বইয়ের পরিচিতিঃ-
- নাম - গোল্ড ইজ মানি
- লেখক - জেমস রিকার্ডস
- অনুবাদ - রাকিবুল হাসান
- প্রচ্ছদ - সিদ্দিক মামুন
- প্রকাশনা - ফাউন্টেন পাবলিকেশন
- পৃষ্ঠা - ১৪৩ পৃষ্ঠা
- মুদ্রিত মূল্য - ২২০
- রেটিং - ৯/১০
- রিভিউ লিখেছেন 💕 তানভীর সরোয়ার তালহা
"ভাগ্য ভাল যে জনগন ব্যাংক এবং মুদ্রা ব্যবস্থার রহস্য সম্পর্কে কিছুই জানে না। কারন যদি জানতে পারত তবে তারা আজকে রাতের মাঝেই গন-আন্দোলন শুরু করে দিত।" HENRY FORD
"আপনার কাছে যদি কোন সহায় সম্পদ নাও থাকে, যদি খুব সামান্য পরিমানে স্বর্ণ থেকে থাকে তবে আপনাকে টেক্কা দেয়ার মত কেও নেই" জনৈক অর্থনীতিবিদ
- পূর্বে "গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড" অনুসরণ করে মুদ্রার মূল্য নির্ধারণ হত অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট পরিমান স্বর্ণ মজুদের বিপরিতে নির্দিষ্ট পরিমান মুদ্রা ছাপানো হত। স্বর্ণের মূল্যের উপর নির্ভর করত মুদ্রার দাম।
- কিন্তু কারেন্সি ব্যবস্থাপনার কিছু খুঁতের কারনে আমেরিকার ৩৭তম প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৭১ সালে "গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড" বাতিল ঘোষণা করেন। উনি সম্পূর্ণ নতুন একধরনের কারেন্সি ব্যাবস্থা চালু করেন যাকে "FIAT CURRENCY" বলা হয়।
- বর্তমানে এখন কোন স্বর্ণের বিপরিতে কোন মুদ্রা ছাপানো হয় না। এমনকি এই মুদ্রার বিপরিতে আসলে কিছুই রাখা হয় না। টাকা এখন শুধু টাকাই। জাস্ট প্রিন্ট করা কিছু কাগজ। এর বেশি কিছুই না।
- টাকা যদি এখন শুধুই প্রিন্ট করা কাগজ হয়ে থাকে তাহলে ঠিক কোন ব্যাপারটি মুদ্রার মূল্যর জন্য দায়ি ? কেন ১০০০ প্রিন্ট করা টাকার মূল্য ১০০০ টাকা ? এর কম বা বেশি না কেন ?
- এই সম্পূর্ণ বিষয় নির্ভর করছে মানুষের আস্থার উপর। অর্থাৎ টাকার প্রতি মানুষের আস্থা আছে বলেই এর চাহিদা আছে এবং চাহিদা আছে বলেই এর একটি মূল্য আছে। যেদিন মানুষ টাকার উপর ভরসা হারাবে সেদিন সমগ্র পৃথিবীর অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে, টাকার আর কোন মূল্য থাকবে না।
- আচ্ছা, ঠিক আছে তাহলে কিভাবে বুঝব মানুষ টাকার উপর ভরসা হারাচ্ছে ?
- উত্তর সহজ। স্বর্ণের দাম দেখেই বলা যাবে। স্বর্ণের দামের সাথে মানুষের ভরসার সম্পর্ক আছে। টাকার প্রতি মানুষের ভরসা যত কমতে থাকবে, স্বর্ণের দাম তত বাড়তে থাকবে। টাকার প্রতি মানুষের ভরসা যত বাড়তে থাকবে স্বর্ণের দাম তত কমতে থাকবে।
- ১৯২৫ সালে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ছিল ৪.২৫ ইউরো। যা এখন বেড়ে দাড়িয়েছে ১৮০০ ইউরো এর আশেপাশে। দেখা যাচ্ছে স্বর্ণের দাম এখন পর্যন্ত ৪৫০০% এরও বেশি পরিমানে বেড়ে গিয়েছে।
- এইসব কিছুর মানে একদম সহজ। টাকার প্রতি মানুষের ভরসা বেশ দ্রুত গতিতে কমে যাচ্ছে। এখনি বলা যায় আর কয়েক দশকের মধ্যে বা তারও আগে বিশ্ব অর্থনীতি সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রচলিত মুদ্রা বলতে কিছুই থাকবে না।
এই সব কিছুর সমাধান?
