এই বাড়িতে বিয়ে করে প্রথম যেদিন এসেছিলাম, সেদিন রাতেই খাবার টেবিলে বসে বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। টেবিল ভর্তি পোলাও, মুরগির কোর্মা, খাসির মাংসের রেজালা সবই ছিল তবে তার কোনো কিছুই আমি খেতে পারছিলাম না। সব খাবারগুলোর স্বাদই মিষ্টি ধরনের। মনে হচ্ছে, রান্না করার পর কেউ যেন ঝাল তরকারিগুলোতে তিন চার চামচ চিনি ঢেলে দিয়েছে। বুঝলাম, আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেদের মিষ্টি ধরনের তরকারি পছন্দ। এদিকে আমার বাবার বাড়ির লোকেদের মধ্যে ঝাল-ঝাল কষানো মাংস, ঝাল শুটকির তরকারি, চ্যাপা শুটকির বড়া এই ধরনের খাবারের প্রচলন বেশী। স্বাভাবিক ভাবেই আমিও ওই ধরনের খাবারে অভ্যস্ত ছিলাম। খাবার টেবিলে আমার ইতস্তত ভঙ্গি দেখে রানার ভাবি বোধহয় কিছু টের পেয়েছিলেন। তিনি চটজলদি ফ্রিজ থেকে বোম্বাই মরিচের আচারের কৌটাটা বের করে দিয়ে বলেছিলেন, মৌরি তুমি চাইলে এখান থেকে আচার নিয়ে খেতে পারো। বুঝতে পারছি, আজ তোমার অনেক ধকল গিয়েছে। আজ বোধহয় তোমার মুখে তেমন কোনো রুচি নেই।
সেদিন রাতে ভাবির কথাগুলো আমার শাশুড়ি খুব ভালোভাবে নেননি। ভাবির দিকে তাকিয়ে বিরক্তমুখে বলেছিলেন, প্রথম দিনেই আমার ছোট বৌমাকে তোমার মত বানাবে নাকি! যতই চেষ্টা করো, ছোট বৌমা কোনোদিনও তোমার মত হবে না। এই বাড়ির সব নিয়ম নীতি, অভ্যাস সে খুব ভালোভাবে রপ্ত করবে।
ভাবি আর কথা বাড়াননি। নতুন বউয়ের সামনে শ্বাশুড়ি কর্তৃক এহেন অপদস্থ হওয়ার কারণেই হয়ত তার ফর্সামুখটা টকটকে লাল হয়ে গিয়েছিল। আমি আড়চোখে আমার স্বামী রানার দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম, রানাও যেন তার ভাবির এহেন অপমানে বেজায় খুশী। অপরদিকে রানার পাশে তার বড় ভাই মলিন মুখে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজ স্ত্রীর এমন অপমান তিনি খুব ভালো ভাবে নেননি। হয়ত আমি সামনে ছিলাম বলে চুপ করে অপমানটুকু সয়ে নিয়েছিলেন।
আমার বিয়ে হওয়ার এক মাস পার হতে না হতেই আমার কাছে কিছু বিষয় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। যেমন, এই বাড়িতে দুটো ভাগ রয়েছে। এক ভাগে রয়েছে, আমার শ্বাশুড়ি এবং রানা যারা তখন আমাকে তাদের ভাগে নেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল, অপর ভাগে ছিল রানার বড় ভাইয়া এবং ভাবি। আমার আর রানার কিন্তু প্রেমের বিয়ে। অপরদিকে ভাইয়ার সাথে ভাবির পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছিল। অথচ বিয়ের পর দেখা গেল সব সমীকরণ উল্টে গেছে। রানা তার মায়ের কথা ছাড়া এক চুল নড়ে না। মা যা বলবেন তাই হবে। তিনি আমার খাওয়ার অভ্যাস, কী কাপড় পরব, রানার সাথে কোথায় বেড়াতে যাব, আমি অনার্স পর্যন্ত পড়ব নাকি মাস্টার্স শেষ করব সব নির্ধারণ করবেন। আমি রানাকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছিলাম। তবে এই বোঝানোর মধ্যে দিয়ে দাম্পত্য কলহ আর ক্রোন্দল ছাড়া আমার