রিভিউ - অনার্য দেব : লেখক আলী ওয়াহাব সৌহার্দ্য | Onarjo Deb : Ami Wahab Showhardo


বই : অনার্য দেব
লেখক : আলী ওয়াহাব সৌহার্দ্য
প্রকাশনী : বাতিঘর প্রকাশনী
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৫৯২
মুদ্রিত মূল্য : ৭০০৳
ব্যক্তিগত রেটিং ৫/৫

"ইন্দ্র প্রস্থ ভেঙেছি আমরা, আর্যাবর্ত ভাঙি 
গড়েছি নিখিল নতুন ভারত নতুন স্বপনে রাঙি!"

মানবজাতির ইতিহাস কেমন? কীভাবে এ মানবজাতির প্রসার? এই উপমহাদেশেই বা কীভাবে মানুষে মানুষে গড়েছে ইতিহাস? আর্য, না অনার্য? কার প্রভাব কতটা? কেই বা এগিয়েছে, কেই বা পিছিয়েছে? কার প্রভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে এই মনুষ্য জাতি?

আর্য-অনার্য যুদ্ধ নতুন কিছু নয়। প্রাচীনকাল থেকেই এর রেশ চলেছে যুগ থেকে যুগান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। রামায়ণ, কিংবা মহাভারত, অথবা নানান সময়ে বিভিন্ন যুদ্ধে মুখ্য হয়ে উঠেছে আর্য-অনার্যের লড়াই। কেউ জেনে বুঝে, কেউ বা খেয়ালের ছলে এ যুদ্ধে শামিল হয়েছে। এই আর্যরা কারা? কোথা থেকে এসেছিল তারা? উপমহাদেশের মাঠেঘাটে লেখা আছে আর্যদের ইতিহাস। তবে ওরা যে এই তল্লাটের নয়। বহিরাগত এক জাতি হঠাৎ-ই এসে রাজ করা শুরু করে এই প্রাচীন ভূমিতে। আর অনার্য? কোন ভিত লুকিয়ে আছে সুবিশাল অনার্য জাতির ইতিহাসের পেছনে? ইতিহাসের ছলে গল্প হবে। পুরাণের আড়ালে উন্মোচন হবে সত্যের রূপরেখা। কেননা, পুরাণ-ই যে ছদ্মবেশী ইতিহাস! যার যেমন সত্য আছে, তেমনই মিথ্যার আড়ালে রং ছড়ানো গল্পও আছে। সত্য-মিথ্যার এ বিভেদে কোনটা আসল, কে জানে?

বলা হয়ে থাকে, ইতিহাস লেখা হয় বিজয়ীদের দ্বারা। যারা বিজয়ী, তারা-ই সেরা। তারা-ই বীর। ইতিহাস জুড়ে কেবল তাদের-ই গুণকীর্তন। সেসব গুণকীর্তনে কত যে রং ছড়িয়েছে তার হিসেব নেই। আচ্ছা, শুধু কি তারা-ই বীর? যাদের হারিয়ে তাদের এই বিজয় নিশান, সেসব সৈনিকদের মধ্যেও তো বীরদর্পে লড়াই করা কেউ না কেউ হয়তো ছিল। ইতিহাসে তারা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছে। কেননা পরাজিতদের কেউ মনে রাখে না। আলেকজান্ডার দি গ্রেট, সম্রাট নেপোলিয়ন, সম্রাট অশোক, চেঙ্গিস খান, তৈমুররা ইতিহাসে অমর। তাদের বীরত্বগাঁথার পরিচর্যা চলে সবখানে। তারা কি সত্যিই নায়ক? না-কি কখনো খলনায়ক হিসেবেও আবির্ভাব হয়েছিল? ইতিহাস কী বলে?

ইতিহাস হোক, কিংবা মিথ! এ এক অন্যরকম যাত্রা। এ যাত্রার প্রতিটি বাঁকে রহস্য, চমকে যাওয়ার উপাখ্যান। এমন এক রোমাঞ্চকর যাত্রায় স্বাগতম...

▪️কাহিনি সংক্ষেপ :

ঘটনার শুরু মাহমুদুল হাসানের মৃত্যু দিয়ে। মৃত্যুর পর তার শেষ ইচ্ছা, তাকে যেন পোড়ানো হয়। কিন্তু মুসলমানের লাশ তো আগুনে পোড়ে না। তাহলে, এমন ইচ্ছায় পেছনে রহস্য কী? মৃত্যুর আগে তিনি তার ভাগনেকে দিয়ে গেলেন একটি খাম। যেখানে আছে একটি স্ক্রিপ্টেক্স আর দু'টি মৃত মানুষের ঠিকানা। মৃত মানুষকে খুঁজবে কী করে জায়েদ আরাফাত?

