নীলডুমুর : কিঙ্কর আহ্সান - Nil Dumur By Kingkor Ahsan




বই:- নীলডুমুর
লেখক:- কিঙ্কর আহ্সান 
জনরা:- সমকালীন উপন্যাস 
প্রকাশনী:- জ্ঞানকোষ প্রকাশনী
ব্যক্তিগত রেটিং:-[৯.৫/১০]
Review Credit 💕 Himadri Sharma

কিঙ্কর আহ্সান! সময়ের জনপ্রিয় একজন লেখক। লেখকসত্তা ছাপিয়ে লেখকের বিনয়ে মাখামাখি স্বভাব আমাকে দারুণভাবে বিস্মিত করে তোলে। মানুষটাকে বেশ আগে থেকেই চিনি আমি, লেখাও পড়েছি বেশ অনেকগুলো, কিন্তু সামন-সামনি দেখা গেলো বইমেলায়। পরিচয় দিতেই ‘ভাই আমার’ বলে বুকে টেনে নিলেন। নেই কোনো অহংকার, ঠোঁটে লেগে থাকে মিষ্টি হাসি, কথার জাদুতে ঘায়েল করেন তার পাঠকদের। কী অমায়িক ব্যবহার ভাইয়ের! মুগ্ধতা শুধুই বেড়েই যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই ভালোলাগা-মুগ্ধতাটুকু ছাপিয়ে আজ কথা বলছি কিঙ্কর আহ্সানের লেখা নতুন বই “নীলডুমুর” নিয়ে।

উপন্যাসের প্রধান চরিত্র একজন লেখক। তিনি নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত সব ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাজিয়েছেন এই বইটি। সে গল্পগুলো বিশ্বাসের, সে গল্প বন্ধুত্তের, সে গল্প কাছে না পাওয়ার, সে গল্পগুলো অভিমানের, সে গল্পগুলো এই নগরীর বাস্তব এক রূপরেখা। এটা কী তবে লেখকের আত্মজীবনী ঘরানার কিছু? না, সেটা নিয়ে লেখক মোটামুটি দ্বিধায় ফেলে দিয়েছেন তার পাঠকমহলকে। আমি বরং এদিকে না যেয়ে গল্পে ফিরি। গল্প বললেও এটা আসলে আমার কাছে কঠিন এক ধাঁধার মতোন মনে হয়েছে! শুরুতেই যখন আমি ধাঁধাটা আঁচ করতে পেরেছিলাম, তখন থেকেই ক্রমশ ধাঁধার উত্তর মেলানোর চেষ্টা করে গিয়েছি। যখনই মনে হতো, আমি হয়তো ধাঁধার উত্তর মেলানোর খুব কাছাকাছি রয়েছি, তখনই গল্পের মোড় অন্যদিকে চলে গিয়েছে। মস্তিষ্কে জন্ম নিত নতুন এক রহস্য! নাকি বাস্তবতা? চরম উত্তেজনা নিয়ে একের পর এক পৃষ্ঠা পড়ে শেষ করেছি। অভিমানি এক লেখকের জীবনটাকে পড়তে পড়তে কখন যে ১৭৫ পৃষ্ঠার অবসান হলো, টেরই পাইনি। শেষের ৫-৬ পৃষ্ঠার প্রতিটি আলাদা শব্দ আমাকে আলাদাভাবে ভাবিয়ে তোলেছিল। গল্পটি অদ্ভুত এক আকর্ষণ বলে পুরোটা সময়জুড়ে বেঁধে রেখেছিল এই আমাকে।

লেখক তাঁর শৈশবকাল কাটিয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দার্জিলিং শহরে। পরবর্তীকালে লেখক বাংলাদেশে চলে আসেন। এখানে শুরু হয় তাঁর জীবনের। বিয়ে করে স্ত্রীর সাথে বেশ সুখেই কাটিয়েছেন কয়েকটা দিন। তারপর শুরু হলো সাংসারিক টানাপোড়েন। সেই টানাপোড়েনে পরে একটা সময় লেখক সিদ্ধান্ত নিলেন ঘর ছাড়ার। এরপর থেকেই মূলত গল্পের শুরু। কত সব কাহিনি। একেক সময় একেক দিকে সাগরের বিশাল স্রোতের মতো এগিয়ে চলেছে কাহিনিগুলো। এসেছে নতুন সব চরিত্র। 

‘জীবনের এই সময়ে এসে আজ আমি টের পেলাম, আমার আপন বলে কেউ নেই। কেউ আমার কাছের নয়।’—লেখকের এই উপলব্ধিই বলে দেয় কেন তিনি ঘর ছেড়েছেন। লেখক হয়তো চেয়েছিলেন একান্তই নিজেকে সময় দিতে, নিজেকে ভালোবাসতে। তাই তার এক বড় ভাইয়ের বাড়িতে চলে যান তিনি। সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার শমসেরনগরে। বলে রাখাটা জরুরি, লেখক যখন শমসেরনগরের চা-বাগান বেষ্টিত পরিবেশের বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন কিছুটা আবেগ-অনুভূতি কাজ করে আমার মনের গহীন কোণে। হওয়াটাই যে অতি স্বাভাবিক। কারণ জন্মসূত্রে যে আমি এই এলাকার সন্তান। হয়তো বিশেষ এই কারণে লেখকের এখানকার কাটানো জীবনটাকে আমি আরো ভেতর থেকে অনুভব করতে পারছিলাম। 

