আত্মার ব্যাধি গীবত : ওবায়দুল ইসলাম সাগর | Attar Badhi Gibot : Obaydul Islam Shagor

  • বই: আত্মার ব্যাধি গীবত
  • লেখক: ওবায়দুল ইসলাম সাগর 
  • পৃষ্ঠা: ৯৬
  • ধরণ: পেপ্যারব্যাক
  • প্রকাশন: ফাতিহ প্রকাশন
  • ফিক্সড প্রাইস: ১২০৳

বইটি এমন এক টপিকে লেখা! যার ব্যাধিতে আক্রান্ত গোটা সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র। এমনকি দ্বীনি মহলও এই ব্যাধির সংক্রামক থেকে রেহায় পাচ্ছে না। এমতাবস্থায় এই মারাত্মক ব্যাধির প্রতিষেধক হিসেবেই বইটি কাজ করবে ইনশাআল্লাহ। 

আবার অনেক ক্ষেত্রে গীবত করাও সওয়াবের কাজ, সেসব ক্ষেত্রগুলো না জানার কারণে, আমরা সওয়াব তো পায়ই না, বরং যেসব ক্ষেত্রে গীবত পাপের কারণ হয়, সেসব কাজেই আমরা অভ্যস্ত। তাই গীবত সম্পর্কে আমাদের জানা দরকার। বইটিতে গীবতের খুটিনাটি বিস্তর ও সহজ সাবলীল ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে।



প্রি-অর্ডার চলবে ২২ মে ২০২২ তারিখ পর্যন্ত ইন শা আল্লাহ।

আমরা সিয়াম পালন করি, সালাত আদায় করি, দান-সাদকা করি, যাকাত আদায় করি, হজ্ব পালন করি, ভালো কাজের আদেশ করি, খারাপ কাজের নিষেধ করি, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহভিত্তিক জীবন পরিচালনা করার চেষ্টা করি। পাশাপাশি আরও একটি কাজ ব্যাপকভাবে করি, তা হলো নেকি বিলানো। মনের অজান্তেই এতো সব ভালো ভালো কাজের কষ্ট করে অর্জিত নেকিগুলো বিলিয়ে দেয়াতেই যেন প্রশান্তি।

ভাবুনতো! এইযে এতোগুলো ভালো কাজ আপনি করলেন, আশা রাখেন যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আখিরাতে আপনাকে দয়া করে আপনাকে জান্নাত দান করবেন, কিন্তু আখিরাত জীবনে গিয়েই দেখলেন, অর্জিত সেই আমল, অলরেডি আপনি নিজ হাতেই বিলিয়ে দিলেন, অন্য মানুষকে। কেবল বিলিয়েই বসে থাকলেন না, তাদের পাপগুলোও নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। জান্নাতের দারপ্রান্তে গিয়েও অবশেষে ফিরে আসতে হলো ভয়ানক সেই জাহান্নামে। কেমন হবে সেই অনুভূতি?

হ্যাঁ গীবত এমনই একটি পাপ, যে পাপের কাফফারা কেবল সওয়াব দিয়েই আদায় করতে হয়। অথচ গীবতের ভয়াবহতা সম্পর্কে না জেনে, আমরা অনায়াসেই এই পাপে লিপ্ত। যখন কারোর গীবত করি, মনে হয় আমি তো ভালো কাজই করছি! অথচ বুঝে উঠতে পারি না, আমি আসলে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছি।
বইটি এমন এক টপিকে লেখা! যার ব্যাধিতে আক্রান্ত গোটা সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র। এমনকি দ্বীনি মহলও এই ব্যাধির সংক্রামক থেকে রেহায় পাচ্ছে না। এমতাবস্থায় এই মারাত্মক ব্যাধির প্রতিষেধক হিসেবেই বইটি কাজ করবে ইনশাআল্লাহ।

আবার অনেক ক্ষেত্রে গীবত করাও সওয়াবের কাজ, সেসব ক্ষেত্রগুলো না জানার কারণে, আমরা সওয়াব তো পায়ই না, বরং যেসব ক্ষেত্রে গীবত পাপের কারণ হয়, সেসব কাজেই আমরা অভ্যস্ত। তাই গীবত সম্পর্কে আমাদের জানা দরকার। বইটিতে গীবতের খুটিনাটি বিস্তর ও সহজ সাবলীল ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে।

