বিষণ্ন জোছনা বইটি কেন পড়বেন? সাঈদ আজাদ | Bisonno Josna By Sayed Azad

  • বই: বিষণ্ন জোছনা
  • লেখক: সাঈদ আজাদ
  • প্রকাশক: মোহাম্মদ আল আমিন সরকার
  • প্রকাশনী: বায়ান্ন ('৫২)
  • প্রচ্ছদ: তৃত
  • বইয়ের ধরণ: উপন্যাস
  • প্রথম প্রকাশ: একুশে বইমেলা ২০২০
  • মুদ্রিত মূল্য: ৬০০৳
  • পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৩৮৪



"ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন— যেন কোন্ বিকীর্ণ জীবন
অধিকার ক’রে আছে ইহাদের মন;
দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ
মরণের সাথে লড়িয়াছে;
চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে
এক গাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা-একা;
যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের— মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা
এই জেনে।"
জীবনানন্দ দাশের 'আট বছর আগের একদিন' কবিতাটির কিছু পঙক্তিমালার মধ্য দিয়ে দ্বার উন্মোচিত হয়েছে 'বিষণ্ন জোছনা'র যার নামের মাঝেই গেঁথে দেয়া হয়েছে উপন্যাসটির যাবতীয় গল্পগাঁথার অব্যক্ত সারাংশ।

☆ প্রচ্ছদ কাহন: 
                 রূপালী থালার ন্যায় শীতাংশুর দিগ্বিদিক বিচ্ছুরিত আলোকরশ্নির সমাহার রূপালী জোছনা নামে পরিচিত। আর যে রাত এরূপ রৌপ্য আলোকমণ্ডিত হয়ে সজ্জিত হয়, সাহিত্যলংকরণে তাকে বলা হয় রূপালী রাত্রি। কিন্তু 'বিষণ্ন জোছনা' শব্দযুগল যেন রূপালী রাত্রি, রূপালী জোছনা— শব্দগুলোর সাথে ঘোষণা করে পরিপূর্ণ বৈপরীত্য। 
জোছনারও যে বিষণ্ন রূপ হতে পারে, তা বইটির প্রচ্ছদ না দেখে ধারণা করতে পারতাম না। ঘন অন্ধকারের সাথে মিশেছে আবছা সবুজাভ নীল আর তার মাঝেই বিষণ্ন মুখে আবির্ভূত হয়েছে একখানা পূর্ণচন্দ্র। এই চন্দ্র ছড়ায় না কোনো আশার আলো, দেয় না কোনো সুখের আভাস। এই চন্দ্র কেবলই হাজির হয় এক ঝুলি বিষণ্নতা আর অফুরান বেদনা নিয়ে। আলোকরূপী অলংকারবিহীন পূর্ণচন্দ্রের বিষণ্ন জোছনায় অপেক্ষমান এক তরুণীর কাষ্ঠরঙা অবয়ব এবং তার গহন কেশে উন্মুখ হয়ে চেয়ে থাকা ছোট্ট পাখিটি যেন দুঃখবিলাসে মগ্ন হয়েছে। তরুণীর কুন্তলে গেঁথে রাখা শুভ্র প্রসূন হয়তো তার জীবনেরই ক্ষুদ্র কিছু সুখময় মুহূর্তের প্রতীকি রূপ। 

☆ ফ্ল্যাপ কথন: 
                 ভালোবাসা! অদেখা অমূল্য অনুভূতি। ভাগ্যবান সে, সত্যিকারের ভালোবাসা জীবনে যে পায়!
মানুষ মাত্রই ভালোবাসার কাঙ্গাল। কেউ বুঝতে শেখার পর থেকে খুঁজতে থাকে ভালোবাসাকে। কেউ ভালোবাসা পেয়েও অবহেলায় এড়িয়ে যায়। কেউ বুকের মধ্যে প্রবল তৃষ্ণা নিয়ে প্রতীক্ষায় দিন গোনে, কখন ভালোবাসা তার বুকের দরজায় কড়া নাড়বে। 
বিষণ্ন জোছনা হয়তো ভালোবাসার গল্প। হয়তো স্বার্থের গল্প। হয়তো পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মিলানোর উপাখ্যান।  
বিষণ্ন জোছনার ম্লান আলোতে ভালোবাসার স্বরূপ খুঁজে বেড়ায় বায়জিদ। জামান। ভালোবাসার অপেক্ষায় দিন কাটে জোনাকির। সায়রার। আম্বিয়ার। তৌফিকের। তারা কি পায় তাদের আকাঙ্ক্ষিত সেই আস্বাদ?
বিষণ্ন জোছনা কজন অসুখী মানুষের গল্প। ভালোবাসা প্রত্যাশী কজন মানব-মানবীর প্রতীক্ষার গল্প।

