আস্বাদন করতে চাইলে পাঠককেও তেমনটা ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের মূল্য চোকাতে হবে।




পরিশেষে বলব, ❛আগুনি❜ উপাখ্যান বাংলা ফ্যান্টাসির সম্পদ এবং আমাদের মতো ফ্যান্টাসি প্রেমীদের সম্পত্তি। লেখককে সাধুবাদ জানানোর ভাষা নেই, যেমনটা নেই প্রতিটি খুঁটিনাটি নিয়ে বিশদ আলোচনা করার। তবে এই বই নিয়ে একটা সময় তুমুল আলোচনা হবে বলে বিশ্বাস। বইয়ের অলংকরনের কথা আলাদা করলে বলতে হয়। কাহিনির সাথে সামঞ্জস্য দারুণ সব চিত্রকর্মের কারণে কিছু অস্পষ্ট বিষয়ও স্পষ্ট রূপে ধরা দিয়েছে। চিত্রগুলো দেখে মুগ্ধ হয়েছি। এমন কিছুও সম্ভবত আগে কোনো ফ্যান্টাসি বইয়ে হয়নি। আসলে না হওয়ার সারি এতই লম্বা যে আর তালিকা করতে ইচ্ছে করেনি। এমন জিনিস হাতে নিয়ে পড়ার অনুভূতি যে কেমন হবে—তা ভাবতেই ভালো লাগা দিগুণ হচ্ছে। আশা করছি ‘গল্পদ্রুম’ বইটির পেপারব্যাক বা হার্ডকপি সংস্করণ শীঘ্রই বাজারে প্রকাশ করবে।




এমন দারুণ উত্তেজনাকর দীর্ঘ এক যাত্রা, পদে পদে বিপদ আর বাস্তবতার শিক্ষা। নগরে নগরে সংগ্রাম সেই সাথে যুদ্ধের আগমনী বার্তা। ভালোবাসার ব্যর্থ গল্প আর আগুনি দেওয়ার সংকল্প। ভয়কে জয় করার সাহস আর শৈশবের তিক্ত স্বাদের যন্ত্রণায় লেখা ❛আগুনি❜ উপাখ্যান প্রতিটি চরিত্রের এক একটি নিজস্ব গল্প। যা অভাবনীয় আর অকল্পনীয়।




যারা ফ্যান্টাসি পছন্দ করেন অথবা না করেন; বাংলা ভাষা নিয়ে যাদের গর্ব সেই গর্বে গর্বিত হওয়ার আরও একটি সেতু এই ❛আগুনি❜। একবার এর ওপর দিয়ে হাঁটা ধরলে পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। মাঝে মাঝে এমন বই পড়লেও জীবন সার্থক মনে হয়। এখন নিজেকেও লেখকের মতো সার্থক মনে হচ্ছে।


একটি উক্তি দিয়ে লেখাটি শেষ করি,

❝জীবনে বড়ো লড়াই কালেভদ্রে আসে, ছোটো লড়াইগুলো আসে রোজ। ছোটোগুলো জিতে অভ্যাস করো।❞



বি.দ্র. ❛আগুনি❜ তিনটি ই-বুক খন্ডে বিভক্ত। আমি অনেক কষ্টে মেইলে ‘অনলি রিড’ অপশনে পড়েছি। ফাইল শেয়ারের কোনো অপশন নেই। তাই অযথা লিংক খুঁজে বিব্রত করবেন না। ধন্যবাদ। বাকি কোনোকিছু জানতে হলে, https://golpodroom.com/ ওয়েবসাইটে ঢুঁ মেরে দেখতে পারেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