বই রিভিউ : বুক ও পিঠের গল্প, একসঙ্গে লুৎফর হাসান, ভাসানীর উত্থানপর্ব, ওপারে আঁধার, ঢাকাইয়্যা গল্পগুলো,

বইঃ বুক ও পিঠের গল্প 
লেখকঃ আইয়ুব আল আমিন 
প্রকাশনীঃ কিংবদন্তী পাবলিকেশন 
ধরনঃ গল্পগ্রন্থ 

পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ
লেখক আইয়ুব আল আমিন এর গল্পগ্রন্থ " বুক ও পিঠের গল্প" ২০২২ বই মেলায় প্রকাশিত হয়। বইটি প্রকাশ করেছে কিংবদন্তী পাবলিকেশন। 



বইটিতে মোট ২১ টি গল্প রয়েছে। গল্পগুলো হলোঃ
১) মেনির মা। ২) মতি কাকা। ৩) নকশা। ৪) টিপ। ৫) জল জোছনা রাত। ৬) চিঠি। ৭) একটা পিতলের ল্যাম্প। ৮) রব ভাই। ৯) মায়া। ১০) ব্যাথা। ১১) জলযাত্রা। ১২) বৃষ্টি। ১৩) পোলাউ। ১৪) ম্যাজিক। ১৫) দাদাজান। ১৬) হিসেব। ১৭) পুষ্প পূর্নিমা মঞ্জুরী। ১৮) মূর্ছনা। ১৯) জীবন। ২০) প্রেসিডেন্ট। ২১) হলুদ খাম।

১) মেনির মা। 
মেনির মা চরিত্রটি গ্রামের একটি পরিবারে থাকা গরু। গরুর বাচ্চার নাম মেনি। তাই গরুটিকে মেনির মা বলে ডাকে। একটা মধ্যবিত্ত পরিবারে লেখকরা দুই ভাই বোন, বোনের নাম আসমা। আসমা ছোট। তাদের দুই ভাই বোনের থেকে তাদের মা মেনির মাকে বেশি ভালোবাসে।শীত চলে গেছে কিন্তু এখনো শীতের আমেজ কাটেনি। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে আসমা অসুস্থ হয়ে পরে। ভীষণ জ্বর হয়। এমন সময় আসমার চিকিৎসার জন্য মেনির মাকে বিক্রির জন্য হাটে নিয়ে যেতে রওনা হয় লেখক ও তার বাবা। এক সময় লেখক মনে মনে ভাবে যদি আজ হাটে মেনির মা বিক্রি না হতো। মাহুতেই ভাবনা থমকে যায় আসমার কথা ভেবে। মেনির মা বিক্রি না হলে আসমার চিকিৎসা হবে না। এমন টানাপোড়েনের মধ্যে লেখক গল্পের ইতি টানেন এখানে।

২) মতি কাকা।
এই বইয়ে আর একটি গল্প মতি কাকা। এই গল্পে লেখক তার শৈশবের কথা উল্লেখ করেছেন। লেখকের মা মারা যায় তার জন্মের সময়। তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে। তারপর থেকে প্রথম প্রথম তার সত মা তাকে আদর করলেও যখন তার সত মায়ের মেয়ে হলো তখন থেকে আর তাদের সাথে থাকা হয় না। দাদির ঘরে থাকতো।তাদের বাড়িতে কাজ করতো ময়না। ময়নাকে লেখক ময়নামা বলে ডাকতো। ময়নামার স্বামী মতি কাকা। মতি কাকাকে লেখক তার নিজের বাড়ির লোকই ভাবতেন। কিন্তু মতি কাকা ময়নামার মতই এ বাড়িতে কাজ করতেন। মতি কাকার মা এই বাড়িতে কাজ করতো। তিনি মারা যাওয়ার পর এ বাড়িতেই বড় হয় মতি কাকা। মতি কাকা অনেক ভালোবাসতেন লেখকে। আশ্বিন মাসে যাত্রা পালা আসতো। মতি কাকা সেই যাত্রা পালা দেখতো। আর পরদিন লেখক তার থেকে যাত্রা পালার ঘঠনা শুনতো। স্বপ্নে লেখক দেখে যাত্রা পালায় নবাবকে কেউ ছুরি মারে। সেই নবাবটা মতি কাকা। ঘুম ভেঙে যায় লেখকের। আর শুনতে পায় মতি কাকাকে কেউ মাছ ধরার কোচা দিয়ে মেরে ফেলেছে। হুবহু স্বপ্নে যা দেখেছে তাই। 

