লাভ লেটার বই : লেখক আরিফ মাহমুদ | Love Letter By Arif Mahmud Books

  • বই লাভ লেটার
  • লেখক আরিফ মাহমুদ
  • প্রকাশনী আর রিহাব পাবলিকেশন
  • সংস্করণ ১ম এডিশন, ২০২১
  • পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৮৮
  • বাঁধাই হার্ডকভার
  • ভাষা বাংলা


লাভ লেটার। প্রেমপত্র। শুদ্ধ ভালোবাসার। শুভ্র ভালোবাসার। পবিত্র ভালোবাসার।

পবিত্র প্রেম-কাহিনি। ভালোবাসার স্নিগ্ধতাভরা কথন-বচন। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ ভালোবাসার লিখন। আবেগ-মোহিত ভালোবাসার। স্নেহময় ভালোবাসার। পুষ্প সুরভিত ভালোবাসার। বৃষ্টিবিধৌত গোলাপ পাপড়ির মতোন এক একটি চরণ, আচরণ।

মিষ্টি ভালোবাসার নির্মল ছোঁয়া। ভালোবাসার শুদ্ধ্যশুদ্ধি। ভালোবাসার খুনশুটি। ভালোবাসার শুদ্ধাচার। ভালোবাসার আঁধার; স্বাদ-বিস্বাদ।

অশুদ্ধ কর্ম ও তার প্রতিকার; অশুভ প্রেম ও তার প্রতিবিধান। দীনের আলোয় আলোকিত হওয়ার প্রত্যয়-জ্ঞান।

বক্ষ্যমাণ পুষ্পমাল্যটি গাঁথা কয়েকটি ফুলে। পবিত্র প্রেমপত্রে। ভালোবাসার মানুষটির মিষ্টি চরিত্রে। আদর্শ ‘ভালোবাসার সাথি-সঙ্গিনী' মনোনয়ন। আদর্শ বৈবাহিক বন্ধন ও স্বর্গীয় আস্বাদন। হারাম রিলেশন ও এর দর্পণ-উত্তরণ। ধর্ম, জীবন ও যৌবন-নিষিদ্ধ কর্ম ও আদর্শ যুব-উন্নয়ন। দুর্বিষহ জীবন থেকে উত্তরণ। সুন্দর ভালোবাসার জীবন।

পরিশেষে, সুহৃদ পাঠকবর্গ বইটিতে কোনো ধরণের অসঙ্গতি বা ভুল-ত্রুটি লক্ষ করলে আমাদের জানাবেন। পরবর্তী সংস্করণে আমরা ঠিক করে দেবো ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের ‘আদর্শ যুব উন্নয়নের এই খিদমাহ’কে কবুল করুন। প্রকাশকসহ এই খিদমাহর সাথে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত প্রত্যেককে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমিন; ইয়া রব্বাল আলামিন!

আরিফ মাহমুদ 26.6.2021 ইং

প্রিয় মুহতারামা!

আমার হবু গৃহরাণী!

আশা করি আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন। ভালো থাকারই কথা, কেননা আমি যে প্রতিটা মোনাজাতে আপনার জন্য দোয়া করি।

না আপনাকে একদমই ভুলি নি। আপনাকে ছাড়া প্রতি মুহূর্ত যেন বছর-সমান। শুধু আপনি নন, আপনাকে ছাড়া আমিও যে একা!

আমিও আপনাকে খুব মিস করি। আপনার অতি আবেগ-মোহিত প্রলাপগুলো অনুভব করতে পারি। তখন শুধু দোয়া করি, যেন আল্লাহ নিজ রহমতে আপনার মনকে শীতল করে দেন।

প্রিয়তমা! সত্যিই যদি একবার আপনাকে দেখতে পেতাম! তাহলে বলতাম, কীভাবে কাটে আপনাকে ছাড়া আমার মুহূর্তগুলো। মাছ পানি থেকে ওঠালে যেমন কষ্টে কাতরায়, আপনাকে ছাড়া আমার মনও কাতরায় মুহুর্মুহু। আপনাকে আমার বাড়ি নিয়ে আসার প্রস্তুতি শেষ, তবে আপনার খোঁজ যে এখনো আমার কাছে পৌঁছায় নি! একবার কোনো ওসিলায় আপনার খোঁজ পেলে—অপেক্ষা করে কষ্ট করতে হবে না আর আপনার, কথা দিলাম।

