বেলালের আত্মস্বর : সৈয়দ সালিম গিলানী | Belaler Attosor : Soiyod Salim Gilani

  • বই: বেলালের আত্মস্বর 
  • (হযরত বেলাল রাযি এর জীবনকাহিনী)
  • লেখক: সৈয়দ সালিম গিলানী
  • অনুবাদ: আবদুল্লাহিল বাকি
  • প্রকাশক: নাশাত পাবলিকেশন 
  • প্রচ্ছদ: ফয়সাল মাহমুদ 
  • পৃষ্ঠাসংখ্যা: ২৭৪
  • মুদ্রিত মূল্য: ৩৩৫/-
  • ধরন: হার্ডকাভার


বই প্রেক্ষাপট
আবিসিনিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ যুবক বেলাল। দাসের ছেলে হিসেবে জন্ম থেকেই দাস। সামাজিক মানুষ হিসেবে দ্বিতীয় স্তরের। কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে সকল মানুষ সমান। সে যেই বংশের আর বর্ণের হোক না কেন।

মক্কায় লাঞ্চনা, অপদস্থতা ছাড়া সে আর কিছুই পায় নি। কিন্তু পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল্লাহ (সা:) তিনি ব্যতিক্রম। তিনি ছাড়া আর কেউ দাস বেলালের দিকে তাকিয়ে একটিবার স্নেহের দৃষ্টিতে হাসে নি। আর তাঁর এই ছোট্ট মুচকি হাসিতেই বেলালের জীবন বাঁধা পড়ে গিয়েছিল। অদ্ভুত এক বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল বেলাল। আর তাইতো কাফেরদের সকল অবর্ণনীয় অত্যাচারও সয়ে নিতো।


বই অভ্যন্তরে:
“নাশাত পাবলিকেশন” থেকে প্রকাশিত বই “বেলালের আত্মস্বর”। বক্ষ্যমান গ্রন্থটি উর্দু ভাষায় রচিত সৈয়দ সালিম গিলানীর “বেলাল” গ্রন্থের ভাষান্তর। যেখানে বেলালের ইসলামপূর্ব জীবন থেকে ইসলাম পরবর্তী এবং মৃত্যু পর্যন্ত চিত্রায়িত হয়েছে মধুঢালা, প্রাঞ্জল শব্দে। বইয়ের উপস্থাপনা আর শব্দবিন্যাস এতটাই হৃদয়গ্রাহী যে পাঠক এক লহমায় তা শেষ করে নিতে পারবে।


বইটির বিশেষত্ব হলো “বেলালের জীবনী” নিয়ে মিথ্যা ও বানোয়াট গল্প বর্জিত, সহজবোধ্য অনুবাদ, চমৎকার উপাস্থাপনা, পর্যায়ক্রমিক ঘটনা প্রবাহ, ঘটনার পেছনের ব্যাখা সম্বলিত একটি বই। যা আমাদের বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য দারুণ এক সংকলন।

একজন গোলাম, যে তাঁর প্রকৃত মনিবকে চিনে নিয়েছিল, যাকে অবর্ণনীয় অত্যাচার করা হয়েছিল শুধুমাত্র এক আল্লাহতে বিশ্বাস করেছিল বলে, যাকে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল নিজের বিশ্বাসের বিনিময়ে সেই গল্পের নতুন সংকলন এই বই।

অনুবাদকের কথা

আরবের যে প্রেক্ষাপটে ইসলামের উত্থান ঘটেছে— সে সময় কতৃত্বশীল দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল রোম, পারস্য আর আবিসিনিয়া। সে সময়ের আরব বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ থাকলেও বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল— তা কিন্তু নয়। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে উপরোক্ত তিনটি রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল আরবের।

ইসলামের সামাজিক প্রেক্ষাপটও এর অভিন্ন ছিল না। এজন্যই মুসলমানরা প্রথম হিজরত করেছে আবিসিনিয়ায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য যেতে হতো তাদেরকে শামে। আর শাম ছিল রোম সাম্রাজ্যেরই একটি অংশ। আর ইয়েমেনের সাথে তো আবরের স্বাভাবিক যোগাযোগ ছিলই। ইয়েমেন তখন পারস্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

আরবজাতীয়তার অন্তর্ভুক্ত সাহাবিদের পাশাপাশি এই তিন অঞ্চল থেকেও আমরা প্রভাবদীপ্ত তিনজন সাহাবিকে দেখতে পাই ইসলামের ইতিহাসে। রোমদের পক্ষ থেকে সুহাইব রোমানি, পারস্য থেকে সালমান ফারসি আর আবিসিনিয়া থেকে বেলাল হাবশি।

সুহাইব রা. ছিলেন অত্যন্ত সুন্দর, ফর্সা। মাঝারি গড়নের উচ্চতা। তিনি আরবি পারতেন বটে, তবে তার উচ্চারণে রোমান ভাষার টান ছিল। কারণ তিনি শৈশব আর কৈশোর যাপন করেছেন রোমানের সংস্কৃতিতেই। পরে দাস হয়ে মক্কায় আসেন। শুরুর দিকেই ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হন।

সালমান ফারসি রাদিয়াল্লাহু আনহু জন্মগ্রহণ করেছেন ইস্পাহানের এক গ্রামে। সত্যের সন্ধানে বের হয়েছিলেন। অনেক ঘাটের জল খেয়ে পরে মদিনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

আর বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু আগমন করেছিলেন হাবশা থেকে। জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে। তার মাতা হামামা ছিলেন একজন প্রাক্তন আবিসিনীয় রাজকুমারী। বিয়ের সময় তিনি আর স্বামী রাবাহ স্বাধীনই ছিলেন। কিন্তু আমুল ফিলের ঘটনার পর আবিসিনিয়া শাসক-শূন্যতার দরুন বহিঃআক্রমণের শিকার হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দাসত্ব বরণ করতে হয় রাজকুমারীকে। তাই জন্মের সময় বেলাল দাস হয়েই জন্ম নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গী। কিন্তু তার ছিল দীর্ঘ দেহ আর প্রশস্ত কাঁধ।