৬) চিঠি।
আমার সব থেকে ভালো লাগে চিঠি গল্পটা,
এই গল্পটায় কেন্দীয় চরিত্র প্রণব। লেখক মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। তিনি চারুকলায় পড়বে। এতেই বেঁধে গেলো যত বিপত্তি। পড়াশুনা বাদ তবু চারুকলায় পড়াবে না। অনেক কিছু বুঝিয়ে পরিবারকে রাজি করায় লেখক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে এডমিশন হয়। এখানেই পরিচয় হয় প্রণবের সাথে। পরিচয় বলতে কিছু চিঠির মাধ্যম। লেখকের রুমে আগে থাকতো প্রণব। প্রণব আত্মহত্যা করে সেই থেকে রুমটায় একা থাকতেন লেখকের এক বড় ভাই। আলমারি খুলে একটা বস্তায় অনেক চিঠি খুঁজে পায় লেখক চিঠি গুলো সমীরণ নামের একজন পাঠিয়েছে প্রণবকে। মোট ৩৮৭ টা চিঠি। প্রণব দিনাজপুর গিয়ে পরিচয় হয় সমীরণের সাথে। তখন প্রণব অর্নাস দ্বিতীয় বর্ষে আর সমীরণ ক্লাস টেনে। দুজনই কথা থেকে প্রেমে পরে যায়। এর পর চিঠি দেওয়া নেওয়া। হঠাৎ একটা চিঠিতে সমীরণ উল্লেখ করে তার বিয়ের বিষয়। কিন্তু প্রণবের থেকে কোন উত্তর যায় না। এরপর কয়েকটা চিঠি এতই করুণ লেখক তা প্রকাশ করেননি। প্রণব কেন আত্মহত্যা করে তা জানার জন্য লেখক অস্তির হয়ে যায়। লেখক দিনাজপুর আসে এবং খোঁজ করে সমীরণের। দেখা হয় তাদের। লেখক রাজশাহী থেকে এসেছে শুনেই সমীরণ তাকে কিছু জিজ্ঞেস না করে বাড়ি নিয়ে যায়। কান্নায় ভেঙে পরে সমীরণ। ভাই বলে লেখকের হাত ধরে। লেখক অনুভব করে তাদের ভালোবাসার অসীম স্পর্শ সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই। গল্পটা শেষ হয়েও শেষ হয় না। গল্পের সমাপ্তি হয় এখানেই।

এমন ভাবে প্রতিটা গল্পেই লেখক তুলে এনেছে তার শৈশব থেকে শুরু করে এখন অবধি ঘটে যাওয়া সব ঘঠনা। প্রতিটা গল্পের শেষ এমন ভাবে শেষ হয়েছে যা পড়ার পর নিজের কৌতুহল আরও বৃদ্ধি পাবে এর পর কি হয়েছিলো জানার জন্য। 

পাঠক প্রতিক্রিয়া-
বুক ও পিঠের গল্প বইটা অসাধারণ, বইটাতে মোট ২১ টা গল্পের মধ্যে প্রতিটা গল্পেই কোনো না কোনো ভাবে জীবনের সাথে মিশে যাওয়া গল্প। বইটার সব থেকে বেশি কৌতুহলী করেছে চিঠি গল্পটা। সমীরণের সাথে দেখা হওয়ার পর কি লেখক জানতে পেরেছিলো প্রণব কেন আত্মহত্যা করলো?। প্রতিটা গল্প একটা স্বপ্নের মতো করে সুন্দর এবং সহজ ভাষা ব্যাবহার করে লেখক লিখেছেন। যে কেউ বইটা পড়তে ধরলে ঠিক তার জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার সাথে হুবহু মিল খুঁজে পাবে পাঠক। বইটির প্রচ্ছদ আকর্ষণ করবে একজন পাঠককে খুব সহজেই। আর একটা কথা না বললেই নয়, আমার পড়া যে সকল বই দেখেছি তার মধ্যে সব কটা বইয়ে দেখেছি বইয়ের ব্যাক কভারে ঘটা করে লেখকের ছবি সহ তার পরিচয় অর্জন সব উল্লেখ করা থাকে। কিন্তু এই বইয়ে সব উল্টো লেখকের ছবি নেই ঘঠা করে পরিচয় নেই।

