বইঃ আরেক ফাল্গুন [PDF Download] (পিডিএফ ডাউনলোড)
লেখকঃ জহির রায়হান এর বই পিডিএফ
ধরনঃ উপন্যাস
প্রচ্ছদ মূল্যঃ১২০ টাকা
প্রথম প্রকাশঃ ১৯৬৯
ফাইল টাইপঃ পিডিএফ ডাউনলোড
ফাইল সাইজঃ ১:৪ এমবি মাত্র
যাদের একান্ত চেষ্টা আর সংগ্রামে আজ একুশে ফেব্রয়ারী প্রতিষ্ঠিত,পেছনের সেই মানুষগুলোর গল্প আরেক ফাল্গুন।সময় ১৯৫৫ সাল।তখনও বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে প্রান দেয়া শহীদদেরকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি,বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষনা করা হয়নি।তখনও একদল ছাত্র তার শহীদ ভাইদের স্বীকৃতির জন্য,ভাষার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছিলো।তৎকালিন সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কয়েকজন ছাত্র মিলে বর্তমান অবস্হিত শহীদ মিনারের জায়গায় কাগজে,বাশে মোড়ানো একটি মিনার তৈরি করে ভাষা দিবস পালনের উদ্দেশ্যে । একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে কেন্দ্র করে তারা স্বৈরাচার সরকারের বাধার মুখেও নানা ধরনের কর্মসূচি পালনের উদ্যেগ গ্রহন করে।এই উপন্যাসটি মূলত তাদের পালিত এই কর্মসূচিগুলোকে কেন্দ্র করেই।
কাহিনী সংক্ষেপঃ
আরেক ফাল্গুন বইটি শুরু হয় সিপাহী বিদ্রোহের ভয়াবহ ঘটনাকে স্মরন করিয়ে। ভাষা আন্দোলন ট্রাজেডির কয়েকবছর পেরুলেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে ও ভাষা শহীদদেরকে তখনও মূল্যায়ন করা হয়নি। আরেক ফাল্গুন বইয়ের প্রধান চরিত্র বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রনেতা মুনিম ও তার নেতৃত্বে একদল শিক্ষার্থী--আসাদ, নীলা,সালমা,রানু তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকারের সকল বিধিনিষেধ কে উপেক্ষা করে শহীদ দিবসকে যথাযথ মর্যাদা দান ও ভাষাশহীদদের স্মরনে ভাষা দিবস পালনের উদ্দেশ্যে দিন-রাত কাজ করে যায়।দিনটিকে কেন্দ্র করে তারা নানা ধরনের কর্মসূচি পালনের উদ্যেগ নেয়।দেয়াল লিখন,পোস্টার, কালো ব্যাজ বিতরণ, স্লোগান ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা প্রত্যেকে কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং নিজেদের স্বার্থকে তুচ্ছ করে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে তাই প্রতিফলিত হয়েছে পুরো উপন্যাস জুড়ে।
শুধু প্রতিবাদই নয় লেখক মূনিমের প্রেমকাহিনীর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন তখনকার ছাত্রসমাজের আবেগের জায়গাটিকে।প্রেয়সির চাইতেও সে প্রতিবাদকর্মসূচিকে আপন করে নেয়।আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে প্রেমিকা ডলি তাকে প্রত্যাখান পত্র দিলেও ভালোবাসাকে হ্রিদয়ের গভিরে আগলে রেখে আন্দোলনের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়। মুনিমের মতো আরেকজন আপোসহীন একনিষ্ঠ বিপ্লবী ছাত্রকর্মী আসাদ।