আপনাকে খাওয়ানো পরানো নিয়ে আমি মোটেই চিন্তিত নই গো প্রিয়তমা। রিজিকের মালিক আল্লাহ। আপনার রিজিক আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত; আপনি যেখানেই যাবেন সেখানেই আল্লাহ আপনার রিজিক আপনার সাথে পৌঁছে দেবেন; তাই আমার চিন্তার কোনো কারণ নেই। মাঝে মাঝে শুধু চিন্তা হয় যদি আপনার অভিভাবক বা জাহিল সমাজের কুপ্রথায় কান দিয়ে আপনি আমার সামর্থ্যের বাইরে দেনমোহর চেয়ে বসেন, তবে কিন্তু আমার মতোন গরিবের আশা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। তাই এ ব্যাপারে কীভাবে আপনার অভিভাবককে সামলাবেন তা আপনার ওপরই ছেড়ে দিলাম।

জানেন? আমারও না মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হয় আপনার দ্বারা সওয়াব অর্জন করতে। প্রায় সময় ভাবি ইশ! যদি খাবার সময় আপনার মুখে খাবার-লোকমা তুলে দিয়ে, আপনার চোখে চোখ রেখে রহমতের দৃষ্টিতে তাকিয়ে; বাড়ি থেকে বের হওয়া ও বাড়িতে ঢোকার পর আপনার কপালে চুমু এঁকে, রাতে হাত ধরে আপনাকে হাঁটতে নিয়ে গিয়ে সওয়াব হাসিল করে নিতাম। ইন শা আল্লাহ এক দিন সবই হবে।

আপনার কাছে আমার চাওয়া শুধু এতটুকুই—যেভাবে চললে আল্লাহ খুশি হবেন এবং আমাদের জীবন আল্লাহর অশেষ রহমতে ঘেরা থাকবে, সেভাবে আপনি চলবেন এবং আমাকে চলতে অনুপ্রাণিত করবেন।

আপনার আর আমার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যেন হয়—একমাত্র আল্লাহ তাআলাকে

সন্তুষ্ট করা।

ভালো থাকবেন। নিজের যত্ন নেবেন। আর তাহাজ্জুদে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি করে চাইবেন, আল্লাহ তাআলা যেন খুব তাড়াতাড়ি আপনাকে আমাকে এক করে আমাদের অর্ধেক দীন পূর্ণ করে দেন।

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
ইতি
আপনার হবু হাবিবি।

লাভ লেটার : প্রেয়সীর ভালোবাসা

প্রিয় সম্মানিত! শুরুতেই আমার সালাম ও ভালোবাসা নেবেন। আমি তো প্রেগন্যান্ট! তাই সংসারের নানা কাজ আগের মতোন করতে পারি না। মা-র শরীরটাও ভালো না। তবুও উনি যতটুকু পারেন আমাকে সাহায্য করেন। আমাকে এখন রান্নাঘরে যেতেই দেন না। মা-র অল্প একটু ঠাণ্ডা লেগে গেলে জ্বর, সর্দি, কাশি হয়ে যায়। তাই মা বাবাকে বলে আমাদের পাশের গ্রাম থেকে একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছেন। আপনাকে আমি বলতেই ভুলে গেছি। ক্ষমা করে দেবেন প্রিয়। বাবা আপনাকে দেখার জন্য আমাকে বারবার বলছেন; কিন্তু আমার ফোনটা গত পরশু নষ্ট হয়ে যায়। মায়ের ফোনের কিছুই তো বুঝতে পারি না। বাবাকে একবার ভিডিও কল দিয়ে কথা বলে নেবেন। একদম চিন্তা করবেন না আমাদের জন্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দয়ায় সবাই ভালো আছি। কাজের অনেক চাপ বুঝি? উফফ, অনেক কথাই বলে ফেলেছি! রাব্বুল আলামিন আপনার শরীরটা কেমন রেখেছেন? খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করছেন তো? নামাজটা সঠিক সময়ে আদায় করে নেবেন। আজকে তো রোজা রেখেছেন নিশ্চয়ই? কাজ করতে অনেক কষ্ট হচ্ছে? ধৈর্যধারণ করুন। রব এর উত্তম প্রতিদান দেবেন। আর অবশ্যই তাহাজ্জুদ নামাজের পর আমাদের বাবুর জন্য দোয়া করবেন। ইন শা আল্লাহ, বাবু আপনার মতো দুষ্টু, মিষ্টি, নামাজি হবে। রাব্বুল আলামিন আপনাকে উনার দয়ার চাদরে সারাক্ষণ মুড়িয়ে রাখেন। আমার সবসময়ই এই প্রত্যাশা। কোনোদিন চিঠি লিখি নি। আজ লিখলাম। ভুল হলে ক্ষমা করবেন। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

দশ মিনিট পর......

ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, প্রিয় সম্মানিতা! আমি আগেও বলেছিলাম একটা কাজের মেয়ে বাসায় রাখার জন্য। যাইহোক শুনে খুশি হলাম। তবে একটা বিষয়ে খুব সতর্ক থাকবে। বাসার কাজের জন্য কাজের মেয়ে রাখতে শরিয়াতে কোনো বাধা নেই। তবে শর্ত হলো, বালেগা হলে বাড়ির পুরুষ সদস্যদের সামনে তার পূর্ণরূপে পর্দা করতে হবে। যেহেতু মেয়েটি কারোর মেয়ে, বোন, খালা ইত্যাদি হতে পারে। তাই তাকে নাম ধরে; নয়তো বুবু বা বোন বলে ডাকবে। আর বোনের যা প্রয়োজন—বাবাকে নয়তো মাকে বলবে কিনে দিতে। পরিপূর্ণ হক আদায়ের দিকে সদা খেয়াল রাখবে। আর আমাকে ক্ষমা করে দিও হুমায়রা। তোমার কোনো হকও সঠিকভাবে আদায় করতে পারি নি। বাবা-মা'রও হক আদায় করতে পারি নি। তবুও অনেক ভালো লাগে তখন, যখনই শুনি তুমি বাবা-মায়ের যথেষ্ট দেখাশোনা করছো। আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া। আলহামদুলিল্লাহি আলা কুল্লি হাল। রব আমাকে অনন্যা ও অতুলনীয় পাখিটিকে দিয়েছেন। সেই পাখিটা কিন্তু 

তুমি। আমি তোমার জন্য একটা ফোন কিনেছি। তবে কাউকে পাচ্ছি না দেশে পাঠাতে। সুযোগ পেলেই ইন শা আল্লাহ পাঠিয়ে দেব। হ্যাঁ, কাজের অনেক চাপ। আলহামদুলিল্লাহ, রোজাও রেখেছি। বাবা-মা এবং তুমি যে রোজা রেখেছো, সেটা আমি জানি। আমি তোমাকে রোজা রাখতে বাঁধা দেব না। তবুও শরীরের অবস্থা বিবেচনা করে রোজা রাখবে। আসলে কাজের সময়টাতে ফোন দেয়া নিষেধ। আর আমি কখনো চাই না নিজ দায়িত্বে অবহেলা করতে। আমি সবসময়ই চাই হালাল রোজগার করতে। রাত নয়টার দিকে বাবাকে ফোন দেব। উনাকে বলবে চিন্তা না করতে। মা-কে যতটুকু সম্ভব ঠাণ্ডা লাগাতে বারণ করবে। তুমিও ঠাণ্ডা লাগাবে না। তবে হ্যাঁ, গরম পানি দিয়ে হলেও ওজু করে সঠিক সময়ে নামাজ পড়ে নেবে। বাবাকে ঠিকমতো ওষুধ খেতে বলবে। আমি হার মানতে রাজি যে, দিন শেষে আমার থেকে বাবা-মায়ের যত্ন তুমিই বেশি নিচ্ছো। সেটা দেশে থাকাকালীন সময়েই দেখেছি। খুব ভালোই লাগে তখন, যখন বাবা-মায়ের মুখ থেকে তোমার প্রশংসা শুনি। আমার হকগুলো তুমিই আদায় করে দিচ্ছো। আল্লাহ তাআলা তোমাকে আরও তাওফিক দিন। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি ভালো আছি। এবং সবসময়ই দোয়া করি যে, তিনি সকলকেই ভালো রাখেন, সবখানে, সবসময়। আমার বাচ্চাটাও নিশ্চয়ই দুষ্টুমি করছে। হাহাহা, দেখতে হবে না বাচ্চাটা কার! ছেলে-মেয়ে, যাই হোক না কেন! ইন শা আল্লাহ, তুমি মিলিয়ে নিও, বাচ্চা দেখতে আমার মতোই হবে। আমি সুযোগ পেলে ইন শা আল্লাহ, দেশে আসব। আর আমি সবসময়ই রাতের ইবাদতে সবার জন্য দোয়া করি। বিশেষ করে বাবা-মা, শ্বশুর মশাই, শাশুড়ি এবং আমার বাচ্চা ও তার মায়ের জন্য। নিজের খেয়াল রেখো। আল্লাহ-ভরসা। তিনি সব ঠিক করে দেবেন ইন শা আল্লাহ। কোনো চিন্তা করবে না। একদমই না। আল্লাহ পাক তোমাকে সবসময়ই উনার রহমতের চাদরে ঢেকে রাখবেন এবং শয়তানের কু-নজর থেকে হিফাজতে রাখবেন, ইন শা আল্লাহ। আমার সালাম ও ভালোবাসা নিও। বাবা-মাকে আমার সালাম দিও। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