তারা তিনজনই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ধর্ম হিসেবে মাথা পেতে নিয়েছিলেন ইসলামকে। কিন্তু আরবসংস্কৃতি অপেক্ষা তাদের মাঝে বেশি ছিল দেশীয় সংস্কৃতির প্রভাব। আরবে দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে তার প্রভাব যে পড়েনি, এমনটা অবশ্য


বলা যায় না।

যেমন, রোমানরা সাধারণত একটু বেশি অপচয় করে থাকে। এর নেতিবাচক নয়, ইতিবাচক প্রভাব সুহাইব রাদিয়াল্লাহু আনহুর মাঝেও ছিল। তিনি স্বাভাবিকভাবে ব্যয় করতেন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। তা ছাড়া রোমানরা একটু ঠান্ডা মেজাজের আর রসিকপ্রকৃতির হয়ে থাকে। তার মাঝেও এই রসবোধ ছিল অন্যান্য সাহাবির চেয়ে বেশি। আর পারস্য হলো অনেক আগে থেকেই—সবধরনের পির-মুরিদি, দরগাগিরি,

মরমিবাদের লালনক্ষেত্র। এরকম অনেক খানকায় সালমান ফারসি ঘুরে এসেছেন।

ইসলামগ্রহণের পরও তার মাঝে একটা মরমিবাদী মন সক্রিয় ছিল সবসময়।

আবিসিনিয়ার মানুষরা সাধারণত স্বচ্ছ হৃদয় আর ধর্মপ্রাণ হয়ে থাকেন। বেলালও তেমন ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি স্বজাত হাবশিদের মতো দক্ষ তিরন্দাজ ছিলেন। ছিলেন কষ্টসহিষ্ণু৷ উমাইয়া তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। তিনিও এর প্রতিশোধ নিয়েছিলেন বদরের ময়দানে। তির নিক্ষেপ করেছিলেন উমাইয়াকে লক্ষ করে। সে তির লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। আমূল সেঁধিয়ে গিয়েছিল তার ভেতরে।

তারা কেউ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না আরবসংস্কৃতির। উঠে এসেছিলেন দাস হিসেবে অন্য মাটি থেকে। ইসলাম তাদেরকে মহত্ত্ব দান করেছে, আরবজাতীয়তা নয়। এজন্যই তারা আরব গোত্রবাদকে খুব ঘৃণার চোখে দেখতেন। কিন্তু আরবদের রগ-রেশায় সম্প্রদায়-প্রীতি মিশে গিয়েছিল। সামাজিকভাবে ইসলামের সবচেয়ে বড় প্রচেষ্টা ছিল ধীরে ধীরে এই ভূত আরবের মাটি থেকে বিদায় করা। আউস আর খাযরাজের এই গোত্রবাদী বিবাদ যেন নিষ্পত্তি হয়ে যায়—এই আবেদনেই ইয়াসরিববাসীরা প্রথম বাইয়াতুল আকাবায় এসেছিলেন। নবীজির কাছে প্রস্তাব পেশ করেছিলেন।

সালমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর ভাগ্যই বলতে হয়। আব্বাসি খেলাফতের মতো একটি প্রভাবশালী খেলাফতের রাজধানী ছিল পারস্য; রোম বা আবিসিনিয়া নয়। বংশগত দিক থেকে আব্বাসিদের গর্বের প্রতীক ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস। কিন্তু জাতীয়তার প্রতীক ছিল পারস্যের মুসলমানদের কাছে সালমান ফারসি। তার জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয়ও সংরক্ষণ করে তারা নিজেদের জাতীয়তার মর্যাদা রক্ষা করেছে।

কিন্তু বেলাল ও সুহাইব-এর প্রাক-ইসলামি জীবনের কিছু অংশ-মাত্র পাওয়া যায় ইতিহাসে। সালমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতো এতটা বিস্তৃতভাবে তাদের প্রাক ইসলামি জীবনধারা ও কর্ম আলোচিত হয়নি।

বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর জীবনী সম্পর্কে লিখিত আদি উৎস হিসেবে আমরা দেখতে পাই হাদিস, আসার ( বর্ণনা), সিয়ার (জীবনীমূলক পুস্তক ও বিশ্বকোষ), তারিখ (ঐতিহাসিক বর্ণনার সংকলন)। বিচ্ছিন্নভাবে এসব গ্রন্থে বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর জীবন আলোচিত হয়েছে। 

বিভিন্ন কারণে তিনি বিশেষ গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়েছেন। একদিকে তিনি ছিলেন বহিরাগত আরব, কৃষ্ণবর্ণ দাস। অন্যদিকে ইসলামের জন্য নির্মম শাস্তির শিকার হয়েছেন কাফেরদের হাতে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন মসজিদে নববীর মুয়াজ্জিন। এতসব প্রাসঙ্গিকতার দরুন তাকে বিভিন্ন জীবনীতে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাকে নিয়ে বর্তমানেও বিভিন্ন গ্রন্থ রচিত হচ্ছে বাংলা, আরবি, উর্দু, ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায়।

উর্দু ভাষায় রচিত সৈয়দ সালিম গিলানীর ‘বেলাল' গ্রন্থটি বিভিন্ন দিক থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এখানে বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর জীবন, রাসুলের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা, অনুষঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে তারই মুখে, আত্মজৈবনিক স্বরে। যেন এটি কোনো আত্মকথা৷ এই পন্থায় জীবনী তুলে ধরার দরুন লেখক সেই যুগের বিভিন্ন বিষয় ও ঘটনার বিশ্লেষণ করার সুযোগ পেয়েছেন। রূপকথা, মিথ, বানোয়াট ঘটনার আশ্রয় না নিয়েও তিনি একে দিতে পেরেছেন ঔপন্যাসিক ভাষ্য— ঘটনার বিস্তৃতি, কথোপকথনের চমৎকারিত্ব ও বৈষয়িক ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে। তিনি যেই ঝরঝরে, স্বাদু গদ্যের প্রয়োগ করেছেন মূলগ্রন্থে, অনুবাদে সেটার একান্ত অনুকরণ ভিন্ন অন্য কিছুর কথা ভাবতে পারিনি আমি।

