সর্বনাশিনী : সায়ন্তনী পূততুন্ড | Sorbonasini : Sayantani Puttund

 

বই- সর্বনাশিনী
লেখিকা- সায়ন্তনী পূততুন্ড
প্রকাশক- বিভা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ- জানুয়ারি ২০১৯
পৃষ্ঠা সংখ্যা- ৩৫২
ধরণ- থ্রিলার (অধিরাজ সিরিজ)
পাঠ অনুভব : সুরজ ঘোষ

🍁সদ্য পড়া শেষ করলাম বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় থ্রিলার লেখিকা সায়ন্তনী পূততুন্ড ম্যামের অধিরাজ সিরিজের প্রথম বই " সর্বনাশিনী"। এই বইটি মূলত একটি সাইকোলজিকাল থ্রিলার। বইটি সম্পর্কে ফেসবুকে অনেক রিভিউ এবং সাজেশন পড়ে, বইটি পড়ার প্রতি একটি অমোঘ আকর্ষন অনুভব করেছিলাম। তো একদমই সময় নষ্ট না করে কিনে ফেললাম বইটি। পড়ার পর আমার যা অনুভূতি তা এখন সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেবো।

🍁 সায়ন্তনী ম্যামের লেখা এটি আমার পড়া প্রথম বই। লেখিকার লিখন কৌশল সত্যিই অসাধারণত্বের দাবী রাখে।বাক্য গঠন, শব্দ চয়ন, লেখার বুনন সত্যিই অত্যন্ত মনোগ্রাহী।যখন বইটি পড়তে শুরু করলাম, তখন পৃষ্ঠাসংখ্যা দেখে রীতিমত ভয় পাচ্ছিলাম যে হয়তো অনেকটা সময় লাগবে বইটি শেষ করতে। কিন্তু লেখিকা এত সুন্দর এবং প্রাঞ্জল ভাষায় বইটি লিখেছেন যে ৩৫১ পৃষ্ঠা সংখ্যা বিশিষ্ট বৃহৎ উপন্যাসটি কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পড়ে শেষ করে ফেলতে পেরেছি। এটি যেহেতু একটি থ্রিলার উপন্যাস, তাই থ্রিল এর মধ্যে ভরপুর মাত্রায় আছে।এত সুন্দর ভাবে লেখার মাধ্যমে উনি উপন্যাসের ঘটনাক্রম বর্ণনা করে গেছেন যে বই থেকে চোখ সরানো আমার পক্ষে একরকম অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। ওঁনার লেখার আরেকটি বিষয় সম্পর্কে বলতেই হয়, উনি এত নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেন যে পড়তে পড়তে একঘেয়েমি লাগার প্রশ্নই ওঠে না।

  🔴 বিষয় সংক্ষেপ

🍁 এবার আসি উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে। প্রথমেই বলেছি উপন্যাসটি সাইকোলজিকাল ক্রাইম থ্রিলার জনরার। গল্প কিছুটা এগোলেই জানা যায়, "সর্বনাশিনী" নামাকৃত একটি জনৈক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে কলকাতা শহরের বিভিন্ন নামিদামি এবং ধনকুবেরদের ডেথ ফোরকাস্ট অর্থাৎ আগাম মৃত্যু সংবাদ পোস্ট করা হচ্ছে। প্রায় মৃত্যুর সাত থেকে আট দিন পূর্বে সেই ফেসবুক প্রোফাইলে পোস্ট করা হচ্ছে Rip পোস্ট । ফেসবুক প্রোফাইল টিতে ছবি দেওয়া আছে একজন কৃষ্ণাঙ্গী সুন্দরীর।তাছাড়া আর অন্য কোনো ধরনের তথ্য দেওয়া নেয়। পোস্টটি প্রোফাইলে আপডেট করার সাথে সাথেই কলকাতা পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারে যে মৃত ব্যক্তিটি ব্যাবসায়িক কাজের সুবাদে কিছুদিনের জন্য 'out of city' বা 'out of country' আছেন। তারপর হঠাৎ করেই শহরের কোনো শুনশান রাজপথে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করছে পুলিশ। মৃতদেহের ফরেনসিক টেস্ট করেও কোনো বিষ বা ক্ষতচিহ্নের হদিশ মিলছে না ।বহু তদন্তের পরেও কোনো কূলকিনারা না করতে পেরে অবশেষে Case টি হস্তান্তরিত করা হয় সিআইডি হোমিসাইড টিম কে।