ভারতীয় 'র' এজেন্সির দুই জাঁদরেল অফিসার কঙ্গনা রানী সিং আর সারতাজের কাছে জঙ্গি সন্দেহে বন্দী আসিফ আসগর নামের এক যুবক। জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। প্রবল অত্যাচারেও মুখ খুলেনি আসিফ। ধৈর্য হারিয়ে অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে, আসিফের মুখ খোলানো যায়নি। শেষে শুধু একটা বাক্যে শেষ আসিফ আসগর। "যাব ইকবাল হুসেইনকা ঘোড় সাওয়ারকে আয়েগা ইনসাফ। ইনসাআআআআআফ!" কে এই ইকবাল হুসেইন? ভারতীয় 'র' এজেন্সির ঘুম হারাম। তবুও খুঁজে পাওয়া যায়নি। কঙ্গনা বা সারতাজ, সামাল দিবে কীভাবে?

মামার দেওয়া ঠিকানা অনুসন্ধান করে জায়েদ আরাফাত খুঁজে বের করেছে প্রফেসর ইমেরিটাস দীপক কুমার বিশ্বাসকে। যিনি কয়েক বছর আগেই লোক চক্ষুর আড়ালে চলে গিয়েছিলেন। জায়েদের হতে অচেনা বর্ণমালার কম্বিনেশন লক! কিছুটা দ্বিধা বিভক্ত হয়ে সাহায্য করতে রাজি হন প্রফেসর। তখন কী আর জানতেন, এই রহস্য সমাধানে ছুটতে হবে ইতিহাসের পেছনে। জানা যাবে এমন কিছু অজানা তথ্য, যা হয়তো পৃথিবীর অতীত ইতিহাসই পাল্টে দেবে। আর এই ইতিহাসেই আগ্রহ প্রফেসর ইমেরিটাসের। তাই জায়েদকে ফিরিয়ে দিতে পারেননি। জায়েদকে সাথে নিয়ে ছুটেছেন এ দেশ থেকে ও দেশে। আর তাদের পেছনে ছুটে আসছে মৃত্যু। কীভাবে বাঁচবে ওরা?

ইলা শর্মা, বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম আশ্রমের অধিপতি। একা হাতে সব সামাল দেন। তার একটা ফোনকলে ওলটপালট হতে পারে অনেক কিছুই। তার কল এলো প্রফেসর ইমেরিটাস দীপক কুমার বিশ্বাসের কাছে। সাহায্য করতে চায় ওরা। যেই রহস্য দিয়ে গিয়েছেন মাহমুদুল হাসান, সেই রহস্যে ভাগ আছে ওদেরও। সাহায্যের আশায় জায়েদ আরাফাত ও প্রফেসর এমেরিটাস উড়ে গেলেন ভারতে। এবার হয়ত সাহায্য পাবেন। সমাধান করতে পারবেন রহস্যের।

আবু তাহের খালেদ, সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেল। এই সাবেক হওয়ার পেছনে অনেক ইতিহাস আছে। যেই ইতিহাস করুণ, যেই ইতিহাস বেদনার। নামের সাথে লেগেছে ট্রেইটর। সবাই বলে আবু ট্রেইটর খালেদ। নামে বেঈমান হলেও কর্মে মোটেও তেমন নয়। শিক্ষক প্রফেসর দীপক কুমার বিশ্বাসের একটি ফোনকলে আগুনে ঝাঁপ দিতেও প্রস্তুত সে। বাংলাদেশ থেকে উড়াল দিলো সুদূর ভারতের উদ্দেশ্যে। কে জানত, সাহায্য করতে গিয়ে মৃত্যুর দুয়ার খুলে যাবে! তাহের কি পারবে জায়েদ ও প্রফেসরকে বাঁচাতে? না-কি বিদেশ বিভুঁইয়ে নিজেই নিঃশেষ হয়ে যাবে?

হাভিয়ের গ্যাব্রিয়েল মড্রিচের লক্ষ্যটা বিশাল। এই লক্ষ্যের কাছে যে করেই হোক পৌঁছাবে। আর তাতে মানবজাতির ক্ষতি হলেও সে পরোয়া করে না। তার এই বেপরোয়া লক্ষ্যে খুলে গিয়েছে মৃত্যুর দুয়ার। নরকের দুয়ারের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে শেষ চেষ্টায় জায়েদ আরাফাত ও প্রফেসর ইমেরিটাস। মানবজাতিকে রক্ষা করতে হলে এ চেষ্টায় সফল হতেই হবে। আর যদি ব্যর্থ হয়.....?

