সালাফদের ক্ষুধা বই : ইমাম ইবনু আবিদ দুনিয়া | Salafder Khuda By Imam IBN Abid Duniya


  • বইঃ সালাফদের ক্ষুধা।
  • মূলঃ ইমাম ইবনু আবিদ দুনিয়া।
  • অনুবাদঃ মাসুদ আলিমী।
  • পৃষ্ঠাঃ ১৪৪ পৃষ্ঠা।
  • মুদ্রিত মূল্যঃ ২০০ টাকা।
  • প্রকাশনায়ঃ সীরাত পাবলিকেশন।
  • লিখেছেন: Amina Binte Abdul Muqit‎ 

বর্তমান যুবক-যুবতীর কাছে ফুডলাভার যেন হিরকখচিত কোনো ট্যাগ। আজ এখানে, তো কাল ওখানে। চেক ইন দিয়ে কবজি ডুবিয়ে খাওয়া, মনমতো খাওয়ার পেছনে তাদের আগ্রহের সীমা নেই। পাশাপাশি ফুড রিলেটেড গ্রুপগুলোতে ক্যাফে-রেস্তোরাঁগুলোর দাম কমিয়ে 'প্লেটার' দেওয়া তো বিরাট প্রতিযোগিতা। আজ উম্মাহর বড় একটা অংশ এই প্রতিযোগিতার পেছনে ছুটছে। সারাদিন পরিশ্রম করে খাওয়ার জন্য টাকা কামানো। খেয়ে সেই টাকা উড়ানো। এক উদরপূর্তির পেছনে আমাদের কত সময়, পরিশ্রম, অর্থব্যয়!

উম্মাহর বর্তমান সদস্যরা ভোজনরসিক, পেটুক ট্যাগ পেয়ে ঢেকুর তোলে। অতীতের দিকে তাকালে দেখব আমাদের আসলাফ সামান্য খেয়েও ঢেকুর তুলতে ভয় পেতেন। তাদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে চমৎকারভাবে সাজানো হয়েছে বইটি। কতটা খেতেন, কী খেতেন, কেন খেতেন, কতটুকু বিরতি দিয়ে খেতেন আমাদের আসলাফ, তা জ্বলজ্বল করছে প্রতিটি পাতায় পাতায়। কোনো বাড়তি কথা না বলে, রেফারেন্সসহ সালাফদের ঘটনা টেনেছেন লেখক। এত চমৎকারভাবে অনুবাদ করা হয়েছে বইটি, মনেই হয়নি কোনো অনুবাদ পড়ছি। সাবলীলভাবে সাজানো প্রতিটি ঘটনা নিজের মাঝে আফসোস জাগিয়ে তোলে। উদরের পেছনে ব্যয় করা সময়, অর্থ, শ্রমের জন্য আফসোস জাগে মনে। আত্মসংযমের দৃঢ় সংকল্প মনে বাসা বাঁধে।

নাম শুনে বোকার মতো ভেবেছিলাম বইটা সম্ভবত সালাফদের ইলম অর্জনের গল্প নিয়ে হবে। না হয় আর কিসে ছিল তাদের ক্ষুধা! বইয়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেখে ভেবেছিলাম, 'ও আচ্ছা! খাওয়া দাওয়া নিয়ে বইটা! থাক এটা লাগবে না'। কিন্তু এখন বুঝছি, যদি লাগবে না ভেবে বইটি না পড়তাম, তবে কত বড় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতাম! আল্লাহ বই সংশ্লিষ্ট সকলকে উত্তম প্রতিদান দিন।

ফুডলাভার তো বটেই, যারা প্রয়োজনের চেয়ে এক লোকমা ভাতও বেশি খায়, তাঁদের জন্য অবশ্য পাঠ্য এই বই।
বইটি যেকোনো অনলাইন বুকশপে অর্ডার করলেই পাবেন।

একজন দাঈ এই একবিংশ শতাব্দীর মানুষের খাবার দাবার নিয়ে বলেন, 'We eat, because we are bored' – আসলেই। কিছু করার নেই—চলো কিছু খাই, ভালো লাগছে না—চলো কিছু খাই, এক রুম থেকে আরেক রুমে যাচ্ছেন —ফ্রিজ খুলে কিছু না কিছু মুখে দিচ্ছেন, পেটে ক্ষুধা নেই তারপরও কিছু না কিছু চিবাচ্ছেন! আমরা এখন আর বাঁচার জন্য খাই না, খাওয়ার জন্য বাঁচি। যা কিছু হবে হোক, আমাদের পেট সবসময় ভর্তি। বিশাল সব ভুঁড়ি নিয়ে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি, এটা আমাদের কাছে মোটেই লজ্জাজনক কিছু নয়। এমনকি যারা ইসলাম চর্চা করেন তাদের কাছেও না। তাদেরকে দেখবেন বরং এই ভুঁড়ি নিয়ে কতো মজা করছেন। অথচ ভুঁড়িওয়ালাকে দেখে উমার (4) বলেছিলেন—এটা আল্লাহর আযাব!