🍁এই উপন্যাসে যারা সর্বনাশিনীর শিকার হয়েছে তাদের সকলের মধ্যেই একটি Common বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। প্রত্যেকটি মৃত ব্যক্তিই মদ্যপ,লম্পট এবং নারী শরীর ভোগী এক একটা মানুষরুপী জানোয়ার। যারা নিজেদের শরীরের স্বার্থে একটি নারীকে ব্যবহার করে এবং কার্য সম্পাদনের পরে ছুড়ে ফেলে দেয় রাস্তায়। এমনকি এই লাম্পট্যের অধীনস্থ হয়ে তারা নিজেদের স্ত্রী এবং সন্তানদেরকে প্রতিনিয়ত কষ্ট,অপমান ও মানসিক অবসাদের স্বীকার করে চলেছে।

 🍁এবার লেখিকা আমাদের সঙ্গে পরিচয় ঘটান উপন্যাসের মূল চরিত্র সিআইডি অফিসার অধিরাজ ব্যানার্জী ওরফে রাজা -এর সাথে । অধিরাজ এর যে বর্ণনা লেখিকা দিয়েছেন, তা থেকে আমরা জানতে পারি -অধীরাজ প্রায় ৬ ফুটের অধিক উচ্চতা বিশিষ্ট, ঋজুদেহী, অত্যন্ত তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন, রসবোধসম্পন্ন, দৈহিক শক্তি সম্পন্ন এবং সুদর্শন একজন পুরুষ। বলতে গেলে একজন iconic man material.

 🍁Case টি অধিরাজ ব্যানার্জীর কাছে আসা মাত্রই উনি সম্পূর্ণ টিমসহ এই case এর তদন্তে নেমে পরেন। আইপি অ্যাড্রেস ফাইন্ডিং, ডেডবডির ফরেনসিক ল্যাব টেস্ট, সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজ নিরীক্ষণ, সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ- বিভিন্ন পুলিশি কায়দায় অপরাধীকে ধরার কাজে লেগে পরে গোটা সিআইডি হোমিসাইড টিম।

🍁 লেখিকা পার্শ্ব চরিত্রগুলি কেও খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন উপন্যাসে। যেমন - অধিরাজের সহকারি এবং খুব ভালো বন্ধু অর্ণব, ফরেনসিক এক্সপার্ট ড: অসীম চ্যাটার্জী, পবিত্র আরো অনেকেই। Suspected characters এবং main criminal এর চরিত্র বুননও বেশ সুন্দর।

🍁 উপন্যাসের স্রোতে আপনি যতই ভেসে যাবেন ততই ধীরে ধীরে পরিচয় ঘটবে বিভিন্ন সন্দেহভাজন চরিত্রগুলির সঙ্গে।চরিত্র গুলোর মুখোশ যখন ক্রমশ প্রকাশ্যমানতায় পর্দানশীন হবে এবং গল্পের ঘটনাপ্রবাহ নিজের তালে বয়ে চলতে চলতে একটি অভাবনীয় মোড় নেবে তখন উপন্যাসটি পড়ার ইচ্ছাপ্রাবল্য দ্বিগুণ বা ততোধিক হারে বর্ধিত হবে।

 🍁লেখিকা উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহকে এমন cinematic angle এ বর্ণনা করেছেন যে প্রতিটা দৃশ্য আমার চোখে একদম হুবহু সিনেমার মতো ফুটে উঠেছে। আর গল্পটাও বেশ সুন্দর এবং রোমাঞ্চকর। বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি যদি আমাদের অখাদ্য কুখাদ্য না গিলিয়ে এই উপন্যাসটি এবং বর্তমান সময়ের বিভিন্ন লেখক-লেখিকার উপন্যাস গুলো নিয়ে সিনেমা নির্মান করেন তবে, বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সফলতার শীর্ষ চূড়ায় পদার্পণ কেউ আটকাতে পারবেনা,হলফ করে বলতে পারি। একটু ভেবে দেখবেন বিষয়টা।