গীবতের প্রকারভেদ

আমরা নিজেদের জানা অজানা অবস্থায় যে গুনাহটি নিঃসঙ্কোচ সবচেয়ে বেশি পরিমাণ করে থাকি তা হচ্ছে গীবত। এটি এমন এক গুনাহ, যা করার সময় আমাদের মনে হয় না—আমরা যে গুনাহ করছি।

গীবতের ক্ষতিসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো, যার গীবত করা হয় তার আমলনামায় গীবতকারীর সওয়াব চলে যায় এবং গীবতকারীর আমলনামায় যার গীবত করা হয়; তার গুনাহ চলে আসে। এজন্যেই হযরত হাসান বসরী রহিমাহুল্লাহ যখন শুনতেন কেউ তার সম্পর্কে গীবত করেছে, তখন তিনি সে ব্যক্তির জন্য অনেক ফল এবং হরেকপদ মিষ্টদ্রব্য হাদিয়া হিসেবে পাঠিয়ে দিতেন এবং বলতেন : মাশাআল্লাহ, তিনি আমার অনেক উপকার করেছেন।

গীবত হচ্ছে গুনাহে কবীরা বা বড়ো গুনাহ। কুরআনুল কারীমে সূরা হুমাযার প্রথম আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন—

وبل لكل همزة لمزة

‘দুর্ভোগ প্রত্যেকের—যারা পশ্চাতে ও সমুখে লোকের নিন্দা করে।'

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন

‘তোমরা একে অপরের গোপন বিষয় অনুসন্ধান করবে না এবং একে অপরের আড়ালে নিন্দা করবে না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত  খেতে পছন্দ করবে? প্রকৃতপক্ষে তোমরা তো এটাকে ঘৃণ্যই মনে করো। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ তওবা গ্রহণকারী পরম দয়ালু।'৩

গীবত কতটা ন্যাক্কারজনক ব্যাপার—তা বুঝতে আমরা এই আয়াতের দিকে মনোযোগ দিই। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উল্লিখিত আয়াতে গীবত করাকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। লক্ষ করুন, এখানে আল্লাহ তায়ালা গীবতের ব্যাপারে কত শক্তিশালী ও পরিষ্কার তুলনা দিয়েছেন বান্দার বোঝার সুবিধার্থে। প্রথমত আদম সন্তান পরস্পর ভাই-ভাই, রক্তের সম্পর্কে না হোক; আচার-আচরণ ও প্রকৃতিগত দিক থেকে সকল মানুষ একই মৌলিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।

লোভ, ঘৃণা, হিংসা, সুবিধাগ্রহণ ইত্যাদি মৌলিক প্রবণতা সব মানুষের মধ্যেই কমবেশী রয়েছে প্রকৃতিগতভাবেই। সে হিসেবে সব মানুষই ভাই-ভাই। দোষী ব্যক্তি যে রকম রক্ত-মাংসের তৈরী মানুষ, গীবতকারীও তেমনই রক্ত-মাংসের তৈরী মানুষ। মুহূর্তের দুর্বলতায় পরিবেশ পরিস্থিতির প্রভাবে, শয়তানের প্ররোচনায় যে-কেউ কোনো একটি অপরাধ করে থাকতে পারে। সে-রকম অবস্থায় পড়লে কিংবা সে-রকম সুযোগ পেলে গীবতকারীও যে—সে অপরাধটি করত না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই স্বভাবগত দিক থেকে অপরাধকারী আর গীবতকারী একই বৈশিষ্ঠ্যের অধিকারী। স্বভাবগতভাবে তারা ভাই-ভাই।