☆ উপন্যাস আখ্যান: 
                 গ্রামীণ পটভূমির উপর রচিত উপন্যাসটিতে উঠে এসেছে বেশ কিছু টুকরো টুকরো গল্পগাঁথা। জমি-জমাসংক্রান্ত পারিবারিক বিবাদ মিমাংসার উদ্দেশ্যে ডাকা সালিসিতে গ্রামের তথাকথিত গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের নানাবিধ আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে সূচনা হয় উপন্যাসটির। অসুস্থ বাবার মৃত্যুর পর হুট করেই মিরাজ বাবার স্বাক্ষরসমেত দলিল নিয়ে যাবতীয় বিষয়-সম্পত্তির উপর নিজের মালিকানা দাবি করে। কিন্তু বড় ভাই সিরাজের মতে মিরাজ অসদুপায় অবলম্বন করেছে। ন্যায্যাধিকার লাভের আশায় মামলা-মোকদ্দমার আশ্রয় নিলেও মেলেনি সুবিচার, বরং বেড়েছে বিরোধ। স্বার্থান্বেষী মহলের শোষণ, মিথ্যে মামলার দায়, ঋণের বোঝা, অভাবের উল্লাসধ্বনি, খুনের অপরাধ, আত্মহনন, মানসম্মান বিসর্জন আর সবকিছুর উর্ধ্বে আপনজনদের কলুষিত রূপ— এ যেন এক বিষাদসিন্ধু যার অতল বিষাদে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে একটি পরিবার, একটা গোছানো সংসার। 

বিষণ্ন জোছনা কিছু মানুষের মনোবেদনার আখ্যান। কখনো স্বজনহীন ভিটেমাটিহীন আম্বিয়ার শূন্য কোলের হাহাকার, কখনো বা সায়রার মতো একাকী মায়ের সন্তান বুকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার লড়াই। বিষণ্ন জোছনা তৌফিকের পেয়েও হারিয়ে ফেলা ভালোবাসার গল্প। নিজের অস্তিত্বের সংকটে ভোগা বায়েজিদের নিঃসঙ্গতার গল্প। আপাতদৃষ্টিতে চারপাশের মানুষদের হয়তো সুখীই দেখি আমরা। দেখি, তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন। কিন্তু চেনা মানুষগুলোর মনে থাকে অচেনা দুঃখ। সেই দুঃখ কি আমাদের স্পর্শ করে? হয়তো করে, হয়তো করে না। যদি সত্যি স্পর্শ‌ করতো গহীন অন্তরে, তবে জোছনা এতো বিষণ্ন কেন?

☆ চরিত্র বর্ণন: 
                 একটি সার্থক উপন্যাস গঠনে প্রতিটি প্রধান চরিত্রই সমান গুরুত্ব বহন করে, অন্যদিকে অপ্রধান চরিত্রগুলো উপন্যাসের ভীত গঠনে রাখে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। আর এই প্রধান এবং অপ্রধান চরিত্রগুলোর মিশ্রণেই লিখিত হয় একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ উপন্যাস। চরিত্রের চিত্রায়নে লেখকের মুন্সীয়ানা উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে জীবন্ত রূপে উপস্থাপন করে পাঠকের সামনে।

গল্পের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ তার 'বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল' বইটির উৎসর্গ পত্রে লিখেছেন,
[
"উৎসর্গ
উপন্যাস লেখার একটা পর্যায়ে উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে রক্ত-মাংসের মানুষ মনে হতে থাকে। তাদেরকে বই উৎসর্গ করা কি যুক্তিযুক্ত না? ‘বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল’ বইটির হেদায়েতের বড় ভাই বেলায়েতকে।"
]
একটি উপন্যাসে প্রতিটি চরিত্রই কিছু না কিছু বার্তা বহন করে, তাই চারিত্রিক বিশ্লেষণে চরিত্রগুলোর সৃষ্টিরহস্যের মর্মার্থ অনুধাবন করা যায়। প্রথমেই আলোচনা করছি উপন্যাসটির প্রধান চরিত্রগুলো নিয়ে।