লাভ লেটার : লাভ ফর ওয়াইফ

তিন দিন পরে আমার বিয়ে। বিয়েতে আমার একদম মত নেই। শুনেছি পাত্রী অনেক ইসলামিক মাইন্ডের!! কারো সামনে বের হয় না। তাকে নিয়ে কীভাবে আমি আমার জীবন কাটাব তা চিন্তা করতেও গা ঘিন ঘিন করছে!! বিয়েটা বাবা-মায়ের পছন্দে হচ্ছে। আমারও যে পছন্দের কোনো মেয়ে আছে বা কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে তা কিন্তু না। এরকম কোনো কিছুর সাথে আমি কখনো জড়াই নি। তবে আমার স্বপ্ন ছিল এমন কোনো জীবনসঙ্গিনী পাব যাকে নিয়ে সারা শহর রিক্সা দিয়ে ঘুরব, তার পরনে থাকবে নীল শাড়ি, খোপায় থাকবে লাল গোলাপ আর আমি পড়ব নীল পাঞ্জাবি। ধ্যাৎ!! সবকিছু গুড়েবালি। মেয়েটা নাকি হাত-পা মোজাসহ ইয়া মোটা আলখাল্লা ছাড়া বাইরে বের হয় না। কী জঘন্য!! এরকম মেয়েকেই পছন্দ করল বাবা-মা! তাদের মুখের ওপর কিছু বলতেও পারছি না। এর মধ্যে বাবা দু-বার স্ট্রোক করছেন। উত্তেজিত হবেন ভেবে বাবার ইচ্ছার কাছে নিজেকে কুরবানি দিয়ে দিলাম। বিয়ের তোড়জোড় চলছে বাড়িতে। আমার ছোট বোনের মন খারাপ। সে এরকম মেয়েকে নাকি ভাবি হিসেবে মেনে নিতে চায় না। আমরা ভাই বোন চুপচাপ!!

বিয়েতে যখন আমাদের মানে আমাকে আর আমার বউকে একসাথে করা হলো তখন আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এ আমি কী দেখছি!! এটা কি আমার বউ নাকি ভূত!! বিয়েতে কেউ পর্দা করে??? আজিব তো। বিয়েতেও হাত-পা মোজাসহ একেবারে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢাকা। মানে কী??? মা-ও দেখি খুশিতে গদগদ! অবশ্য আমার কিছু আত্মীয় এরই মধ্যে কানাঘুষা শুরু করে দিছে। শুনেছি মেয়েটার নাম আয়িশা। নামটাও কীরকম গেঁয়ো!!

বাসরঘরে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না। ভাবিরা জোর করে ঢুকিয়ে দিল। গিয়ে দেখি ২০ হাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে বসে আছে; মনে হচ্ছে বউকে না ঘোমটা দেখতে আসছি।

—এই যে। ঘোমটা কি সরানো যায়?? [আমি]

–[কোনো সাড়া নেই]

–ঠিক আছে এরকমই বসে থাকেন। আমি ঘুমালাম। –[ঘোমটা সরিয়ে] আসসালামু আলাইকুম।

–[মনে করেছিলাম পূর্ণিমা দেখব এত দেখি অমাবস্যা]

—কী হলো সালামের জবাব দিলেন না যে?? —ওয়ালাইকুমুস সালাম। এখন ঘুমান; আমি খুব টায়ার্ড।

—আসুন ২ রাকাত নফল নামাজ পড়ি। আর আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি। —এই মেয়ে শোনো। আমার এসব ন্যাকামি একদম ভালো লাগে না। তুমি যা ইচ্ছা করো। আমাকে কোনো বিষয়ে জোর করবে না। জোরাজোরি করা আমি একদম পছন্দ করি না।

—অহ। জি আচ্ছা।

একটু পর পেছনে তাকিয়ে দেখি, সে নামাজে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা আহামরি সুন্দরী না হলেও তেমন একটা খারাপ না।

সকালে ঘুম থেকে ওঠে নাস্তার টেবিলে যেই যাব অমনি গেঁয়োটা এসে হাজির

—আসসালামু আলাইকুম।

–বার বার সালাম দেয়ার মানে কী। যত্তসব!!

