অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে যে গল্পগুলো পড়বেন : তানজীম রহমান - যে কারণে বইটি পড়বেন!

  • এক ঝলকে বইঃ
  • অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে যে গল্পগুলো পড়বেন
  • লেখকঃ তানজীম রহমান
  • আদী প্রকাশন
  • পৃষ্ঠাঃ ৩৬৮
  • অধ্যায়ঃ ৩
  • গল্প সংখ্যাঃ ২১




“তারা বাবা-মা, তাদের জন্মই হয়েছে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে, কৈশোরের জটিলতা তাদের কোনদিন পার করতে হয়নি।”
আচ্ছা, এই কথাটা কৈশোরে ভাবিনি, এমন কেউ কি আছি? তবুও কৈশোরে এই কথা ভাবা আমরা যখন বাবা/মা হই, তখন আমাদের কিশোর সন্তানটাও এই একই কথা ভাবে।কারণ জীবন আদতে সরলরেখা নয় বরং একটা চক্র। জীবনের এক একটা ধাপে আমরা ঝপাৎ করে এক চক্র থেকে লাফ দিয়ে অন্য চক্রে জড়িয়ে যাই, আগের চক্রের এক বাক্স রহস্য অমীমাংসিত রেখে; এক ঝাঁক প্রশ্নের উত্তর না জেনেই। আমাদের জীবনের মতোনই কিন্তু আরো একটা ব্যাপার আছে যেখানে অমীমাংসিত রহস্য আর উত্তরহীন প্রশ্নের ঘনঘটা। কী সেটা? স্বপ্ন!


#পাঠ_প্রতিক্রিয়া - অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে যে গল্পগুলো পড়বেন
আপনাদের বেলায় কী হয় জানি না, আমার বেশিরভাগ স্বপ্নই অমীমাংসিত রহস্য হয়ে থাকে; হয় ভয় পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে যায় বলে স্বপ্নের শেষটা আমার জানা হয় না, নতুবা স্বপ্নের শেষটা মনেই থাকে না। স্বপ্নের মতোই অদ্ভুতুড়ে, অমীমাংসিত কিছু গল্প ঠেসে লেখক তানজীম রহমান বুনেছেন “অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে যে গল্পগুলো পড়বেন” বইটি।


আচ্ছা, বই পড়ে কখনো কি ইচ্ছে হয়েছে যে লেখককে মুখোমুখি বসিয়ে মনে জমা প্রশ্নগুলোর উত্তর তাঁর থেকে আদায় করে নেই? এই বইটা পড়ে আমার মনে হয়েছে লেখককে একটা চুপচাপ কফি শপে টেনে নিয়ে মুখোমুখি বসিয়ে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করি- এই যে আপনার মনে সুমনার ঠাই হবে না জেনেও আপনি তাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেললেন, ভালো হলো ব্যাপারটা?! বাঁশিওয়ালাকে এমন কাঠখোট্টা বানালেন ক্যান? আমি সবসময় কল্পনায় লোকটাকে “ক্যারিশমাটিক” দেখেছি! মনের ক্ষত নিয়ে এই যে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি তাতে কি চারপাশে ক্ষতহীন ক্ষতমানবও জন্মাচ্ছে তবে? কমোড বেয়ে কি আসতে পারে পানিমুড়া? লুকাশনির পিছু নিয়ে নিয়ে সুন্দরবন যাওয়া যায় না? ষোল নাম্বার বাড়িতে ডেলিভারি বয়টা কি বেখাপ্পা না কিংবা উড়ন্ত পান্থকে দেখে রুবার ছুটে আসার কথা না? দাদীর অন্যায়টা কী?- এইসব প্রশ্ন উদ্রেককারী গল্প জ্যমেয় ভু, শ্রোতা, ক্ষতমানব, চুল, লুকাশনি,ষোল নাম্বার বাড়ি চেনার তেরোটি উপায় আর কর্মপুলিশনিয়ে বইটার প্রথম অধ্যায়- হরর। প্রতিটা গল্প আসলেও অদ্ভুত ভয়ের মুখোমুখি করে দেয় পাঠককে। এই অধ্যায়ে আরো তিনটে গল্প আছে অবশ্য। অরণ্য গল্পটায় বেশ করে ভূতুড়ে বর্ণনা লেখক আনলেও এই গল্প আমার সবচেয়ে কম পছন্দ হয়েছে। এজন্যই গল্প শেষে গল্পের কোন রেশ মনে থেকে যায়নি।