তাই কেউ যখন অন্য একজন অনুপস্থিত দোষী ভাইয়ের নামে গীবত করে, তখন সে তার মৃত ভাইয়ের গোশত আহার করে বটে। এখানেও আল্লাহ তায়ালার তুলনাটা কত সুন্দর ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে লক্ষ করুন। এখানে ‘মৃত’ বলতে ‘অনুপস্থিত’ বোঝাচ্ছে। একজন ‘মৃত’ ব্যক্তির শরীর থেকে গোশত খুলে নিলেও মৃতব্যক্তি যেমন কোনো প্রতিবাদ করতে বা বাধা দিতে পারে না; তেমনই একজন ‘অনুপস্থিত’ ব্যক্তির নামে হাজারটা সত্য-মিথ্যা দোষের কথা বর্ণনা করলে অনুপস্থিত থাকার কারণে সেও—সেসব কথার কোনোরকম প্রতিবাদ করতে পারে না কিংবা নিজের স্বপক্ষে কোনো বক্তব্য পেশ করতে পারে না। অথচ সেই একই কথা তার সাক্ষাতে বললে, নিশ্চয়ই সে আত্মপক্ষ সমর্থন করে কোনো না কোনো কথা বলতে চাইত।  

গীবত কী?

জিহ্বা একটি মাংসপিণ্ড হলেও এটি হৃদয়ের দ্বার। এটি অন্তরের খবর সরবরাহ করে। এটি যেমন মানুষকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে ডোবাতে পারে, তেমনি সাফল্যের শীর্ষেও সমাসীন করতে পারে। অযথা ও অপ্রয়োজনীয় যাবতীয় কথা থেকে জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ রেখে আল্লাহ এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করাই ঈমানের অনিবার্য দাবী।

ঝগড়া-বিবাদ, তিরস্কার, মিথ্যা কথা, মুনাফেকি, পরনিন্দা, গালমন্দ ইত্যাদি থেকে যবানকে নিয়ন্ত্রণ রাখাই ঈমানের আবশ্যকীয় অংশ। জিহ্বাকে সংযত রাখার ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসে অসংখ্য উদ্ধৃতি আলোচিত হয়েছে।

ইসলামী শরীয়তে গীবতের হুকুম হলো হারাম ও কবীরা গুনাহ। তাই কুরআন হাদীসে গীবত থেকে বিরত থাকার জন্যে কঠোর থেকে কঠোরতর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তবে দেশ, সমাজ ও জাতির কল্যাণার্থে জালিম শাসক তথা নেতা-উপনেতার গীবত করা, দ্বীনের স্বার্থে যেকোনো মানুষের দোষের বর্ণনা দেওয়া, অত্যাচারীর স্বরূপ তুলে ধরা ও সংশোধনের উদ্দেশ্যে দোষের বর্ণনা জায়েয।

শরীয়তের পরিভাষায় কোনো ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার এমন কোনো দোষ ত্রুটি বর্ণনা করা—যা শুনলে সে অসন্তুষ্ট হয়, তাকে গীবত বলা হবে। তা বাচনিক কিংবা লেখনীর মাধ্যমে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে বা অন্য যেকোনো পন্থায়ই হতে পারে। আর যদি এমন দোষ বর্ণনা করা হয়— যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে নেই, তা হলে তা মিথ্যা অপবাদ হিসেবে গণ্য হবে। একেই কুরআনের ভাষায় ‘বুহতান' বলা হয়।

একটি কথা মনে রাখা জরুরী, ব্যক্তি মুসলমান হোক কিংবা অমুসলিম; গীবতের ক্ষেত্রে ব্যক্তির ধর্ম দেখার কোনো সুযোগ নেই। আপনি মুসলিম হয়ে একজন অমুসলিম ব্যক্তির গীবত করার ইখতিয়ার রাখেন না। অমুসলিম ব্যক্তিকে নিয়ে গীবত জায়েয মনে করা চরম পর্যায়ের মূর্খতা।

আমাদের লক্ষ রাখতে হবে, অনুপস্থিত জীবিত বা মৃত যেকোনো লোককে গালি দেওয়া মহাপাপ, এবং কোনো মুমিনকে গালি দেওয়া কবীরা গুনাহ। আর যাকে গালি দেওয়া হয়, তার কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া এই কবীরা গুনাহ মার্জন করা হয় না। তাই অন্য কবীরা গুনাহের চেয়ে গীবতের গুনাহ মারাত্মক এবং ভয়াবহ। এটাও একধরনের হক, যা গীবতকারীর কাছ থেকে ক্ষমাপ্রার্থনা ছাড়া মাফ সম্ভব নয়। তাই কাউকে গালমন্দ করা কোনো মুমিনের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না—বরং এটি মুনাফিকের নিদর্শন মাত্র; আর কোনো মুনাফিক প্রকৃত অর্থে ঈমানদার হতে পারে না।

কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি লক্ষ করলে দেখা যায়, গীবত সম্পর্কে মানুষের ধারণা খুব কমই রয়েছে। আমরা এমন অনেক কথা-বার্তা, আচার-ব্যবহার এবং কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত; যেগুলো গীবত পর্যায়ের গুনাহ, কিন্তু অজ্ঞতাবশত আমরা অধিকাংশই গীবতের প্রকারভেদ সম্পর্কে ধারণা রাখি না। সেজন্য আমরা অজান্তেই গীবত করে বসি। আমরা শুধু মনে করি বা ধারণা রাখি, লোকের অনুপস্থিতিতে তার দোষ-চর্চাই গীবত, কিন্তু এর বাহিরেও যে গীবতের নানান প্রকারভেদ রয়েছে সে সম্পর্কে আমরা অবিহিত নই।

মৃতব্যক্তির গীবত

জীবিতের গীবত যেমন হারাম, তদ্রূপ মৃতব্যক্তিকে গালি দেওয়া, তাদের মন্দ বলা, তাদের দোষ-ত্রুটির বর্ণনা করা এবং গীবত করা সবই হারাম; যদিও তারা জীবদ্দশায় পাপকর্মে লিপ্ত ছিল।

এ ব্যাপারে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে

বলেছেন—

‘তোমরা মৃতদের গালি দিয়ো না, কারণ তারা তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান পাওয়ার স্থানে পৌঁছে গেছে।

‘তোমাদের মধ্যে কেউ মারা গেলে তাকে ছেড়ে দাও এবং তার গীবত কোৱো

না।

‘তোমরা মৃতব্যক্তির সৎগুণাবলী আলোচনা করো এবং তাদের গীবত থেকে বিরত থাকো।”

হাদীসের বাণী ছাড়াও বিবেকের দাবি এমন যে, মৃতদের গীবত আমাদের জন্য উচিত নয়। এর তিনটি কারণ উল্লেখ করা যায়।

এক. মৃতব্যক্তি জীবিত ব্যক্তির গীবত করতে অক্ষম। অতএব জীবিত ব্যক্তিরও

উচিত, মৃতব্যক্তির গীবত না করা।

হযরত আবু দারদা রাদিআল্লাহু আনহু প্রায়ই কবরস্থানে যেতেন এবং কবরের পাশে বসতেন। লোকেরা এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন, “আমি এমন লোকের নিকট বসি, যারা আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং
কিতাবুল-তারগীব ওয়াত তারহীব
* আবূ দাউদ, কিতাবুল-বিররি ওয়াস-সিলাহ
· আবূ দাউদ

দৈহিক কাঠামোর গীবত

জীবনে এতশত ভালো কাজ করলেন; অথচ একটি ভুলের জন্যে জান্নাত থেকে বঞ্চিত হয়ে; হয়ে গেলেন জাহান্নামী—কেমন হবে তখনকার অনুভূতি?

বর্তমান সমাজে মহামারীর আকার ধারণ করেছে এমনই এক ধরনের গীবত। এমন গীবত নির্দ্বিধায় সবাই অসহনীয় মাত্রায় করে যাচ্ছে; দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই গীবত সম্পর্কে মানুষের তেমন কোনো ধারণাই নেই। আর এটা হলো দৈহিক কাঠামোর গীবত।

কোনো ব্যক্তিকে ছোট বা হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে তার দৈহিক ত্রুটির উল্লেখ করে গীবত করা হারাম। যেমন : এভাবে বলা হয় যে, অমুক ব্যক্তি খুবই স্থূলদেহী বা বেটে, তার নাক লম্বা, চোখ খুবই ছোট অথবা দেখতে খুবই কুৎসিত, কানে শোনে না, চোখে দেখে না, নাক কাটা। এভাবে কারো দৈহিক ত্রুটি বর্ণনা করে তাকে অপমান করাও গীবতের অন্তর্ভুক্ত।

ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু বলেন

আল্লাহ তায়ালা মুমিন বান্দার যেকোনো ধরনের গীবতকে হারাম ঘোষণা করেছেন; যেরূপ তিনি মৃত প্রাণীর গোশত খাওয়াকে হারাম করেছেন।১২

মুহাম্মাদ বিন সীরিন রহিমাহুল্লাহ বলেন—

এক ব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলে ফেলেন যে, সে খুবই কালো। অতঃপর তিনি বলেন আমি তার গীবত করে ফেলেছি। তাই আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

গীবত ও চোগলথোরীর পার্থক্য


অনেক মানুষ মনে করে থাকে, যার মধ্যে যে দোষ-ত্রুটি নেই, তার সে দোষ ত্রুটি বর্ণনাই হচ্ছে গীবত; এই ধারণা মোটেই সঠিক নয়। গীবত হচ্ছে তা-ই, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে যে দোষ-ত্রুটি বিদ্যমান রয়েছে, সে দোষ-ত্রুটি অপরের কাছে বর্ণনা করা।

আর চোগলখোরী হচ্ছে, কারো মান-সম্মান ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্যে বা পরস্পরের মাঝে শত্রুতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কারো নামে মিথ্যা দোষ-ত্রুটি প্রচার করে বেড়ানো; যা অভিযুক্ত ব্যক্তির মাঝে নেই।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন—

‘আমি কি তোমাদের হুঁশিয়ার করব না; চোগলখোরী কী? তা হচ্ছে কুৎসা রটানো; যা মানুষের মধ্যে বৈরিতার সৃষ্টি করে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন, নিশ্চয়ই কোনো ব্যক্তি সত্য কথা বললে সত্যবাদী লিপিবদ্ধ হয়; আবার কেউ মিথ্যা বললে মিথ্যাবাদী লিপিবদ্ধ হয়। ২৬

কুরআন-হাদিসে চোগলখোরের সমালোচনার সাথে কঠোর হুশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে। আবার অনেক স্কলারগণ চোগলখোরীকে গীবতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, তবে নিঃসন্দেহে চোগলখোরীও একটি মারাত্মক অপরাধ।


‘ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টির জন্যে একের কথা অপরের নিকট পৌঁছানোকে চোগলখোরী বলে। ২৭

চোগলখোরদের উদ্দেশে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেন—

‘আর তুমি আনুগত্য কোরো না প্রত্যেক এমন ব্যক্তির; যে অধিক কসমকারী, লাঞ্ছিত। পেছনে নিন্দাকারী ও যে চোগলখোরী করে বেড়ায়। ২৮

কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন স্থানে যারা ‘পেছনে নিন্দাকারী, একজনের কথা অন্যজনের কাছে লাগিয়ে বেড়ায়'—তাদের নিন্দা করা হয়েছে। তাদের সম্পর্কে কঠিন সাবধানবাণীও শোনানো হয়েছে। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন—

‘কাত্তাত (যে একের কথা অন্যের কাছে লাগিয়ে বেড়ায়) জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ২৯

ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন মদীনা বা মক্কার বাগানগুলোর মধ্য থেকে কোনো এক বাগানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি এমন দু-ব্যক্তির আওয়ায শুনতে পেলেন, যাদের কবরে আযাব দেওয়া হচ্ছিল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এদের দু-জনকে আযাব দেওয়া হচ্ছে, অথচ কোনো গুরুতর অপরাধে তাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না। তারপর তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, এদের একজন পেশাব করতে গিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করত না; অপর ব্যক্তি চোগলখোরী করত।' অতঃপর তিনি একটি খেজুরের ডাল আনতে বললেন এবং তা ভেঙ্গে দু-টুকরো করে প্রত্যেকের কবরের উপর এক টুকরো করে রাখলেন। তাঁকে বলা হলো—'হে আল্লাহর রাসূল, কেন এমনটা করলেন?' তিনি বললেন, ‘আশা করা যেতে পারে; যতক্ষণ পর্যন্ত এ দু-টি ডাল শুকিয়ে না যায়, তাদের আযাব কিছুটা হালকা করা হবে।