কোনো প্রতিকূলতাই তাকে আন্দোলনের মাঠ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি।উল্লেখ্য যে, উপন্যাসের শেষাংশে আসাদ চরিত্রটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে।আবার, মেডিকেল কলেজের ছাত্রী সালমা ১৯৪৮ এর ভাষা আন্দোলনে দুইহাত হারানো কারারুদ্ধ বিপ্লবী রওশনের স্ত্রী। স্বামীর জন্য হৃদয়ে গভীর ভালবাসা লালন করে আন্দোলনে সে অত্যন্ত কঠোর ও দৃঢ় অবস্থান রেখেছিলো।স্লোগানে উত্তেজিত হাত দুটি আর কখনো তাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করবে না ভেবে সালমার হৃদয়ে প্রতিনিয়ত যে রক্তক্ষরণ হয় তা অবলীলায় পাঠক হৃদয়ে রক্তক্ষরণের সৃষ্টি করবে।
এই নিষ্ঠাবান ছাত্রদের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামি কর্মকান্ডের পাশাপাশি ছাত্রদের মাঝে লুকিয়ে থাকা গুপ্তচর ও প্রক্টরের বিবেচনাহীন চিত্রও ফুটে উঠেছে উপন্যাসটিতে।শেষে বহুল প্রতিক্ষিত একুশে ফ্রেব্রয়ারী দিনটি আসলে পুলিশের সাথে ছাত্রদের সংঘর্ষ হয় এবং তাদের সকলকে পুলিশ গ্রেফতার করে।কেউ কেউ মারাত্মক আহত হলেও তাদেরকে সুচিকিৎসার ব্যবস্হা করা হয়না।জেলে ঢোকানোর সময় দেখা যায় এতো ছাত্র গ্রেফতার করা হয়েছে যে তাদের জায়গার সংকুলান করা কষ্টকর হয়ে দাড়ায়।তখন কবি রসুল চিৎকার দিয়ে বলে উঠে, জেলখানা আরো বাড়ান সাহেব। এতো ছোট জেলখানায় হবে না।আরো একজন বলে উঠে,এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্ত দ্বিগুন হবো!
হ্যাপি রিডিং। এই পৃথিবী বইয়ের হোক।
আরেক ফাল্গুন বই রিভিউ ২
বই: আরেক ফাল্গুন
লেখক: জহির রায়হান
ধরণ: চিরায়ত উপন্যাস
প্রকাশনী: অনুপম প্রকাশন
মুদ্রিত মূল্য: ১২০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৭২
"আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো ৷"
🔷️শুরুর কথাঃ
ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক অন্যতম সেরা উপন্যাস "আরেক ফাল্গুন" ৷ উপন্যাসটিতে ভাষা আন্দোলন পরবর্তী আমাদের দেশের ছাত্র শিক্ষক এবং সরকারি আমলাদের কথা আলোচনা করা হয়েছে ৷ বইয়ে ৫২'র ভাষা শহীদদের স্মরণে একুশে ফেব্রুয়ারি এবং শহীদ মিনার নিয়ে অসাধারণ গল্পের চিত্র-পট দেখা যায় ৷
🔷️লেখক পরিচিতিঃ
লেখক জহির রায়হান ৷ তিনি ঔপন্যাসিক, গল্পকার এবং বাংলাদেশি চলচিত্র পরিচালক ৷ বাংলা সাহিত্যে তার যোজন যোজন পদচারণা ৷ ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন ৷ তাছাড়া "হাজার বছর ধরে" উপন্যাসের জন্য আদমজী পুরস্কার (১৯৬৪), চলচিত্রে অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় একুশে পদক (১৯৭৭), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯২) লাভ করেন ৷
তার পরিচালিত ছবি- "স্টপ জেনোসাইড", "এ স্টেট ইজ বর্ন" ৷ পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচিত্র "সঙ্গম" তার হাত দিয়েই তৈরি হয় ৷
জহির রায়হান ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন ৷ ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি বড় ভাই শহীদ সাংবাদিক-ঔপন্যাসিক শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে তিনি নিখোঁজ হন ৷
🔷️কাহিনী সংক্ষেপঃ