রাজনীতির মারপ্যাঁচ, ধর্মীয় বিদ্বেষ ছাপিয়ে লড়াইটা ইতিহাসের বা পুরাণের, সত্য-মিথ্যার, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের, ভালো-খারাপের। এ লড়াই জিতবে কে?

▪️পাঠ প্রতিক্রিয়া :

"অনার্য দেব" বইটা শেষ করার পর যে কয়েকটি ইংরেজি শব্দ মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, সেগুলো হলো - "মাইন্ডব্লোইং"... "আউটস্ট্যান্ডিং"... "ব্রিলিয়ান্ট"... দুর্দান্ত এক কন্সপিরেসি থ্রিলার এই "অনার্য দেব"। আমি ড্যান ব্রাউনের "রবার্ট ল্যাংডন সিরিজ" আর জেমস রলিন্সের "সিগমা ফোর্স সিরিজ"-এর অনেক বড়ো ভক্ত। সেসব বিদেশি লেখকের বই পড়তে পড়তে আমার খুব ইচ্ছা ছিল, যদি কোনো দেশি লেখক এমন এক মাস্টারপিস লিখতেন! আমার সেই ইচ্ছা পূরণ করার জন্য লেখক আলী ওয়াহাব সৌহার্দ্যকে অনেক ধন্যবাদ। লেখক বইটি লিখতে অনেক বেশি পরিশ্রম করেছেন। প্রচুর পড়াশোনা করেছেন। নিজের তাত্ত্বিক জ্ঞান খুব সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ইতিহাসের সাথে পুরাণের মিশেল, সেই সাথে বর্তমানের ছুটে চলা লেখক যেভাবে চিত্রায়িত করেছেন, এর জন্য তাকে সাধুবাদ জানাতে হয়। এক অসাধ্য সাধন করেছেন তিনি।

"অনার্য দেব" শুধু ইতিহাসের গল্প নয়। এতে উঠে এসেছে ভারতীয় পুরাণ। এমন এক গল্প, যার জানার মাঝেও কিছু অজানা ভিড় করেছিল। উপন্যাস শুধু ইতিহাস কিংবা মিথের নয়, দেশে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা লেখক অত্যন্ত সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ধর্মীয় বিদ্বেষ কতটা ভয়াবহ হতে পারে, সেটার নমুনাও দেখিয়েছেন লেখক। প্রায় ছয়শ' পৃষ্ঠার বইটিতে একে একে উঠে এসেছে ইতিহাস, মিথলজি, ভাষাতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, বিজ্ঞান, দর্শন, সিম্বলজি, গুপ্তসংঘ; বিদেশি থ্রিলারের ক্ষেত্রে খুব জনপ্রিয় উপদান হলেও বিশাল কলেবরের এ ধারার উপন্যাস আমাদের দেশে খুব একটা চোখে পড়ে না। লেখক প্লটের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের কার্পণ্য করেননি। এত এত জিনিসকে একসাথে এক সূত্রে বাঁধা সহজ কোনো বিষয় না। এক্ষেত্রে লেখকের তারিফ করতেই হয়। 

"অনার্য দেব" লেখকের রচিত দ্বিতীয় বই। দ্বিতীয় বইয়ে এসে লেখক যেভাবে তথ্য, উপাত্তের সমন্বয় ঘটিয়েছেন, তা প্রশংসা করার মতো। এত এর তথ্যের ভিড়ে খেই হারিয়ে ফেলা অসম্ভব কিছু না। কখনো খেই হারিয়েছি, ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। তবে আকর্ষণ হারাইনি। এত বড়ো থ্রিলারের ক্ষেত্রে পাঠকের আকর্ষণ ধরে রাখাও তো একটি অর্জন বটে। লেখকের ভাষাশৈলী চমৎকার, বর্ণনাশৈলী অসাধারণ। বিশাল কলেবরের এ ধারার উপন্যাসের ক্ষেত্রে ভাষাশৈলী খুব গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বহন করে। সাবলীল লেখনী না হলে বুঝতে অসুবিধা হতে পারে। লেখক এ দিক দিয়ে সফল। তবে কিছু ক্ষেত্রে বর্ণনা দুর্বল লেগেছিল। বিশেষ করে আক্রমন দৃশ্যগুলোতে। হয়তো আরো ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন।