গীবত ত্যাগের উপকারিতা

প্রথমত গীবতের যে সমস্ত বিষয়গুলো সমাজ, রাষ্ট্র, জাতি, গোষ্ঠী ও ব্যক্তির অপকার বয়ে আনে, ঠিক তার বিপরীত উপকার সাধিত হয় গীবত পরিহারের মাধ্যমে। এর বাহিরেও নিজের আমল, ইখলাস, আখলাক পরিশুদ্ধ হয় গীবত ত্যাগের মাধ্যমে। দুনিয়ার পাশাপাশি সবচেয়ে বড়ো যে উপকার; আখেরাতের কল্যাণ তো রয়েছেই।

ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো একটির সাথে অন্যটি এতটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ যে, একটি বাদ দিয়ে অন্যটি গ্রহণ সম্ভব নয়। আবার সেই একটি গ্রহণ করলেও সেটা পরিপূর্ণ হয় না। বিগত পর্বগুলোতে আমরা দেখেছি, গীবতকে কেন্দ্র করে; এর মাধ্যমে জড়াতে হয় আরও নানাবিধ পাপ এবং নিন্দনীয় কাজে। ঠিক তেমনিভাবে গীবত পরিহার করলে গীবত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সাথে সাথে এর মাধ্যমে সংঘটিত হওয়া অন্যান্য পাপসমূহ থেকেও পরিত্রাণ পাওয়া যায়। যেটা গীবত পরিহারের সবচেয়ে বড়ো উপকার।

এর বাহিরেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপকার রয়েছে, যেগুলো গীবত পরিহারের মাধ্যমে অর্জিত হয়। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলো—

এক. গীবত করা মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমতুল্য। যে ব্যক্তি গীবত

পরিহার করে সে এমন জঘন্য পাপ থেকে বেঁচে যায়।

দুই. গীবত করা যেনার চেয়ে মারাত্মক এবং জঘন্য অপরাধ, যে ব্যক্তি গীবত পরিহার করে সে এমন গর্হিত অপরাধ থেকেও বেঁচে যায়।

তিন. গীবত করার মাধ্যমে রোযার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ ইবাদত নষ্ট হয়ে যায়। অতএব যে গীবত পরিহার করে সে নিজের রোযাকে সহীহ রাখতে পারে। এভাবে আমরা সতর্কতার সাথে রমযানের রোযা পালন করতে পারি।

চার. গীবতের দ্বারা অযুও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্যে হানাফী মাযহাব মতে কোনো ব্যক্তি অযুর পর গীবত করলে বা মিথ্যা বললে, তার উচিত পুনরায় অযু করা।

হযরত ইবরাহীম নাখভী রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত— ‘দুটি কারণে অযু ভঙ্গ হয়, পায়খানা-প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে কোনোকিছু বের হলে

এবং কোনো মুসলিমকে কষ্ট দিলে।'৩২

মুহাদ্দিসীনে কেরাম এই হাদিসের আলোকে অযুর পর গীবত করলে পুনরায় অযু করার নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা গীবত সেটাই, যেটা শুনলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কষ্ট পায়।

উপর্যুক্ত বিষয়গুলো খেয়াল করলে দেখা যাবে, ইসলামে শিরকের পর জঘন্য পাপটি হলো যেনা-ব্যভিচার, আর গীবত এরচেয়ে মারাত্মক; তা হলে গীবত পরিহারের মাধ্যমে কত বড়ো পাপ থেকে আমরা বেঁচে যাচ্ছি।

নামায আদায় এবং কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে অযু। নামায এবং রোযা ইসলামের মৌলিক পাঁচটি বিধানের মধ্যে অন্যতম দুটি শর্ত। তা হলে গীবত করার মাধ্যমে এ দুটি জিনিস যেমন নষ্ট হচ্ছে, আবার গীবত পরিহারের মাধ্যমে এই দুটি জিনিস তার ভিত্তি ধরে রাখছে। অতএব, আমরা যেন গীবত পরিহারের মধ্য দিয়ে সবকিছুর ভিত্তি ঠিক রাখি।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের সবাইকে গীবত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার তাউফিক দান করুন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