জোনাকি: জোনাকি পোকার টিমটিম করে জ্বলা আলোকবিন্দুর ন্যায় বিন্দু বিন্দু স্বপ্ন নিয়ে এক স্বপ্নীল রজনীর সাধ বুনেছিল জোনাকি যেথায় সঙ্গী রবে নিখাদ ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখা মানুষটি। কিন্তু পুষ্পের ন্যায় স্নিগ্ধ মুখোশ্রীর এই স্বপ্ন বিভোর তরুণীর সব আশা নিরাশায় আচ্ছন্ন হয়েছিল তৌফিকের ক্ষণিকের অবহেলায়, তবুও জোনাকি অপেক্ষা করেছিল। উপন্যাসের একটা পর্যায়ে গিয়ে বাবার মান রক্ষার্থে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় জোনাকিকে। কিন্তু অন্তর পুড়ে অঙ্গার হয়েছিল পরিণতি না পাওয়া ভালোবাসার আনলে।

তৌফিক: 'বিষণ্ন জোছনা'য় গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া এক রত্নের কথা উঠে এসেছে। একটা শিল্পের সাথে শিল্পীর জড়িয়ে থাকা আত্মীক বন্ধনের সুর ব্যক্ত করেছেন ঔপন্যাসিক, যেই সংস্কৃতি আজ মৃত, আমাদের নবীন প্রজন্ম হয়তো তার নামই কোনোদিন শোনেনি। যাত্রাপালা, উপন্যাসে তৌফিক চরিত্রটির সাথে পাঠকের পরিচয় ঘটবে এই ঐতিহ্যটির হাত ধরেই। জীবনের সুখ-দুঃখের গল্পকথা নাট্যমঞ্চে দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসতো। আজ সেসবই রূপকথা। আমাদের প্রজন্ম বায়োস্কোপ আর যাত্রাপালা চেনে না, তারা চেনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিস্ময়কর সব আবিষ্কার। উপন্যাসটায় সেই জমজমাট যাত্রার কথা নয়, বরং মৃতপ্রায় সংস্কৃতির নিশ্চিহ্নরত চিত্র ফুটে উঠেছে। কিন্তু শিল্পের সাথে জুড়ে থাকা মানুষগুলোর অন্তরে আজো বেঁচে আছে যাত্রা। তৌফিক তেমনই একজন মানুষ, যে তার শিল্পটাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে, এমনকি ভালোবাসাকেও তুচ্ছজ্ঞান করে প্রিয়ংবদার তরে রেখে গেছে শুধুই অবহেলা। কিন্তু কথায় বলে না, "সময় গেলে সাধন হবে না"(লালন)।

বায়েজিদ ও জামান: উপন্যাসের সবচেয়ে ব্যতিক্রম চরিত্র দুটি হলো বায়েজিদ ও জামান। বায়েজিদ সম্পর্কে জোনাকির ছোট ভাই। কিন্তু কেন যেন সে আর পাঁচটা সুস্থ সাধারণ ছেলের মতো নয়। পড়ন্ত কৈশোরে এসে সে উপলব্ধি করলো, সে অন্যদেরচেয়ে অনেকটাই আলাদা। তার চিন্তাভাবনা, শারীরিক চাহিদা, দৃষ্টিভঙ্গি সবকিছু ব্যতিক্রম। কিন্তু এই বৈচিত্র্যের কোনো সংজ্ঞা তান জানা নেই। উপন্যাসের মধ্যভাগে এক নতুন চরিত্রের আগমন ঘটে, নাম জামান। এবং এই মানুষটিই সর্বপ্রথম বায়েজিদের অস্বাভাবিকতা বুঝতে পারেন। কেননা বায়েজিদের মতো তারও আছে কৈশোরের এক বিভৎস স্মৃতি যা তাদের বর্তমানের জন্য অভিশাপস্বরূপ। উপন্যাসের একটা পর্যায়ে অবশ্য জামানের আত্মনির্ভরশীল সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে তীব্র প্রচেষ্টা দেখা যায়, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। 

