বৃত্তের চারপাশে : কৌশিক জামান - কেন পড়বেন?

'একটা বিন্দু থেকে শুরু হয়ে নির্ধারিত চক্রাকার পথ ঘুরে আরেকটা বিন্দুতে এসে ফুরিয়ে গেলো— এই তো জীবন! নিয়তির কম্পাস কখনো মসৃণভাবে ঘুরছে, আবার কখনো থমকে যাচ্ছে অনিশ্চয়তায়। জীবনের বৃত্তান্ত দিতে গিয়ে তাই দুই শব্দে বলা যায়--'বৃত্তবন্দি জীবন'- কৌশিক জামান



বইঃ বৃত্তের চারপাশে
লেখকঃ Kousik Zaman
প্রকাশনীঃ পেন্ডুলাম
প্রচ্ছদঃ রাজীব দত্ত
মুদ্রিত মূল্যঃ ১৮০/-


You could hold the secrets that save
Me from myself
I could love you more than love could
All the way from hell
-Damien Rice


একটার দিকে শাটলে করে ক্যাম্পাস থেকে শহরে ফিরছিলাম। শাটলের বগিতে তুমুল স্বরে চলছে জেমসের 'আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেব, তুমি আমার!' আর ট্রেনের জানালা দিয়ে ছুটে যাচ্ছিলো চারপাশের বৃত্তবন্দী জীবনের ফ্রেম। সেই ফ্রেমে একে একে বইতে থাকে কারো জন্য এক জীবনের অপেক্ষা, বন্ধুত্বের সুখধারা, অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা আর অভিমানের নাগরিক বোঝা। এসব ভাবনার অগোচরে হাতে উঠিয়ে নিলাম একটা গাঢ় রঙের সূর্যমুখী ফুল! হ্যা, দেখতে আস্ত এক সূর্যমুখী যেন। এই শহরের প্রতিটি প্রেমিকের বুক-পকেটে এমন সূর্যমুখী লুকানো। এমন এক সূর্যমুখীর নাম 'বৃত্তের চারপাশে'। এবারের বইমেলাতে কৌশিক জামানের প্রথম নভেলা। বাষট্টি পৃষ্টার যাপিত জীবনের কথা।


পড়া শুরু করতে করতে ট্রেন ফতেয়াবাদ স্টেশনে এসে থামে, নামতে থাকে গন্তব্যের এক এক সারথি। আর আমার সম্মুখে আমি দেখতে পাই গল্পকথক তার গল্প বলে চলেছে ট্রেনের গতির সাথেই তাল মিলিয়ে। খুব ছিমছাম, জটিলতা ছাড়াই গল্প বলে চলেছেন জটিল বৃত্তের বলয়ে আবদ্ধ এক মানুষ। এই নাগরিক জীবনের বিষন্নতার গল্প। স্কুলের ভাল ছাত্রদের কাতারে থেকেও যার ছন্দপতনের শুরু। হঠাৎ করেই বুকের ভেতরের গর্ত বেরিয়ে আসে গল্পকথকের সামনে। যে গর্ত শুধু গভীরই হতে থাকে আর দূরে যেতে থাকে একে একে পরিবারের প্রিয় মানুষগুলো।


তার ভাষ্যে, 'এই দূরত্ব কিংবা বিষণ্ণতা আমার মধ্যে একটা অন্ধকার গর্তের সূচনা করলো। এই একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতার গর্তকে ভরাট করার জন্য অন্যরা কী করে জানি না, আমি যেটা করলাম সেটা হলো বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা দেয়া শুরু করলাম"।
আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকি নব্বই দশকের আমেজে ভরপুর একজন মানুষের স্মৃতিগন্ধা।


