হাটি হাটি পা পা : লেখকঃ ফিরোজা বহ্নি | Hati Hati Paa Paa

বইয়ের নামঃ হাটি হাটি পা পা
লেখকঃ ফিরোজা বহ্নি
প্রকাশনীঃ আদর্শ 
প্রকাশকালঃ ৬ই এপ্রিল, ২০২১
মুদ্রিত মূল্যঃ ৩৮০/= 

অনেকদিন পর এমন এক বই পড়লাম যেটার মোহ থেকে গত ৩দিন যাবত বেরোতেই পারছি না। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল মাত্র এক বছর আগে প্রকাশিত এত অসাধারণ একটা বইয়ের খোজ আমি এতদিনে পেলাম! 



বইটা পাওয়ার ব্যাকগ্রাউন্ড টা বলি এবার। এ বছর Proloy Hasan এর প্রকাশিত #হালাল_মার্কেটিং বইয়ের এর কাজে আদর্শ প্রকাশনীতে যাওয়া হয়েছিল আমার ক্যাম্পাস শেষে। কথা ছিলো আদর্শ থেকে কাজ শেষ করে আমরা দুজন মিলে বইমেলায় ঢু মারতে যাবো। কিন্তু কিসের কি! বইয়ের কাজ তো শেষ হচ্ছিলো ই না। তখন আদর্শ এর এত এত বই থেকে র‍্যান্ডমলি একটা বই নিয়ে পড়তে বসে গেলাম। টানা ৫ঘন্টা বইটা পড়ে এক বসাতেই শেষ করে ফেললাম। মনে হচ্ছিলো গোগ্রাসে গিলছি বইটি। কিন্তু এরপর তো আর এই বইয়ের আবেশ থেকে বেরোনোই যাচ্ছে না। 

একটা শিশুর ভালোভাবে গড়ে উঠার ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের অবদান যে কতখানি সেটা হয়তো সবাই জানে। কিন্তু কজন সেটা উপলব্ধি করে বাচ্চাকে সে অনুযায়ী গড়ে তুলতে জানে। বইটির লেখিকা ফিরোজা বহ্নি ও চমক হাসান তাদের মেয়েকে এত সুন্দর ভাবে গড়ে তুলছেন তার আসলে তুলনা চলে না। একটা মেয়ের মা হয়ে উঠা থেকে শুরু করে পরের জার্নি গুলো পার করা, বাচ্চার ঘুম, খাওয়া, পটি ট্রেনিং, কথা বলা শেখানো, বর্ণমালা শিখানো এই সব কিছু লেখিকা তার মেয়েকে একদম ভিন্ন ভাবে করেছেন। 

আপনি শুনলে অবাক হবেন, আমরা কি করি? বাচ্চা ঘুমালে আলো নিভিয়ে, চারপাশ নিঃশব্দ করে তারপর ঘুমানোর একটা পরিবেশ করি, তাই তো? কিন্তু লেখিকা তার মেয়েকে এসবের কিছুই করেন নি। বরং তার মেয়ে যেনো যেকোন পরিস্থিতি তে নির্বিঘ্নে ঘুমাতে পারে সেই ব্যবস্থা করেছেন, আলো জালিয়ে রেখে, টুকটাক শব্দ করে! কি অদ্ভুত তাদের ভাবনা গুলো তাই না? আমরা এভাবে ভাবি ই না। 

আরেকটা ব্যাপার যেটা মুগ্ধ করার মতো ছিলো সেটা হলো, আমরা কি দেখতে পাই, একটা বাচ্চা, মায়ের কিছু একটা পেয়ে বাবার কাছে নালিশ করে। বাবা তখন মাকে বকুনি দিয়ে বাচ্চাকে খুশি করে। কিন্তু ফিরোজা বহ্নি আর চমক হাসান এই কাজটা কখনো করেননি। তাদের মেয়ে বর্ণমালা যদি মায়ের কাছে এসে বলতো দেখো বাবা এই ভুল করেছে। লেখিকা তখন তার মেয়েকে বুঝিয়ে বলতেন, তার বাবা ইচ্ছে করে এমনটা করেনি, ভুল করে করেছে। আর করবে না। আবার বর্ণমালা যদি তার বাবার কাছে এসে নালিশ করতো মা তার সাথে খেলছে না তখন বাবা বুঝাতো যে মা তো কাজে ভীষণ ব্যস্ত আছেন, ফ্রি হলেই খেলবে তোমার সাথে। চলো ততক্ষণে আমি তোমার সাথে খেলি। আমি অবাক হয়ে গেলাম তাদের পরস্পর পরস্পরের কি পরিমাণ শ্রদ্ধাবোধ আর ভালোবাসা এবং সেটা তারা তাদের মেয়ের ভিতরেও তৈরি করে দিচ্ছেন একটু একটু করে। 

