আফ্রিকার খঞ্জর - বইটি কেন পড়বেন? : আল আমিন সরল | Africar Khonjor - Why Read?

কয়েকদিন আগে এই গ্রুপে একটা জিজ্ঞাসা পোস্ট দিয়েছিলাম, 'আমার লেখা প্রথম উপন্যাস 'আফ্রিকার খঞ্জর' কে পড়েছেন?'
মাত্র দুইজন বাদে প্রায় সবাই উত্তর দিয়েছিলেন, পড়া দূরে থাক, তাঁরা বইটার নামই শুনেননি।
  • Title আফ্রিকার খঞ্জর - পাঠ প্রতিক্রিয়া !
  • Author আল আমিন সরল
  • Publisher স্বরে অ
  • Quality হার্ডকভার
  • ISBN 97898480474391
  • Edition 1st Published, 2022
  • Number of Pages 192
  • Country বাংলাদেশ
  • Language বাংলা

বিষয়টা লেখক হিসেবে আমার জন্য দুঃখের এবং কষ্টের। কেননা, প্রত্যেক লেখকই চান, তার লেখা গল্প কিংবা উপন্যাস পাঠকরা পড়ুক। না পড়লেও অন্তত নাম জানুক।

জিজ্ঞাসা প্রশ্নের উত্তরদাতাদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ পরামর্শ দিলেন, আফ্রিকার খঞ্জর উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু লিখে গ্রুপে পোস্ট করতে, যাতে করে পাঠকেরা বইটি সম্পর্কে জানতে পারেন। পরামর্শদাতাদের ধন্যবাদ।

আফ্রিকার খঞ্জর, উমাইয়া খিলাফতের আমলে আমির মুসা বিন নুসাইরের নির্দেশে তারিক বিন যিয়াদের স্পেন অভিযান ও তার যুদ্ধ জীবনের উপর ভিত্তি করে রচিত উপন্যাস। 
তারিক বিন যিয়াদ, যিনি প্রথম জীবনে ছিলেন একজন সামান্য দাস। কিন্তু নিজের শক্তিমত্তা, সাহস ও কর্মপ্রচেষ্টায় বিশাল মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি হয়ে স্পেন অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। যুদ্ধ করেছিলেন, তৎকালীন সবচেয়ে প্রতাপশালী সম্রাট রডারিকের বিরুদ্ধে।

স্পেন অভিযানের প্রেক্ষাপট, যুদ্ধকালীন সময়, তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্ব, ত্যাগ, কৌশল, স্পেনের তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা, সমস্তটাই ফুটে উঠেছে আফ্রিকার খঞ্জরে।

বলে রাখা ভাল, ইতিহাসের আশ্রয় নিয়ে রচিত হলেও, আফ্রিকার খঞ্জর ইতিহাসের বই নয়। ঘটনার পরম্পরা ঠিক রেখে লেখকের নিজের মতো করে লেখা উপন্যাস।
আবার, এটা কোন ইসলামিক উপন্যাসও নয়। যুদ্ধের দুই পক্ষের মধ্যে এক পক্ষ মুসলিম জাতি ছিলো সত্যি কিন্তু উপন্যাসে তাদের নিয়ে কোন পক্ষপাত করা হয়নি। বস্তুনিষ্ঠ ভাবে উপন্যাসের ঘটনা এগিয়ে গেছে। শেষও হয়েছে সচারাচর উপন্যাসের ধারা ঠিক রেখেই।

জানিনা, আমার এই লেখা পাঠকের মধ্যে আফ্রিকার খঞ্জর নিয়ে আগ্রহ তৈরি করবে কিনা। করলে আলহামদুলিল্লাহ। না করলে দুঃখের সাথে বলতে হবে, ভাল একটা উপন্যাস পাঠকের লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে গেল!

আফ্রিকার খঞ্জরের ফ্ল্যাপঃ

'বন্ধুরা আমার, তোমরা হচ্ছো যোদ্ধা জাতি। যুদ্ধ ছাড়া আর কোন কর্মই তোমাদের জানা নেই। মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে মায়ের কন্ঠ শোনার আগেই তোমরা অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনেছো। তোমরা হচ্ছো সেই জাতি, যাদেরকে আজ পর্যন্ত কেউ পদানত করতে পারেনি। যোদ্ধারা আমার, আজকে যুদ্ধের তৃতীয় দিন। গত দুইদিন তোমরা সাহসের সাথে লড়াই করেছো। আমি চাই তোমরা আজকে মরণপণ যুদ্ধ করো। আজকেই যুদ্ধের পরিণতি ঠিক করে দাও। সমুদ্রের ওপার থেকে যেমন করে তোমরা তেড়েফুঁড়ে এসেছো, তেমনি আজ তেড়েফুঁড়ে ঢুকে যাও প্রতিপক্ষের সৈন্যদের ভেতর। জুলফিকার হয়ে উঠুক তোমাদের প্রত্যেকের তরবারি। আজকে কোন কৌশল নয় শুধুই যুদ্ধ। মনে রেখো, তোমরা বাতিলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছো। তোমরাই বিজয়ী হবে। সবাই প্রস্তুত হও।' গলার রগ টান টান করে দুলকি চালে ঘোড়া ছোটাতে ছোটাতে চিৎকার করে বললো তারিক বিন যিয়াদ।