বাইন্ডিংঃ
বইটির বাইন্ডিং নিয়ে কোন কথা বলার নেই। দারুন সব কিছু। বইটি প্রকাশ করেছে কিংবদন্তী পাবলিকেশন। কিংবদন্তী পাবলিকেশন এর বাইন্ডিং মানেই অসাধারণ। 
শুভ কামনা রইলো বইটির জন্য।

২/
বইঃ একসঙ্গে লুৎফর হাসান 
ধরনঃ নির্বাচিত উপন্যাস 
লেখকঃ লুৎফর হাসান 
প্রকাশনীঃ কিংবদন্তী পাবলিকেশন 



পাঠক প্রতিক্রিয়াঃ
উপন্যাস ঝিনাই পাখি,
ঝিনাই পাখি উপন্যাসে মুল চরিত্র রুস্তম ও অনন্যা (অনু) রুস্তম তাকে ভালোবেসে অনু বলে ডাকে। অনন্যা নবগ্রামের জমিদার বজেন্দ্র ভাদুড়ির মেয়ে। বজেন্দ্র ভাদুড়ি অভিজাত ব্রাহ্মণ জাত। লেখক এখানে রুস্তম চরিত্রে নিজেকে উপস্থাপন করেছে। রুস্তম ও অনন্যা দুজন দুজনকে ভালোবাসে। অনন্যার সাথে রুস্তমের প্রথম দেখা হয় রুস্তম তার চাচার সাথে জমিদার বাড়িতে দুধ দিতে গিয়ে। প্রজাদের উপর জমিদারের চাপা বৈষম্যের কথা মুখ ফসকে অনন্যার কাছে বলে রুস্তম। যা অনন্যার মনের কথা হিসেবে আবিরভাব হয়। অনন্যা রুস্তমকে ঝিনাই নদীর বাঁকে তমাল গাছের নিচে দেখা করার জন্য বলে যায়। সেই থেকে শুরু হয় তাদের ভালো লাগা। তাদের এই ভালো লাগায় বাঁধা হয় ধর্ম। 

অনন্যা হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের আর রুস্তম মুসলিম। অনন্যার কারণেই আজ তারা এক ঘরে চাইলেও রুস্তম স্বাধীন ভাবে নিজ গ্রামে ঘুরতে পারেনা। ঠিক একই ভাবে অনন্যাও এক ঘরে। আর এই এক ঘরের জন্য দায়ী রুস্তম। ঝিনাই নদীর বাঁকে তমাল গাছের নিচে তাদের ভালোবাসার গভীরতা বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। রুস্তম ভাবনায় বিভোর হয়। কালকেই দেখা হলো অথচ তার ভাবনা হয় কয়েক জন্ম মনে হয় তাদের দেখা হয়না। রুস্তমের বড় ভাইয়ের মেয়ে তাদের দুজনের মধ্যে খবর আনা নেওয়া করে। চিঠিতে অনন্যা তার আগ্রহের আকুতি জানায় রুস্তমের কাছে। সাক্ষী হয় ঝিনাই নদীর বাঁকে তমাল গাছ। রুস্তম আর অনন্যা জমিদারের কাছে ধরা পরে, সবাই জেনে যায় তাদের ভালো লাগার কথা। গভীর রাতে জমিদার বাড়িতে শালিস বসে। রুস্তমের বাবা ভাইয়ের উপস্থিতে জমিদার শর্ত ছুড়ে দেয় রুস্তমকে আর এই গ্রামে থাকতে দেওয়া হবে না অন্য কোথাও যেতে হবে অনন্যার থেকে অনেক দুরে। রুস্তমকে তার পরিবার নিয়ে যায় হেমনগর জমিদারের হোস্টেলে। 

রুস্তমের মধ্যে রাজ্যের চিন্তা ভর করে, অনন্যা কি ভাবে আছে। হঠাৎ একদিন করিম নামের একজন চিঠি নিয়ে আসে রুস্তমের কাছে। চিঠিতে অনন্যা রুস্তমকে অনেক কথা বলে এবং বলে পড়ালেখায় মনোযোগী হতে। সে ভালো আছে তার উপর কোন নির্যাতন করা হয়নি। রুস্তমের পরিক্ষা শুরু হয়। টানা ৪০ দিন পরিক্ষা চলে। পরিক্ষা শেষে রুস্তম বাড়ি ফিরে আসে। অনন্যার জন্য ভাবতে থাকে এই সময় অনন্যা তাদের বাড়ির উঠানে হাজির হয়। রুস্তমের অনুপস্থিতে ঘটে যাওয়া ঘটনা বলে অনন্যা। অনন্যা পরক্ষণেই প্রস্থান করে। নিজেকে অপরাধীর মতো মনে করে রুস্তম আবার হোস্টেলে চলে যায়। হঠাৎ কিছুদিন পর অনন্যার চিঠি আসে। অনন্যা লিখে...

