আল্লাহর কাছে সব বলে দেবো : জানে আলম | Allahor Kase Sob Boledebo

জানে আলমের সর্বশেষ কাব্য পাঠ : একটি সোনালি বিভব
হাসান আলীম

Title আল্লাহর কাছে সব বলে দেবো
Author জানে আলম
Publisher প্রতিভা প্রকাশ
Quality হার্ডকভার
Edition 1st Published, 2020
Number of Pages 80
Country বাংলাদেশ
Language বাংলা


জানে আলম একজন কবি। তিনি কবি হয়ে উঠেছেন। তাঁর সাথে কবিতার আঙিনায় পরিচয় তা প্রায় তিন দশকের। রূপগঞ্জ  থেকে অনেক কষ্ট করে কবিতার আড্ডায় যোগ দিতেন। কবিতা পাঠ করতেন আরও অনেক তরুণ ও প্রাজ্ঞ কবিদের সাথে। আমিও কবিতা পড়তাম এবং তুখোড় আলোচনা করতাম।ঢাকার অনেক সাহিত্য আসরে আমি আলোচনা করতাম। জানে আলম তার কোন কোনটায় যেতো।কবিতা পাঠ করতো। আমি তাকে তখন থেকে অনেক সম্ভাবনাময় কবি বলে মনে করতাম।
এবার অর্থাৎ গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর কবি আমাকে তার দুটি কবিতার বই উপহার দিলেন এবং একটি ছড়ার বইও।
কবিতার বই দুটোর নাম-১.আল্লাহর কাছে সব বলে দেবো(২০২১).২.গোপনে কাঁদো গোপনেই মুছে ফেলো অশ্রু (২০২০).বই দুটো প্রকাশ করেছে আরেক ধীমান কবি ও ছড়াকার মঈন মুরসালিন তাঁর প্রকাশনা সংস্থা 'প্রতিভা প্রকাশ 'থেকে। চমৎকার প্রোডাকশন, নান্দনিক সাজসজ্জা বইয়ের। দৃষ্টি আকর্ষণ করবে কবিতা প্রেমিদের।
কাব্য গ্রন্থ দুটোর নামকরণে রয়েছে অধ্যত্ম রসের চমক।
তিন দশকে অর্থাৎ নব্বই দশক থেকে এ পর্যন্ত তার বেশ কিছু ছড়া, কবিতা এবং সম্ভবত ছোটদের গল্পের বই বের হয়েছে। আমার কাছে তার বইয়ের তালিকা এ মুহূর্তে নেই। আর আমি এ সময়ে খুব সংক্ষেপে তার কবিতার বই 'আল্লাহর কাছে সব বলে দেবো' এর পাঠ প্রতিক্রিয়া জানাতে প্রয়াস পাবো।
জানে আলম একজন বিশ্বাসী এবং মূলধারার আধ্যাত্মিক আধুনিক কবি।অত্যন্ত সহজ করে বাণী প্রধান করে তিনি কবিতা লিখতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন।
তিনি ইকবাল, রুমি, তাবরেজ, মীর তকি মীরের কিছুটা অনুসারী। 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আনন্দরসের জারকে এবং সুন্দরের আবাহনে বাণী প্রধান করে কবিতা লিখতেন বেশি। নজরুল চিত্রকল্প এবং অলঙ্কারের বিচিত্র রসে রঙিন কবিতা লিখতেন।তার কবিতার প্রধান বিষয় ছিলো মানবতা,দ্রোহ এবং প্রেম।তার কাব্য ভাষা ছিলো চমকপ্রদ এবং নতুন। বাণী প্রধান কবিতাও লিখেছেন তিনি। তাঁর কবিতায় পরীক্ষা নিরীক্ষাও রবেছে।আরবি ছন্দে, সংস্কৃত ছন্দে এবং বাংলার প্রধান তিন ছন্দেই তিনি কবিতা লিখেছেন। 
জানে আলম ছন্দ জানাশোনা কবি। স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষর বৃত্ত  মুক্তক অক্ষর বৃত্ত এবং গদ্য ছন্দে তিনি কম বেশি ছড়া কবিতা লিখেছেন। 
তিনি ছন্দ সচেতন কবি কিন্তু তার
কবিতায় গভীর ব্যজ্ঞনাময় চিত্রকল্পের সমাহার এবং অলঙ্কারের আধিক্য নেই। তার কবিতা নীতিমালা এবং আধ্যাত্মিকতার পরিবৃত্তে ঘুরপাক খেতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে বেশি। 
তবে তাঁর কবিতায় নতুন মেসেজায়িত চিত্রল পঙক্তি রয়েছে। 
আমার মনে হয়েছে এ সময়ের একটি অন্যতম সেরা কাব্য গ্রন্থ এটি। এ গ্রহ্নে ৫২ টি কবিতা রয়েছে। এর অধিকাংশ গদ্যছন্দের চমৎকার কবিতা। তবে বেশ কিছু স্বরবৃত্ত ছন্দের, মাত্রাবৃত্ত ছন্দের এবং মুক্তক অক্ষর বৃত্ত ছন্দের কবিতা রয়েছে এ কাব্য গ্রন্থে। এটি একটি চমৎকার কাজ করেছেন তিনি। যে কোন প্রাজ্ঞ পাঠক এবং কবি তার এই একটি
কবিতার বই পড়ে বুঝতে পারবে তাঁর শক্তিমত্তা এবং বৈচিত্র্যময়তার ব্যাপারে।
গদ্য কবিতার কিছু উদ্ধৃতি-
 ১.