"আরেক ফাল্গুন" ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক উপন্যাস ৷ লেখক ১৯৫২ সালের আলোকে উপন্যাসটি সাজিয়েছেন ৷ তবে বইটিতে ১৯৫৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের গল্প আলোচনা করা হয়েছে ৷ সালাম, বরকত, রফিক, শফিকদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা বাংলাকে মার্তৃভাষা হিসেবে পেয়েছি ৷ ১৯৫৫ সালে তাদের সম্মানে প্রথম শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়৷
উপন্যাসের নায়ক চরিত্র মুনিম, আসাদ, রাহাত, জামান, সালমা, বেনু সহ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একদল ছাত্র-ছাত্রী একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের জন্য খালি পায়ে হেঁটে একত্র হয় ৷ তারা স্থাপন করে বাঁশ আর কাগজের শহীদ মিনার ৷ ক্ষণস্থায়ী এই শহীদ মিনার পুলিশের তোপের মুখে টেকেনি বেশিক্ষণ ৷
পুলিশ ছাত্রদেরকে লাটি চার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে ৷ আবার শত শত ছাত্রদেরকে গ্রেফতার করতে শুরু করে৷ লেখ বলেছেন—
"নাম ডেকে ডেকে তখন একজন একজন করে ছেলেমেয়েদেরকে ঢোকানো হচ্ছিল জেলখানার ভেতরে৷ নাম ডাকতে ডাকতে হাঁফিয়ে উঠছিলেন ডেপুটি জেলার সাহেব ৷ এক সময় বিরক্তির সঙ্গে বললেন, উহ অত ছেলেকে জায়গা দেব কোথায়? জেলখানা এমনি ভর্তি হয়ে আছে ৷
ওর কথা শুনে কবি রসুল চিৎকার করে উঠল, জেলখানা আরও বাড়ান সাহেব ৷ আর একজন বলল, এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো ৷"
"আরেক ফাল্গুন" উপন্যাসটি মূলত ২১ শে ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠার গল্প ৷ গল্পে উঠে এসেছে একদল ছাত্র, দেশ প্রেমিকের কথা ৷ যারা জীবনের বিনিময়ে সোনার বাংলার সব দ্বান্ধিকতা উঁবে দিতে চেয়েছে ৷ উপন্যাস থেকে বাদ যায়নি— স্বদেশ বিরুধী দালালদের কথা ৷ যারা দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করেছে ৷
🔷️পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ
"আরেক ফাল্গুন" উপন্যাসটি ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে ২১ শে ফেব্রুয়ারি পালনের গল্প ৷ ১৯৫৫ সালে প্রথম শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপন করা হয়৷ শহীদদের স্মরণে ভোর থেকেই ফুল নিয়ে হাজির হতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মেডিকেল কলেজ পড়ুয়া একদল ছাত্র-ছাত্রী ৷ তাদের কারোর পায়ে জুতো নেই ৷ গায়ে কালো কাপড় ৷ প্রথম দেখায় মনে হবে পাগল নয়তো শহরের অন্যরকম বিলাসিতা ৷ ছাত্ররা প্রথমে একজন করে আসতে শুরু করে ৷ তারপর দুজন, তিনজন এভাবে অনেকজনে সমবেত হয় ৷
শহীদদের স্মরণে ফুল দিতে চাওয়া ছাত্রদের পণ্ড করে দেয় পুলিশ ৷ প্রথমে ছাত্ররা রুখে দাঁড়ায় ৷ পুলিশের নির্মমতায় ছাত্রদের দল পণ্ড হয়ে যায় ৷ টিয়ারশেল গ্যাস এবং লাঠি চার্জ করা হয় ছাত্রদের উপর ৷ তবুও একদল ছাত্র রুখে দাঁড়াতে চায় ৷ তবে অত্যাচারীর রক্তচক্ষু থেকে তারা রেহাই পায়নি ৷ এক, দুই করে গ্রেফতার করা হয় অজস্র ছাত্রকে ৷ তবুও ছাত্ররা দমে যায়নি ৷ তারা পুলিশের গাড়িতে বসেও স্লোগান দিতে থাকে ৷
"শহীদের খুন ভুলবো না ৷ বরকতের খুন ভুলবো না ৷"
🔷️উল্লেখযোগ্য উক্তিঃ
▪︎"শান্তি বলতে কী মনে করে ওরা ৷ অন্যায়ের কাছে মাথা নত করা ৷আক্রমণের কাছে আত্মসমর্পণ?"