"অনার্য দেব" উপন্যাসে সংলাপের গুরুত্ব অপরিসীম। এই সংলাপের মধ্য দিয়েই লেখক তার পরিশ্রমের ফল, সকল তথ্য-উপাত্ত জানানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিছু কিছু সংলাপ সত্যি অসাধারণ ছিল। হৃদয়ে দাগ কেটে যাওয়ার মতো। আবার কিছুক্ষেত্রে আরেকটু পরিণত সংলাপ আশা করেছিলাম। বিশেষ করে জায়েদ আরাফাত আর প্রফেসর ইমেরিটাসের মধ্যে কথোপকথনের সময় কিছু জিনিস বাড়তি মনে হয়েছে। যার আসলে প্রয়োজন ছিল না।

"অনার্য দেব" উপন্যাসের শুরু একটা স্ক্রিপ্টেক্স দিয়ে। যা রহস্য এগিয়ে যাওয়ার চাবিকাঠি। এর মধ্য দিয়ে হেঁয়ালির ছন্দে গল্প এগিয়েছে। সব সূত্র সেই হেঁয়ালিতেই দেওয়া ছিল। নিজের মগজ খাটানোর ব্যবস্থাও ছিল পুরো বই জুড়ে। তাই বইটি শুধু পড়ে আনন্দ পাওয়ার ক্ষেত্র শুধু না, ছিল নিজেকেও ওদের সাথে একই যাত্রায় শামিল করার উপাদান।

"অনার্য দেব" বইয়ের ক্ষেত্রে লেখক যে পরিমাণ পরিশ্রম করেছেন তার পুরো ছাপ ছিল বইয়ের প্রতিটি পাতায়। কিছু বিষয় সত্যি ভালো লেগেছে। বিশেষ করে দিনের শুরুতে বারের নাম ও তার বর্ণনা ভালো লেগেছে। আমরা এর কতটা জানি? আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, বইটি পড়ার সময় কিছু জায়গায় অনেক প্রশ্ন মাথায় এসেছিল। কয়েক পৃষ্ঠা পর সেসব প্রশ্নের উত্তর লেখক দিয়েছেন। বা গল্পের খাতিরেই সেসব প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি। লেখক প্লট হোল না রাখার সবরকম চেষ্টাই করেছেন।

▪️চরিত্রায়ন :

সারা পৃথিবীর মানবজাতি হুমকির মুখে। এদের রক্ষা করতে হবে। বাঁচাতে হবে পৃথিবীর প্রাণ। - এই ধরনের উপন্যাসের ক্ষেত্রে মুখ্য চরিত্র থাকে দুয়েকজন বা একটি দল। "অনার্য দেব" উপন্যাসে সারা পৃথিবী ঘুরে মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা করে গিয়েছেন তরুণ পদার্থবিদ জায়েদ আরাফাত আর নৃবিজ্ঞানী, ভাষাবিদ প্রফেসর ইমেরিটাস দীপক কুমার বিশ্বাস। গল্পে ছোটখাটো অনেক চরিত্র এলেও এ দু'টি চরিত্রই প্রধান। 

উপন্যাসে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল একজন মুসলিম আর একজন অমুসলিম, দুইজন একসাথে রহস্য সমাধানে ছুটছেন। একজন বিশ্বাস দিয়ে সমস্ত কিছু ধারণ করেন, আরেকজন যুক্তিতর্কে আস্থা রাখেন। লেখকের এই দিকটি প্রশংসনীয়, তিনি সকল ধর্মকে পাশাপাশি রেখে গল্পের রথ ছুটিয়েছেন। তবে চরিত্র ডেভেলপের ক্ষেত্রে লেখকের আরেকটু মনোযোগী হতে পারতেন। জায়েদ আরাফাতের অতীতের অনেককিছু জানতে পারলেও তো যথেষ্ট মনে হয়নি। আরেকটু জানানো যেত বলে মনে হয়েছে। ওদিকে প্রফেসর ইমিরিটাসের সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। তার লোক চক্ষুর আড়ালে চলে যাওয়ার রহস্য জানার ইচ্ছা ছিল। বিশাল এ উপন্যাসে লেখক যেহেতু বর্ণনার দিকে নজর দিয়েছিলেন, এই দিকে আরেকটু নজর দিতে পারতেন।

এছাড়া উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র স্বতন্ত্র, মূল্যবান। সবার ক্ষেত্রে চরিত্রগুলো ডেভেলপ করার প্রয়োজন ছিল না। লেখক সে চেষ্টাও করেননি। তবে প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সবার একটু একটু অবদান এই উপন্যাসকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে।