বইটির অনুবাদ ছিল দীর্ঘ একটা প্রমোদভ্রমণের মতো। বিভিন্ন বাঁক ও পথ পাড়ি দিয়ে সমাপ্তি ঘটেছে এর। ইসলামের প্রথম যুগের ঘটনাগুলোর অনুবাদ করার সময় মনে হচ্ছিল সেগুলোর একেকটি চিত্র ছায়াছবির পর্দার মতো জীবন্ত হয়ে উঠছে চোখের সামনে। কখনো ভেসে উঠছিল আনন্দের চিত্র, কখনোবা বেদনার। সেগুলোর প্রক্রিয়াগত প্রভাব পড়ছিল মনে। এর বাহ্যিক প্রকাশও এড়াবার শক্তি ছিল না আমার। ফলে কখনো চোখের কোণে জমেছিল বেদনার বিন্দুজল, কখনো ঠোঁটে ফুটেছিল আনন্দের উজ্জ্বলতা।

বইটাতে তথ্য ও বিষয়গত উপস্থাপনার চেয়ে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ঘটনার পরম্পরা, পাঠ-উপযোগিতা ও বিশ্লেষণের উপর। তাই কিছু স্থানে পাঠকের ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকে। সেসব স্থানে ব্যাখ্যামূলক ফুটনোট যুক্ত করে দিয়েছি। এতে বইয়ের মাহাত্ম্য খাটো হয় না, পূর্ণতা লাভ করে মাত্র।

বইয়ের রচনায় লেখকের ভাব যেমন উচ্চাঙ্গের, ভাষাও তেমনি প্রাঞ্জল, গতিশীল ও ওজস্বিনী৷ লেখক সৈয়দ সালিম গিলানী একাধারে সুনিপুণ বাকশিল্পী, কবি ও ভক্ত। তার আন্তরিকতাপূর্ণ ভক্তির ভাবোচ্ছ্বাস ও কাব্যের লালিত্য গ্রন্থটিকে সুষমামণ্ডিত করেছে। তার ভাব ও ভাষায় কাব্যের ললিত রচনায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে ভক্তিপ্রবণ মুসলিম-অন্তরের মর্মকথা। ভক্ত প্রেমিকের মধুঢালা রচনাবিন্যাস বইটিকে নিয়ে গিয়েছে অনন্য উচ্চতায়।

বই, বইয়ের লেখক ও অনুবাদকের প্রয়াস আল্লাহ কবুল করুন।

ফিকশনের মোরাকাবায় বেলালের রুহ

আপনি রুশ সাহিত্যের একটা বিপ্লবী উপন্যাস তুলে নেন, যেখানে লেনিনের শাগরেদদের সরল জীবনের হাসি-কান্না, দেয়াল টপকানো আর সংগ্রামের কথা আছে। সরল ভাষায়। দেখবেন আপনার চোখ ভরে উঠছে হঠাৎ পানিতে, লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, মনে জেগে উঠছে স্পন্দন। যতই আপনি দাগিয়ে দাগিয়ে আব্বাস মাহমুদ আক্কাদের আয়ুশ শু‘উব বা আবদুল্লাহ আজ্জামের লাল কর্কট পড়েন, যতই মার্কসবাদের খুনোখুনি সম্পর্কে শোনেন, বা মানুষের উদ্ভব-বিষয়ক তাদের তত্ত্বের ভুলের যত গভীর দুর্বলতার কথাই জানেন না কেন—তাদের কোনো এক গ্রীষ্মকালীন বক্তৃতা বা অক্টোবরের জেলখানার ক্ষুধা আপনার হৃদয় স্পর্শ করবে। সেইসব উপন্যাস আপনার জীবনের বোধ যেমন করে নাড়িয়ে দেবে তার সিকিভাগও পারবে না জহির রায়হানের 'হাজার বছর ধরে'র শেষ বাক্য—তার বিনির্মিত সাহিত্যের প্রেক্ষাপট। কারণ মার্কসীয় সাহিত্য গড়ে উঠেছে একটা বিশ্বাসের উপর, একটা আকুতি উপর, একটা সংগ্রামের ব্যর্থ ইতিহাসের লাল পতাকার উপর।

মানুষের কাছে—মানে আসলেই যারা মানুষের কাতারে উন্নীত—তাদের কাছে রক্তের চাইতেও মূল্যবান থাকে আপন বিশ্বাস ও ধর্ম। আরবিতে আছে, বিশ্বাস তাকেই বলে, যার শেষরক্ষা করতে গিয়ে মানুষ জাস্ট মরে যায়—যেন তার মৃত্যু সেই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করার একটা অদৃশ্য খুঁটি হয়ে আজন্মকাল দাঁড়িয়ে থাকে। তাই বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত জীবন ও তাদের মাটির গল্প শুনলে অন্তর জেগে ওঠে; সেটা যে ধর্মেরই হোক। দ্য পিয়ানিস্ট বা লাইফ ইজ বিউটিফুলে নাৎসিদের হাতে ইহুদিদের জীবন দেখে আমাদের চোখে যেমন পানি আসে একই রকম উত্তাপ আসে বাইবেলের Love the Lord your God with all your heart and with all your soul—এর অন্তর্নিহিত মর্মের স্পর্শে। সেই চিত্রটা নির্যাতন বা দুঃখের হওয়া জরুরি না; আপনি এমনিতেই কাঁদবেন একা একা থাকলে।

পৃথিবীতে ইসলাম এসেছিল হাজার বছর আগে পরম এক বিশ্বাসের শরবত নিয়ে—যারাই তা পান করেছে তারাই হয়ে গেছে কালের সুলেমান। তারা আমাদের মতো পয়দাগত ইসলাম নিয়ে পৃথিবীতে হাজির হননি। প্রত্যেককে চরম মূল্য দিতে হয়েছে নিজের বিশ্বাসের বিনিময়ে। তাদের সবাইকে নিয়েই একদিন রচিত হয়েছিল একটা সোনালি হিস্ট্রি, একটা পবিত্র বিস্তৃত দেয়ালচিত্র—যেগুলোকে অনুসরণ করার মিথ্যা নাম দিয়ে আমরা প্রত্যহ জীবনের দুঃখ ঘাটছি।