আফ্রিকার খঞ্জর প্রকাশ করেছে 'স্বরে-অ' প্রকাশনী।

রিভিউ - পড়ুন আফ্রিকার খঞ্জর বই

  • বই ‘আফ্রিকার খঞ্জর’
  • লেখক: আল আমিন সরল
  • প্রচ্ছদ: জান্নাতুন তূর্ণা
  • প্রকাশক: স্বরে-অ প্রকাশনী
  • মূদ্রিত মূল্য: ৪০০ টাকা।
“সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। ভূমধ্যসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝে যে ২৪ মাইলের সরু জলরাশি তার ওপর সূর্যের লালচে আলো তৈরি করেছে মনোমুগ্ধকর এক সৌন্দর্য। সেই সৌন্দর্যের কিছুটা এসে পড়েছে সিউটা দুর্গের ওপর। দুর্গের ছাদে রেশমের পোশাক পরে পায়চারি করছেন সিউটা অধিপতি কাউন্ট জুলিয়ন। মনিমুক্তা খচিত খাপবদ্ধ তলোয়ার ঝুলছে তাঁর কোমর বন্ধনীর সাথে।” এভাবেই শুরু হয়েছে আল আমিন সরলের প্রথম উপন্যাস ‘আফ্রিকার খঞ্জর’। প্রথম উপন্যাস হলেও এর পাঠ অভিজ্ঞতায় কখনোই মনে হয়নি লেখকের প্রথম উপন্যাস এটি। ভীষণ পরিণত লেখন শৈলী, পরিমিত-পরিশিলীত শব্দের ব্যবহার, বাহুল্য নেই আবার অলংকারের ঘাটতিও নেই। প্রথম রচনাতেই যে শিল্পবোধের পরিচয় সে দিয়েছে, তা মুগ্ধ করেছে আমাকে। 

এক কথায় আফ্রিকার খঞ্জরের পরিচয় হলো- স্পেন বিজয়ী বীরযোদ্ধা তারিক বিন যিয়াদের দুর্ধর্ষ যুদ্ধজীবনের আখ্যান। এক দিকে রোমান সম্রাজে্যর ক্ষমতাধর অধিপতি সম্রাট রডারিক আর অন্যদিকে মিসরের আমীর মুসার অধিনস্ত বার্বার জাতিগোষ্ঠী থেকে আগত এক সেনাপ্রধান তারিক বিন যিয়াদ। এর কাহিনী, গল্প-গঠন, কীভাবে কী হলো সে আলাপ করছি না, কারণ তা পাঠক পড়বেন। আমি শুধু এইটুকু বলে রাখি- একটা বীরগাথা যেভাবে গড়ে ওঠে, যেভাবে প্রস্ফূটিত হয় একেকটি চরিত্র, যেভাবে তৈরি করা হয় আবহ, যেভাবে বর্ণনা করলে স্পর্শ করে পাঠক মনন, আমার মনে হয়েছে তার কোথাও কোনো খামতি রাখেনি সরল। প্রথম উপন্যাসেই নিজের সর্বস্ব ঢেলে দিয়েছে। 

সাধারণত একজন লেখক পর পর বেশ কয়েকটি রচনার পর নিজেকে খুঁজে পান, ভাষাকে নিজের বশীভূত করার কৌশল রপ্ত করে নেন, কিন্তু সরল সেই কাজটির অনেকাংশই যেন সম্পন্ন করেছে তার প্রথম রচনাতেই। পাণ্ডুলিপি পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি- সমকালের নতুন-পুরনো বহু লেখকের চেয়েও শক্তিশালী তার রচনা।

সিউটা রাজে্যর অধিপতি কাউন্ট জুলিয়ন, টলোডোর আচার ব্যবসায়ী মাউলি বেকো, উজায়েল, হোরাস, সম্রাট রডারিক, সেনাপতি ক্লডিয়াস, আমির মুসা, তারিকের বন্ধু হামজা, উজায়েল প্রতিটি চরিত্র যার যার জায়গায় ভীষণ উজ্জ্বল। দাবার গুটির মতো একেকজনকে ইচ্ছেমত ব্যবহার করেছে সরল। তার কথা ও বর্ণনার মিশেলে প্রতিটি চরিত্র দারুণ প্রস্ফূটিত হয়েছে। কোনো চরিত্রই আরোপিত মনে হয়নি, বরং চোখের সামনে ঘুরে বেড়ানো চরিত্রদের মতোই জীবন্ত মনে হয়েছে। 
সরলের সংলাপ নির্মাণ এক কথায় অনবদ্য। 