সায়রা ও আম্বিয়া: এই চরিত্র দুটি একত্রে বর্ণনার কারণ দুজনই সহায়-স্বজনহীন। অল্পবয়সে বৈধব্য বরণ করে নেয়া সায়রার আশ্রয় হয়েছিল জামানের বাড়িতে। একমাত্র সন্তান টুনটুনি ছিল তার একাকী লড়াইয়ের খুঁটি। আম্বিয়ার সেটুকুও নেই। নিঃসন্তান আম্বিয়া জলে ভাসা খরকুটের ন্যায়। একটা সময় দাইয়ের কাজ করতো, অন্যের সন্তান কোলে নিয়ে নিজের ক্ষতের মলম খুঁজতো। আম্বিয়া চরিত্রটির মাঝে গ্রামীণ নারীসুলভ কুটকাঁচালির আভাসও লেখক দিয়েছেন।

উপন্যাসটিতে আরো অনেক চরিত্রের মেলবন্ধন ঘটেছে। জোনাকির বাবা সিরাজ, মা আমিরা, বোন সোনিয়া, শাশুড়ি তারাবিবি। এই তারাবিবি চরিত্রটি আমার বেশ লেগেছে। রক্ষণশীল মানসিকতার উদারমনা একটি বিচক্ষণ চরিত্র। পরিবারের কথা বাইরে পাঁচ কান না করেই, বিবেচনাবুদ্ধির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার কৌশলী ভাবনা সবার থাকে না। বাবা-মায়ের ভূমিকায় থাকা সিরাজ-আমিরা চরিত্র দুটির মধ্যকার পারস্পরিক বোঝাপড়াও আমায় মুগ্ধ করেছে। আম্বিয়ার ভাসুর পো আমজাদ নামের একটা চরিত্রও দেখা যায় কয়েকটি অধ্যায়ে। প্রচণ্ড অসভ্য বেয়াদপ এই চরিত্রটি তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে শাস্তিও পেয়েছিল। আর উপন্যাসের সবচাইতে ছোট চরিত্র সায়রার মেয়ে টুনটুনি। দুঃখের করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পায়নি এই শিশুচরিত্রটিও। সবচেয়ে ভয়ংকর পরিণতি হয়েছিল তার বিনা অপরাধেই, সকলের অজান্তে।

☆ ভাষা বিশ্লেষণ ও আলোচনা-সমালোচনা:
                 সহজ, সাবলীল শব্দচয়ন এবং আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে ছোট ছোট বাক্যে বিন্যস্ত হয়েছে উপন্যাসটির একেকটি গল্প। তবে বেশ কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং বাক্য ও বর্ণনাগত অসংগতি চোখে পড়েছে।