গল্পকথক বলতে থাকে তার জীবনের বয়ে যাওয়া সব স্মৃতিচিহ্নের কথা। সেই সময়গুলোতে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার, এসএমএস, হোয়্যাটস–অ্যাপের প্রত্তাপ শুরু হয়নি। পত্রমিতালিতেই বিনিময় হতো বন্ধুত্বের আদান-প্রদান। তাই এখনকার মতো এতো ঠুনকো ছিলনা সেসময়কার বন্ধুত্বের সুতো! তখন একটা চিঠি লিখে এক মাসেরও বেশি প্রতীক্ষা থাকতো উত্তরের জন্য। যেমনটি রফিক আজাদ লিখেছেন,


"এমন অনেক দিন গেছে
আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থেকেছি,
হেমন্তে পাতা-ঝরার শব্দ শুনবো ব’লে
নিঃশব্দে অপেক্ষা করেছি বনভূমিতে-
কোনো বন্ধুর জন্যে
কিংবা অন্য অনেকের জন্যে
হয়তো বা ভবিষ্যতেও অপেক্ষা করবো…
এমন অনেক দিনই তো গেছে
কারো অপেক্ষায় বাড়ি ব’সে আছি-
হয়তো কেউ বলেছিলো, “অপেক্ষা ক’রো
একসঙ্গে বেরুবো।”


গল্প শুনতে শুনতে ট্রেন এসে থামে চৌধুরীহাট স্টেশনে। পাশ থেকে আরো কিছু সারথি নামতে থাকে নিজেদের গন্তব্যে৷ আমি জানালার দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই এক অপ্সরী স্মার্টফোনের বাটনে বার্তা প্রেরণ করছে কোনো প্রিয় বন্ধুর উদ্দেশ্যে। এক সেকেন্ডের মধ্যেই তার মোবাইলের স্ক্রিন জ্বলজ্বল করে উঠে প্রিয় শব্দের মূর্ছনায়।


"If you missed the train I'm on
You will know that I am gone
You can hear the whistle blow a hundred miles".
আমি আবারো চোখ সরিয়ে আনি গল্পকথকের কাছে। স্মৃতিগন্ধা টেনে লোকটা বলতে থাকে, 'এমনও সময় গেছে এক মাসে একশোর বেশি চিঠি এসেছে, বা আমি লিখেছি। চিঠির উত্তর পেতে পেতে আগের চিঠির বক্তব্য ভুলে যেতাম। পড়াশোনা বাদ দিয়ে এসবে থাকার জন্য বাসা থেকে কথাও শুনতে হতো প্রচুর। সেসব কিছুই আমার কানে যেতনা। আমি ভেবেছিলাম এসব বাদ দিয়ে গর্তটা চাপা দেয়া সম্ভব হবে। কিন্তু বাস্তবে গর্তটা শুধুই বেড়ে যাচ্ছিলো'।


আমি কয়েকবার জানালার দিকে তাকিয়ে আবারও চোখ আনি গল্পকথকের চোখে! গল্পকথক একে একে বলে যাচ্ছে তার জীবনের মোড়গুলোর কথা। কিছু সুখে জড়ানো আর বাকিটা বিষণ্ণতায় মোড়ানো। তার আক্ষেপ ঝরে পড়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উপরে। আর যেটা বাড়তে বাড়তে গভীর হচ্ছিলো গর্ত। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যর্থতায় যেখানে সুইসাইড করে গল্পকথকের ক্লাসের একজন। হাসিখুশি ছেলেটা কীভাবে আত্মহত্যা করে? হয়তো হাসিখুশি মানুষেরাই বুকের ভেতরে সবচে বেশি অন্ধকার নিয়ে ঘোরে। কেউ কেউ ঘোরে ব্ল্যাকহোল নিয়ে! আমি মুখে নাগরিক জোকারের মতো হাসি এনে আবারও তাকায় জানালার দিকে। সে হাসির অতলে লুকিয়ে থাকে রফিক আজাদের প্রতিক্ষার মতো যন্ত্রণা! প্রিয় বন্ধুর ওয়াদা ভঙ্গ করার ব্যাথা নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি ক্যান্টনমেন্টে এসে গেছে ট্রেন। জাংশনের দেয়ালে লেখা, 'সুবোধ, কবে হবে ভোর?