▪︎"আকাশে মেঘ নেই ৷ তবুও ঝড়ের সঙ্কেত৷
বাতাসে বেগ নেই ৷ তবুও তরঙ্গ সংঘাত ৷"
▪︎"দেশ আমার, ভয় নেই ৷"
▪︎"শহীদের খুন ভুলবো না ৷ বরকতের খুন ভুলবো না ৷"
▪︎"দমন নীতি চলবে না ৷"
▪︎"আকাশের তারা গুণে কি শেষ করা যায়? যেদিকে তাকাও সমুদ্রের মতো ছড়িয়ে আছে জনতা ৷ আর সবার কণ্ঠে বিদ্রোহের সুর ৷"
▪︎"আসাদের বাড়ি থেকে কেউ আসেনি ৷ মা যার নেই, দুনিয়াতে কেউ বুঝি নেই তার ৷"
🔷️উপন্যাসটি কেন পড়া উচিত:-
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বাংলা ভাষাকে মায়ের ভাষায় রূপ দেওয়া হয় ৷ তবে ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়েও একদল অপশক্তির হাত থেকে তখনও বাংলা মুক্ত হয়নি ৷ শহীদ মিনার ভেঙে দেওয়া এবং ছাত্রদের উপর নির্যাতন করার চিত্র "আরেক ফাল্গুন" উপন্যাসটিতে দেখা যায় ৷
বইটি পড়লে পাঠক বায়ান্নো পরবর্তী সমাজের রূপ স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবেন ৷ ১৯৫২'র ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ের চিত্র উপলদ্ধিতে পাঠককে বইটা পড়া উচিত বলে মনে করি ৷
🔷️বইটি কারা পড়তে পারবে:-
আমার মনে হয় বইটি সব শ্রেণীর মানুষের জন্য লেখক রচনা করেছেন ৷ বইটিতে ভাষা আন্দোলন যেভাবে আলোচিত সাথে সাথে প্রেমও আলোচনায় এসেছে ৷ তবে এপ্রেম কিংকর্তব্য বিমূঢ় নয় ৷ দেশের প্রতি দায়িত্ব পালনের সময় সব কিছু নেহায়েত ৷ এখানে প্রেম নয় দেশকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে ৷ লেখক মুনিমের মাধ্যমে বিষয়টা স্পষ্ট তোলে ধরেছেন ৷
আমার মনে হয়, বইটি সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য প্রযোয্য ৷ যে কোন পাঠক বইটি পাঠে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন ৷
🔷️ব্যক্তিগত রেটিং:
রেটিয়ের মাধ্যমে বইয়ের মান যাচাই করা যায় না ৷ বই সম্পর্কে জানতে হলে বুঝতে হলে অবশ্যই বইটি পড়তে হবে ৷ কারণ, পাঠক মাত্রই ভিন্ন রুচির ৷
বইটিতে আমার ব্যক্তিগত রেটিংঃ-
৫/৫
আরেক ফাল্গুন pdf বই রিভিউ ৩
বই রিভিউ : আরেক ফাল্গুন বই pdf
লেখক: জহির রায়হান
প্রকাশনা: অনুপম
প্রথম প্রকাশ: ১৯৬৯
ঘরানা: উপন্যাস
'আরেক ফাল্গুন' ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত প্রথম উপন্যাস। উল্লেখ্য যে, এটি প্রেম- দ্রোহ- আশা- আকাঙক্ষা- আদর্শ সবকিছুর সংমিশ্রণে একটি কালোত্তীর্ণ উপন্যাস।
প্রেক্ষাপট :
১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাসের আবর্তন শুরু হয় ১৯৫৫ সালের কতিপয় ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্ররা শহিদদের স্মৃতি রক্ষার্থে এবং তাঁদের আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে শহিদ দিবস পালন করতে চেয়েছিলো। কিন্তু তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকার এর চরম বিরোধিতা করে। সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে গিয়ে ছাত্ররা তাদের সংকল্পে অটল থেকে শহিদ দিবস পালন করেছিলো। আর এর পরিণতিই 'আরেক ফাল্গুন' উপন্যাসে সার্থকভাবে চিত্রিত হয়েছে। বলাই বাহুল্য, আরেক ফাল্গুন উপন্যাসের সার্থক চিত্রায়ণের মূল কারিগর এর রচয়িতা জহির রায়হান। যিনি ছিলেন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় সৈনিক। ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে তাঁর তীব্র আবেগ আর গভীর দেশপ্রেমের অনুভূতি যেন ঠিকরে বের হয়ে আসছিলো প্রতিটি শব্দে। ঠিক সে কারণেই 'আরেক ফাল্গুন' কালের ঊর্ধ্বে গিয়ে আজও বাংলা সাহিত্যের এক জীবন্ত সৃষ্টি।
কাহিনী ও চরিত্র পর্যালোচনা:
১৯৫৫ সাল। লালবাগে সিপাহি বিদ্রোহ যেখানে হয়েছিলো সেখানকার ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকেই কাহিনীর শুরু। উপন্যাসের মূল চরিত্র মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তরুণ ছাত্ররা যারা সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের তরফ থেকে প্রবল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শহিদদের আত্মত্যাগের মর্যাদা দিতে শহিদ দিবস পালন করতে চায়। এদেরই একজন মুনিম। তাকে ঘিরেই উপন্যাসটি শুরু হয় এবং এগোতে থাকে। ভাষা আন্দোলনের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মুনিম হাটছিলো খালি পায়ে। মুনিম উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে সে। শহিদ দিবস পালন আন্দোলনের নেতা ও দিক নির্দেশক সে। তার জীবনের অন্য অনেক কিছুর চেয়ে সে এই শহিদদেরকে প্রাধান্য দিয়েছিলো, এমনকি প্রেমিকা ডলির চেয়েও। ডলি ও আন্দোলন এর মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বলা হলে সে আন্দোলনকে বেছে নেয়। অভিমানী প্রেমিকা ডলিও মুনিমকে ছেড়ে তার আরেক অনুরাগী বজলেকে গ্রহণ করতে চায়, যদিও বজলেকে সে কখনো ভালোবাসেনি। মুনিম ছিলো আদর্শবাদী। সে প্রেমিকার ওপরে তার আদর্শকে স্থান দিয়েছিলো। আন্দোলনে সে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলো, দিকনির্দেশনা দিয়েছিলো।
গল্পটা ছিলো সালমারও। সেও সক্রিয় ছিলো আন্দোলনে যার কিনা স্বামী, ভাই ও বোন আন্দোলনের কারণে জেলে রয়েছে। ভালোবেসে রওশনকে বিয়ে করেছিলো সে। রওশনের হাতে লেখা চিঠির জন্য অপেক্ষা করে থাকত সে। এখনো জেল থেকে সে রওশনের চিঠি পায় কিন্তু সেই চিঠি অন্য কাউকে দিয়ে লেখানো কারণ ভাষা আন্দোলনে রওশন তার দুটি হাতই হারিয়েছে, যে হাত দিয়ে রওশন সালমাকে চিঠি লিখতো, বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করতো।
ক্ষণিকের পরিচয়ে সালমার অনুরাগী হয়ে পড়েছিলো আসাদ। আসাদ, যে ছাত্র আন্দোলন এর সময় সালমার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনেও সামনের সারিতে ছিলো সে। জেলও খেটেছিলো। এবারও সে আছে আন্দোলনে এবং সামনের সারিতেও। আন্দোলনে মেয়েরাও পিছিয়ে ছিলো না। বেনু, রানু, নীলা, সালমা প্রত্যেকেই নিজেরদের অবস্থান থেকে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলো। ছিলো আরো বেশ কিছু চরিত্র যেমন কবি রসুল, মাহমুদ, শাহানা কিংবা সালমার দুষ্টু ভাই শাহেদ। প্রত্যেকটা ছোট ছোট চরিত্রই ছিল পরিমিত এবং কাহিনীর প্রয়োজনে। কাউকেই বাহুল্য মনে হয়নি, প্রয়োজনের খাতিরেই তারা এসেছে।
