আমরা ভূত কেন দেখি! - আসিফ খান

বাংলা লোকসাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে ভূত একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের সংস্কৃতিতে কিছু উল্লেখযোগ্য ভূত হলো পেত্নী, শাকচুন্নি, চোরাচুন্নি, মেছোভূত, নিশিভূত, গেছোভূত, ডাইনী, গোভূত যেগুলোর সাথে আমরা সবাই পরিচিত। পৃথিবীতে বোধহয় এমন কোনো ভাষা নেই যাতে ভূতের গল্প নেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কৌতূহলী মন জানতে চায় আসলেই কি ভূত বলে কিছু আছে?  


বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে বাস্তবে ভূত বলে কিছু নেই কারণ ভুতের অস্তিত্বের কোন প্রমাণ বিজ্ঞানীদের কাছে নেই। আমাদের আশেপাশে যেসব প্যারানরমাল ঘটনা ঘটে অথবা আমরা শুনতে পাই তার ৯৯ শতাংশ ঘটনারই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। আজ আমরা এমনি কিছু ভৌতিক অভিজ্ঞতাকে বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো। 

১) ভূত দেখা 

প্যারানরমাল হ্যালুসিনেশন হওয়ার পিছনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কার্বন মনোক্সাইডের পয়জনিং এবং প্যারাইডোলিয়াকে দায়ী করা হয়। কার্বন মনোক্সাইড আমাদের শরীরে ঢুকলে সেটি রক্তের সাথে মিশে রক্তকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে পৌঁছাতে বাঁধা প্রদান করে। যার ফলে বিষক্রিয়াতে আক্রান্ত ব্যক্তির মাথা ঘোরায়, পেট ব্যথা করে, বিভিন্ন ধরনের শব্দ শুনতে পায় এবং ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন হয়। কুকিং গ্যাস পাইপে লিকেজ, গ্যাস গিজারে ত্রুটি, হিটিং ফার্নেসে ত্রুটি, এসির ত্রুটি থাকলে ঐখানে উপস্থিত আশেপাশের মানুষের এ ধরনের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এজন্যই অনেক  পুরাতন বাড়ীতে মানুষ ভূত দেখতে পাওয়ার দাবি করে। কারণ পুরাতন বাড়িতে উপরোক্ত ত্রুটিপূর্ণ জিনিস গুলো থাকার বদৌলতে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস ছড়িয়ে থাকে। কিন্তু অনেকে হয়তো এমন কোন বাসায় ভূত দেখেছেন যেখানে এই ধরনের বিষক্রিয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। বিশ শতকের দিকে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার ভিক ট্যান্ডি রাত জেগে কাজ করার সময় তার ল্যাবে অদৃশ্য কোন কিছুর উপস্থিতি অনুভব করতো। সে ল্যাবের ভিতরে ডিপ্রেসড ফিল করতো এবং কখনো কখনো আত্মা দেখতে পেতো। একদিন সে দেখতে পেলো, তার পাশে থাকা একটি ইন্সট্রুমেন্ট খুবই দ্রুত কম্পিত হতে থাকলো। সে যখন ভাইব্রেশনের মূলে পৌঁছানোর চেষ্টা করলো তখন সে খেয়াল করলো যে ভাইব্রেশনের উৎপত্তিস্থল হচ্ছে তার নতুন লাগানো ফ্যান যেটার আশেপাশে সে আত্মা দেখার দাবি করেছিল। এবং সেই স্ট্যান্ডিং ওয়েভের কম্পাঙ্ক ছিলো ১৯ হার্জ। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ২০ হার্জের নিচের কম্পাঙ্কে আমাদের অক্ষিগোলক ভাইব্রেট করতে থাকে। তখন আমরা এমনসব জিনিস দেখি যেগুলোর অস্তিত্ব বাস্তবে নেই। এসময় আমাদের দেহে প্যারানরমাল সেনসেশন নিজ থেকেই তৈরি হতে থাকে। তাই প্যারানরমাল এক্সপেরিয়েন্স হলে ঘাবড়ে না গিয়ে আপনার বাসায় সব যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক আছে কিনা সেটি ভালো করে দেখে নিন। 
এবার চলুন দেখি অন্ধকারে মানুষ সবচেয়ে বেশি ভূত দেখার দাবি করে কেনো। আসুন আগে জেনে নেই প্যারাইডোলিয়া সম্পর্কে। এটি একটি সাইকোলজিকাল কন্ডিশন যার জন্য আমাদের মস্তিষ্ক সবকিছুতেই পরিচিত প্যাটার্ন খোঁজার চেষ্টা করে। যেটার খুবই পরিচিত উদাহরণ হচ্ছে মেঘে বিভিন্ন চেহারা দেখতে পাওয়া, বেলমেজের ভুতুড়ে মুখের ছাপ ইত্যাদি। এই ব্যাপারটা ফেসবুকের এআই তেও খেয়াল করা যায়। ফেসবুকে যদি আপনার চেহারার কাছাকাছি প্যাটার্নের চেহারার কেউ ছবি আপলোড করে তাহলে ফেসবুকের এআই আপনার কাছে নোটিফিকেশন পৌঁছে দিবে এটা উল্লেখ করে যে, আপনার ছবি কেউ অন্য প্রোফাইল থেকে পোস্ট করছে। আর হাজার বছর আগে মানুষ যখন গুহায় থাকতো তখন রাতের অন্ধকারে মানুষ সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত থাকতো কারণ তখন অন্যান্য অনেক প্রাণীই শিকারের জন্য বের হতো যারা অন্ধকারেও দেখতে পায়। তাই অন্ধকারে ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা সব মানুষের ডিএনএতেই বিদ্যমান থাকে। যখন অন্ধকার এবং প্যারাইডোলিয়া এক হয় তখন অন্ধকারে কোন কিছু না থাকলেও স্বাভাবিক জিনিসকেও আমাদের ভূত মনে হয়। 