দৌড়াচ্ছো কেন?ঘুরে দাঁড়াও 
যার ভয়ে তুমি হাঁপাচ্ছ, সেতো কাগুজে বাঘ।
তার নিজস্ব কোন সত্তা নেই। কোন সত্ত্ব নেই 
সে কেবল ডামি।(দৌড়াচ্ছ কেনো? ঘুরে দাড়াও, পৃষ্ঠা ২৭)
২.তুমি তো অমাবস্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছো।
কি করে পাবে পূর্ণিমা চাঁদের দেখা। 
ভোরের হাওয়াকে উপেক্ষা করে কি করে ফোটাবে ফুল বলো?(এসো নিজেদের আপডেট করে নেই, পৃষ্ঠা -১০)
উপরোক্ত কবিতার উদ্ধৃতিতে দেখা যায় প্রতি পঙক্তিতে সুনির্দিষ্ট মাত্রা সংখ্যায় পর্ব বিভক্ত করা যায় না কিন্তু একটা প্রবাহমানতা এবং গতিশীলতার স্বাচ্ছন্দ রয়েছে। 
অক্ষর বৃত্ত মুক্তক ছন্দ -
১.শেষ রাতে কে আমার নিকটে আসে,কে?
পিনপতন নীরবতায় কার আগমন
আমাকে আকুল করে তোলে?(কে আমার নিকটে আসে,পৃ-০৯)
প্রতি পঙক্তিতে মোট মাত্রা মান ক্রম-১৪/১৬/১০।
২.কোথাও বোমা হামলার শব্দ শুনি না আর
ইথারে ভেসে আসেনা আর কোনো
জালিম শাহীর হুঙ্কার -(আল্লাহর কাছে সব বলে দেবো, পৃ-১৩)
প্রতি পঙক্তিতে মাত্রা মান ক্রম-১৫/১২/৯
স্বরবৃত্ত ছন্দ-
১.শোন প্রিয়/ নৈতিকতা 
যে তোমাকে/ ভালোবাসে
দুঃখ ব্যথার /অশ্রুজলে
তার কেবলই /দুচোখ ভাসে(শোন প্রিয় নৈতিকতা, পৃ-৭৯)
মাত্রা বিন্যাস-৪/৪, প্রতি পঙক্তিতে।
২.মিশতে পারি/ মাটির সাথে 
কিংবা শীতল/ পাটির সাথে 
মিশতে পারি /আরো
মুখে যদি/ হাসি থাকে/ কারো।(সাবাস সাবাস সাবাস,পৃ-৭৭)
মাত্রা
 বিন্যাস-৪/৪,৪/৪,৪/৪,৪/৪/২
মাত্রা বৃত্ত -
১.গাছপালা নদী/ কেউ নাস্তিক/ নয়
আল্লার প্রেমে /তারা মশগুল /রয়
মানুষেরা হয়ে/যায় পথহারা/কেউ 
দেখ চেয়ে তারা/কতো অসহায়/ফেউ(অনঘ অন্তমিল  ১৫.,পৃ-৫৫)
মাত্রা বিন্যাস-৬/৬/২,৬/৬/২,৬/৬/২,৬/৬/২ প্রতি পঙক্তিতে।
২.দেখো চেয়ে দেখো/ চেয়ে 
উঠোনের /রোদ
জাগাও জাগাও/তুমি
সুস্মিত /বোধ।(ঐ,পৃ-৫৭)
মাত্রা বিন্যাস প্রতি পঙক্তিতে-৬/৬/২,৬/৬/২।
প্রত্যেক কবির সৃষ্টির একটা লক্ষ্য
থাকে। জানে আলমও কোন লক্ষ্যহীন কবিতা লিখেন নি।তার
একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে। একটি সুস্থ ও কল্যানময় সত্য সুন্দরের সমাজের স্বপ্ন দেখেন তিনি। তিনি স্বাপ্নিক। মানুষকে সেই কাঙ্ক্ষিত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য স্বপ্ন দেখান এবং নিজের স্বপ্নের কথা এবং বিশ্বাসের কথা বলতে চান।তিনি বলেছেনও। কবিরা বিশেষ করে বড়ো কবিরা অনেক ক্ষেত্রেই সরাসরি বলেন না।তারা বলেন শিল্প করে।তারা ওয়াজও করেন না আবার শ্লোগানও দেন না।তবে তিনি যে ভাবেই বলেন তা কবিতা
করেই বলেন।
জানে আলমও তার দর্শন তার চিন্তার কথা অনেকটা শিল্পময় করে উপস্থাপন করেছেন। সমাজ, পরিবার এবং রাষ্ট্রের অসংগতি অত্যন্ত সুচারু ভাবে বলেছেন। তার এই বলাটা তার মতো হয়েছে। সহজ সবুজ আটপৌরে নীলাম্বরী পোশাকের 