"স্বর্ণ"
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ-
বিশ্ব অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে স্বর্ণ যে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ তা বলে বুঝানো সম্ভব নয় না। নিছক কৌতূহলের থেকেই বইটি পড়া। And The Result Was Jaw Dropping।
- সাধারন ভাবে বইটার রিভিউ না করে আমি ভিন্ন পদ্ধতিতে বইটি নিয়ে আলোচনা করব। তাই নিচে পয়েন্ট আকারে বলব বইটি থেকে আমি কি কি জানতে পারলাম এবং আপনারাও জানতে পারবেন...
- আমেরিকা এবং চায়না কিভাবে ধিরে ধিরে পুরো পৃথিবীর অর্থনীতি এবং রাজনীতির কবজা করছে তার সুন্দর বর্ণনা আছে।
- চায়না কিভাবে অদুর ভবিষ্যতে পৃথিবীর সবথেকে বড় হর্তাকর্তা হিসেবে আগমন করবে তার বিবরন আছে। ঠিক এই কারনেই চায়না কখনই তাদের স্বর্ণ মজুদের পরিমান অফিশিয়াল ভাবে প্রকাশ করে না। অপরদিকে আমেরিকা সগর্বে তাদের ৯০০০ টন স্বর্ণ মজুদের কথা সবখানে বলে বেড়ায়। কেন চায়না তাদের মজুদের কথা কখনই প্রকাশ করে না ?
- আমেরিকা যত বড়ই ডাকসাইটে পালোয়ান হোক না কেন, তারা চায়নাকে জমের মতই ভয় পায়। কারন কি ? চায়না বর্তমানে অর্থনীতিতে এমন স্ট্র্যাটেজিতে খেলছে তারা চাইলে যেকোনো মুহূর্তে আমেরিকার অর্থনীতি ধ্বংস করে দিতে পারবে। অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইবেন না। কিন্তু বইটা পড়ে দেখুন, আপনারাও বাধ্য হবেন বিশ্বাস করতে
- বৈশ্বিক মুদ্রাযুদ্ধের ব্যাপারে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে। কিভাবে একটা দেশের মুদ্রার মান বাড়ে বা কমে এবং একটা দেশ অন্য দেশের অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে পারে সে ব্যাপারে বর্ণনা আছে।
- কেন সৃষ্টির শুরু থেকেই স্বর্ণ একমাত্র অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে অবস্থান করছে সে ব্যাপারে বিশদ আলোচনা আছে। বর্তমান পৃথিবীতে স্বর্ণের থেকেও মূল্যবান পদার্থ আছে কিন্তু একমাত্র স্বর্ণকেই সবাই কেন গুরুত্ব দিয়ে চলে সে ব্যাপারে জানতে পারবেন।
- ভবিষ্যতে আগত বিশ্ব অর্থনীতি ধ্বসে আমাদের করনিয়, কিভাবে স্বর্ণের সাথে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করব, স্বর্ণ দিয়ে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা শক্তিশালি করব সেই ব্যাপারে জানা যাবে। বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, আর কিছু বছর পর পৃথিবীতে কাগুজে টাকা বলতে কিছু থাকবে না। যা থাকবে তা হচ্ছে স্বর্ণ। তাই যে দেশের কাছে স্বর্ণ বেশি থাকবে তারাই ভবিষ্যৎ পৃথিবীর চালক হিসেবে অবস্থান করবে।
- বর্তমান পৃথিবীর সবথেকে বড় কারেন্সি কর্পোরেশনের ব্যাপারে জানতে পারবেন, যারা স্বর্ণের খেলার মাঠের রেফারি হিসেবে পরিগনিত হচ্ছে। তারাই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতের অর্থনীতির নিয়ম কানুন।
- ব্যাংকের লোণ ব্যবস্থার গোপনীয় টেকনিকের ব্যাপারে যা জানবেন তা আপনাকে অবাক করে দিবে। কিভাবে ব্যাংক অন্যের টাকা দিয়ে খেলাধুলা করে ধীরে ধীরে মানুষদের থেকে টাকা ছিনিয়ে নিচ্ছে এবং ব্যাংকের মালিকেরা কেনইবা তাদের টাকা ব্যাংকে জমা করে না তা জানলে আমার মনে হয় এরপর থেকে আপনারা ব্যাংকে টাকা রাখতে ২য় বার ভেবে দেখবেন।
- এইরকম অর্থনীতির আরও অনেক অনেক কিছু সম্পর্কে জানতে পারবেন।
.