সুর আর কারখানা নামে দু’টি গল্প নিয়ে কল্পবিজ্ঞান অধ্যায়। দু’টো গল্পই বিজ্ঞানের বিচারে সাদামাটা কারণ লেখক কমার্সে পড়েছেন (লেখকে ভাষ্যমতেই)। এই কাবঝাব কম থাকায় আর পরিধিতে ছোটখাটো বলে গল্প দু’টোর প্রেক্ষাপট খুব জমকালো কিছু মন হবে না। কিন্তু লেখক জিতেছেন শেষ দানে, দু’টো গল্পেরই শেষটা এমন যে পড়ে পাঠক বলে ফেলবে, “এভাবে তো ভেবে দেখিনি!”
অন্যরকম অধ্যায়ের গল্প সাতটা বাস্তবিকই অন্যরকম। পড়ে না ভয়ে কাঁটা দেয়, না দুঃখ দুঃখ বোধ হয়, না হয় আনন্দ-অনেকটা ঝাঁঝহীন স্প্রাইটে চুমুক দেয়ার অনুভূতি। সেই স্প্রাইটটাও যদি ঠান্ডা না হয় তবে যেমন অনুভূতি হওয়ার কথা, তেমনটা হয়েছে এই অধ্যায়ের “হাসি” গল্পটা পড়ে। এই গল্পের নাম “হাসি” হলেও সবচেয়ে হাস্যকর আসলে “জ্ঞান” গল্পটা; বদ জ্বীনওয়ালা একটা গল্প পড়ে যে এমন মজা পাবো ভাবিনি।


অন্যরকম অধ্যায়ে এসেও কিন্তু আমার প্রশ্নের ঝুড়ি খালি হয়নি। লেখককে আরেক দফা টেনে বসিয়ে জিজ্ঞেস করি –আচ্ছা, “শরনপন” নামটার বিহাইন্ড দ্যা স্টোরি কি আমি যেমনটা ভেবেছি তেমনই? বানান কিঞ্চিৎ অদলবদল করে নিয়েছেন? “একটি লজ্জাজনক ঘটনার ব্যবচ্ছেদ”-এ লজ্জাজনক ঘটনাটা কার সাথে ঘটলো বলেন তো? সেই লোকের বউ তো সুবিধের না! স্বামী শশুড়বাড়িতে এলে তাকে তো বউয়েরা সবসময়েই গুছিয়েগাছিয়ে রাখতে চেষ্টা করে! আর এই গল্পে কিনা এত গুরুতর সমস্যার সমাধান স্বামী বাবাজিকে বউ গুছিয়ে দেয়নি?! “প্রতিবিম্ব” গল্পে কোনটা আসলে প্রতিবিম্ব?


এই বইটার সবচেয়ে বড় আবেদন মনে হয় আসলে গল্পগুলোর অমীমাংসিত থেকে রহস্যময় হয়ে ওঠা। কিন্তু পাঠকমনে খচখচানি না রেখে শেষ হয়ে যাওয়া “থ্রিলার” অধ্যায়ের “সাক্ষাৎ” আর “ওকাম-এর উলটো ক্ষুর” গল্প দু’টো সেই আবেদনে কিঞ্চিৎ বালুচাপা দেয়ায় “থ্রিলার” অধ্যায়টাই হয়ে গিয়েছে বইটার চাঁদের কলঙ্ক! এই গল্প দু’টোকে এই বইতে মনে হয় তেমনটাই বেমানান লেগেছে যেমনটা ব্রণের দাগ না ঢাকা আমাকে বিয়েবাড়িতে লাগে। থ্রিলার গল্প হিসেবেও গল্প দু’টো মোটামুটি মানের। উপরোন্ত ওকাম-এর উলটো ক্ষুর-এ লেখকদের লেখার সময়ের মনোস্তত্ত্ব নিয়ে এমন বিশাল লেকচার দেয়া হয়েছে যাতে আমি অন্যরকম অধ্যায়ের স্বদেহভোগী গল্পের খুনী কে সেটা আগেই বুঝে গিয়েছি- লেখক নিজেই নিজের জালে ধরা পড়ে গিয়েছেন...