শহিদ দিবস পালনের সব প্রস্তুতি ও আয়োজন ঠিকমতই চলছিলো। ছাত্ররা পরিকল্পনা মাফিক এগোচ্ছিলো। কিন্তু ছাত্ররা জানতে পারেনি তাদের মধ্যেই কেউ প্রতারণা করছে, ছাত্রদের দলের মধ্যে ঢুকেছিল গুপ্তচর। দলের বিশ্বাসঘাতক সবুর খান ছিলো পুলিশের চর। পুলিশকে সে ছাত্রদের গতিবিধির সকল খবর দিচ্ছিলো। শহিদ দিবস উদযাপন শুরুর ঠিক আগমুহূর্তে পুলিশ ছাত্রদের উপরে হামলা করে এবং সবাইকে জেলখানায় নিতে যায়। পুলিশের এক অফিসার ছাত্রদের সংখ্যা দেখে মন্তব্য করলে তখন ছাত্ররা বলে ওঠে- "জেলখানার সংখ্যা বাড়ান জেলার সাহেব; আসছে ফাগুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো।"
এই সমাপ্তি বাক্যকে নির্দ্বিধায় 'আরেক ফাল্গুন' উপন্যাসের ম্যাজিক বাক্য হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। এই বাক্যটি বাঙালির প্রতিবাদী মনোভাবের পরিচয় বহন করে, ঐক্যের শক্তির চিত্রপ্রদর্শন করে এবং বাঙালিকে বারবার আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করে। যার প্রমাণ আমরা পেয়েছি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে। বারবার সংখ্যায় অধিক হয়ে একতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জবাব দিয়েছি সকল অন্যায়-অত্যাচারের, ছিনিয়ে এনেছি বিজয়।
পাঠ প্রতিক্রিয়া:
'আরেক ফাল্গুন' উপন্যাসটি যেন বারবার পড়লেও রেশ কাটে না। ভাষা সংগ্রামের এত বছর পার করে এলেও এই উত্তরাধুনিক যুগে এসে উপন্যাসটি পড়তে বসে আমি যেন অক্ষিপটে সকল ঘটনার বাস্তব চিত্রায়ণ দেখতে পাচ্ছিলাম। আরেক ফাল্গুন কে দ্রোহ-প্রতিবাদের বাইরে গিয়ে প্রেমের উপন্যাস বললেও বোধহয় খুব ভুল হবে না। উপন্যাসের পুরোটা জুড়েই ছিলো প্রেম। শেষের দিকে মুনিম এবং ডলির মিলনাত্মক পরিণতিও উপন্যাসে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। আপাতদৃষ্টিতে, প্রেম ও আন্দোলনের মতো পরস্পর বিপরীতমুখী দুটি বিষয়কে অবলীলায় একসূত্রে গেঁথেছেন ঔপন্যাসিক। ঔপন্যাসিক জহির রায়হানের নিতান্ত সহজ-সরল-সাবলীল শব্দগুচ্ছ দিয়ে সৃষ্টি অসাধারণ লেখনীশৈলী আমাকে বরাবর মুগ্ধ করে।এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। তাঁর কলমের দক্ষ আঁচড়ে সমগ্র উপন্যাস জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রদের আবেগ, আদর্শ, দৃঢ়চেতা মনোভাব, সাহস ও মাথা নত না করার দৃঢ়সংকল্প অঙ্কিত হয়েছে।এসব অসাধারণত্বের কারণেই, বাংলা সাহিত্যে 'আরেক ফাল্গুন' এক স্বতন্ত্র স্থান দখল করে আছে।
©️ শানিন হক
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....