প্রিয় রুস্তম,
আমি তোমাকে ভুলিতে পারি নাই, পারিবোও না। অন্য কোন পুরুষ আমাকে স্পর্শ করিতে পারিবে না। আমি তোমার অপেক্ষায় রহিয়াছি, থাকিব। 
চিঠি পেয়েই বেরিয়ে পড়ে রুস্তম প্রথম বর্ষায় অনন্যার মাথায় কদম ফুল দিবে বলে। আজ রাতেও তাদের দেখা হবে এই ভাবনায় রুস্তম যখন বিভোর। হঠাৎ চিৎকার ভেসে আসে। শোনা যায় জমিদার সব ছেড়ে কলকাতা চলে যাবে। জমিদারের বড় মেয়ের পেটে নিবারণ মাঝির ছোঠ ভাই অঞ্জনের বাচ্চা। আত্মসম্মানের জন্য জমিদারের সব ছেড়ে কলকাতায় পাড়ি দাওয়া। অনন্যাও চলে যাবে এটা ভাবতেই রুস্তম অস্থির হয়ে উঠে। ছুটে যায় রুস্তম। কান্নার শব্দে ভেসে যায় জমিদার বাড়ি। অনন্যা ঝিনাই নদীর বাঁকে তমাল গাছে ফাঁসি দিয়েছে। 

জমিদার পরিবারের সবাই গতরাতে চলে গিয়েছে। রেখে যায় তার ছোট মেয়ে অনন্যা ভাদুড়ি (অনু) কে। রুস্তমের ভাবনায় সেই তমালের তলা। সে ভাবে তার অনু তাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারেনি। রুস্তম বসে থাকে হঠাৎ তার কাঁধে স্পর্শ অনুভব করে। বলে উঠে আমি চলে যাইনি অপেক্ষায় আছি। কলকাতা এসো। আমি অপেক্ষা করবো। রুস্তম বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখে অনন্যা আর তার মা দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে গতরাতে.....
অনন্যা রুস্তমের ঠোঁট চেপে ধরে। অনন্যা বলে আমাকে এগিয়ে দেবে না? রুস্তম চিৎকার করে কাঁদে। তার চোখের পানি মিশে যায় ঝিনাই নদীর জলে।

পাঠক প্রতিক্রিয়াঃ 
এক সঙ্গে লুৎফর হাসান বইয়ের ৯ টি উপ্যনাসের একটি ঝিনাই পাখি। ঝিনাই পাখি গল্পের মূল চরিত্র রুস্তম। রুস্তম নবগ্রামের মুসলিম পরিবারে সন্তান। আর এই গ্রামের হিন্দু জমিদার এর মেয়ে অনন্যা ভাদুড়ি। রুস্তম আর অনন্যা ভাদুড়ি দুজন দুজনার প্রেমে পড়ে। তাদের নিয়েই এই উপন্যাস। গোটা উপন্যাস টা একটা ঘোরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। যতই পড়বেন মনে হবে অনন্যা আর রুস্তমের কি হয়েছিলো। তাদের এই ধর্ম বাঁধা কি তাদের এক হতে দিয়েছিলো? উপন্যাসের কথা এবং উপস্থাপন এতই নিখুঁত ভাবে সাজানো হয়েছে যা একজন পাঠক খুব সহজেই বুঝতে পারবে। ঝিনাই পাখি উপন্যাসের নামটা সেই ঝিনাই নদীকেই পাখি বলে সম্মোধন করা হয়েছে। এই উপন্যাসে রুস্তম আর অনন্যার প্রেমের কাহিনীতে একজন পাঠক খুব সহজেই বুঝতে পারবে ভালোবার মাঝে ধর্ম, বর্ণ, আদিপত্য কিভাবে একটা সুন্দর সর্ম্পককে অস্বীকার করে। 