ভাগ্যে আর তেমন কিছু জোটেনি। অনার্স থার্ড ইয়ারে আমার বিয়ে হয়েছিল। শ্বাশুড়ি আমাকে কোনোরকমে অনার্স শেষ করতে দিলেন, চাকুরি করতে দেয়া তো দূরের কথা মাস্টার্সটা পর্যন্ত করতে দিলেন না। অপরদিকে ভাবি ততদিনে মাস্টার্স শেষ করে উঠে পড়ে বিসিএস এর পড়া পড়ছেন। ভাইয়া খুব ভালোমতই জানেন, মা তার স্ত্রীর এই পড়ালেখা ভালো চোখে দেখছেন না তবুও তিনি স্ত্রীর পাশেই ঢাল হয়ে রইলেন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ভাবির বিসিএস এ না হলেও একটা বেসরকারি ব্যাংকে খুব ভালো চাকুরি হলো। অপরদিকে আমি প্রেগন্যান্ট হলাম। আমি মা হতে চলেছি এই খবর জেনে, আমার শ্বাশুড়ি এবং স্বামীর চোখে মুখে একটি বিজয়ের হাসি দেখেছিলাম যেন তারা ভাবিকে খুব বড় একটা টেক্কা দিয়েছেন! কারন ভাবি বিয়ের পাঁচ বছরের মাথাতেও মা হতে পারেননি। সেই সময় ভাইয়া, ভাবির মুখে আমি কিন্তু পরাজয়ের কোনো লজ্জা কিংবা কষ্ট দেখিনি। বরং তারাও আন্তরিক ভাবে খুশী হয়েছিলেন।
আমাকে নিরালায় পেয়ে ভাবী শুধু একদিন বলেছিলেন, এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিয়ে নিলে মৌরি, পড়াশোনাটা শেষ করে বাচ্চা নিলে হত না?
আমি ভাবির দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসেছিলাম। কী করে তাকে বলি, আপনার মত শক্ত খুটি যে আমার পাশে নেই। পুই শাকের ডাটার মত নড়বড়ে একটা খুঁটি আছে যে কিনা নিজেই আষ্টেপৃষ্ঠে অন্য আরেক খুটিকে জড়িয়ে ধরে আছে।
আমি যখন দ্বীতিয় বার মা হলাম তখন ভাবিও একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিলেন। এদিকে আমি দু দুবার পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছি। রানা আর আমার শ্বাশুড়ি আবারো বিজয়ের হাসি হাসল। তাদের ভাবখানা এমন, দেখছো লেখাপড়া আর চাকুরিতে মন না দিয়ে আমাদের কথা শুনলে তোমাদের ভাগ্যেও এতদিনে দু দুখান ছেলে সন্তানের জন্ম হত। তবে ভাইয়া এবং ভাবি যেন এই হাসি দেখেও দেখলেন না। ততদিনে অনেক কিছু বদলে গেছে। রোজ সকাল নয়টায় ভাবিকে নিতে চকচকে কালো রংয়ের অফিসের একটা টয়োটা এলিয়েন গাড়ি আসে। ভাবি তার ছোট্ট পুতুলকে নিয়ে অফিসে বেরিয়ে যান। তার অফিসে বেবিদের ডে কেয়ার সেন্টার আছে। ভাবির চাকুরি হবার পরপরেই ভাইয়া অবশ্য গ্রাম থেকে একটি স্থায়ী সাহায্যকারী মেয়ে এনে দেন যেন ঘরের কাজ করতে আমার কোনো কষ্ট না হয়। মেয়েটির বেতন থেকে তার যাবতীয় খরচ সব ভাইয়া ভাবি সামলাতেন। মুন্নির মত চটপটে একটি সাহায্যকারী মেয়ে পাওয়ার পর আমাকে সংসারের তেমন কোনো কাজ করতে হত না। আমি শুধু বাচ্চাদের সামলাতাম। ভাবি নিজের মেয়ে ছাড়াও আমার ছেলেদের জন্য নিত্য নতুন কাপড় কিনতেন। যে কোনো অকেশনে আমাকেও এটা ওটা নানা উপহার দিতেন। কিন্তু হাসি মুখ আর ভালো ব্যবহার ছাড়া তাদের আমার আর কিছুই দেয়ার ছিল না। কারন ততদিনে আমি আবারো মা হয়েছি এবং রানার একার উপার্জনে তিন বাচ্চাকে ভরণপোষণ করা রীতিমত কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে।
