বই রিভিউ | হৃদয়ে তার পায়ের ছাপ রুকসাত জাহান - Hridoye Tar Payer Sap By Ruksat Jahan

বইঃ হৃদয়ে তার পায়ের ছাপ
ধরনঃ সমকালীন উপন্যাস  
লেখকঃ রুকসাত জাহান
প্রকাশনীঃ চলন্তিকা
প্রকাশকঃ রাশেদ রানা
প্রচ্ছদঃ নিসা মাহ্জাবীন
মলাট মূল্যঃ ২৫০/-
প্রথম প্রকাশঃ অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২.
বই রিভিউ | হৃদয়ে তার পায়ের ছাপ রুকসাত জাহান - Hridoye Tar Payer Sap By Ruksat Jahan

রুকসাত জাহানের লেখা “হৃদয়ে তার পায়ের ছাপ” একটি সমকালীন উপন্যাস। নামকরণ - যে কোনো বইয়ের নামকরণ হচ্ছে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। নাম দেখেই বইটি পড়ার প্রতি অনেকটা আগ্রহের সৃষ্টি হয়। নামের সাথে কাহিনীর সামঞ্জস্যতা থাকলে পড়ার পর এক ধরনের তৃপ্তি পাওয়া যায়। সেদিক দিয়ে এই বইটির যথার্থ নামকরণ হয়েছে।

প্রচ্ছদঃ- প্রচ্ছদ হচ্ছে যে কোনো বইয়ের প্রাথমিক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ভালো বই পড়ার পর যেমন মনে প্রশান্তি আসে, তেমনি কোনো বইয়ের প্রচ্ছদ সুন্দর হলে, সেটা দেখে চোখের তৃপ্তি হয়।

কাহিনী সংক্ষেপ

গ্রামীণ পটভূমিতে লেখা হয়েছে উপন্যাসটি। উত্তম পুরুষে লেখা এই উপন্যাসের কথক হচ্ছে বেলাল। বেলালের কৈশোরে থেকে পূর্ণ বয়স্ক হওয়ার সময়টা উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে। জীবনের নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে কাহিনী এগিয়ে গিয়েছে।

পারিবারিক আবহে লেখা এই উপন্যাসে পরিবার তথা সমাজের কিছু বাস্তবসম্মত চিত্র সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে।

ধনী-গরিবের বৈষম্য, আত্মসম্মানবোধ, পরিশ্রমী মনোভাব, সন্তানের প্রতি অন্ধ স্নেহ, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া, অহংকারের পরিণতি এই বিষয়গুলো উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে।

চরিত্র-বিশ্লেষণঃ-

শোভাঃ-
শোভা চরিত্রটি আমাদের খুব চেনা। বাবা-মায়ের প্রশ্রয়ে এদের সাহস দিন দিন বেড়েই যায়। তারা ন্যায়, অন্যায়ের বিভেদ ভুলে যায়। কিন্তু যখন এদের টনক নড়ে, তখন বড্ড দেরি হয়ে যায়। সন্তানের প্রতি অন্ধ স্নেহ কখনই সন্তানের জীবনে মঙ্গল বয়ে নিয়ে আসে না। তাই বুঝি একসময় শোভাপা নিজের সংসার ভাঙার জন্য উনার মা'কেই দোষারূপ করেছেন।

বেলালঃ-

বেলাল হচ্ছে এই উপন্যাসের আদর্শ চরিত্র। ছোট্ট বয়সেও ওর বোধশক্তি প্রখর। সে সংগ্রাম করে বড়ো হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিশোর বয়সের আবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। এই দিকটা শিক্ষণীয়। পরিশ্রমের মাধ্যমে ভাগ্য বদলে বিশ্বাসী বেলাল এবং সে সফলও হয়। “অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়” এই প্রবাদ যে সবসময় সঠিক নয়, এর প্রকৃত উদাহরণ হচ্ছে বেলাল। লেখিকাকে সাধুবাদ জানাই এমন একটা শক্তিশালী কিশোর চরিত্র সৃষ্টি করার জন্য।