বইটি থেকে ঝিনাই পাখি উপন্যাস টা পড়ে অনেক ভালো লেগেছে। পর্যায় ক্রমে বাকি উপন্যাস গুলোও পড়বো। আপনারাও পড়তে পারেন আমি গ্যারান্টি দিতে পারি হতাশ হবেন না। 

বাইন্ডিংঃ 
২০২২ বই মেলায় বইটি প্রকাশ করেছে কিংবদন্তী পাবলিকেশন। দারুণ কাগজ কোয়ালিটি সহ এত বড় বইয়ের বাইন্ডিং অসাধারণ। কিংবদন্তী পাবলিকেশন এর প্রতি ভালোবাসা এমন সুন্দর প্রডাকশন করার জন্য।

বইটিতে নয়টি উপন্যাস আছে, নয়টি থেকে প্রথম উপন্যাস (ঝিনাই পাখি) থেকে এই রিভিউ।

৩/
বইঃ ভাসানীর উত্থানপর্ব
লেখকঃ মোস্তফা কামাল 
প্রকাশনীঃ কিংবদন্তী পাবলিকেশন 
ধরনঃ ইতিহাসভিত্তিক গল্পগ্রন্থ 




মোস্তফা কামাল এর লেখা ইতিহাসভিত্তিক গল্পগ্রন্থ 'ভাসানীর উত্থানপর্ব'। বইটিতে লেখক ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল সময়ের মধ্যে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক কার্যকলাপ গুলো গল্প আকারে প্রকাশ করেছেন। বইটিতে মোট নয়টি গল্প আছে।

যেগুলো হলোঃ 
১) ভাসানীর উত্থানপর্ব। ২) শেখ মুজিব, মোমেন খাঁ ও জেনারেলগণ। ৩) খান সাহেবের পতন। ৪) রাওয়ালপিন্ডির গোলটেবিল। ৫) স্বাধীনতার প্রস্তুতি পর্ব ও শেখ মুজিব। ৬) ইয়াহিয়ার ফাঁদ। ৭) পাকিস্তান ভাগ এবং ভুট্টোর গল্প। ৮) একটি শপথ অনুষ্ঠানের শেষ কৃত্য। ৯) আমার নেতা। নয়টি গল্পেই তিনি লিখেছেন ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ অবধি রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ নিয়ে। 

১) ভাসানীর উত্থানপর্ব-
ভাসানীর উত্থানপর্ব গল্পে লেখক লিখেছেন শেখ মুজিবের ছয়দফা নিয়ে ভাসানীর সমালোচনার কথা। ভাসানীর ১৪ দফা এবং শেখ মুজিব ৬ দফার মধ্যে যখন ৬ দফা নিয়ে পূর্বপাকিস্তানের জনমনে ব্যাপক সারা তখন ভাসানী ভাবেন ৬ দফার চেয়ে তার ১৪ দফা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা কেন তার দলের এবং জনগণ বুঝেন না। তার চিন্তা গভীর হয়। তিনি হঠাৎ স্বপ্ন দেখে তার ১৪ দফা নিয়ে পাকিস্তানজুড়ে ব্যাপক হইচই পরে গিয়েছে। স্বপ্নে তিনি তার বাড়ির উঠানে অনেক পুলিশ দেখে তার ঘুম ভাঙ্গে ভাসানী তার ১৪ দফা জনপ্রিয় করার জন্য বিভিন্ন সভা বিবৃতি দিতে থাকেন। তিনি বলেন দেশের রাজনীতি দুই ধারায় বিভক্ত একটা হলো সাম্রাজ্যবাদের মুখাপেক্ষী বুর্জোয়া গণতন্ত্রের রাজনীতি অপরটি হলো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতন্ত্রের রাজনীতি। তিনি ছয় দফাকে ন্যায় দেশের জনসংখ্যার এক ভাগের কম উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেনির স্বার্থের প্রতিফলন বলে আখ্যায়িত করেন। ভাসানী সাম্রাজ্যবাদ ও পুজিঁবাদ থেকে মুক্তির জন্য দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার কথা ভাবেন। সে লক্ষে তিনি নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যান। ভাসানী আইয়ূব খানের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু তিনি পরে তার সমালোচনা শুরু করেন। একসময় সরকার পাকিস্তানে রবীন্দ্র সংগীতের মতো পহেলা বৈশাখ পালন নিষিদ্ধ করার কথা ভাবেন। এর প্রতিবাদে বৈঠক হয়। পহেলা বৈশাখ পালন কিভাবে হবে তা নিয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টদের সাথে আলোচনা করে আওয়ামী লীগ নেতারা এতে ভাসানী সমর্থন জানায়। এভাবে মওলানা ভাসানী প্রথমে ছয়দফার বিরোধিতা করলেও পরে ছয় দফার প্রতি নৈতিক সমর্থন জানান ও মুজিবের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হন। একই সঙ্গে আইয়ুব খানের কড়া সমালোচনা করতে শুরু করেন। এবং চুয়ান্ন সালের মতো আবারও জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠেন ভাসানী।
বাকি সকল গল্পেও লেখক ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ দেশ ভাগের পর থেকে স্বাধীনতা পযর্ন্ত ঘটে যাওয়া নানাবিদ ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