 🍁সায়ন্তনী ম্যাডাম উপন্যাসটি কে আরো বেশি ইন্টারেস্টিং করার জন্য এবং case টিতে গভীরতা আনার উদ্দেশ্যে অনেক মেডিকেল টার্মস, সাইন্টিফিক কেমিক্যালস, প্লান্টস, ফরেনসিক টেস্ট ইকুইপমেন্টস সম্পর্কে আমাদের অবগত করেছেন। উপন্যাসটিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে দাবা খেলা। chess বা দাবা খেলা গল্পটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত royeche। এই দাবা খেলা সম্পর্কিত বিভিন্ন টার্মস উপন্যাসে লেখিকা ব্যবহার করেছেন। যারা দাবা খেলা সম্পর্কে ইন্টারেস্টেড তারা আশা করি বেশ উপভোগ করবেন বিষয়টিকে।

   🟢মূলভাবনা 

🍁 লেখিকা উপন্যাসটির মাধ্যমে যে মূল ভাবনাটি আমাদের হৃদয়ে সঞ্চারিত করার প্রয়াস করেছেন সেই সম্পর্কে কিছুটা বলা অবশ্যই প্রয়োজন বলে মনে করি আমি।

🍁কোনো নারীর skin tone অর্থাৎ গায়ের রঙের নিরিখে আমরা সেই নারীটির সৌন্দর্য বিচার করে থাকি। যেখানে একজন গৌরবর্ণা নারী আমাদের সমাজের কাছে সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি, সেখানেই একটি শ্যামবর্ণা বা কালো মেয়েকে সমাজ কুরূপা আখ্যানে ভূষিত করে থাকে। শুধুমাত্র সমাজ নয় এমনকি নিজের পরিবার এবং প্রিয়জনদের কাছ থেকেও সেই নারীটিকে অনেক লাঞ্ছনা, অপমান, বিদ্বেষ সহ্য করতে হয়। এই কারণে নারীটি মানসিকভাবে প্রচন্ড পরিমাণে ভেঙে পড়ে। তার মনে হতে থাকে এই সমাজে বাস করতে গেলে একজন নারীকে অবশ্যই গৌরবর্ণা হতেই হবে। গায়ের রং ছাড়া একটি নারীর অন্য কোনো গুন সমাজের কাছে একদমই বিচার্য নয়।

🍁 আমাদের এই So called সভ্য সমাজের অত্যন্ত নিচু এবং হীন মানসিকতার পরিচয় মেলে উপন্যাসটিতে। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসটির অবতারণা। লেখিকা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন যে কোন সমাজে বাস করছি আমরা? আদেও কি এই সমাজ সভ্যতার দাবি রাখে? একজন নারীর সৌন্দর্য কি শুধুমাত্র তার গায়ের রঙের মাধ্যমে বিচার করা নীতি সঙ্গত? আমরা কি আদৌ মানুষ? নাকি নরপিশাচ ? যাদের কাছে কোনো নারীর মন বা মানসিকতা নয় গায়ের রং এবং সুন্দর চেহারা প্রাধান্য পায়।

 🍁এই অসাধারণ সুন্দর বার্তাটি আমাদের সামনে উত্থাপন করার জন্য লেখিকাকে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। 

🍁 সবশেষে বলব দারুন একটি উপন্যাস পড়লাম। সকলের কাছে আমার একটি মাত্র অনুরোধ থাকবে উপন্যাসটি কে অবশ্যই একবার পড়ার জন্য। এত সুন্দর একটি উপন্যাস সত্যিই বাংলা সাহিত্য জগতে বিরল। উপন্যাসটি পড়ার পরে আমি রীতিমত লেখিকার লিখন শৈলীর প্রেমে পড়ে গেছি। এবার ওঁনার অধিরাজ সিরিজের বাকি বই গুলো অত্যন্ত আনন্দের সহিত ধীরে ধীরে পড়ে ফেলব।

 🍁এই স্বল্প পরিসরে আমার সম্পূর্ণ অনুভূতিটা ব্যক্ত করা সম্ভবপর নয়। যেটুকু পেরেছি চেষ্টা করেছি আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার।

লেখিকার কলমের দীর্ঘায়ু কামনা করি। ভালো থাকবেন লেখিকা। আমাদের আরও সুন্দর সুন্দর লেখা উপহার দিয়ে যাবেন এই কামনা করি।

বই- সর্বনাশিনী
লেখিকা- সায়ন্তনী পূততুন্ড
প্রকাশক- বিভা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ- জানুয়ারি ২০১৯
পৃষ্ঠা সংখ্যা- ৩৫২
ধরণ- থ্রিলার (অধিরাজ সিরিজ)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