লেখক: আহমেদ দীন রুমি
প্রকাশনায়: আদর্শ
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৮৩
মুদ্রিত মূল্য: ৩৪০
রমজানে কোনো বই পড়ব না বলেই ঠিক করেছিলাম। এদিকে মনও মানছিলো না। এরপর ঈদের দিন সন্ধ্যায় বইটা হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা সংখ্যা দেখে বললাম, অহ! এটা তো একদিনে শেষ হয়ে যাবে আমার। সেই একদিন একপক্ষ অতিক্রম করল। অবশ্য পুরো একপক্ষ ধরে বইটা পড়েছি তেমনটা নয়। প্রায় দিনই দেখা গিয়েছে একদমই ধরিনি। আর যেদিন যেদিন পড়েছি সেদিন সেদিনও খুব সামান্য করেই পড়েছি। যেন মাথায় থাকে অনেক কিছুই।
বইয়ের পেছনে আড়াই পৃষ্ঠার তথ্যসূত্র দেখেই আন্দাজ করা যায়, বইটা লিখতে গিয়ে ঠিক কতখানি কাঠখড় পুড়িয়েছেন লেখক। আর পড়তে গিয়ে আমিও তা বেশ হাড়ে হাড়েই টের পেয়েছি বলা চলে। পুরোদস্তুর গবেষণামূলক বই। তাছাড়াও প্রাচীন ইতিহাসগুলো জানা নেই বলেও বারবার পেছনে গিয়েছি, একই প্যারা একাধিকবার পড়েছি। মোট কথা, আমি স্বেচ্ছায়ই এত বেশি সময় নিয়েছি।
সাইরাসকে নিয়ে আমার আগ্রহ মূলত কুরআনে বর্ণিত জুলকারনাইন হিসেবে ওনাকে ধরা হয় বলেই। অনেকেই আলেক্সান্ডারকে জুলকারনাইন ভাবেন৷ একটা সময়ে মূলত সবাই তাই ভাবত। কিন্তু সাইরাস সম্পর্কে যত বেশি জানা যাচ্ছে তত বেশি ইসলামিক স্কলারগণ ওনাকেই জুলকারনাইন হিসেবে ভাবতে শুরু করছেন। সবচাইতে বড়ো কথা, সাইরাস একেশ্বরবাদী এদিকে আলেক্সান্ডার বহু ইশ্বরে বিশ্বাসী। এই একটা জায়গায় এসেই সব বিতর্কের অবসান হয়ে যায় যে আলেক্সান্ডার কোনভাবেই কুরআনের সেই জুলকারনাইন হতে পারে না৷ বেশ আগের একটা লিমিটেড এডিশনের বই পড়েছিলাম। সেটাতে শুরুতে আলেক্সান্ডারের বর্ণনা আর এরপর জুলকারনাইন প্রমাণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। কিন্তু এত ধ্বংসযজ্ঞ চালানো কোনো সম্রাটকে কুরআনে বর্ণিত কোনো ন্যায়বান শাসক ভাবতে পারেনি আমার মন। সেই তৃষ্ণা থেকেই পড়া এই সাইরাস। প্রতি লাইনে যেন জুলকারনাইনকেই খুঁজছিলো আমার মন। খুঁজেও পেয়েছে। তবে অবশ্যই আল্লাহ সর্বজ্ঞানী।
সাইরাস সম্পর্কে বেশিরভাগ তথ্যই আসে গ্রীকদের কাছ থেকে। অথচ দীর্ঘদিন ধরে গ্রীকরা ছিলো পারসিকদের প্রতিপক্ষ। লেখকের মতে, 'বিষয়টা যেন পাকিস্তানের ইতিহাস জানতে ভারতীয় লেখকের উপর নির্ভর করা'। যা হোক, লেখক কেবল গ্রীক উৎসের উপরই নির্ভর করে থাকেননি। তিনি সাইরাসকে নিয়ে হেরোডোটাস, জেনোফোন, টিসিয়াসদের লেখা থেকে তথ্য নিয়েছেন। এছাড়াও নেবুনিদাসের বিবরণী, সাইরাস সিলিন্ডার, দারিয়ুসের বেহিস্তুনলিপি থেকে তথ্য নেন। মূলত সবগুলো তথ্য একত্র করে সঠিক তথ্য খুঁজেছেন লেখক৷