যেসব ব্যাপার ভাল লাগেনিঃ-
বইটি প্রচুর রিপিটিটিভ। অর্থাৎ কিছু কিছু কথা বারবার বারবার, ১/২ পেইজ পর পর এসেছে যেটা বিরক্তির কারন হয়ে উঠে এক সময়। লেখক সম্ভবত প্রতি ২/৩ পেইজ পর পর চায়না কেন পরাশক্তি হবে, কিভাবে ভবিষ্যতের পৃথিবীর হর্তাকর্তা হবে, আমেরিকা কেন চায়নাকে ভয় পায় এইসব নিয়ে আলোচনা করেছেন যেটা বেশ বিরক্তিকর ছিল।
স্বর্ণের ব্যাপারে এত বিশদ আলোচনা থাকলেও সাধারন জনগনের কি করনীয়, তারা কিভাবে ভবিষ্যতে সারভাইভ করতে পারবে এইসব ব্যাপারে মাত্র ২ পেইজ আলোচনা আছে। পুরা বই আমেরিকা, চায়নার স্বর্ণ মজুদ, মুদ্রাযুদ্ধ, স্বর্ণের ইতিহাশ নিয়ে ভরা।
.
শুরু করার আগেঃ-
সবাই এই বইটি থেকে সবটুকু রস নিংড়াতে পারবে না। কারন এই বইটি সম্পূর্ণ ভাবে বোঝার জন্য কিছুটা হলেও পূর্বে থেকে অর্থনৈতিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। বিশেষ করে পরিভাষা গুলা আগের থেকে জানা থাকলে খুবই ভাল।
তাই বলে সাধারন পাঠকেরা কি বইটি থেকে কিছুই বুঝতে পারবে না ?
পারবেন, তবে পরিভাষা গুলা বুঝার জন্য হয়ত আপনাকে গুগল করা লাগতে পারে বা অন্য কোনভাবে সাহায্য নিতে হতে পারে। অর্থনৈতিক পরিভাষা জানা না থাকলে আপনি বইটির বেশি দূর আগাতে পারবেন না, এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে যেতে পারেন। যখনই আমার সামনে কোন পরিভাষা বা কি-ওয়ার্ড পড়েছে, সাথে সাথে গুগল করে ব্যাপার গুলা বুঝে নিতে হয়েছে। আপনারাও যদি এইভাবে করতে পারেন তবেই বইটির সম্পূর্ণ ব্যাপার গুলা পরিষ্কার হবে।
.
অনুবাদঃ-
যেহেতু অনুবাদ বই তাই এই ব্যাপার আলোচনা থেকে বাদ যাবে না। অনুবাদক এখানে বেশ মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। উনি মুলত বইটি ভাবানুবাদ করেছেন তাই কখনই কোন ব্যাপার পেঁচালো মনে হবে না। পাঠকদেরকে বোঝানোর স্বার্থে অনুবাদক মুল বইয়ের থেকে অনেক কিছু বর্ধিত করেছেন। যেমন মুল বইয়ে একটি জটিল টপিক আলোচনার পর অন্য কোন টপিকে চলে গেছে কিন্তু অনুবাদক ওই জটিল টপিককে বোঝানোর জন্য আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট টেনে বোঝানোর চেস্টা করেছেন যেটি নিঃসন্দেহে অসাধারণ একটি উদ্যোগ। তবে অনুবাদক চাইলে উপরে বর্ণিত কাঠখোট্টা পরিভাষাগুলোকে ভেঙ্গে আরও সরল করতে পারতেন।
তারপরেও অনুবাদে এই বইকে আরামসে ৪.৫/৫ দেয়া যাবে
.
ভৌত বিষয়াদিঃ-
স্ট্যান্ডার্ড সাইজের পেপারব্যাক। পেপারব্যাক হলেও পেপারটি বেশ শক্তপোক্ত এবং উচুনিচু টেক্সচারের ছিল যার ফলে খুবই প্রিমিয়াম একটা ফিলিং দিচ্ছিল হাতে। ক্রিম কালারের পেইজ। বাধাই ছিল মধ্যম মানের। মাঝ বরাবর খুলে পড়তে কোন সমস্যা হবে না, যেখানে সাধারনত পেপারব্যাকের বাধাই শক্ত করা হয় বইয়ের রিজিডিটির জন্য।
প্রচ্ছদ বেশ ছিমছাম নজরকাড়া ছিল। বইটির মুল বিষয়বস্তু "টাকা নয়, স্বর্ণই সবকিছু" খুব সুন্দর করেই ফুটে উঠেছে
.
শেষ কথাঃ-
বর্তমান পৃথিবীর অর্থনীতি, স্বর্ণ, বৈশ্বিক মুদ্রা যুদ্ধ, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর অর্থনীতি নিয়ে জানতে চাইলে এই বইটি অনেকটাই অবশ্যপাঠ্য। আরে ভাই বইনরা আর কতো সাদাত হোসাইনের উপন্যাস পড়বেন ? বর্তমান পৃথিবীতে কি হচ্ছে না হচ্ছে এইগুলাওতো জানা দরকারি নাকি ? সবার উচিৎ বইটি পড়ার তাহলে সবার কিছুটা হলেও ধারণা হবে ভবিষ্যতে কি করা দরকার আর ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক যুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরূপ বর্তমানে কি করতে হবে।
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....