তাদের জীবনে নির্মম কষ্ট ছিল, তবে দুঃখ ছিল না। সেইসব কথাবার্তা নিয়ে অতীতেই গ্রন্থিত হয়েছে ইতিহাসের কোটি অক্ষর। মোটা মোটা কিতাব। যেখানে নবীর ঘটনা—তার চারপাশের মাটি ও মানুষের কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ‘উত্তম পুরুষের ক্রিয়াপদে’। নিখাদ পরিশুদ্ধ তথ্যময় ইতিহাস ছিল সেগুলো। অনেকে অনেকভাবে রচনা করছে তাদের কথা। সুন্দর ভাষায়, ফাউল ভাষায়,

আবেগের ভাষায় বা তাত্ত্বিক ভাষায়। শৈশবে আমাদের বাসায় সাহাবিদের অনেক জীবনী ছিল। আব্বু পড়ত আর ঝরঝর করে কাঁদত—আমার মনে আছে, অফিস থেকে এসে প্রায়ই আমাদের শোনাত সেই পাতা-ফুলহীন মরুজীবনের বিকেলের কথা। গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী খুলে আমি বসে থাকতাম অনেক। তিনি শান্ত নিঃশ্বাসে বর্ণনা দিতে থাকতেন তায়েফের দুঃখ অথবা নবীজির। বায়তুল মোকাররম থেকে ২০০৬-এর দিকে আব্বু কিনে নিয়ে এসেছিলেন আসহাবে রাসুলের জীবনকথার ছয় খণ্ড। সেখানে খালিদ বিন ওয়ালিদের যুদ্ধ-জীবনের গল্প পড়ছিলাম—রিডিং শেখার পর। পুরো শৈশবটা ভরে আছে আব্বুর আবেগঘন সাহাবা জীবনের চিত্রায়ণের স্মৃতিতে। তার হু হু করে কেঁদে ওঠার বিমূর্ত স্মরণের আবেশে। কোনোদিন ভোলা যাবে কিনা সেসব হারিয়ে যাওয়া দিনের কথা—জানি না। আমি অথবা ভাইয়া—সেই সংমিশ্ৰিত আধ্যাত্মিক সুরের ছোটবেলা নিয়ে বেঁচে থাকব মৃত্যু পর্যন্ত।

সম্প্রতি নাশাত পাবলিকেশন থেকে ভাইয়ার অনূদিত ‘বেলালের আত্মস্বর' বইটি বের হচ্ছে অপরূপ প্রচ্ছদে। প্রথমে যখন ভাইয়া অনুবাদটা নিয়েছিল আমি বলেছিলাম—ভালো কোনো বই নিতা! প্রতিউত্তরে কিছু বলেনি ভাইয়া। দীর্ঘদিন গত হয়েছে সেই সময়ের পর। ভাইয়াকে আহসান ইলিয়াস ভাই একদিন জানালেন, বইটি যেহেতু প্রকাশ পাচ্ছে শেষবার একটু দেখে দিন। ভাইয়া ফেলে রাখল নিজের বইয়ের শিটগুলো বাসায়। আমি নিয়ে এলাম একদিন সেগুলো মাদরাসায়। পড়লাম আর বারবার ঝাপসা হতে থাকল আমার চোখ। অত্যুক্তি মনে হলেও সত্যি— বই পড়ে কাঁদার মানুষ আমি না; তবু শিশিরের মতো কান্না জমল চোখে।

এখানে বইয়ের নাম দেওয়া হয়েছে যদিও বেলালের জীবন—তবে এটা শুধু বেলালের জীবন না। মুসার আন্দোলনের বিশ্লেষণ ও ঘটনাপ্রবাহের চিত্র যেমন ‘উত্তম পুরুষের তুলিতে আঁকা যায়, তেমনি লেখা যায় ইউশার কণ্ঠে বা হারুনের আত্মস্বরে।

একইভাবে ইসলামের উত্থান-পতন–দুঃখ-আনন্দ—বিজয় বা রক্তাক্ত সন্ধ্যার কথা এখানে আবৃত্তি করানো হয়েছে বেলালের জবানে, তার আজানের গন্ধবহ কণ্ঠে। আত্মজৈবনিক সুরে।

মুসলিমসভ্যতার দুটি গ্রেট সিলসিলার সফল বাস্তবায়ন ঘটেছে বেলালের জীবনে—এক ফ্রিডম বা স্বাধীনতার প্রেরণা, দুই রেসিজম বা কালো মানুষকে ঘৃণার পরিবর্তে ভালোবাসার শিক্ষা। এই দিক থেকে বেলাল একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র, ইসলামের আরবীয় পটভূমে। তার অনুভূতির মধ্য দিয়ে সেই ইতিহাসের আলোচনা বিশ্বাসের গভীর আগুনে বাঙময় হয়ে উঠেছে এই বইয়ে বারবার। বদর ওহুদ আকাবা বা মক্কা-মদিনার জীবন শুধু নবীর একার নির্দিষ্ট গল্প না; তাদের প্রত্যেকের গল্প সেই একটাই ছিল। তারা সকলে মিলেই একদিন বিনির্মাণ করেছিল অ্যারাবেস্কে ভরা এক মহিমান্বিত জায়নামাজ—যেটা আজকের পৃথিবীর জায়গায় জায়গায় যুগান্তরের মার খাওয়ার রক্ত নিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

হলিউড থেকে বেলালের জীবনের উপর একটা এনিমেশন নির্মিত হয়েছে ইংলিশে। সেইটার ট্রেইলার যখন ফেসবুকে ছাড়া হয়েছিল, এক ইংরেজ কমেন্টে বলেছিল—ইসলাম বাস্তবিকতার ধর্ম, ফিকশনের না। কয়েকটা দীনি বোন তার সাথে তর্ক জুড়ে দিয়েছিল। তবে তিনি বলতে চেয়েছিলেন—এনিমেশনে যেই বেলালকে দেখানো হয়েছে যে— Bilal lives a peaceful life with his mother and his younger sister in the outskirt of the village until the Byzantine soldiers come, enslave them and kill his mother. And one day she said Bilal-you have to be a great soldier in your future! এটা বাস্তবের বেলালের কাহিনি না। ইসলামকে মানুষের কাছে লোভনীয় করার জন্য আলাদা করে ইমোশনের মিথ্যা ক্ষেত্র তৈয়ার করার দরকার নেই, যৌক্তিকভাবে বাস্তব ঘটনার মধ্য দিয়ে এর যেই মাধুর্য আছে, তা তুলে ধরাই যথেষ্ট—মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য।