—ফজরের নামাজ পড়ার জন্য আপনাকে ডাকলাম কিন্তু..... —কী??? তোমাকে না বলছি এসব না করতে?? ধ্যাৎ সকালটাই মাটি করে দিলো!! মার ডাকে নাস্তার টেবিলে গেলাম—

—আজকে সব আয়িশা মা করেছে রে জাহিদ। [হাসিমাখা মুখে মা বলল]

এই কথা শুনে খাবার মুখে দিতেও ইচ্ছে করছে না। সোহানা তো ওঠে চলে গেছে। আয়িশা মুখ মলিন করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি হালকা নাস্তা করে অফিসে চলে গেলাম। ইদানিং বাইরের খাবার খাওয়ার মোটেও ইচ্ছা হয় না। গেঁয়ো মেয়েটার হাতের রান্না অনেক ভালোই বলতে হয়। তারপর কেন যে তাকে একদমই সহ্য করতে পারি না!!

বিয়ের ৬ মাস পর বাবা মারা গেলেন। সেই শোকে মাও বেশিদিন বাঁচলেন না। আমার পরিবারে নেমে এল শোকের ছায়া। আমি আর সোহানা সারাদিন বাইরে থাকি। রাতে ঘরে ফিরি। সারাটা দিন আয়িশা ঘরে একা থাকে। একবার আমার ফ্রেন্ডরা বায়না ধরে আমার বাসায় আসতে। আয়িশাকে না জানিয়ে তাদেরকে বাসায় আসার অনুমতি দিয়ে দিই। যখন আমার বন্ধুরা আসে আমি দরজা খুলতে গেলাম অমনি আয়িশা দৌড়ে বেডরুমে চলে গিয়ে দরজা ভেতর থেকে লক করে দিল। আমার বন্ধুদের আপ্যায়ন করার জন্য ডাকাডাকি করছি; কিন্তু সে দরজা খুলছে না। আমার ডাকাডাকি শুনে আমার বন্ধুরাও এসে ডাকা শুরু করল। যখন জোরে ধাক্কাতে লাগলাম, দরজা ভাঙার উপক্রম, তখন সে দরজা খুলল। দরজা খোলার পর যা দেখলাম তাতে আমি যতটুকু না অবাক হয়েছি তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছে আমার বন্ধুরা। আয়িশা আপাদমস্তক ঢাকা!! আমি খুব অপমানবোধ করলাম—

—এগুলার মানে কী?? বোরকা পড়ছো কেন ঘরের মধ্যে?? এক্ষুণি খুলো!! খুলে আমার বন্ধুদের নাস্তা দাও। তারা আজ এত আশা নিয়ে আসছে তোমাকে দেখবে আর তুমি এসব ঢং করতেছো?? [আমি]

—আমি বেপর্দা বের হব না। নাস্তা দেব কোনো সমস্যা নেই; কিন্তু এভাবেই যাব। —কী আমার মুখের ওপর কথা?? আমি তোমার স্বামী। আমি যা বলব তাই করবা। —অবশ্যই আপনি যা বলবেন আমি তাই করব; কিন্তু আল্লাহর হুকুম অমান্য করে নয়।

আমার বন্ধুদের জন্য সেদিন তাকে আর কিছু বলি নি। সোহানাকে অনেক কষ্টে রাজি করালাম আমার বন্ধুদের আপ্যায়ন করার জন্য। বন্ধুরা যাওয়ার পর সে আমাকে অনেক বুঝায় এরকম উচ্ছৃঙ্খল [তার মতে] জীবন থেকে আল্লাহর পথে ফিরে যেতে।

সেদিন রাতে অনেক ঝগড়া হয়। রাগের মাথায় একপর্যায়ে গায়ে হাত তুলে ফেলি!! সেদিন সারা রাত জায়নামাজে বসে কেঁদেছে সে!! তারপরও আমার একটুও মায়া হয়নি।