▪️ প্রথমেই বলছি গল্প বলার ধরণ নিয়ে। 'বিষণ্ন জোছনা' উপন্যাসটিতে লেখক একাধিক প্লটের অবতারণা করেছেন। সেসব প্লট এবং চরিত্রের চিত্রায়ন সত্যিই মনে রাখার মতো। কিন্তু গল্প বলার ধরণ আমার পাঠকহৃদয়ে বিরক্তির জন্ম দিয়েছে। প্রারম্ভে স্বতঃস্ফূর্ত বর্ণনা থাকলেও শতকরায় বলতে গেলে ৮৯০% গল্প এগিয়েছে কখনো স্বাভাবিক, কখনো বা অতিমাত্রার ধীর গতিতে। কিছু কিছু ঘটনার পুনঃপুনঃ বিবরণ বাহুল্যতা সৃষ্টি করেছে। শেষ দশ শতাংশ গল্প কেবল সমাপ্তির পথে দ্রুত বেগে দৌড়ে গেছে। সেখানে উপলব্ধির স্থানটা পুরোই শিথিল। উপন্যাস পাঠের শেষাংশে এসে মনে হচ্ছিল, এতটা পথ ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে এসে দেখলাম ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ত্যাগ করে অনেকটুকু এগিয়ে গিয়েছে। যেকোনো মূল্যে হোক, টেনে হিঁচড়ে এগুতে হবে।
▪️ প্রুফ রিডিং এবং মুদ্রণে যথেষ্ট ত্রুটি রয়েছে। বানান আর বিরামচিহ্নের অজস্র ভুল উল্লেখ করতে ইচ্ছে করছে না। ণ-ত্ব বিধান, চন্দ্রবিন্দুর প্রয়োগ, অনুকার অব্যয়ের ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি ভুল হয়েছে।
▪️ অনেক বাক্যই মাঝপথে এসে খেই হারিয়ে ফেলেছে, কিছু কিছু বাক্য এক আধটা শব্দের অভাগ্য অর্থহীনতায় ভুগেছে। 
▪️ নামের ভুলগুলোও বেশ বিব্রতকর। সায়রাকে আম্বিয়া, আম্বিয়াকে সায়রা, মিরাজকে মিজান সম্বোধন পাঠককে দ্বিধান্বিত করবে। 
▪️ চরিত্রের উপস্থাপনা সাবলীল ও বাস্তবতার আলোকে হলেও তাদের বয়স হিসেব করা বা অনুমান করা মুশকিল। অতীত এবং বর্তমানের দৃশ্যপট গল্পকথকের হাত ধরে বারে বারে পাল্টেছে আর সময়গত অসামঞ্জস্যতার সৃষ্টি সেখানেই।
▪️ শেষ বয়সে আম্বিয়া দাইয়ের কাজ ছেড়ে দিয়েছিল, এ বাড়ি ও বাড়ি কাজকর্ম করে পেটেভাতে জীবিকা নির্বাহ করতো। অকস্মাৎ একদিন এক বয়স্ক লোকের আগমণ এবং পরবর্তীতে তার অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যাটির সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মারা যাওয়ার ঘটনাটা নিঃসন্দেহে বেদনাদায়ক। সেই শিশুটি আম্বিয়া নিয়ে এসেছিল মাতৃত্বের অপূর্ণতা পূরণের জন্য। কিন্তু বাচ্চাটি মারা যায়। এ বাচ্চাটি আর সায়রার মেয়ে টুনটুনির পরিণতিপ্রসঙ্গ কেমন যেন অগোছালো লেগেছে। 
▪️ একটা উপন্যাসে প্রতিটি চরিত্র পাঠকের মন মতো হবে, এমন কোনো কথা নেই। তাদের পরিণতি নির্ভর করে তাদের স্রষ্টার ভাবনার উপর। কিন্তু এতো এতো পাপ, অন্যায়, অনাচার, অবিচার করার পরও মিরাজের অবাধে চলাচল আর কোনো শাস্তি না হওয়াটা ক্ষোভ জাগিয়েছিল ভাবনায়। রাগ হয়েছিল বায়েজিদের অন্যায় সিদ্ধান্ত আর বিবেচনা বোধহীনতায়ও।
▪️ পঞ্চান্ন অধ্যায়ের এই উপন্যাসটি পাঠের দীর্ঘ যাত্রাপথে প্রায়শই টুইস্টের আনাগোনা থাকলেও কখনো কখনো একঘেঁয়েমিতেও ভুগেছি।

একজন অতি সাধারণ পাঠক হিসেবে উপন্যাসের অনেকগুলো দিক আমায় মুগ্ধ করেছে, করেছে সত্যের মুখোমুখি। যেমন–
▪️ 'ভিলেইজ পলিটিক্স' শব্দটির সাথে আমার পরিচয় আমার নানাবাড়ির গ্রামের মাধ্যমে। মানুষ কতটা খারাপ হলে নিরপরাধ নির্ঞ্ঝাট মানুষের কপালে মাদক পাচারকারীর সিলমোহর লাগিয়ে র্যাব অবধি টেনে নিয়ে যেতে পারে, তার দৃষ্টান্ত সেই গ্রামের মানুষগুলো। আল্লাহ সহায় ছিলেন বলেই হয়তো ক্রসফায়ারের মুখ থেকে আমার সেই নিকটাত্মীয় ফিরে এসেছিলেন। 'বিষণ্ন জোছনা'র অধ্যায়গুলো পড়ার সময় আমার বারে বারে এই জঘণ্য শব্দজোড়ার কথা মনে হচ্ছিল।
▪️ যেকোনো গল্প-উপন্যাসের উপমা, রূপক, বর্ণনাশৈলী আমায় বরাবরই মুগ্ধ করে। 'বিষণ্ন জোছনা'র প্রারম্ভে অতি সাবলীল কিছু বর্ণনায় তেমনই ভালা লাগার অস্তিত্ব আমি খুঁজে পাই। যেমন–
"তাজা মাছ কেটে পানিতে ধুলে পানির যেমন রঙ হয়, তেমন লালচে রংয়ের পাতায় ছেয়ে গেছে গাছ দুটো।"
কিংবা 
জোনাকির তৌফিকের সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময় পরনে থাকা সালোয়ারের রঙকে বলা হয়েছে পাকা মরিচের রঙ।
আবার,
"মনে হয় হাতের তালু না যেন ডুমুর গাছের পাতা।" 
▪️ জোনাকি তৌফিকের জোছনাবিলাসের সুখী মুহূর্তটুকুও মনে রাখার মতো যদিও দুবার দুজনের ভাবনায় পৃথক পৃথক উপস্থাপনের ব্যাপারটা অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। কিন্তু ভালো লাগার কারণ 'বিষণ্ন জোছনা' বাসীদের জীবনের গল্পে সুখের স্মৃতি অল্পই ঠাঁই পেয়েছে।