এই ক্ষেত্রে ‘বেলালের আত্মস্বর' সফল। উপন্যাসের নাম করে একটাও মিথ্যা প্রেমকাহিনি বানানো হয়নি এখানে। বানোয়াট কেচ্ছাও তুলে ধরা হয়নি।

যত খারাপ মানুষই হোক—আত্মজীবনের বয়ানে তাদের নিঃশ্বাস আদিম অনুভূতি ও স্মৃতির শান্ত রোমন্থনের সুরে ভরে ওঠে। যখন তারা অতীতের কথা বলে, প্রকাশ করা যায় না এমন এক নস্টালজিক ঘ্রাণ টান দিয়ে নিয়ে যায় কবরের দিকে— তারা মরে গেছে বহু বহুকাল আগে। শামসুর রাহমানের কালের ধুলোয় লেখা, সৈয়দ আলী আহসানের জীবনের শিলান্যাস, নেলসন ম্যান্ডেলার লং ওয়াক টু ফ্রিডম, বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসীর রিসালাতুন ইলাশ শুয়ুখ, আহমদ আমিনের হায়াতি, বা টাইটানিকের বৃদ্ধ মহিলাটির নিষ্প্রভ দৃষ্টির স্মৃতিচারণের কোলে শিল্পের যেই রূপ অঙ্কিত হয়েছে—তার সাথে অন্য কোনো কিছুর তুলনা চলে না দুনিয়ার।

একইভাবে বেলাল যখন দামেশকের মাটিতে বসে সুদূর অতীতে ফেলে আসা জীবনের সুন্দর সময়গুলোর বর্ণনা দিতে থাকে সরল মাধুর্যে সহজ মানুষের মতো— ভেতরে জেগে ওঠে কান্না।

এটা পড়ার আগ পর্যন্ত মনে হচ্ছিল–প্রথম কাজটা বাজে বই দিয়ে শুরু হলো ভাইয়ার। এখন মনে হচ্ছে—এটাই হওয়া দরকার ছিল প্রথম।

এটা উপন্যাস না, আত্মকথা; যেখানে একটা আন্দোলনের উত্থান-পতনের বহু প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা হয়েছে— কখনো আবেগে, কখনো দার্শনিক বিশ্লেষণে। সেগুলো পড়ে দেখা জরুরি। 
বইটির মধ্যে টেনে ধরে রাখার একটা ক্ষমতা আছে। কয়েকদিন আগে অনেক প্রস্তুতি নিয়ে রাহীকুল মাখতুম পড়েছিলাম— বইয়ের সাথে জোর করে নিজেকে বেঁধে৷ মহৎ বই মানেই টেনে ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে না। তবে এটা না থাকাও কোনো অপরাধ না।

আখের, বইটি আমার ভালো লেগেছে।
আবদুর রহমান রাফি মিশকাত, আকবর কমপ্লেক্স



আমি বেলাল বলছি

আমি বেলাল। গায়ের বরণ কালো। আবিসিনিয়ার এক নিগ্রো দাস রাবাহের ঘরে আমার জন্ম। দাসের ছেলে হিসেবে জন্ম থেকেই আমি দাস। দাসত্বের মাঝেই আমার চোখের আলো ফুটেছে। বেড়ে উঠেছি গোলামির শৃঙ্খল পায়ে জড়িয়ে। এই গোলামির মধ্য দিয়েই স্পর্শ করেছি যৌবন। দাস হিসেবে আমার বেচাকেনা হয়েছে বারবার...

এভাবেই হয়তো একদিন গোলামির দাগ বুকে নিয়ে, চাবুকের আঘাতে জর্জরিত হয়ে, পরিচয়হীন আমার নিষ্প্রাণ দেহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত ধুলোবালির স্তূপে। কিন্তু...

একদিন মক্কার বিখ্যাত ব্যবসায়ী উমাইয়া আমাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। এরপর শুধুই ইতিহাস...

জীবনের পড়ন্ত বেলায় এখন আমি দিনকাল যাপন করছি দামেশকে। অতীত স্মৃতির দিগন্তে উমাইয়া একটা অস্পষ্ট কালো দাগের মতো সুদূরপরাহত। একটা সময় ছিল—যখন এই কালো দাগ আমার জীবনের সকল আকাশ আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। আঁধারের পর্দা দীর্ণ করে বেরিয়ে আসার মতো আলোর ছিটেফোঁটাও ছিল না।

কালো অন্ধকার মেঘের মতো—কখনো সে ছড়িয়ে পড়ত। অথবা জমাটবদ্ধ

শিলাদৃঢ় হয়ে উঠত। তীব্র পাথর বৃষ্টির মতো বর্ষিত হতো কখনো। তবে ছিন্ন হতো না কখনোই গোলামির দুর্ভেদ্য প্রাচীর...

আমার আকাশে তার কালো মেঘ ছড়িয়ে পড়লে সমগ্র জগৎ—চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসত। জমাটবদ্ধ হলে বিশাল শিলাবৃষ্টির মতো আমাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিত। তার বজ্রধ্বনি গর্জে উঠলে নরকের কালো বৃষ্টির মতো চারদিক ফেটে পড়ত। বর্ষণ করলে তার চাবুকের আঘাতে বিশ্ব চরাচরের শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসত। এ থেকে রেহাই পাবার কোনো পথ ছিল না...