এরপর থেকে আয়িশার ওপর চলতে থাকে আমার শারীরিক আর মানসিক নির্যাতন!! এত অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতা দেখে মাঝে মাঝে আমিও অবাক হই। তারপরও একটা দিন আমার কাছে তালাক চায় নি। উল্টা তার পরিবারের কাছে আমার সুনাম করত। আমি যা কখনো ওর সাথে করি নি বা বলি নি তা তার মায়ের কাছে বলত।

এরই মধ্যে আমার চাকরিটা হঠাৎ করে চলে যায়। বাবার পেনশনের টাকা দিয়ে চলতে থাকে সংসার। সোহানারও বিয়ে দিতে হবে। এ-সবকিছু নিয়ে আমি খুব ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকি। আয়িশা আমাকে সান্ত্বনা দেয়। বোকা মেয়েটা আমাকে কুরআনের আয়াত শুনায়। সে বলত, আল্লাহ বলেছেন—

‘আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছে করেন রিজিক সম্প্রসারিত করেন, আর যার জন্য চান সীমিত করেন। তারা পার্থিব জীবনে আনন্দে মেতে আছে; অথচ আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন অতি নগণ্য বস্তু।' [সুরা রাদ, আয়াত : ২৬।]

আমি কাজ না করলেও নাকি আল্লাহ রিজিক দেবেন। যত্তসব হাস্যকর বাণী শুনাত। এসব শুনে আমার মাথা আরও গরম হয়ে যেত। রাগে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতাম। সারা রাত বারে [ক্লাবে] পড়ে থাকতাম!!

একদিন বাইরে থেকে এসে দেখি আয়িশা অনেক সেজেগুজে বসে আছে—

—আজ আপনাকে একটা খুশির সংবাদ দেব। [আয়িশা]

-আমার আবার খুশির সংবাদ!! হাহ। বলো কী বলবে। —আমি মা হতে চলেছি। [লজ্জায় মাথা নিচু করে বলল] —কী?? এটা খুশির সংবাদ?? ফালতু কোথাকার!!

—কী বলছেন আপনি?? কেনা মা হতে চায়? আর আপনিও বাবা হবেন। এর চেয়ে আর কী খুশির খবর থাকতে পারে?? [কান্না-বিজরিত কণ্ঠে] —এটা আমার জন্য মোটেও খুশির খবর না। অভাবের সংসারে আবার আরেকজন!!

সোহানার বিয়েটাও এখনও দিতে পারি নি। এর মধ্যে উনি আসছে খুশির সংবাদ

নিয়ে। এই বাচ্চা তুমি রাখবে না। কালকের মধ্যেই এব্রোশন করিয়ে আসো!!

—আমি পারব না। এটা আল্লাহর দেয়া আমানত। আমি আল্লাহর একটা অশেষ নিয়ামতকে খুন করব?? অভাবের তাড়নায় আমি এত বড় পাপ করতে পারব না। আল্লাহ বলেন

‘দরিদ্রতার ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না।

আমিই তাদেরকে রিজিক দিই আর তোমাদেরকেও। তাদের হত্যা মহাপাপ।' [সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩১।]

আমি পারব না আল্লাহর আদেশকে অমান্য করতে।

—কী, মুখের ওপর কথা। কথায় কথায় জ্ঞান দেও আমাকে? এই মুহূর্তে আমি লাথি মেরে একে শেষ করে দিতে পারি। কিন্তু তা আমি করব না। আমি তোমাকে তিন দিনের সময় দিলাম। এই কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

সে এব্রোশন করায় নি; তাই প্রায় আমি তাকে মারধর করতাম। গভীর রাতে কান্নার আওয়াজে ঘুম ভাঙত, দেখতাম সে জায়নামাজে বসে কাঁদছে। তার যখন আট মাস তখন সে একদিন আমায় বলল—

—সোহানা ইদানিং ছেলেদের বাসায় নিয়ে আসে, যখন আপনি বাসায় থাকেন না। আমি বারণ করায় সে আমার গাঁয়ে হাত তুলেছে আজ। [আয়িশা]