একের পর এক জাংশন ছেড়ে ট্রেন ছুটে যাচ্ছে তার গন্তব্যে। আর গল্পকথক তার বুক পকেটের সূর্যমুখীটাকে আস্তে আস্তে করে সামনে মেলতে থাকে। যেখানে গল্পকথকের স্কুল, কলেজের অনেক অপ্রাপ্তি মিলিয়ে যেতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। মিলিয়ে যেতে থাকে গল্পকথকের দীর্ঘ লালিত অস্তিত্বের গর্ত। ভার্সিটি শেষে গল্পকথক একটা পত্রিকায় চাকরি নেয় যেটা মুলত মিউজিক নিয়েই কাজ করে। মিউজিক নিয়ে তার ভাবনা বদলাতে থাকে।


আন্ডারগ্রাউন্ড মিউজিক নিয়ে কাজ করার সুবাদে গল্পকথকের জীবনে আসে মনসুর নামে এক বন্ধুর প্রবেশ। অঝোর স্রোতের আশাতে তারা বুক বাঁধে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের। এই বিপ্লবের ধাক্কাতেই গল্পকথকের জীবনে আসে সবচে বড় বিপ্লবের উপাখ্যান, এই বিপ্লবের নাম আমরা দিতে পারি, 'সাবরিনা'। প্রেমের উত্থান পর্ব শুরু।


আর আমার ট্রেন এসে যায় ষোলশহর স্টেশনে। অধিকাংশ নেমে যায় ষোলশহরে। একটু পরে ট্রেন আবার চলতে শুরু করে। বগিতে কয়েকজন গলা মিলিয়ে গাইতে থাকে,
"ভাবনা নয় কোন যেতে চাই সুদূরে
তুমি আমি যাব হারিয়ে দুটি হাত বাড়িয়ে
জীবনের যা কথা কিছু নয় হতাশার
শুধু সুখ চাই আর ভালবাসা আশা হোক দুরাশা
চাই কার মন পেতে
চাই কারো সুর হতে"।


আর গল্পকথক আবার বলতে শুরু করে, যাদের জন্ম আশির দশকে, তাদের কাছে নব্বই দশকের কথা উঠলেই মনে হয় সেদিনের কথা। অথচ, পেরিয়ে গেছে চল্লিশ বছর। আর সাবরিনা! মনে হয় এইতো চার-পাঁচ বছরের কথা। অথচ পেরিয়ে গেছে এক যুগ। আমিও ট্রেনের গতিতে মন্থর হয়ে শুনতে থাকি প্রেমের উপাখ্যানের কথা। আর এক আলোক বর্ষ দূরত্ব নিয়ে অনুরণন করতে থাকি প্রিয় বন্ধুর!


একটা ঘটনার প্রেক্ষাপটে সাবরিনার সাথে গল্পকথের আলাপন। সাবরিনা সেদিন নিউজ করতে আসে সেই ঘটনার। যদিও ঘটনাটি সেদিনের মতো চাপা পরে গেলেও জীবনের সবচেয়ে বড় নিউজ চলে আসে গল্পকথকের জীবনে, সাবরিনা শিরোনামে। অদ্ভুত মায়াতে জড়ানো চোখগুলোতে কাজল ভরানো, ছোটোখাটো গড়নের প্রাণোচ্ছল এক নারী। যার প্রবেশের মধ্য দিয়ে গল্পকথকের আজন্ম অতৃপ্তি আর বিষণ্ণতার গর্ত মিলিয়ে যায়। সাবরিনার সাথে ধীরে ধীরে কাজের সুবাদে বাড়তে থাকে তার সখ্যতা। একদিন সাবরিনা একজন নামকরা ফটোগ্রাফারের ইন্টারভিউ নিতে যায়। সাথে ছিল গল্পকথক। ভাগ্যে অবিশ্বাসী গল্পকথকের সেদিন মনে হলো, এই মেয়ের পাশে যে ছেলে থাকবে সে অনেক ভাগ্যবান হবে!
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতোই মজে যায় গল্পকথকের জীবনে।