একটা মেয়ে যখন মা হবে তখন চারপাশ থেকে নানান গুঞ্জন শুরু হতে থাকে। এটা করো, ওটা করলে তোমার বাচ্চা ফর্সা হবে। এটা খুব ই ব্যাড প্র‍্যাক্টিস। লেখিকা বইতে দেখিয়েছেন, বাচ্চা সাদা-কালো হওয়ার আগে সুস্থ হওয়াটা খুব বেশি জরুরী। আমিও সেটাই মনে করি।

আরেকটা ব্যাপার লক্ষণীয় ছিলো যেটা তারা কখনো নিজেদের মেয়ের সামনে ঝগড়া করতেন না। মেয়ে ঘুমিয়ে থাকলে হয়তো হালকা কথা কাটাকাটি হতো। কিন্তু জেগে গেলে আবার তারা আগের মতো হাসি-খুশি। নিজেদের হ্যাপি ফেইস সবসময় মেয়েকে দেখিয়েছেন যা তাদের মেয়েকে প্রাণবন্ত হতে সহায়তা করেছে। 

আমাদের সমাজের অন্যতম প্রধান যে সমস্যা, বাচ্চারা ডিজিটাল ডিভাইস কিংবা বোকা বাক্সে আসক্তি হয়ে যাওয়া৷ ফিরোজা বহ্নি কি সুন্দর ভাবে তার মেয়ে বর্ণমালাকে সেসব থেকে দূরে রেখেছেন সেটা পড়ে একদম মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি আমি! কোন গান, কবিতা কিংবা ছড়া, অথবা বর্ণমালা শেখানো সবকিছুতেই মেয়েকে গল্পের মাধ্যমে শিখিয়েছেন। 

আপনি যদি নতুন বাবা-মা হয়ে থাকেন তাহলে তো আপনার জন্যে এটি অবশ্যপাঠ্য আর না হয়ে থাকলেও এটি পড়তে আপনার এতটুকু বোরিং লাগবে না। এখানে কোন উপদেশ নেই কিংবা নেই কোন কাটখোট্টা পরামর্শ বরং নিজেদের জীবন থেকে নেয়া কিছু কাহিনীর সমন্বয় যা আপনাকে গতানুগতিক নিয়ম থেকে বের হয়ে একটু অন্যভাবে ভাবতে শিখাবে, মুগ্ধ করবে আপনাকে....

বই: হাঁটি হাঁটি পা পা
লেখক: ফিরোজা বহ্নি
মুদ্রিত মূল্য: ৩৮০ টাকা
কাব্যকথার ঘর মূল্য: ৩১২ টাকা (১৮% ডিসকাউন্টে) 

বইটিতে লেখকের মা হয়ে ওঠার গল্প, ফিরোজা বহ্নি আর চমক হাসানের দাম্পত্য জীবনের গল্প আর তাদের সন্তান বর্ণমালার বেড়ে ওঠার গল্প রয়েছে। মূলত বর্ণমালাকে কীভাবে তারা বড়ো করেছেন তার সহজ সরল গল্প বলেছেন লেখক এই বইয়ে। 
 
চমক হাসানের ফেসবুক পেইজে দীর্ঘদিন ধরে ফলো দেওয়া আমার। প্রায় প্রত্যেকটা ভিডিওই দেখি আমি। সেখান থেকেই ফিরোজা বহ্নিকে চেনা। তাদের প্যারেন্টিং দেখে চমৎকৃত হই। বর্ণমালার মা প্রায়ই ওকে গল্পের মাধ্যমে এটা ওটা শেখায়। সত্যি বলছি ওইটুকুনি বাচ্চা মেয়েটার বাংলায় দখল দেখে অবাক হয়েছি ভীষণ। বিদেশ বিভূঁইয়ে একা একা এমন চমৎকারভাবে সন্তানকে কীভাবে বড়ো করছে ভেবে অবাক হই। 