নবী রাসূল থেকে সাহাবিদের প্রজন্ম কিংবা যেকোনো সোনালী প্রজন্মের মধ্যে একটা জিনিস সবসময় এক ছিল— তাঁরা পেটের বিষয়ে সবসময় সজাগ থাকতেন। বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু না হলেই নয়, ঠিক ততটুকু খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতেন। আর এটাই ছিল তাঁদের আত্মশুদ্ধি, আল্লাহমুখীতা আর দুনিয়া বিমুখীতার অন্যতম কারণ। এমনকি চিকিৎসা বিজ্ঞানেও অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ, পেট ভরে খাওয়াটা বারণ। না খেয়ে নয়, বরং হিসেব করলে দেখা যাবে যাবতীয় রোগ বালাই আস্তানা গেঁড়ে বসে অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণজনিত কারণে।

দ্বীন ইসলামের যুহদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রে সংযম। এটা স্বাস্থ্য, দ্বীন, অন্তরের পরিশুদ্ধি সবকিছুর মূলকেন্দ্র। এই বই সালাফদের খাওয়া দাওয়ার যুহদ, তাঁরা কতটুকু খেতেন, কি খেতেন, বিলাসিতা কীভাবে পরিহার করতেন, অধিক খাওয়াকে তাঁরা কীভাবে দেখতেন এসব বিষয় আলোচিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় যুহদের উপর অনেক বই অনূদিত হয়েছে, রচিত হয়েছে। শুধু খাওয়া দাওয়ার যুহদ নিয়ে একক বই সম্ভবত এই প্রথম। আমাদের পুঁজিবাদী আর চরম বস্তুবাদের এই দুনিয়ায় যখন ফিতনার সোনালী সময় যাচ্ছে, এখানে ‘যুহদ’ কথা উঠলেই আমাদের চোখ কপালে উঠে যায়, তার উপর আবার খাওয়া দাওয়ার সংযম নিয়ে বললে তো আরও বিপদ। কিন্তু আমরা আশাবাদী এই বইটি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করবে, আমাদের এই ‘খাও দাও ফুর্তি করো' জীবনদর্শনের মূলে আঘাত করবে, আমাদের সালাফদের জীবনদর্শন আমাদের অনুপ্রাণিত করবে। ইনশাআল্লাহ।

সীরাত পাবলিকেশনের পক্ষে
সাজিদ ইসলাম ১৯ এপ্রিল, ২০১৯

ভূমিকা

সকল প্রশংসা আল্লাহর। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের উপর। তাঁর পরিবার, সাহাবা ও অনুসারীবর্গের উপর। আদম সন্তানের ধ্বংসের অন্যতম ভয়ানক একটি কারণ হলো পেটপূজা—

উদরপূর্তি করা। এ কারণেই আদম (Sa) ও তাঁর স্ত্রী হাওয়াকে সম্মানের স্থান (জান্নাত) থেকে বের করে পাঠানো হয়েছে অভাব ও অপমানের ভূমিতে। তাঁদেরকে বারণ করা হয়েছিল গাছটির ফল ভক্ষণে। কিন্তু তাঁদের চাহিদা ছিল প্রবল। তাঁরা তা থেকে খেল। আর সাথেসাথে গা থেকে খসে পড়ল ইজ্জতের আবরণ—–সম্মানের পোশাক!