পাঠক প্রতিক্রিয়াঃ
ভাসানীর উত্থানপর্ব বইটায় লেখক দেশ ভাগ থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত এই তেইশ বছরে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। বইটি পড়লে একজন পাঠক এই দীর্ঘ সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাবহ খুব সহজেই বুঝতে পারবে। শেখ মুজিবকে মওলানা ভাসানী সমথর্ন, ঐক্যবদ্ধ ভাবে নিজেদের অধিকার আদায়, প্রাদেশিক নির্বাচন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, রাওয়ালপিন্ডির গোলটেবিল বৈঠক, ইয়াহিয়ার পতন সহ ততকালীন রাজনৈতিক নানা ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে। বইটি বর্তমান তরুণ সমাজের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এবং নিঃসন্দেহে ভালো একটা বই। 

বাইন্ডিংঃ
বরাবরের মতো এই বইটাও দারুণ ভাবে বাইন্ডিং করেছে কিংবদন্তী পাবলিকেশন, এই জন্য একটা ধন্যবাদ তারা পেতেই পারে। শুভ কামনা কিংবদন্তীর জন্য।

৪/
বইঃ ওপারে আঁধার 
লেখকঃ জয়দীপ দে 
প্রকাশনীঃ কিংবদন্তী পাবলিকেশন 
ধরনঃ উপন্যাস 

রিভিউ লেখার মত এত বুদ্ধি এখনো রপ্ত করতে পারি নাই। কিছু বইয়ের ভাষা এত কঠিন হয় মাঝে মাঝে একটা সংলাপের শেষে আর একটা শুরু হলে সামনেরটা হারিয়ে ফেলি। জয়দীপ দে শাপলু স্যারের উপন্যাস ওপারে আঁধার নিয়ে রিভিউ লেখার সাহস দেখালাম তবুও। ভুল ত্রুটির জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। 



পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ 
ওপারে আঁধার উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সম্রাট। সম্রাটের বাবা রেল এর চাকরি সূত্রে রেল কলোনির একটা কোয়াটারে বসবাস করতেন। সাত ভাই বোনের মধ্যে সম্রাট ছিলেন ছয় নম্বর। ছোট থেকে মায়ের আদর বঞ্চিত সম্রাট বড়ো বোনের কাছেই বড়ো হয়েছে। একসময় মানুষ ভর্তি বাসাটা এখন খালি হয়ে থাকে পরিবারের সবাই যে যার মতো করে থাকে, বোনদের বিয়ে হয়েছে, চাচারা নিজেদের সংসার নিয়ে আলাদা হয়েছে সম্রাট আর রাজা থাকে একসাথে। রাজা সম্রাটের ছোট ভাই। সম্রাট ডিগ্রি কলেজের ভিপি। তাই নর্থ কলোনি এলাকায় তার ক্ষমতা অনেক। রেলকে ঘিরে যত ধরনের অবৈধ চোরাকারবার তাতে নিজেদের আদিপত্ব বিস্তারে মাঝেমধ্যে বিরোধী পার্টির মধ্যে ক্ষমতার রদ বদল দেখা যায়। কখনো কেউ কাউকে ধাওয়া দিয়ে এলাকা ছাড়া করে। মামুনের ধাওয়া খেয়ে সম্রাট এলাকা ছাড়া। ইস্ট কলোনি মামুনের। সম্রাট স্ক্র্যাপ ডিপো থেকে মালামাল সরায়। তার কাজে সাহায্য করে মুন্সি হামিদুল। একসময় সম্রাট এলাকা ছাড়া হয় তার থেকে ক্ষমতা নিয়ে নেয় ইস্ট কলোনির মামুন। টেন্ডার বাজি এবং রেলের তেল চুরি বিরুদ্ধে অবিভুত হয় মহিউদ্দন। যার জন্য অবরুদ্ধ হয় তিনি, স্টাফ ইউনিয়ন এর হাতে রক্তাত হয় মহিউদ্দিন। নিদ্রাময় তাকে উদ্ধার করে সম্রাট।