দাসদের জীবনে কোনো চড়াই-উতরাই নেই। বৈচিত্র্য নেই ঘটনার। সন্ধ্যা কেটে যায়, সকাল আসে। তাদের জীবনে সময়ের ধারা বয়ে যায় এভাবেই।

কিন্তু তাদের কারো জীবনে একবার যদি ট্রাজেডি নেমে আসে, তাহলেই সে নিঃশেষ ও নিস্তব্ধ হয়ে যায় চিরকালের জন্য। অন্য বিয়োগান্তক নাটকের জন্য তার জীবনে আর কোনো স্থান থাকে না।
তারা যদি কখনো লুটিয়ে পড়ে, তাহলে ওঠার সুযোগ থাকে না আর। জীবন একবার ভেঙে গেলে দ্বিতীয়বার জোড়া লাগা হয়ে পড়ে সাধ্যের অতীত। গোলামের জীবনধারা তাহলে কেমন? তাদের জীবন চাবুকের জন্য উৎসর্গিত

নিথর দেহ ছাড়া কিছুই নয়। যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে, যেকোনো কথার

মুখে তাদের দেহে হতে পারে চাবুকের অবিরাম বর্ষণ। উমাইয়া ছিল গর্বিত, আত্ম অহংকারী। ধনদৌলত, বংশগৌরবের অহংকারে অন্যদের সে নিজের অনুগত মনে করত।

আমার ব্যাপারে শুধু তার এতটুকুই জানা যথেষ্ট ছিল— আমি বেলাল, তার টাকায় কেনা গোলাম। এটুকুই। তার ব্যাপারেও আমার এতটুকু জানা যথেষ্ট ছিল—সে আমার মালিক। আমার মনিব।

মালিকের আনন্দ-ক্রোধ শুধু মালিকই জানতেন। গোলামের কোনো অধিকার ছিল না এসব জানার। জরুরিও ছিল না। কোনো প্রশ্ন অথবা কোনো বিষয়ে জিজ্ঞাসা করারও ছিল না কোনো অনুমতি।

তার একমাত্র কাজ—পরিস্থিতি অনুযায়ী ঠিক ঠিক কাজ আঞ্জাম দেওয়া। সঠিক হলে তার ভাগ্য ভালো। আর নয়তো তার কপালে থাকত ভিন্নকিছু। আজ যে দুনিয়ায় বেঁচে নেই, তার সম্পর্কে কোনো অযাচিত কথা বলতে চাই

না। তবে এতটুকু বলতে পারি, উমাইয়া মক্কার বাজার থেকে আমাকে খরিদ করার সময়, দাম আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো লুকোচুরি করেনি। পাই পাই করে গুনে আমার মূল্য চুকিয়ে দিয়েছে। আমিও কোনোদিন তার কোনো ক্ষতি করিনি। উমাইয়ার অনেক কথাই আজ স্মৃতির ঝাঁপিতে জেগে আছে। ভুলতে চেষ্টা

করেও কখনো পারিনি ভুলতে। আমি বেলাল। ছিলাম উমাইয়ার টাকায় কেনা এক গোলাম। সেই কুয়াশাঘন দিনগুলোর গল্প আপনাদের শোনাতে চাই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত... এক আশ্চর্যজনক অভিজ্ঞতায় ভরা এই জীবন—নিখাঁদ করুণ বাস্তবতার দুঃখাশ্রিত উচ্চারণ।

সেই দিনগুলোর নেশা আজ অবধি আমাকে মাতাল করে রেখেছে। আমার মতো গোলাম প্রায় বাইশ বছর সেই মাটিতে নিঃশ্বাস গ্রহণ করেছে, যাকে আমোদিত করে রেখেছে আল্লাহর সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি

ওয়াসাল্লামের শ্বাস-প্রশ্বাসের ঘ্রাণ। তিনি যা বলেছেন—আমি শ্রবণ করেছি। যা করেছেন—দু’ চোখ দিয়ে দেখে দেখে ধন্য হয়েছি।

কাবার আঙিনার দিনরাত

গ্রীষ্মকালের এক সকাল। অভ্যেসমতো উমাইয়া ব্যবসায়ী বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর জন্য বেরিয়ে গেছে। তখন ব্যবসায়ীদের জলসা বসত কাবার চত্বরে সামিয়ানার ছায়ায়। এমন সকালগুলো আমার বেশ ভালো লাগত। ব্যবসায়ীদের সাথে তাদের ক্রীতদাসরাও থাকত। খানিক দূরে বসে অপেক্ষা করত তারা আপন

মালিকদের ইশারার। এই সময় গোলামদের মাঝে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কানাঘুষা চলত। শোনা হতো অথবা বলা হতো সত্য মিথ্যা বিভিন্ন খবর। সময়টাও বেশ ভালো কাটত।

সেই জলসায় আমাদের জন্য সবচেয়ে মজার বিষয় ছিল—গোলাম হবার পরও ছায়ায় বসার পরম সৌভাগ্য লাভ। বলতে গেলে, মক্কার মতো রুক্ষ উষ্ণ অঞ্চলে এই ছায়া ছিল এক বিশাল নেয়ামত। আর সেই ছায়ার নিচে আমাদের মতো গোলামদের অনুভূতি ছিল, যেন এটা আবদ্ধ কারাগারের মধ্যে শ্বাস নেওয়ার মতো শীতল সজীব একগুচ্ছ হাওয়ার ঝাপটা।

মক্কার মরুময় রুক্ষ ভূমিতে কোনো ফসলই ফলত না। ফুলফল, গাছ-ঘাস, গুল্ম-লতা, সবুজ শ্যামল শস্য চোখে পড়ত না কোথাও। দিনের সূর্যের তাপে চারিদিকের পাহাড় থেকে তাম্বুর মতো উষ্ণ ভাঁপ উঠত। মক্কার পাষাণ বুকে সন্ধ্যে নেমে আসার আগ পর্যন্ত অবিরাম চলতে থাকত অদৃশ্য অগ্নি-বৃষ্টি।

তারপরও যেন এই শহরে লুকিয়ে ছিল এক অজানা জাদু–সম্মোহন। ম্যাগনেটিক পাথরের মতো চুম্বকাকর্ষণে যেন সে স্বদেশবাসী মানুষের অন্তরগুলো বেঁধে রাখত নিজের সাথে। এজন্যই মক্কার বাইরে কেউ গেলেও মক্কায় ফিরে আসার জন্য মন আনচান করত। এলোমেলো হয়ে যেত উদাস ভাবনারা। যতটা দ্রুত সম্ভব— প্রয়োজনের কাজকারবার শেষে মানুষেরা আবার মক্কার পথ ধরত। মক্কার নাম শুনলে উটগুলোর কান পর্যন্ত খাড়া হয়ে যেত। গতি বাড়িয়ে দ্রুত এগিয়ে আসত মক্কার দিকে।