২) স্লিপ প্যারালাইসিস 

এই ব্যাপারটি বাংলাদেশে বোবায় ধরা নামে অনেক বেশি পরিচিত। অনেকে এটাকে কাবুস নামক জীনের আক্রমণ মনে করে। কিন্তু অতি প্রচলিত জিন দ্বারা পজেসড হওয়ার বিষয়টির মত কাবুস জীনের আক্রমণের ব্যাপারটিও হাদীসে কোথাও নেই। আগে স্লিপ প্যারালাইসিসের ঘটনাটিকে বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে না পারায় একেকজন একেকরকম ব্যাখ্যা দাড় করাতো। স্লিপ প্যারালাইসিস মূলত সকালের সময় ঘুমভাঙ্গার কাছাকাছি মুহূর্তে হয়। ঐসময় মানুষ সজাগ হয় এবং চোখ এক্টিভ থাকে কিন্তু শরীর নড়াচড়া করতে অক্ষম হয়। তখন আমাদের মস্তিষ্ক ভৌতিক জিনিসপত্র হ্যালুসিনেট করতে থাকে অনেকটা বাস্তবে স্বপ্ন দেখার মতো এবং বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি নিজে থেকেই তৈরি হতে থাকে। এই কন্ডিশনটা মূলত ঘুম কম হলে, স্ট্রেস থেকে অথবা অ্যাবনরমাল স্লিপ সাইকেল থেকে ট্রিগারড হয়। এছাড়াও অনেকের নার্কোলেপসি নামক নিউরোলজিক্যাল রোগ থেকেও স্লিপ প্যারালাইসিস হতে পারে। স্লিপ প্যারালাইসিস বেশিরভাগ সময় এক থেকে দুই মিনিটের বেশি থাকে না। ঐ সময়টাতে প্যানিক না হয়ে আমাদের শান্ত থাকতে হবে। শান্ত থাকার জন্য আপনি আপনার শ্বাস-নিঃশ্বাস পর্যবেক্ষণ করতে পারেন, সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করতে পারেন অথবা দোয়া পড়তে পারেন। 

অদৃশ্য কোন শক্তিতে বিশ্বাস করা বা না করা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। অদৃশ্য কোন শক্তিতে বিশ্বাস থাকাটা সমস্যা না। আমি নিজেও জীনের অস্তিত্বে বিশ্বাস করি। কিন্তু স্বাভাবিক জিনিসকেও ভুতুড়ে মনে করে নিজের জন্য ক্ষতি ডেকে আনাটা সমস্যা। শরীরের কোনো ডিসঅর্ডারকে প্যারানরমাল মনে করে মেডিকেল ট্রিটমেন্ট পরিত্যাগ করাটা সমস্যা। আমাদের সাথে কোন প্যারানরমাল ঘটনা ঘটলে প্রথমে আমাদের সেটা ঘটার পেছনের বিজ্ঞানটা বুঝতে হবে। ক্রিটিকাল থিংকার হতে হবে। নিজের সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা রেখে সায়েন্টিফিক ট্রিটমেন্ট কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। স্পিরিচুয়াল হেল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে চোখ কান খোলা রাখতে হবে। 

পরবর্তী পর্বে আরও কিছু ঘটনার পিছনের সত্যগুলো নিয়ে কথা বলা হবে যেগুলো আমরা প্যারানরমাল মনে করি। ভালো থাকবেন।

Name: Asif Khan 
Designation : Volunteer Content writer 
Writers' Club BD

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