উপন্যাসে আর একটি চরিত্র নার্গিস। নার্গিস চরিত্রটি ব্যাপক ভাবে পাঠক কে সামনে নিয়ে যাবে। সম্রাট নার্গিসকে পছন্দ করে। নার্গিস ফকরুল সাহেবের মেয়ে এবং একজন নাট্যকর্মী। মুক্তপাখি নাটকে নন্দিনীর চরিত্রে অভিনয় করে নার্গিস। নর্থ কলোনি ছেড়ে অফিসার্স কলোনিতে নার্গিসদের কোয়ার্টার হয়েছে। এ নিয়ে অনেক খুশি ফকরুল সাহেব। সম্রাট নার্গিসকে পছন্দ করলেও, নার্গিস কখনো ভাবতো না তাকে নিয়ে। একসময় অফিসার্স কলোনির হিল্লোল নামের একজনের সাথে পরিচয় হয় নার্গিসের। দুজনের মধ্যে গড়ে উঠে সম্পর্ক। হিল্লোল ও নার্গিসকে এক সাথে রিক্সায় দেখে সম্রাট। নার্গিসের উপর সম্রাটের যে দুর্বলতা তা থেকে হিল্লোলকে চড় মারে সম্রাট। কিছুদিন পর হিল্লোল এর চাকরি হয় জার্মানির একটি প্রতিষ্ঠানে। চাকরি থেকে ফিরে এসে নার্গিসের পরিবারের কাছে প্রস্তাব পাঠাবে বলে হিল্লোল চাকরি জন্য ঢাকা মেইলে করে রওনা হয়। পরদিন শোনা যায় ঢাকা মেইল ডাকাতি হয়েছে। খবর আসে সেখান থেকে শুধু হিল্লোল নিখোঁজ। এই নিখোঁজ হওয়ার সকল দোষ এসে পরে সম্রাটের উপর। কারণ কিছুদিন আগে হিল্লোলকে চড় মেরেছিলো সম্রাট। 

অভিযোগ আনা হয় সম্রাটের নামে এই ডাকাতির পিছনে তারই হাত। কিছুদন পর হিল্লোলের লাশ পাওয়া যায় অভিযোগের তীর সম্রাটের দিকে আসে। অথচ এক ধনীর স্ত্রীর সাথে অবৈধ সম্পর্কের কারণে হিল্লোলকে অপহরণ করে মেরে ফেলা হয়। রহস্য উদঘাটন হয় দোষীও চিহ্নিত হয় কিন্তু টাকার কারনে হিল্লোলের বাবা মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে সম্রাটকে দোষী করে মামলা চালায়। কারন আইন চায় সাক্ষ্য-প্রমান যা প্রকৃত দোষীর বিরুদ্ধে ছিলো না।এদিকে সি পোর্ট চালুর জন্য নেভি ও বন্দর এর স্থানীয়দের মাঝে সংঘর্ষের পর বন্দর এলাকাতে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এতে সম্রাট সহ কয়েকজন বিডিআর এর হাতে পিঠুনি খায়। 

মহিউদ্দিন এগিয়ে আসে রক্তাক্ত সম্রাট কে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আড়াই মাস পর বাসায় ফেরে সম্রাট। কিছুদিন পর সম্রাট স্বাভাবিক হতে শুরু করে। এক সময় সম্রাট সুস্থ হয় কিন্তু তার পরপরেই হঠাৎ একদিন পুলিশের পিকআপ আসে সম্রাট এর বাড়িতে। নির্দোষ সম্রাট কে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। অনেক ঘুরেও সম্রাটকে ছাড়িয়ে আনা সম্ভব হয় না। মিথ্যাে অভিযোগে বন্দি হয় সম্রাট। অসমাপ্ত থাকে তার প্রেম। 