বাস্তবিকপক্ষে পেট হচ্ছে প্রবৃত্তির উৎপত্তিস্থল। রোগবালাই, বিপদআপদের উৎসমূল। কেননা পেটের অনুগামী হলো জৈবিক চাহিদা। আর খাদ্য ও বিবাহের (বৈধ জৈবিক চাহিদার) অনুগামী হলো সম্মান ও সম্পদের প্রচণ্ড আগ্রহ। এই দুটিই মানুষকে খাদ্য ও বিবাহের দিকে এগিয়ে দেয়। টেনে নিয়ে যায়। অতঃপর অধিক সম্মান ও সম্পদ কামানোর ধান্ধাই মানুষকে বহু জিনিসের মুখোমুখি করে। নানান প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিহিংসার জালে জড়িয়ে ফেলে। এ দুটোর মধ্য থেকেই জন্ম নেয় লৌকিকতা ও মিথ্যে অভিনয়। রোপিত হয় আত্মগর্ব, আমিত্ব, অহমিকা, অহংকারের বীজ। এসব ডেকে নিয়ে আসে লোভ, হিংসা, ঘৃণা ও বিদ্বেষ। এরপর সে অপছন্দনীয়, অশ্লীল ও অবাধ্য কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জীবনকে বরবাদ করে। এসবের মূলেই হলো পাকস্থলী। উদরপূর্তি ও পরিতৃপ্তি থেকেই নির্গত হয় এসব অপকর্ম।

যদি বান্দা ক্ষুধার মাধ্যমে নিজের প্রবৃত্তিকে দমায়, শয়তানের চলাচলের পথকে সংকীর্ণ করে—তাহলে অবশ্যই আল্লাহর ইবাদাতে নফস তার অনুগত থাকবে।

সে ঔদ্ধত্য ও অবাধ্যতার পথে হাঁটবে না— দুনিয়ার মোহে প্রলুব্ধ হবে না— ক্ষণস্থায়ী জগতকে চিরস্থায়ী জগতের উপর প্রাধান্য দিবে না—দুনিয়ার উপর কুকুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে না।

ক্ষুধার্ত থাকার অনেকগুলো উপকারিতা রয়েছে:

১) অন্তর স্বচ্ছ থাকে। স্বভাবজাত বুদ্ধিকে আলোকিত করে। ব্যক্তিকে করে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। পক্ষান্তরে পরিতৃপ্তি? তা মানুষকে নির্বোধ করে, আর বিবেককে বানায় অন্ধ। এর কারণে চিন্তাভাবনার গতিতে ভাটা পড়ে। দ্রুত উপলব্ধি করার ক্ষমতা বাধাগ্রস্থ হয়। এমনকি ছোট ছোট বালকরা যখন অধিক খায়, তখন তাঁদের মুখস্থশক্তি কমে যায়। স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। বুদ্ধি আর বোধশক্তি হয়ে পড়ে ধীরগতি।

২) অন্তর নরম থাকে। এমন পরিশুদ্ধি অর্জিত হয়, যারা মাধ্যমে সে সাধনার স্বাদ আস্বাদন করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। আল্লাহর স্মরণ তার অন্তরকে প্রভাবিত করে। এমন কত মানুষ আছে, মনের উপস্থিতি সমেত যার জিহ্বা অহরহ আল্লাহর যিকির করে যাচ্ছে—অথচ অন্তর তার স্বাদ পায় না—প্রভাবিত হয় না। কেমন যেন তার আর তার যিকিরের মাঝে পাষাণ মনটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়—তাকে যিকিরের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করে। কখনো যদি সেই পাষাণ অন্তর বিগলিত হয়, তখন যিকির দ্বারা ঠিকই প্রভাব পড়ে। মুনাজাতে লজ্জত হাসিল হয়। আর এসবের জন্য প্রকাশ্য একটি কারণ হলো পাকস্থলী খালি থাকা।

৩) বিনয় ও নমনীয়তা অর্জিত হয়। ঔদ্ধত্য, উল্লাস ও গোঁড়ামি দূর হয়, যা কিনা আল্লাহর স্মরণে গাফিলতি ও অবাধ্যতা সৃষ্টি করে। নফস অন্য কোনো উপায়ে অতটা নতজানু ও বিনয়ী হয় না, যতটা হয় ক্ষুধার কারণে। এসময় নফস তার প্রতিপালকের দিকে স্থির থাকে—মনোযোগী হয়। যখন তার শক্তি কমে যায়, দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন সে অক্ষমতা ও অপমানের ঘাঁটে অবস্থান করে। আর যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ নফসকে অক্ষম ও অপমানিত হতে না দেখে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার মহত্ব ও বড়ত্ব দেখতে পায় না।