আমি ছিলাম নিছক এক ক্রীতদাস। মক্কায় লাঞ্ছনা আর অপদস্থতা ছাড়া নিজের করে আর কিছুই পাইনি। জন্মের পর থেকেই আমার এক ভাগ্য—কখনো মানুষের বোঝা বইতে হয়েছে, কখনো পাহারাদারি, কখনো নিদারুণ কষ্টের

কাজকর্ম। যেন বুঝতে চাচ্ছিলাম, রক্ত-ঘামের কতটুকু বিসর্জন আমি সইতে পারি। নিদারুণ কষ্টেও কেন যেন আমার কোনো বেদনা ছিল না। জীবনে এক ধরনের শান্তির পেলবতা বিরাজমান ছিল।


এখন আমার সামনে দামেশকের সুপেয় শীতল পানি। কিন্তু আমি জানি এবং বিশ্বাস করি, মক্কার সেই রুক্ষ মরুময় এলাকার পবিত্র জমজমের কয়েক আঁজলা পানির সাথে এর কোনো তুলনাই হয় না।

মক্কার পাথুরে মাটি ফুঁড়ে ঝরনার মতো নির্গত হতো যমযমের পবিত্র জল। আমার মতো গোলাম ক্লান্তিহীন পান করে যেত সেই অমিয় সুধা। এমনটা কেন হতো? মক্কার আঙিনায় কি কোনো জাদুর পরশ ছিল?

শস্যহীন বিরানভূমি। সূর্যের তীব্রতায় কাঁপতে থাকা নগরী। নেই কোনো গাছপালা, সবুজ শ্যামল। নেই কোনো পাখি পতঙ্গ প্রজাপতি। প্রকৃতির নান্দনিক দৃষ্টি থেকে বিমুক্ত এ নগরী। তবু কেন বসবাসকারীদের অন্তর এই ভূমিতে পড়ে থাকত? হৃদস্পন্দনের

সঙ্গে কেন এক হয়ে যেত এই মরুভূমির ভালোবাসা?

এর একমাত্র কারণ হলো— জগতের সুরমার সৌন্দর্যে কালো চাদরাবৃত আল্লাহর ঘর কাবা। যার মধ্যে আছে ঊর্ধ্ব আকাশ থেকে নেমে আসা এক রত্ন। এর মাঝে এখানে শতশত খেজুর-বীথিকার ছায়া। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেজুরের উৎপাদন হয় এই ভূমির ক্রোড়েই। বর্বরতা ও জাহেলিয়াতের

যুগেও হেরেম শরিফ ছিল নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তার অভয়নগর। কোষবদ্ধ তরবারি

কারো বিরুদ্ধে উন্মুক্ত করা এখানে বৈধ ছিল না। শত্রুর বিরুদ্ধে হাত তোলা,

ঝগড়া-ফ্যাসাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ — কোনো কিছুরই একদণ্ড সুযোগ ছিল না কাবা

শরিফের সীমানার ভিতর।

কাবা শরিফ মহান আল্লাহর ঘর। নির্মিত হয়েছিল ইবরাহিম আলাইহিস সালামের পবিত্র হাতের ছোঁয়ায়। শুধু এক আল্লাহর ইবাদত ও উপাসনার জন্য।

কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষের মনে বিভিন্ন ওয়াসওয়াসা ও কুমন্ত্রণা জাগতে থাকে। এরই ফলে এই মহান ইবাদতখানা, লাকড়ি পাথর ইত্যাদি দিয়ে নির্মিত মূর্তি ভাস্কর্যের গুদামঘরে পরিণত হয়। এসব মূর্তির জন্য আরবদের মনে ছিল ঐশ্বরিক অবস্থান।

প্রথমে ধীরে ধীরে তাদের মন থেকে সর্বশক্তিমান মহাপ্রজ্ঞাবান এক আল্লাহর বিশ্বাস উঠে যেতে থাকে। তাদের বিশ্বাসের নিরুপদ্রপ ভূমি দখল করে নেয় এই প্রাণহীন মূর্তিগুলো। একটিমাত্র ঈশ্বর নয়, পার্থিব জীবনের লোভ-লালসার শিকার হয়ে শত শত ঈশ্বর বানিয়ে নেয় তারা। ঈশ্বর ছিল তাদের তিনশ ষাটটি।

মজার ব্যাপার হলো, এসব ঈশ্বরকে নিয়ে খুবই জমজমাট হয়ে উঠেছিল তাদের মূর্তি-বাণিজ্য। মূর্তি বানিয়ে বানিয়ে মূল্যের বিনিময়ে ধনী লোকদের কাছে বিকোনো হতো। তারাও খরিদ করে নিয়ে যেত মহানন্দে।

তাদের মধ্যে কেউ ছিল দিবসের ঈশ্বর। কেউবা আবার রজনীর। কেউ ছিল সুস্থদের ঈশ্বর, কেউ আবার রোগীর। উত্তম ভাগ্যের জন্য এক ঈশ্বর, কপাল পোড়ার জন্য আরেকটি। প্রবাসে এক ঈশ্বর, নিবাসে আরেক।

তাদের সব ঈশ্বরই ছিল পার্থিব জীবনের একেকটি চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণের জন্য। পরকালীন জীবনে সুখ-শান্তি লাভ করার জন্য কোনো ঈশ্বর গ্রহণ করার সদিচ্ছা তাদের কখনোই জাগেনি।

কাবা শরিফের পাশ দিয়ে যেসব কাফেলা আগমন ও নির্গমন করত, মূর্তি বিকিয়ে তাদের কাছ থেকে কীভাবে টাকাপয়সা হাতানো যায়—এই ধান্দাই তাদের ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল; বাজার অথবা মন্দিরে যেমনটা দেখা যায়।