যখন দেখলাম বর্ণমালাকে বড়ো করার গল্প বই আকারে প্রকাশ করেছেন তিনি, তখন সাথেসাথেই পড়ে ফেললাম খানিকটুকু। একদমই সহজ সরল গল্প। পড়লে মনে হবে যেন এটা বুঝি আমাদেরই গল্প৷ আমাদের বাচ্চাদের মায়েরা যেটা করেন, বাচ্চা ঘুমালে আস্তে আস্তে উঠে পড়েন, বাতি নিভিয়ে দেন। তিনি সেটা করেননি বরং বাতি জ্বালিয়ে রেখেছেন, প্রয়োজনে খুটখাট শব্দও করেছেন৷ যেন বাচ্চা সবেতেই অভ্যস্ত হতে পারে। আমার মনে হয় সার্ভাইভালের জন্য এসব ভীষণ জরুরি৷ 

প্যারেন্টিং বিষয়ে পড়াশোনায় আগ্রহীরা এই বইটা পড়ে দেখতে পারেন। আশা করছি লেখক আপনাদের নিরাশ করবেন না।

ফিরোজা বহ্নি- লেখক হিসেবে পরিচিত নাম নয়। তাঁর লিখিত প্রথম বই ‘হাঁটি হাঁটি পা পা’ ও কোনো পরামর্শের ঝুলি কিংবা ‘উচিত-অনুচিত’-র বয়ানও না... এই লেখা কোনো ‘আদর্শ’ মায়ের কিংবা ‘আদর্শ’ সন্তানের গল্প না, এই লেখা নিতান্তই একটা পথচলার গল্প, এক এলোমেলো মানুষের ‘মা’ হয়ে ওঠার গল্প, মা হওয়ার পর তার বদলে যাওয়া রূপ ও বদলে যাওয়া জীবনের গল্প, একটা নতুন জীবনের আলোয় নতুন করে ‘জীবন’ দেখার গল্প।

বইটি নিয়ে রকমারি ভেরিফায়েড ক্রেতার রিভিউর কিয়দাংশ-

“একটা মানব শিশুর জন্মের প্রক্রিয়াটা যত না কঠিন, তাকে একটু একটু করে বড় করে তোলা তার চেয়েও কঠিন। কঠিন পথটা আরও একটু অনিশ্চিত হয়ে যায় বোধহয় প্রথম সন্তানের বেলায়। সন্তানের পুষ্টি, সুন্দর ঘুমের অভ্যাস, খাবার খাওয়া, সময়মত বুকের দুধ ছাড়ানো, Potty training, স্রোতের বিপরীতে গিয়ে তাকে বোকা বাক্স (মোবাইল, টিভি, আইপ্যাড) থেকে দূরে রেখে সুস্থ একটা মানসিকতা তৈরি করা - সব মিলিয়ে যেন এক রণক্ষেত্র। এই রণক্ষেত্রে প্রতিটি মা-ই এক একজন সেনাপতি। এই সেনাপতিদের রণকৌশলের পিছনে লুকিয়ে থাকে শিল্প। বহ্নি আপু খুব যত্নে শিল্পীর আঁচড়ে একে দিচ্ছেন তার মেয়ে বিনীতা বর্ণমালার মানসপট।

স্ক্রিনটাইম নিয়ে এখনকার বাচ্চাদের মায়েদের অনেক অভিযোগ থাকে। বইটা পড়লে জানা যাবে লেখিকা কীভাবে তার ছোট্ট মেয়েটিকে এই অভিশাপ থেকে দূরে রাখছেন। জানা যাবে বর্ণমালাকে ‘বড় হয়ে কি হবে’ প্রশ্নের উত্তরে সে কেন বলে ‘আমি একটা Happy মানুষ হতে চাই’। এই ভাল থাকার মন্ত্রটাই যে আমরা বাচ্চাদের শেখাতে ভুলে যাই।”

হাঁটি হাঁটি পা পা
by ফিরোজা বহ্নি
TK. 323
https://cutt.ly/fQEtXsp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