ঝুমিঃ-

ঝুমি চরিত্রটাও পছন্দের। শান্ত, দৃঢ়! তবে একটু অভিমানী। মায়ের ওপর অভিমান করে একটা ভুল করতে চেয়েছিল অল্প বয়সে। এটা যতটা না ওর নিজের দোষ, তার চেয়ে বেশি দোষ ওর বয়সের এবং অবশ্যই এজন্য পারিপার্শ্বিকতা দায়ী। বাবা-মাকেও সন্তানদের কৈশোরকালীন সময়ে ওদের প্রতি ব্যবহারে আরও যত্নশীল হতে হবে। তবে ভুল থেকে ফিরে এসে আবার জীবনের লক্ষ্যের দিকে ছুটে চলেছে ঝুমি। এটাই ভালো লেগেছে।

নোভাঃ-

অতি ছোটো পরিসরে হলেও এই চরিত্রটি পাঠকদের হৃদয়ে ছাপ রেখে যায়। স্বল্পভাষী, নিরীহ, মিষ্টি একটা মেয়ে নোভা।

বরকতঃ-

উপন্যাসের শুরু এবং শেষে একটুখানি উপস্থিতি হলেও এটা একটা স্ট্রং চরিত্র। মনে প্রচন্ড ইচ্ছেশক্তি আর পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকলে যে শত বাঁধা পেরিয়েও নিজ লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়,সেটা বরকত ভাই দেখিয়ে দিয়েছেন। আমার খুব পছন্দের একটা চরিত্র এটা।

এছাড়াও বেলালের বাবা-মা,চাচা-চাচী,রুমেল, মানিক,শামীম,শিকদারসহ অন্যান্য চরিত্রগুলিও যার যার অবস্থান অনুযায়ী সাবলীল।

পাঠ-প্রতিক্রিয়াঃ-

অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায় লেখা এই উপন্যাস পড়ে আমি পাঠক হিসেবে পুরোপুরি তৃপ্ত হয়েছি। নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় লেখা বোধগম্য সংলাপগুলো উপন্যাসের অন্যতম সংযোজন। এই উপন্যাসের বর্ণনা এতই সাবলীল ছিল যে, পড়ার সময় মনে হয়েছে চোখের সামনে সবটাই দেখতে পাচ্ছি। গ্রামীণ জীবন, চরের জীবনধারা, টাকার জন্য রক্তের সম্পর্কে জটিলতা, গ্রামের মানুষের কুটিলতা সবই আছে। 

অহংকার যে পতনের মূল আর পরিশ্রম যে সৌভাগ্যের প্রসূতি, এই প্রবাদ বাক্যগুলির সত্যতা দেখিয়েছেন লেখিকা। সুন্দর কিছু সামাজিক মেসেজ আছে উপন্যাসে। 

কিছু অসঙ্গতিঃ-

এক জায়গায় বলা হয়েছে, শোভাপা উনার চাচাতো বোন ঝুমি থেকে পাঁচ বছরের বড়ো। ঝুমি ক্লাস টেনে পড়ে। পরক্ষণেই বলা হলো শোভাপার বয়স চব্বিশ। আবার লেখিকা বললেন তখন গ্রামে ছয় /সাত বছর বয়স বাচ্চাদের ওয়ানে ভর্তি করা হতো।

সে হিসেবে সাত বছরে ভর্তি হলেও তো টেনে পড়ুয়া ঝুমির বয়স বড়োজোর ষোল হবে। শোভাপার বয়স একুশ হওয়ার কথা। চব্বিশ হলো কীভাবে? 

আর উত্তম পুরুষে লেখা উপন্যাসের দু'একটা জায়গায় নাম পুরুষ ব্যবহার করা হয়েছে। 

এই সামান্য দু'একটা ভুল ছাড়া আর সবই ঠিকঠাক ছিল।

বইটি আমার হৃদয়ে ছাপ ফেলে গিয়েছে।

রেটিংঃ- ৯/১০

আর হ্যাঁ, আজকাল আমার এমন হয়েছে কেনো গল্প অর্ধেক পড়লেই বাকিটা অনুমান করতে পারি। এবং শেষটা আমার অনুমানের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। যেন এই গল্পটা আমিই লিখেছি।