পাঠক প্রতিক্রিয়াঃ
ওপারে আঁধার উপন্যাসটি একটি মিশ্রিত উপন্যাস 
যেখানে লেখক রাজনীতি, প্রেম, রেল কলোনির মধ্যে বসবাস করা একটি পরিবার, এবং রেলের মধ্যে চোরাকারবারের যে মহা উৎসব সেই বিষয় বস্তু গুলো সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন। উপন্যাসটিতে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে নার্গিস চরিত্রটি। যা সহজে পাঠককে সামনের দিকে নিয়ে যাবে। বইয়ের ভাষাগত দিকটি খুব সুন্দর ভাবে প্রকাশ করেছে লেখক যা পাঠকের জন্য বুঝতে অনেক সহজ হবে।
১২৭ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি পড়তে শুরু করলে না শেষ করে উঠতেই চাইবে না সহজে। মোট কথা দারুণ একটি উপন্যাস এটা। 

বাইন্ডিংঃ বাইন্ডিং নিয়ে কিছু বলতে চাই না, কিংবদন্তী পাবলিকেশন এর বই মানে বলার মতো কোন গ্যাপ থাকে না।

৫/
বইঃ ঢাকাইয়্যা গল্পগুলো
লেখকঃ আসলাম সানী
ধরণঃ গল্পগ্রন্থ
প্রকাশনীঃ কিংবদন্তী পাবলিকেশন
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৪০ 
মুদ্রিত মূল্যঃ ২০০ টাকা

বিলকিস বানু শরাবের ট্যাকা চায় মহাজন ট্যাকা দ্যাও বহুৎ ট্যাকা হইছে বান্ডিল দ্যাও। নইলে তোমার গলার চেইন, পাঞ্জাবির সোনার বুতাম হাতের আংটি...?
কুচ নেহি হ্যায় সব ফাক্কা স্টেডিয়াম অয়া গেছেগা বিলকিস। 
তাইলে এউগা চুমা দেও মোহব্বত করো মহাজন..... তোমার আড়তে পেয়ার ব্যাচো? পেয়ার দ্যাও... 



লেখক, সাংবাদিক 
আসলাম সানীর গল্পগ্রন্থের বই ঢাকাইয়্যা গল্পগুলো

এই বইয়ে তিনি 
ঐতিহ্যবাহী ঢাকার আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ করেছেন। বইয়ে গল্প আছে ছয়টি, 
গল্প গুলোতে একজন পাঠক খুঁজে পাবে প্রেম, ভালোবাসা, আভিজাত্য সংস্কৃতি, সভ্যতা দেশপ্রেম ও ঐতিহ্য। 
গল্প ছটি হলো 
১/ কানওয়ালা
২/ ডিজেল মেরা লাল হ্যায়
৩/ বাচ্চুর পুরাণ ঢাকা 
৪/ গণযুদ্ধ মনযুদ্ধ
৫/ পুরাণ ঢাকার জেল্লা
৬/ নিজামুদ্দির রাইত বিরাইত 

পাঠ প্রতিক্রিয়া:

প্রতিটা গল্পে লেখক তুলে এনেছেন ততকালীন ঢাকার ঘটে যাওয়া ঘটনা। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধে ঢাকার যে ভুমিকা বিস্তার তাও ফুটে তুলেছেন এই বইয়ে। 
পাঠক সহজে যেন বুঝতে পারে 
পুরাণ ঢাকার ঐতিহ্য, বংশগত খানদানি আভিজাত্য এই বিষয় গুলো সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় প্রকাশ করেছেন লেখক। 
বইয়ের ভাষাশৈলী পাঠকে কাছে টানবে নিশ সন্দেহে।
আমি মুগ্ধ হয়েছি প্রতিটা গল্পেই।
মহাজনের কাছে প্রেম চেয়ে বিলকিস বানুর গান পেয়ার দে মুঝে পেয়ার দে। মাঝে মাঝে ব্যাবহিত হিন্দি সংলাপ আপনাকে মুগ্ধ করবে। লেখার মধ্যে কথা বলার যে একটা টান থাকে তা সহজেই বুঝতে পারবে পাঠক।

বইটির প্রডাকশন নিয়ে জানতে চাইলে আমি বলবো 
একথায় অসাধারণ, 
বাইন্ডিং, পেজ লেখার ফ্রন্ট,প্রচ্ছদ না দেখলে বিশ্বাসই করবেন না এত সুন্দর হতে পারে। 
এর জন্য প্রকাশনী একটা ধন্যবাদ পেতেই পারে।

© All Review & Photo Credit 💕 Easel Islam

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