সাইরাসের মাতা মান্দানা ছিলেন মিদিয়ার সম্রাট অস্তাইজেসের সন্তান। তখন অবশ্য অস্তাইজেস সম্রাট নন। কিন্তু একদিন এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন তিনি যার অর্থ এই যে মান্দানার গর্ভের সন্তান তার মসনদ দখল করে ফেলবে। সেই ভয়ে অস্তাইজেস মান্দানাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন সেই দূরের পারস্যের এক রাজ্য আনসানের শাসক ক্যামবিসেসের সঙ্গে। আনসান ছিলো একাবাটনা অর্থাৎ মিদিয়ার অধীন ছোট্টো এক রাজ্য। অস্তাইজেস অতো দূরের ছোট্টো এক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে বেশ নিশ্চিন্তেই ছিলেন। অতো দূর থেকে নিশ্চয়ই মান্দানার ছেলে রাজ্য দখল করতে আসবে না। এদিকে মান্দানা গর্ভবতী। ঠিক তখন আবার একই স্বপ্ন দেখলেন অস্তাইজেস। জ্যোতিষীও পূর্বের কথাই শোনালো৷ অস্তাইজেস ফন্দি আঁটতে থাকলেন মান্দানার সন্তানকে মেরে ফেলার। কিন্তু ভাগ্যক্রমে সাইরাস বেঁচে যায়। রাখাল দম্পতি মিত্রাদাতেস এবং তার স্ত্রী স্পাকোর কাছে মানুষ হতে থাকে আব্রাদাতেস নামে।
একপর্যায়ে সাইরাসের আসল পরিচয় প্রকাশ পায়৷ ফিরে যায় আসল বাবা মা ক্যামবিসেস আর মান্দানার কাছে। ন্যায়বান ক্যামবিসেসের কাছ থেকে পেতে থাকে ন্যায়নীতি আর জীবনের শিক্ষা। কোনো এক ঘটনায় জ্যোতিষীও অস্তাইজেসকে ভরসা দেন যে এই ছেলে আর তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তাই অস্তাইজেসের কাছেও থাকে সে। সামরিক শিক্ষা নেয় সেখান থেকে৷ ফলে একইসাথে একজন ভালো আর ন্যায়পরায়ণ শাসক হওয়ার শিক্ষা যেমন পায় তেমনি পায় সামরিক শিক্ষাও৷
এক পর্যায়ে যা হওয়ার ছিলো তাই হলো। মিদিয়ার বিশাল সংখ্যক সৈন্যের বিপরীতে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে জিতে যায় সাইরাস এবং তার বাহিনী। মিদিয়াবাসীও অস্তাইজেসের অত্যাচারে অতিষ্ট ছিলো ফলে সহজেই মেনে নিলো সাইরাসের অধীনতা। উল্টে গেল দান৷ যেই পারস্য মিদিয়ার অধীন ছিলো, সেই মিদিয়াই এখন পারস্যের অধীন। সাইরাস চাইলেই মিদিয়াকে পারস্যের অধীন করে রাখতে পারত। এমনকি পারস্যবাসী তাই চাইছিলো। কিন্তু এখানেই সাইরাসের মাহত্ম্য। সাইরাস কখনোই কাউকে প্রজা করে রাখেনি বরং সবাইকেই দিয়েছে সমান অধিকার। এমনকি অস্তাইজেসকেও দিয়েছে অভূতপূর্ব সম্মান যেখানে তাকে মেরে ফেলাই ছিলো যুক্তিযুক্ত। মূলত সাইরাস কাউকেই যুদ্ধপরবর্তী সময়ে হত্যা করেনি। বরং বসিয়েছে প্রশাসনিক কাজে যেমনটা দেখা যায় লিডিয়ার শাসক ক্রিসাস, ব্যাবিলনের সম্রাট নেবুনিদাসের বেলায়। এদের প্রত্যেককেই পরবর্তীতে উঁচু আসনে অধিষ্ঠিত করা হয়েছিল। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর কথাটা একদম খাঁটি প্রমাণ করেছেন সাইরাস।