এই উপন্যাসের নোভার পরিণতি আমি যেমনটা ভেবেছিলাম, তেমনটাই হয়েছে। বেশি বললে হয়তো স্পয়লার হয়ে যাবে। তাই এটুকু বলছি, বেলালের শেষটা আমি একেবারেই অনুমান করতে পারিনি। বিশেষ করে একেবারে শেষের সংলাপটা হৃদয়ে গভীরভাবে ছাপ ফেলেছে। আর উপন্যাসটির প্রথম দু'চার লাইন পড়ে আমি ভেবেছিলাম উপন্যাসের কথক বোধহয় কোনো মেয়ে চরিত্র হবে। পরে দেখলাম বেলাল নামক ছেলে চরিত্র। এখানেই বোধহয় একজন লেখকের লেখার সার্থকতা। প্রথমেই কোনো পাঠককে টাস্কি খাইয়ে দেওয়া।

পরিশেষে বলবো, রুকসাত আমার ব্যাচমেট বান্ধবী। পেশায় একজন চিকিৎসক। ঢাকার অত্যন্ত নামকরা একটি হাসপাতালে ডেন্টাল সার্জন হিসেবে কর্মরত আছে। তবে নিজে ডাক্তার হলেও, বইয়ে দাঁতভাঙ্গা কোনো শব্দ লিখেনি সে। ভীষণ সুখপাঠ্য ছিল বইটি।

রুকসাতের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইলো। ওর নতুন বইয়ের অপেক্ষায় রইলাম।

পরিচিতিঃ উপন্যাসঃ হৃদয়ে তার পায়ের ছাপ রিভিউ

পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ রুকসাত জাহানের "হৃদয়ে তার পায়ের ছাপ" উপন্যাসটি পড়ে শেষ করলাম। উপন্যাসটি পড়ে যথাযথভাবে নামকরণের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছি। সত্যি সুনিপুণভাবে হৃদয়ে ছাপ ফেলেছে। 

উপন্যাসটি গ্রামীণ জীবনকে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে। এখানে ফুটে উঠেছে একটা পরিবারের খুনশুটি, ভালোবাসা, গ্রাম্য রাজনীতির চিত্র।
 মা প্রায়ই বলেন," প্রায় সব পরিবারেই একজন থাকে যে নিজের থেকে অন্যকে নিয়ে বেশী ব্যস্ত, ঝামেলা পাকানোই তাদের একমাত্র লক্ষ্য।" 
  এ উপন্যাসের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র শোভাপাই তার উজ্জল সাক্ষী। আবার এটা প্রায়শই লক্ষ্য করা যায় যে একই পরিবারের অনেকগুলো ভাইবোন থাকলে, যার অর্থ বেশী থাকে, তার প্রভাব বেশী থাকে। এই উপন্যাসেও লেখক সে বিষয়টা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে মনেই হয় নি এটা গল্প। 
এ উপন্যাসে প্রেম ভালোবাসার উপাখ্যানও লেখক অত্যন্ত মার্জিতভাবে তুলে ধরেছেন। 

মোটকথা, হাজার বছর ধরে উপন্যাসটি পড়ে যেমন ঐ সময়কার গ্রামীণ চিত্র সম্পর্কে আমরা স্পষ্ট ধারনা পেয়েছি, ঠিক এই উপন্যাসেও বর্তমান সময়ের চিত্র ফুটে উঠেছে। গল্পটি পড়ে খারাপ লেগেছে, কিছু সময় রাগ উঠেছে, হাসি এসেছে। একটু প্রেম প্রেমও পেয়েছে। কাহিনীটি উত্তম পুরুষে বর্ননা করায় যেনো আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেয়েছি।

 উপন্যাসটি পড়ে মনে হলো, এমন কেনো জীবন! যেভাবে চাই সেভাবে কেনো হয় না!!! 

যে লাইনটা পড়ে সবচেয়ে বেশী হাহাকার লেগেছে আমার সেটা লিখছি-- 

"চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট ভাষায় মিথ্যে কথা আজও বলতে পারি না। " 

বই পরিচিতিঃ 

  • উপন্যাসঃ হৃদয়ে তার পায়ের ছাপ 
  • লেখকঃ রুকসাত জাহান 
  • প্রকাশনীঃ চলন্তিকা  
  • মলাটমূল্যঃ ২৫০/-
  • রিভিউ ও বইছবিঃ ঈশিতা আদনীন

Buy This Book Hardcopy

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