নতুন এই পরিবেশে আসার পর লেখকের জীবনে ঘটে যায় নানান ঘটনা। যুক্ত হয় হরেক চরিত্র। লেখকের জীবনে আসে বন্ধু অমিত, পরিতোষ, সুমিতা বৌদি, মাদূরী। আসে অদ্ভুত মেয়ে শিফা, যে কিনা আগে থেকেই সবকিছু বলে দিতে পারতো। লেখকের জীবনেরও অনেক কিছুই সে আগে থেকে বলে দিতো। শিফার এহেন কর্মকান্ডে লেখক প্রায়ই অবাক হতেন। প্রথমদিকে আমি স্বাভাবিকভাবে ধরেই নিয়েছিলাম, এই শিফা বুঝি লেখকের লেখার প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া এক পাঠক! কিন্তু পরবর্তীতে যখন সামনে আসে, আসলেই কে এই শিফা?, কি সম্পর্ক এর লেখকের সঙ্গে?, কিভাবে সে এতো কিছু জানে লেখকের ব্যাপারে?; রীতিমতো বিশাল এক ধাক্কাই খেতে হয়েছে আমায়। আমি জানি, এই পরিস্থিতিতে প্রতিটি পাঠক অবাক হবে। এই টুইস্টটা না হয় টুইস্ট হয়েই থাক আপাতত!

এই শিফা আবার লেখকের নিকট আরেকটা বিশেষ কারণে গুরুত্ব পেয়েছে। কী সেটা? কৈশোরকালে লেখক যখন পড়ালেখার জন্য দার্জিলিং যান, সেই শহরে পরিচয় হয় নেহা মেহতার সঙ্গে। সেই পরিচয় একটা সময় এসে জন্ম দেয় এক মিষ্টি প্রেমের গল্প! দিনের পর দিন লেখক সময় কাটিয়েছেন এই নেহা মেহতার সাথে। কতশত আড্ডা, পাশাপাশি বসে কফিতে চুমুক দেয়া, সুস্বাদু মম কিংবা স্পেশাল পেস্ট্রি! সবকিছুর সাথেই নেহা মেহতা ও লেখকের সুখের পরশ লেপ্টে ছিল। শমসেরনগরের মেয়ে শিফার মুখপানে তাকিয়ে লেখক অনুভব করতে পারতেন তার কৈশোরকালের প্রিয় এই মানুষটিকে। কত অদ্ভুত সম্পর্কগুলো! তাই না?

শমসেরনগরে যখন দিন অতিবাহিত হচ্ছে লেখকের, তখন তিনি অদ্ভুত ভাবে খেয়াল করলেন, এই যে এতোটা সময় থেকে তিনি পরিবারের সাথে নেই কেউ তো একটিবারের জন্যেও হলে তার খোঁজ করছে না! লেখকের প্রতি কি তাদের এতটুকুও ভালোবাসা কাজ করে না? আর কেউ না হোক, স্ত্রী সোমা তো তার খোঁজ নিতে পারতো। সোমার ভালোবাসারাও কি তবে ডাহা মিথ্যে? আর স্নেহপরায়ণ বাবা? রাগী মা'টাও পারতেন না শত রাগ ভুলে গিয়ে ছেলের একটা খোঁজ নিতে? বড্ড অভিমান বাসা বেঁধেছে লেখকের মনে। তারচেয়ে শমসেরনগরের জীবনই এখন লেখকের কাছে সর্বোচ্চ সুখের জায়গা।

সুন্দরী মাদূরীর সাথে একই ঘরে বসে লেখকের সুখ-দুঃখের আলাপচারিতা, বন্ধু অমিতের সদ্য জন্মানো সন্তানের মৃত্যুতে লেখকের ভেঙে পড়া, গ্রামের কৃষক ষাটোর্ধ বাবলু ভাইয়ের সঙ্গে লেখকের মিশে যেতে চাওয়া, বাস স্ট্যান্ডের শুক্কুর আলির বাঁদর আসমানির দেখানো খেলা— এসব ঘটনাপ্রবাহ গল্পকে আরও বেশি জমিয়ে তুলেছে।

গল্পের শেষটা তবে কোথায়? কিছু আন্দাজ করতে পেরেছেন? আন্দাজ করেও আসলে খুব একটা লাভ হবেনা। গল্পের শেষটা যে রহস্যে ভরপুর! শেষ মুহূর্তে এসে কিনা টিটু ভাই বনে গেলেন ভিলেন!! তবে একজন পাঠক হিসেবে কিছু জিজ্ঞাসা আমার মনে থেকেই যায়—

লেখকের পরিবার কি পারতো না লেখকে খোঁজে বের করতে?
স্ত্রী সোমা কেনই বা এতো নীরব হয়ে থাকতে পেরেছে? কেন সে ভালোবাসাকে আগলে রাখতে পারলো না? 
শিফা! শিফা কী পারতো না একটি বারের জন্য হলেও ‘বাবা’ বলে জড়িয়ে ধরতে? 

মুগ্ধতা কিঙ্কর ভাইয়া। মাঝেমধ্যে খুব ইচ্ছে করে চিৎকার করে বলে উঠি—“আমার কেন আপন কেউ থাকবে না? কেন? কেন?”

মানুষ বইতে বাঁচুক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