একসময় রানা বোধহয় নিজের ভুলগুলো বুঝতে পেরেছিল। তবে ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। আমি দুই পুত্র এবং এক কন্যার মা হয়েছি। তাদের স্কুল, প্রাইভেট সামলাতেই আমার হিমশিম অবস্থা। আগের মত শরীরেও আর শক্তি পাই না। বিয়ের দশ বছরের মাথাতেই ছিপছিপে তরুনী থেকে স্থূলাকার মহিলায় রূপান্তরিত হয়েছি। এদিকে, যে ছেলে মা বলতে পাগল ছিল সেই ছেলেই তখন কথায় কথায় মায়ের সাথে বিভিন্ন পারিবারিক বিষয় নিয়ে ঝামেলা করে। প্রায়ই মা-ছেলের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শোনা যায়। এরপর আমার শ্বাশুড়ি যতদিন বেঁচে ছিলেন বড় ভাইয়া এবং ভাবি তার ওষধ পত্র থেকে শুরু করে যাবতীয় সকল খরচ বহন করতেন। মৃত্যুর আগে তার প্রাণপ্রিয় ছেলের রানার সাথে তার বিশাল একটা দুরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এরপর যতদিন রানা বেঁচে ছিল আমি খুব ভালোভাবেই বুঝতাম, নিজের জীবনের এই পরিনতির জন্য রানা মনে মনে নিজের মাকে দায়ী করে।
কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে আমি আমার তিন সন্তানের দিকে তাকালাম। আগামীকাল আমার বড় ছেলের বিয়ে। মনে হলো, কথাগুলো আজ আমার তাদেরকে বলা খুব জরুরি।
আমার মেয়ে মৃদু কন্ঠে বলল, মা তুমি কেন এত কিছু সহ্য করেছিলে? বড় চাচির মত তুমিও তো তোমার পড়াশোনা শেষ করতে পারতে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারতে!
আমি মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, চিনি আর নুনের পার্থক্য জানিস? আমি হয়ে গিয়েছিলাম তোর দাদীর দেয়া ঝালের তরকারিতে মেশানো সেই দুই তিন চামচ চিনির মত যাকে চাইলে প্রয়োজনেও ব্যবহার করা যাবে আবার অপ্রয়োজনেও ব্যবহার করা যাবে। এদিকে তোর চাচী ছিল নুনের মত যাকে অপ্রয়োজনে কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না। তবে তখন আমি এতসব জটিল কথাবার্তা বুঝিনি রে! যখন বুঝেছি তখন অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে।
ছেলেমেয়েরা সবাই চুপ। আমিও কিছুক্ষন চুপ করে রইলাম। একটু পর ছেলে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বললাম, আমি চাইনা এই বাড়িতে তোদের বাবা-মা কিংবা দাদীর মত আর কারো পরিনতি এমন হোক। তোরা এখন থেকে নিজেরা নিজেদের ভালো মন্দের পার্থক্য বুঝবি। নিজেকে ভালোবাসবি, নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছে, চাওয়া-পাওয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবি। মনে রাখবি, নিজেকে ভালো না বাসলে, নিজের কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হলে অন্য কাউকেও ভালোবাসা যায় না, পরিবারের একে অপরের বিপদে পাশে থাকা যায় না, একে অপরের দুঃখ কষ্টগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া যায় না।
সমাপ্ত
নুন
তামান্না স্মৃতি
২৮.০৫.২০২২
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....