এ ধরনের ঐতিহাসিক আখ্যানে সময়-কাল-সামাজিক অবস্থান বুঝে যথাযথ সংলাপ নির্মাণ খুব সহজ কাজ নয়। বর্তমান থেকে বহু বহু বছর পেছনে গিয়ে সেই সময়টাকে ধরা, সেই সময়ের মানুষের মুখের ভাষাকে বিশ্বাসযোগ্যরূপে বর্তমানের কাছে তুলে ধরার যে কঠিন কাজ, সেটাও বেশ দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করেছে সে। পুরো বইটা পড়তে গিয়ে কোনো বাক্য বা কোনো সংলাপ অপ্রয়োজনীয় বা কাঁচা হাতের মনে হয়নি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরেকটু বিস্তৃত হতে পারত বলে মনে হয়েছে। যারা আমার মতো রসিয়ে রসিয়ে-তাড়িয়ে তাড়িয়ে গল্প পড়তে পছন্দ করে, তাদের হয়তো এই জায়গাতে কিছুটা ঘাটতি মনে হতে পারে। তবে সাধারণ পাঠকের বিচারে বললে, আফ্রিকার খঞ্জরকে একটি পরিপূর্ণ উপন্যাসই বলতে হবে। 

একটি উপন্যাস স্বার্থক হওয়ার জন্য তার মধ্যে সাধারণত স্থান-কালের যথার্থ উল্লেখ, বাস্তবতার প্রতি তীক্ষ্ন দৃষ্টি, মানুষের হৃদয়ের গভীর তলদেশ স্পর্শ করার ক্ষমতা থাকতে হয়, আফ্রিকার খঞ্জরে এর সবগুলোই রয়েছে।

পাঠ অভিজ্ঞতায় যা বুঝেছি- আফ্রিকার খঞ্জর মূলত একটি বিশাল আখ্যানের প্রথম পর্ব। বিশাল কলেবরের কাহিনী পাঠের যে খায়েস তা পূর্ণ হওয়ার আগেই বইটা শেষ হয়ে গেছে। তারিক বিন যিয়াদের বীরগাথা পাঠের যে প্রস্তুতি নিয়ে বসেছিলাম, তার পূর্ণতা পাওয়ার জন্য হয়তো পরের বইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। যে অভিজ্ঞতা হয়েছে প্রথম পর্ব পাঠে, তার ওপর ভিত্তি করে এ কথা স্পষ্ট করেই বলতে পারি যে, পরের বইয়ের জন্য অত্যন্ত আনন্দচিত্তে অপেক্ষা করব। সমকালে চালু শত শত গার্বেজের ভিড়ে এমন মনিমুক্তার মতো রচনা হরহামেশা মেলে না। যদি মেলে, তাকে হেলা করতে নাই, এ কথা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।

শেষ করার আগে বইয়ের সেটআপ-গেটআপ নিয়ে দু’টি কথা বলতে চাই। যদিও এর সাথে লেখকের সম্পর্ক নেই, বরং এর দায় পুরোটাই প্রকাশকের, তবুও বইয়ের আলোচনায় কথাটা বলা উচিত বলে মনে করি। আফ্রিকার খঞ্জর বইটাকে মনে হয়েছে জোর করে চেপে ধরা হয়েছে। মানে বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা কমানোর জন্য ফন্ট ছোট করা হয়েছে যেমন, তেমনই মার্জিন এরিয়াকেও ছেটে ফেলা হয়েছে কিছুটা দৃষ্টিকটুভাবে। পড়তে খুব বেশি অসুবিধা এতে না হলেও চোখের সুখ নষ্ট করছে এটা।  

সম্ভবত বইয়ের দাম কিছুটা নাগালের মধ্যে রাখতে এই অদ্ভুত মেকাপের দিকে গিয়েছেন প্রকাশক। তারপরও বিষয়টা ভালো লাগেনি। জোর করে পৃষ্ঠা বাড়ালে যেমন চোখে লাগে, কমালেও। প্রচ্ছদ ছবিতে যেমন আকর্ষণীয় হয়েছে, মূল বইয়ে সেই সৌন্দর্যে কিছুটা ভাটা পড়েছে। হাতে গোনা দুই একটা ছাড়া মূদ্রণ প্রমাদ তেমন একটা নজরে আসনি।

শেষ করছি শেষ একটি কথা দিয়ে- কোনো লেখকের প্রথম বই পড়ে মুগ্ধ হওয়ার ঘটনা সম্ভবত আমার এই প্রথম। কেউ যদি লিখতে চায়, সে লিখুক। তবে লেখার আগে আল আমিন সরলের মতো প্রস্তুত হয়ে আসুক, প্রথম রচনাতেই রাখুক তার দক্ষতার ছাপ। লেখকের প্রথম রচনা পড়ার একটা মজা আছে। সেই মজাটা আমি নিয়মিতই পেতে চাই। যে বা যারা প্রথম লিখছেন, তাদের প্রথম বইটা সামনে এলে আমি খুব আনন্দের সাথে তা পড়ার চেষ্টা করি সব সময়। সকলের মঙ্গল হোক। বই পাঠ হোক আনন্দের।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