–তোর সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। তুই আমার বোনের নামে আমার কাছে বদনাম করছিস? এই বলে তাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে এলোপাথাড়ি লাথি দিই। সে ব্যথায় ছটফট করতে থাকে। যখন দেখলাম রক্তে সারা ফ্লোর ভিজে গেছে তখন আমার টনক নড়ে!! সোহানাকে যখন ডাকতে যাব তখন দেখি একটা ছেলেকে নিয়ে অন্তরঙ্গভাবে বাইরে থেকে ঘরে ঢুকতেছে!! আমাকে অসময়ে ঘরে দেখে সে বিপাকে পড়ে যায়!! একটু আগে আমি আমার বোনের নামে অপবাদ দেয়ায় কী জঘন্য একটা কাজ করে ফেললাম!! দৌড়ে গিয়ে আয়িশাকে নিয়ে হসপিটালে গেলাম। এই প্রথম আয়িশার জন্য আমার ভেতরটা নাড়া দিয়ে ওঠল! তার জন্য সুপ্ত অনুভূতি জাগ্রত হলো। এই প্রথম ওর প্রতি আমার ভালোবাসা অনুভব করলাম। টের পেলাম চোখ বেয়ে অজরে পানি ঝরছে!! বুঝতে লাগলাম অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি ওর সাথে!! ডাক্তার বলল অবস্থা খুব সিরিয়াস। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে এরকম হওয়ার কারণ জানতে চেয়েছিল ডাক্তার। লজ্জায় আমি কিছুই বলতে পারি নি। শুধু বলেছি, ‘বলতে পারব না।

আয়িশার ওপর আমার অকথ্য নির্যাতনটা হয়তবা উনি টের পেয়েছেন। টের পাওয়ারই কথা; কারণ আয়িশার সারা শরীরে আমার আঘাতের চিহ্ন যে স্পষ্ট ফুটে আছে!! আমার খুব অস্বস্তি লাগছিল। অপারেশন শেষ হবে আর আমি দৌড়ে গিয়ে আমার বউকে জড়িয়ে ধরে মাফ চাইব। চিৎকার দিয়ে বলব ‘প্রচণ্ড ভালোবাসি তোমায় আয়িশা। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও।' আমি জানি সে আমাকে ফিরিয়ে দেবে না। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার মলিন মুখে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আর যা বললেন, আমি তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। ডাক্তার বলল, আমার নাকি ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছিল।

—হয়েছিল মানে?? [আমি]

–দুঃখিত মা মেয়ে কাউকে বাঁচাতে পারি নি!!

আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না।

আয়িশার লাশ ধরে অনেক কান্নাকাটি করেছি। চিৎকার দিয়ে বলেছি ‘আমাকে একা রেখে যেও না। ফিরে এসো প্লিজ। অনেক বেশি ভালোবাসব তোমায়। আমাকে একটিবার সুযোগ দাও।' শুনে নি আমার কথা!! সেদিন রাতে আয়িশাকে স্বপ্নে দেখি। সে আমাকে হাসিমুখে বলছে—

‘আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব। আপনাকে ছাড়া আমি জান্নাতে একপাও আগার না। কথা দিলাম। আর কাঁদবেন না; আমার যে অনেক কষ্ট হয়। আমার জন্য দোয়া করুন। আর আপনি তাওবা করুন।'

তখনই মসজিদে গিয়ে অনেক কান্নাকাটি করি। আমার কান্নার আওয়াজে ইমাম সাহেব আসেন। জিজ্ঞেস করেন আমার কান্নার হেতু। আমি সবকিছু খুলে বললাম। উনি বললেন আল্লাহ বলেছেন—

‘গুরুতর শাস্তির আগে আমি তাদেরকে অবশ্যই লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব যাতে তারা [অনুশোচনা নিয়ে] ফিরে আসে।' [সুরা সাজদা, আয়াত : ২১]

এটা আপনার জন্য সেরকমই, যাতে আপনি আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে পারেন। —আমি পরকীয়ায় লিপ্ত ছিলাম যা আমার স্ত্রীও জানত না।

–আল্লাহ বলেন, “[এটা শিক্ষা দেয়] যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা চাও, আর অনুশোচনাভরে তাঁর দিকেই ফিরে এসো, তাহলে তিনি একটা নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত তোমাদেরকে উত্তম জীবনসামগ্রী ভোগ করতে দেবেন, আর অনুগ্রহ লাভের যোগ্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে তিনি তাঁর অনুগ্রহ দানে ধন্য করবেন।' [সুরা হুদ, আয়াত : ৩]

—আমি মদ খেতাম!!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