ব্যাবিলনের সম্রাট নেবুচাদনেজার ধ্বংস করেছিল জেরুজালেম নগরী। ধ্বংস করেছিল আল আকসা এমনকি সেখান থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল সমস্ত কিছু। দুটো বিশালাকারের থাম, স্বর্ণ ও রৌপ্যের অসংখ্য পেয়ালাসহ আরো অনেক অনেক জিনিস। সেই থেকে ইহুদিরা ছিলো ব্যাবিলনের অধীন। নবী ইয়ারমিয়া ভবিষ্যৎবানী করে গিয়েছিলেন এমন একজনের যিনি আসবেন আর ইহুদিদের উদ্ধার করবেন। সেই থেকে দিন গুনছিলাও ইহুদিরা। এবং সেই দিন সত্যিই এলো৷ সাইরাস বেলশৎসর এবং নেবুনিদাসের কাছ থেকে ব্যাবিলন দখল করে নিলেন। ব্যাবিলনের ধ্বংস করে দেওয়া মন্দিরগুলো নির্মাণ করলেন৷ ইহুদিদের ফিরিয়ে দিলেন তাদের জন্মভূমি জেরুজালেমে আর নির্মাণ করলেন সেকেন্ড টেম্পল৷ নেবুনিদাসের কাছ থেকে ব্যাবিলন দখল করার পর কিন্তু তার সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ করা হয়নি বরং কারমেনিয়াতে তাকে শাসনকর্তার পদ দেওয়া হয়েছিল।
সাইরাস নিজে ছিলেন জরাথুস্ত্রবাদী। জরাথুস্ত্রবাদ মূলত একেশ্ববাদই৷ কিন্তু তিনি কখনোই অন্যের ধর্মে বাধা প্রদান করেননি বরং মন্দির নির্মাণ করে দিয়েছেন৷
সাইরাস হচ্ছেন সেই মানুষ যিনি একইসাথে একটি জাতির পিতা, ত্রাতা এবং একমাত্র অইহুদি যাকে ইহুদিরা মেসিয়াহ বলে মানে।
বইটিতে সাইরাস এবং তার সঙ্গে আনুসঙ্গিক আরো যত বর্ণনা প্রয়োজন সবই সংযুক্ত করেছেন লেখক। এরপর কুরআনে বর্ণিত জুলকারনাইনের সঙ্গে প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। তাই করতে গিয়ে সাহায্য নিয়েছেন তাওরাত এবং বাইবেলের। কেননা, তাওরাত এবং বাইবেলে আগে থেকেই জুলকারনাইনের ব্যাপারে ছিলো। ইহুদি পন্ডিতগণ সেটা জানতেন বলেই রাসূল (সঃ)কে তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি সত্য নবি কি না সেটা প্রমাণের জন্য। সুতরাং, তাওরাত এবং বাইবেলের সাহায্য নেওয়াই যেতে পারে এই বেলায়।
একটা ছোট্টো বিষয়, ভুল কি না জানি না। নেবুচাদনেজারকে এই বইয়ে নেবুকাদনেজার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
পুরোনো ইতিহাস পছন্দ বা গবেষণাধর্মী বই ডালভাত এমন মানুষদের জন্য অবশ্য পাঠ্য এই বই৷
©সালিন
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....