এই খাপছাড়া থ্রিলার অধ্যায়টা বাদ দিলে বইটা একটা ভালোবাসা। লেখকের লেখনী মাখনের মতো বলে অদ্ভুত সব গল্পের উপস্থিতি থাকার পরেও তেমন ধাক্কা না খেয়ে, দুই রাতে দুই বসায়, তিন অধ্যায় আর ২১ টি গল্পের ৩৬৮ পৃষ্ঠার বইটা শেষ করে ফেলা সম্ভব হয়েছে। আরেকটা কারণ হয়তো আদী প্রকাশনের এই বইটার পাতায় পাতায় বানান-ছাপার ভুলচুক তেমন চোখে না পড়া। বাঁধাই যদিও তেমন আরামের হয়নি; মোটা বই বলে দু’হাতে চেপেধরেই বইটা পড়তে হয়েছে।


এই বইয়ের গল্পগুলোর সবচেয়ে বড় আকর্ষন আসলে এটাই যে পড়ে পাঠক খুঁতখুঁত করবে, পাঠকের মাথার ভেতরে খচখচ করবে, একটা “অদ্ভুত অদ্ভুত” বোধ হবে। বইয়ের গল্পের মতো বইয়ের প্রচ্ছদও কেমন যেন অদ্ভুত ঘোর লাগিয়ে দেয়ার মতোন। এত সুন্দর যে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে; তাকিয়ে থাকতে থাকতেই গোলমান লেগে যায়- ঐ যে নীচে বাম কোণায় ওটা কি গ্যাস সিলিন্ডার?! গ্যাস সিলিন্ডারের পাশে এগুলো আবার কী? রঙিন ইট নাকি দাঁড় করিয়ে রাখা বই? মধ্যিখানে এটা কি চায়ের কেটলি?!- প্রচ্ছদের জন্য চিত্রশিল্পী আলী সাগর আর প্রচ্ছদ শিল্পী রুবেল অরভিল প্রশংসার দাবিদার।


অতিপ্রাকৃত গল্প পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য করার একটা বিশাল অস্ত্র হচ্ছে সত্যের সাথে কল্পনা মিশিয়ে পাঠককে গল্পগুলো “অবাস্তব হলেও অবিশ্বাস্য নয়” এমন একটা অনুভূতি দেয়া। এই কাজে লেখক শতভাগ সফল।

তাই তো লেখকের গল্প ফুড়োলেও আমার প্রশ্নগাছটি মুড়োলো না- আপনি কি আসলেই মনে করেন আপনার চোয়ালের গড়ন সুন্দর? আপনি আসলেই কি আমার মতো সকালে চা না খেয়েই সিএনজিতে চড়ে অফিসে যান যেন ঘুম ঘুম ভাবটা অফিসে গিয়ে চা খাওয়ার আগ পর্যন্ত না কাটে? আর চা’টা ঠিকঠাক খেতে না পারলে আপনার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকে? নিজের লেখা গল্পেও কি আপনি বেশি মানুষের সাথে কথা বলার ভয়ে নায়ক না হয়ে পার্শ্বচরিত্র হয়ে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন কথায় কথায় কি আসলেও “বা*’ শব্দটা ব্যবহার করেন? জুনায়েদ নামটা কি আপনার খুব পছন্দ? আসলেও কি এই গল্পগুলো কমবেশি আপনার স্বপ্নে পাওয়া? –প্রশ্নগুলি আসলেই লেখককে জিজ্ঞেস করতে মন চায়।


বই পড়া শেষ হয়েছে অনেক আগে। কিন্তু মাথার মধ্যে প্রশ্নগুলোর ছটফটানি থামছে না... রাফি-রাঙ্গার ওপর হিংসে হচ্ছে... লেখকের মুখোমুখি কখনোই হওয়া হবে না। কিন্তু লেখককে প্রশ্নগুলি হয়তো জিজ্ঞেস করে ফেলতেই পারি, আখতার সাহেবের মতোন ই-মেইল করে? আখতার সাহেবের ই-মেইল গল্পে পাঠক আখতার সাহেবের মেইল জায়গা করে নিতে পেরেছে; আমার মতো যেই পাঠক এত মনোযোগ দিয়ে লেখকের স্বপগুলোকে পড়েছে তার সরল কিছু প্রশ্নের উত্তরও হয়তো লেখক দিয়ে দিবেন অন্য কোন বইয়ে- স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি কী?


ক্ষতি নেই প্রশ্ন করতেও – আচ্ছা, লেখক কি আসলেও “নিখোঁজ” গল্পের বাবা-মা কৈশোর পায়নি ভাবা চরিত্রটির মতো মানুষদের দলে? নাকি “অকৃতজ্ঞ” গল্পের “আর দেখা দিও না” বলতে বলতেই নিখোঁজ হয়ে যাওয়া বাবা-মা’র মুখ আরেকটিবার দেখার জন্য ছটফট করা মানুষদের দলে?হয়তো আমরা সবাই-ই আসলে দু’টো দলেই আছি? তাই তো আমরা অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখি... স্বপ্ন দেখে অদ্ভুত সব গল্প লিখি... গল্প পড়ে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখি... চক্রে পড়ে ঘুরি... ঘুরতেই থাকি... ঘুরতেই থাকি...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