আচ্ছাদনে আবৃত করে বলেছেন। 
বুঝতে কষ্ট হয়না।
কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে এটি পরিস্কার করা যায়-
১.কথা ছিলো সত্যেই খুঁজবো
সুস্মিত সুরভিত সুমধুর সুখ
যেভাবে নাহাল খুজে নেয় ফুল থেকে আসাল।
কিন্তু মিথ্যের মাদকতায় মোহিত হয়ে যাই
নিজের ভেতরে সৃষ্টি করি অজ্ঞাত রোগ।(নিশুতি রাতের সেজদার মতো,পৃ-১২)
২.দুঃখিত বাংলাদেশ, আমি দুঃখিত
ভোরের নির্জনে ব্যথিত বেদনায় থেকে থেকে 
শিস দেয়া দয়ালু দোয়েলের মতো
আমি দুঃখিত।(দুঃখিত বাংলাদেশ, আমি দুঃখিত, পৃ-১৪)
৩.ইউসুফ উজ্জ্বল পূর্ণিমা চাদকে
নির্বাসনে পাঠিয়েছ
অমাবস্যাকে প্রধান অতিথি করতে আর
বাঁধা থাকলো না।(পদক দাও পদক,পৃ-১৮)
৪.দুঃখ করো না,পৃথিবী আবার মরিয়ম ফুল হবে 
শুধু তোমাকে হতে হবে একটুকু ভোরের হাওয়া(পৃথিবী আবার মরিয়ম ফুল হবে, পৃ-২০)
৫.যে কোন সময় মৃত্যুদন্ড ঘোষণা হতে পারে 
এখানে তৌহিদীপ্রাণ যেন
হাজ্জাজ বিন ইউসুফের রাজত্বে 
জুবায়ের ইবনে তালহা।(তৌহিদ প্রাণের কথা,পৃ-৩২)
৬.ধর্ষকদের চলছে প্রজাপতি উত্সব
একটু পরেই মীরন আসবে
লুত্ফার দেহ করতে ব্যবচ্ছেদ
আপনারা করতালির জন্য প্রস্তুত হোন।
এইতো প্লাকার্ড হাতে দাড়িয়ে গেছে 
নগরীর শ্রেষ্ঠ গণিকা(পুটির ধ্যানে থাকা বক,পৃ-৩৯)
আমাদের চিরায়ত বাংলা সাহিত্যের, বাংলা কবিতার অলঙ্কার এবং চিত্রকল্পের সম্রাট কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ।এ সরনিতে আরও চমকপ্রদ হচ্ছেন জসিমউদদীন, আল মাহমুদ এবং শামসুর রাহমান। 
ষাট, সত্তর, আশি,নব্বই,  প্রথম দশক,দ্বিতীয় দশকের কেউ কেউ এ বিষয়ে ঝলসে উঠেছেন।
জানে আলমও বেশ কিছু চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন যা আমাকে ক্ষানিকটা আনন্দ দেয়।
তিনি মূলত বর্তমান সময়ের নির্ভিক এবং নিবিড় আদর্শবাদী, ঐতিহ্যবাদী তরুন কবি।
তিনি অকপটে তার বিশ্বাসকে চিত্রকল্পময় করতে কসুর করেন না।তিনি অত্যন্ত সত এবং কমিটেড কবি যেমন তিনি বলেন
 -১.আমরা তো পাপের পরশে কালো হয়ে যাওয়া /হজরে আসওয়াদ।
২.জান্নাতুল আদন থেকে হুর বালিকা /লোবার হাসির ছটা এনে /পৃথিবীকে
করে তুলবে মুগ্ধমধুর,সুস্মিত সুখের।
 ৩.এসো আমরা আমাদের 
অঙ্গিকার রক্ষায়/নিবেদিত হই/
নিশুতি রাতের সেজদার মতো।
৪.যাকে করেছো তুমি জেলে বন্দী,সে তো চাঁদের /চেয়ও অতি উজ্জ্বল ইউসুফ আলাইহিস সালামের /সহোদর-বেন ইয়ামিনের প্রতিচ্ছবি। 
৫.সুচারু সত্য সভ্যতার তুরতুস নগরীতে আসহাফে কাহাফ/যদিও আবার ফিরে এসেছিলো 
আমি আর ফিরে আসব না।
আমি জানে আলমের কাব্যচর্চার
ক্রমঅগ্রসরমানতা লক্ষ্য করেছি। তিনি আসলে নিজেকে দিনে দিনে আপডেট করছেন।তার স্বপ্নের সানুদেশে পৌঁছে যাবেন অচিরাৎ, অকস্মাৎ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