সুতরাং পেট ও লজ্জাস্থান হলো জাহান্নামের একটি দরজা। আর তার মূল হলো পরিতৃপ্তি। নফসের পরাজয় ও নতজানু হওয়া জান্নাতের একটি দরজা। আর তার মূল হলো ক্ষুধা। অতএব যে জাহান্নামের দরজাটি বন্ধ করল, সে মূলত জান্নাতের দরজাটিই খুলে দিল। কেননা এ দুটো বিপরীতমুখী। উভয়ের মাঝে পূর্ব-পশ্চিমের দূরত্ব। যখন একটা নিকটবর্তী হয়, তখন অন্যটা দূরে সরে যায়।

সালাফদের ক্ষুধা

৪) ক্ষুধার্ত ব্যক্তি কখনো বালামুসিবত ও আল্লাহর শাস্তির কথা ভুলে না—ভুলে না বিপদাপন্ন মানুষের কথা। আর যে পরিতৃপ্ত, সে ক্ষুধার যন্ত্রণা বুঝে না। বুঝে না ক্ষুধার্ত মানুষের যন্ত্রণাও। বিচক্ষণ ব্যক্তি শুধু অন্যের কষ্টটাই দেখে না, দেখে আখিরাতের কষ্টটাও। নিজের তৃষ্ণার দ্বারা সে অনুমান করে কিয়ামাতের ভয়াবহ সেই দিনে মানুষের তৃষ্ণার কথা। নিজের ক্ষুধার মধ্যে চিন্তা করে জাহান্নামীদের ক্ষুধার কথা।

৫) ক্ষুধার কারণে সকল প্রকার গুনাহের খাহেশাত নিস্তেজ হয়ে যায়। নফসে আম্মারাহ তথা গুনাহ প্রবণ অবাধ্য মনের উপর কর্তৃত্ব লাভ হয়। কেননা সকল গুনাহের সূচনাই হলো এই খাহেশাত ও নফসের শক্তি। আর নিঃসন্দেহে খাদ্যই হলো এর রসদ। সুতরাং কম খাদ্য সকল খাহেশাত ও নফসের শক্তিকে দুর্বল করে দেয়।

৬) ক্ষুধা ঘুম দূর করে। রাত্রিজাগরণে সহায়ক। যে তৃপ্ত হতে চায়, সে অধিক পরিমাণে খায়। যার পানাহার বেশি, তার ঘুমও বেশি। আর অধিক ঘুমের দ্বারা কেবল জীবনের মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট হয়— তাহাজ্জুদ ছুটে যায় — স্বভাবে অলসতা এবং অন্তরে কাঠিন্য নেমে আসে। জীবন মণিমুক্তার চেয়ে মূল্যবান। এটাই বান্দার মূল পুঁজি। আর ঘুম হলো মৃত্যু। অতএব, অধিক ঘুম জীবনকে কেবল ক্ষতিগ্রস্ত করে।

৭) ইবাদাতে লেগে থাকা সহজ হয়। নিশ্চয় অধিক আহার ইবাদাতের প্রতিবন্ধক। মানুষ জীবিকা অর্জনে যে সময়টুকু ব্যয় করে, যে পরিমাণ ছুটাছুটি ও মেহনত করে, সে সময়টুকু এবং মেহনতটুকু যদি যিকিরে, মুনাজাতে এবং সকল ইবাদাতে লাগাত, তাহলে অধিক লাভবান হতো। অধিক মুনাফা অর্জন হতো। বেশি খাইখাই করার দ্বারা যে ইবাদাতটা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে, সেটা হলো সিয়াম পালন করা। কেননা সিয়াম পালন ঐ ব্যক্তির জন্যই সহজ, যে ক্ষুধাকে অভ্যাস বানিয়ে নিয়েছে।

৮) অল্প আহারের উপকার হলো, শরীর সুস্থ থাকে— রোগব্যাধি কম হয়। কেননা, অধিক আহার রোগব্যাধির অন্যতম কারণ। এই রোগব্যাধি ইবাদাতে বাধা দেয়, অন্তরকে অস্থির করে রাখে, বান্দার জন্য আল্লাহর যিকির ও ফিকিরে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে—জীবনকে করে তুলে দুর্বিষহ। এসব কিছু থেকে বাঁচতে গিয়ে ব্যয় ও খরচের এমন রাস্তা খুলে যায় — খাহেশাতের গোলামি করে, অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জন করেও যা বন্ধ করা যায় না। অথচ ক্ষুধা? এসব থেকে মুক্ত, বরং এসবকে আরো দূরে সরিয়ে রাখে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