"অনার্য দেব" উপন্যাসে একজন অনার্য দেবের কথা বলা হয়েছে। হাজার হাজার বছর আগে এই উপমহাদেশে একজনের আবির্ভাব হয়েছিল, যার প্রভাবে বদলে গিয়েছিল ভারতের একাংশের ইতিহাস। লেখক সেই চরিত্রের মূল সুন্দরভাবে ফুটিয়েছেন। এছাড়া আর্য জাতির রাজা, যোদ্ধা, দেব-দেবী; ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক চরিত্রের সমন্বয় খুব দক্ষতার সাথেই করেছেন।

"অনার্য দেব" উপন্যাসে আমার প্রিয় চরিত্র আবু তাহের খালেদ। সাবেক হয়ে যাওয়া একজন আর্মি অফিসারের ফেলে আসা জীবনের গল্প, হতাশা-বিষাদে জর্জরিত কিন্তু লক্ষ্য না হারানো একজন মানুষকে লেখক এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন; মন ছুঁয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমি শেষ পরিণতি মানতে পারিনি। এমন না হলেও পারত!

▪️বানান ও সম্পাদনা :

বাতিঘর প্রকাশনীর বানান নিয়ে নতুন করে বলার নেই। তাদের বইয়ে বানান ভুল বা মুদ্রণ প্রমাদ না থাকলে মনে হয় না, বইটি বাতিঘরের। তবে সস্তির বিষয়, বানান ভুলের সংখ্যা দিনে দিনে কমে আসছে। তবে যেগুলো মানতে পারি না, সেগুলো হলো - কি/কী এর ভুল ব্যবহার। লেখক বইয়ের সব জায়গায় কি এর ব্যবহার করেছেন। এছাড়াও মত/মতো, হত/হতো, হল/হলো এর কখন কোনটা ব্যবহার হবে সেটা জানা থাকা জরুরি। নাহলে অর্থ বিভ্রাটের সুযোগ থাকে। কয়েক জায়গায় এ-কারের পরিবর্তে অদ্ভুত ধরনের এক চিহ্ন এসে পড়েছিল। শেষ দিকে কিছু জায়গায় যুক্তবর্ণ ভেঙে যাওয়া লক্ষ্য করেছি।

প্রায় ছয়শ' পৃষ্ঠার বইয়ের কিছু জায়গায় সম্পাদনার প্রয়োজন অনুভব করেছি। উপন্যাসের প্রয়োজনে কিছু ছবি এসেছে। যার অনেকগুলোর নিচে বর্ণনা থাকলেই, কিছু ছবিতে তা ছিল না। এতে কিছুটা বুঝতে অসুবিধা হয়েছিল। অনেক ছবি গল্পের প্রয়োজনে যে জায়গায় ছবির প্রয়োজন, তার থেকে কিছুটা দূরে ছিল। একেক ছবি একেক সাইজে, আবার অ্যালাইনেও গড়বড় ছিল। 

▪️প্রচ্ছদ ও বাঁধাই :

বাতিঘরের বইয়ের ক্ষেত্রে অভিযোগ থাকে, বাঁধাই ঠিক মতো হয় না। পৃষ্ঠা খুলে আসার সম্ভাবনা থাকে। "অনার্য দেব" বইয়ে সে সমস্যা একবারেই ছিল না। বিশাল বইটি খুলে পড়তে অসুবিধা হয়নি। বাঁধাই দুর্দান্ত। সে হিসেবে দামটা পাঠকের নাগালের মধ্যে থাকা আরও বেশি সস্তি দেয়।

প্রচ্ছদ ঠিক মনমতো হয়নি। মোটামুটি ঠিক আছে, তবে আরও ভালো হতে পারত। সামনের প্রচ্ছদের চেয়ে আমার পেছনের প্রচ্ছদ বেশি আকর্ষণীয় লেগেছে। মনে হয়েছে ব্যাক কভারের ছবিটা সামনে ব্যবহার করা গেলে প্রচ্ছদটা আরও ভালো চমৎকার হতে পারত।

▪️পরিশেষে, "অনার্য দেব" একটি ফিকশন উপন্যাস। যেখানে সমন্বয় ঘটেছে ইতিহাস, পুরাণ, ভাষাতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, সিম্বলজি, বিজ্ঞান, গুপ্তসংঘ-এর। এরই সাথে উঠে এসেছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ধর্মীয় বিদ্বেষ আর প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতা। এর অনেকটুকু সত্যি হলেও সবটা নাও হতে পারে। কখনো কখনো সত্যের আড়ালে থাকে মিথ্যা। আবার মিথ্যার আড়াল থেকে উঁকি দেয় ভয়ংকর কোনো সত্য। কোনটা বিশ্বাসযোগ্য, আর কোনটা না; তা জানতে হবে। আর জানতে না পারলে খেই হারাতে হবে। হারিয়ে যেতে হবে অতল গভীরে!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