☆ প্রিয় কথন/উক্তি:
               ▪️ জোনাকি একদিন বলেছিল, "জোছনা মিথ্যা একটা ব্যাপার তৌফিক। জোছনার আলোতে যেমন সুখ আছে, তেমন দুঃখও আছে। আবার যখন জোছনা রাত আসবো দেইখ্যো খেয়াল কইরা, কেমন একটা মন খারাপ মন খারাপ ভাব থাকে জোছনার আলোতে। মনে করো সেই রাতের জোছনাও মিথ্যা। একটা কল্পনা। ভাববা, এমন কোন রাত আমগ জীবনে আসে নাই কোন সময়।" 

               ▪️ "মানুষ মরে গেলে 
              একেবারে হারাইয়া যায় না।
              কারো না কারো মনে ঠিকই
              থাইক্যা যায়।"

               ▪️ “সকল পূর্ণিমা এক নয়। কোনো পূর্ণিমায় মানুষ সব হারায়। কোনো পূর্ণিমায় মানুষ সব পায়। চাঁদের তাতে কিছু আসে যায় না। সে নিরাসক্ত থেকে নিজেকে নিঃশেষ করতে থাকে৷ পূর্ণিমা থেকে চলে যায় অমাতে।"

☆ পাঠানুভূতি: 
                 আলাদা করে পাঠানুভূতি প্রকাশের আবশ্যকতা তেমন একটা নেই, কেননা সম্পূর্ণ রিভিউটিই আমার পাঠপ্রতিক্রিয়া‌। তবুও বলবো, হয়তো লেখক অনেকটা সময় এই উপন্যাসের জন‌্য উৎসর্গ করেছেন, কিন্তু আরো কিছুটা সময় যদি এর জন্য দেয়া যেত তবে হয়তো পাঠকরা নিখুঁত একটা সাহিত্যকর্ম পরিতৃপ্তির সহিত নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতে পারতো। অসংগতি আর ত্রুটি-বিচ্যূতিগুলো তাদের মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটানোর সুযোগ পেত না। বই পড়ার বিষয়টা যতটা না জানার, ঠিক ততটাই অনুভবের-অনুধাবনের-উপলব্ধির।

'বিষণ্ন জোছনা' উপন্যাসটির প্রতিটি চরিত্রের নিজস্ব কিছু গল্প আছে। তন্মধ্যে কিছু গল্প দুঃখের, কিছু বা হারিয়ে যাওয়া সুখের। সুখপাখিটা যেন বারে বারে এসে ফিরে যায় জীবনের উঠোন থেকে। এই উপন্যাসটি মাস ছয়েক আগে প্রথম পড়েছিলাম। কিন্তু প্রতিটি গল্প, সত্ত্বা আমার অন্তরে জ্বলজ্যান্ত এক একটা গল্পগাঁথা। দীর্ঘ ছ'মাস পর আমি অনায়াসেই পাঠানুভূতি ব্যক্ত করতে পারছি। এখানেই হয়তো লেখকের সার্থকতা, লেখনীর কৃতিত্ব।

"বিষণ্ন জোছনা হয়তো ভালোবাসার গল্প, 
ভালোবাসার মাঝে লুকায়িত অপ্রাপ্তির আর্তনাদের গল্প,
বিষণ্ন জোছনা হয়তো স্বার্থের গল্প, 
লোভ-লালসার অনির্বাণ অভিশাপে দগ্ধ একটি পরিবারের গল্প,
বিষণ্ন জোছনা হয়তো অপূরণীয় শূন্যতার আখ্যান,
পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মিলানোর অসমাপ্ত উপাখ্যান..."

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