প্রতিবছর নির্দিষ্ট এক মাসে আরবের সকল গোত্র মাইলের পর মাইল সফর করে বিভিন্ন মূর্তির পদতলে অর্চনা দিতে আসত। তখন চারিদিকে ঝলমল রংবেরঙের আড়ং ও বেসাতি বসত। মেলা বসাত শাম-ইয়েমেন-পারস্যসহ অন্যান্য দূরদূরান্তের বণিকরা। সোনা-চান্দি, আতর-জামা সবকিছুরই জমে উঠত রমরমা ব্যবসা। বিক্রি হতো পাশাপাশি দাস-দাসি এবং তিনশ ষাট ঈশ্বর।

“দেখো দেখো, ও নাকি খোদার সাথে বাতচিত করে।”— আবু জেহেলের আকস্মিক এই কণ্ঠ গোলামদের খানিকটা চমকে দিল। আবু জেহেলের গোলাম বসে বসে ঝিমুচ্ছিল। আওয়াজ পাওয়া মাত্রই ঘোলা ঘোলা চোখ নিয়ে এক ঝাঁকুনিতে দাঁড়িয়ে গেল। কাণ্ডখানা দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে আবু জেহেল। মাথা নিচু করে গোলাম বসে পড়ে।

“পয়গাম্বর সাহেব, স্রোতবাহী পানির উপর দিয়ে আমাদের একটু হেঁটে দেখান তো আপনার নবুয়তের সত্যতা দেখি।”— এটা ছিল উমাইয়ার তাচ্ছিল্যভরা বিদ্রুপ।

উমাইয়া কী বলতে চাচ্ছে তা প্রথমে বুঝতে না পেরে ঝটপট করে আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম। আহা কপালপোড়া আমার মালিক! আজ জাহান্নামে বসে বসে যথোচিত উত্তর

পাচ্ছে সেই বিদ্রুপভরা প্রতিটি বাক্যের। আমি দেখতে পেলাম তাকে। মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহকে। একা নিঃসঙ্গ তিনি। দৃষ্টি পাহাড়ের উচ্চতায় প্রসারিত। লোকে বলে—এক ফেরেশতার সাথে নাকি তার কথাবার্তা হয় মাঝেমধ্যে।

আবু জেহেলের বিদ্রুপের দিকে তিনি ভ্রুক্ষেপ করলেন না। কাবার চারিদিকে চক্কর দিতে দিতে একবার শুধু আবু জেহেল সামনে পড়ে গিয়েছিল। বণিকদল তখন হেসে গড়িয়ে পড়ছিল আবু জেহেল আর উমাইয়ার চুটকিতে। সবাই একসাথে ফুর্তিতে অংশ নিচ্ছিল।


একমাত্র আবু সুফিয়ান ব্যতিক্রম। চেহারার বালিয়াড়ির ভাঁজে ভাঁজে ফুটে উঠছিল গাম্ভীর্যের ছাপ। তাকে মক্কার গোলামরা কীভাবে দেখত— সেটা একটু বলে নিই।

আমাদের মতো গোলামরা প্রাথমিকভাবে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিত আপন মালিককে। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে যে ব্যক্তিকে মর্যাদা দেওয়ার উপযুক্ত মনে করত— সে ছিল আবু সুফিয়ান। শিকার ও শিকারির মাঝে যে সম্পর্কটা থাকে— আমাদের মতো ক্রীতদাসদের সাথে আবু সুফিয়ানের বোঝাপড়াটা ছিল তেমনি।

হঠাৎ করে সে দাঁড়িয়ে গেল। জলসার স্বাভাবিকত্ব ভেঙে সে জোর গলায় বলতে লাগল—“এক খোদা মানা খোদাকে অস্বীকার করার নামান্তর।”

নিজেদের শিরায় হাত রেখেই কথাটা বলতে পেরেছে আবু সুফিয়ান। কারণ এক উপাস্যের আহ্বান কানে তোলা কাফেরদের জন্য ছিল সবচেয়ে অসহ্যকর। নিজেদের বিশ্বাসমতো তৈরি করে নিয়েছিল তারা কিছু ঈশ্বর। একক উপাস্যের ধারণা ছিল তাদের গণ্ডিবহির্ভূত। আবু সুফিয়ান আপন ঘরানায় চিন্তাশীল হিসেবে বিবেচিত ছিল। সে পুনরায় মুখ খুলল: “গজিয়ে ওঠা এই অধর্ম এখনই যদি মূলোৎপাটন করা না হয়, তাহলে প্রভু আমাদের উপর নাখোশ হয়ে এই ভূমি থেকে বরকত উঠিয়ে নেবেন। পাঠিয়ে দেবেন অন্য কোনো স্থানে।”

আবু জেহেল এতক্ষণ নিশ্চুপ ছিল। সে মুখ খুলল: “আবু লাহাব, তুমি তো এর চাচা। আত্মীয়তার দাবি থেকে বলছি—যতদ্রুত সম্ভব নিজের ভাতিজাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনো।”

আবু লাহাব আঁতকে উঠলো। এতদিন স্বেচ্ছায় এসব আলোচনা থেকে নিজেকে দূরে রেখেছে। অংশগ্রহণ করতে চায়নি কখনোই। সে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল : “সঠিক পথে আনব? কিন্তু কাকে? মুহাম্মদকে? সে কি কোনো শিশু? সে তো চল্লিশ বছরের এক বুঝসম্পন্ন লোক। কোনো সন্দেহ নেই—সে আমার এবং আমাদের উচ্চ খান্দানের দুর্নাম রটাতে চায় সমাজে।

সে তো দুদিন আগে ক্রীতদাসকে ধরে এনে আপন সন্তান বলে দাবি করে বসেছে। সে পাগল, উন্মাদ। তার কাছে কেউ কিছু চাইলে সাথে সাথে তাকে দিয়ে দেয়। এটা তো পাগলামি। আবার চোর-বাটপার, নিম্ন বংশের লোকদের ডেকে ডেকে খাবার খাওয়ায়।

যখনই তোমরা দেখবে—দশ-বারোজন লোক তার দরজায় জড়ো হয়েছে, খেয়াল করবে, ঘরের ভিতর থেকে তারা ছোটখাটো জিনিস সরিয়ে ফেলছে। এদের মতো লোকদের সমাদর করা তো পাগলামি। হিশামের বংশের আমার এই ভাতিজা উন্মাদ হয়ে গেছে। পুরোপুরিই উন্মাদ...।” 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