মনে হচ্ছে একজন মানুষ তার জীবনের গল্প একদম সরল ভাবে বলে যাচ্ছে। তার প্রেম আর বিষাদের যাত্রাপথের কথা। যেখানে আসছে মিউজিশিয়ান বন্ধু মনসুর থেকে শুরু করে অতলে হারিয়ে যাওয়া আরেক প্রিয়জন রেজওয়ানের গল্প। এত অতলের মাঝেও শক্ত ভাবে গেঁথে আছে সাবরিনা।


একদিন রাস্তায় রিকশাতে করে যাচ্ছিলো গল্পকথক আর সাবরিনা। দুজনের মাঝে বেশ বাকবিতন্ডা চলছিল৷ হঠাৎ দুর্ঘটনার স্বীকার হয় তারা। সাবরিনা মুহুর্তে ছিটকে পড়ে রাস্তায়। সাবরিনার রক্তে ভেসে যায় গল্পকথকের শার্ট। পাগলের মতো ছুটে হাস্পাতালে নিয়ে যায় সাবরিনাকে। কারণ, সাবরিনাকে ছাড়া গল্পকথকের জীবন যে চলবে না। এই দুর্ঘটনা যেন গল্পকথককে আরো একবার স্মরণ করিয়ে দেয় সাবরিনাকে তার জীবনে কতটা দরকার।


যদিও সাবরিনার জীবনেও কঠোর সংগ্রাম। ব্রোকেন ফ্যামিলিতে বেড়ে উঠা সাবরিনার মা সিজোফ্রেনিয়াগ্রস্ত! সাবরিনা কি পারবে জীবনের এই ঋজুতা পেরিয়ে গল্পকথকের অস্তিত্বে মিশে যেতে? বৃত্ত কি পূর্ণ হতে পারবে গল্পকথকের অস্তিত্বের গর্ত ভরিয়ে?
এই নিয়েই এগিয়ে যাবে নভেলা 'বৃত্তের চারপাশে'।


গল্পকথকের সামনে থেকে চোখ সরিয়ে দেখি আমার শাটল বটতলী স্টেশনে চলে এসেছে। গন্তব্য এসেছে। সামনে থেকে গল্পকথকের ছাঁয়া ধূসরতার সাথে মিলিয়ে যায়। আমি বৃত্তের চারপাশে বইটি হাতে নিয়ে ট্রেন থেকে নামতেই অনুভব করি গন্তব্য একটা আছে, কিন্তু যেখানে পৌঁছানোর পথ যে নেই। আজন্ম পথ বলে আমরা যা ভাবি, তা আসলে দ্বিধা! স্টেশনে নেমে হাঁটতে হাঁটতে শহরের নাগরিক ভীড়ের দিকে এগোতে থাকি। এগিয়ে যেতে যেতে চেরাগি পাহাড়ের মোড় পেরিয়ে জামালখান চত্বরের দিকে অগ্রসর হই। জামালখানের যাত্রী ছাউনির সামনে গিয়ে দেখি, নব্বই দশকের জনপ্রিয় ব্যান্ড 'ব্লু-হর্নেটের ভোকাল মনসুর। উস্কখুস্ক চেহারা আর মলিন শার্টে জীবনের পরিহাসে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বসে আছে যাত্রী ছাউনিতে। হাতগুলো কচলাতে কচলাতে গুনগুন করছে,
'বাটালী হিলের সেই বিকেল কেন আর কাছে আসেনা'।
আর আমাদের জীবন,


'একটা বিন্দু থেকে শুরু হয়ে নির্ধারিত চক্রাকার পথ ঘুরে আরেকটা বিন্দুতে এসে ফুরিয়ে গেলো— এই তো জীবন! নিয়তির কম্পাস কখনো মসৃণভাবে ঘুরছে, আবার কখনো থমকে যাচ্ছে অনিশ্চয়তায়। জীবনের বৃত্তান্ত দিতে গিয়ে তাই দুই শব্দে বলা যায়--'বৃত্তবন্দি জীবন'- কৌশিক জামান।


ডিপ্রেশনের কোনো সম্পূর্ণ সংজ্ঞা নেই, তবে অসংখ্য উদাহরণ আছে।
আমি জীবনে এমন মানুষ দেখিনি যার কখনও ডিপ্রেশন ছিল না। কিন্তু অসুখটা প্রচণ্ড পরিচিত হলেও, এর কারণ থেকে শুরু করে লক্ষণ পর্যন্ত সবই রহস্য আর বিভ্রান্তিতে ঢাকা। শুধু একটা বিষয়ে সন্দেহ নেই: ডিপ্রেশন মানে একাকীত্ব। জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করা, সবকিছু থেকে একটা সীমাহীন দূরত্ব অনুভব করা।

অ্যান্ড্রিয়া গিবসনের কবিতায় একটা লাইন আছে এমন: “শুনেছি, মাঝে মাঝে ক্ষত সারানোর একটাই উপায় থাকে—বারবার, বারবার, বারবার নিজেকে মনে করিয়ে দিতে হয়, যে আমার মতো অন্য অনেকেই এই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে নিজের বুকে।” হয়তো ডিপ্রেশনের একাকীত্ব কাটানোর এই একটাই উপায়। একাকীত্ব দিয়ে একটা সেতু গড়া, যে সেতুর নাম আর্ট, যে সেতুর নাম সাহিত্য, যে সেতু একাকীত্বকে অন্যের সাথে সংযোগ তৈরি করার একটা পথে রূপান্তরিত করে।
কৌশিক জামানের লেখা ‘বৃত্তের চারপাশে’ তেমন এক সেতু। এখানে লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের বিষণ্নতার অভিজ্ঞতা, সেই অভিজ্ঞতার শুরু এবং প্রভাব, আর একজন বিষণ্ন মানুষের চোখে পৃথিবী কেমন—এই বিষয়গুলো উঠে এসেছে। ছোট্ট বই হলেও গল্পটা পরিসরে অনেক বড়ো। একজন মানুষের জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো ধরা দিয়েছে পরিষ্কার লেখনীতে।

যা ভালো লেগেছে:

বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের মধ্যে একটা রীতি দেখি আজকাল, যেটা আমার বেশ বিরক্ত লাগে। এখনকার ‘মূলধারার সাহিত্যিক’ যারা, তারা সেসব বিষয়ে গল্প লেখেন যেগুলো নিয়ে ‘লেখা উচিৎ’। তাই যেসব বিষয়ে তাদের ধারণা সেকেন্ডহ্যান্ড, যেগুলো নিয়ে প্রত্যক্ষ কোনো অভিজ্ঞতা নেই, সেসব নিয়ে মোটা দাগের গল্প লেখা হয় বেশি। যে রাজনীতি বা হাসপাতাল ব্যবস্থা বা ব্যবসার সাথে কোনোদিন জড়িত ছিল না, সে খবরের কাগজ আর ফেসবুক স্ট্যাটাস পড়ে কাঁচা রূপকের মোড়কে গরম ইস্যুর গল্প লেখে। দেশভাগের গল্প যে লেখে, সে সময় তার বাবারও হয়তো জন্ম হয়নি।

‘বৃত্তের চারপাশে’-কে এ ধরনের লেখার বিরুদ্ধে একটা স্টেটমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা যায়। গভীর ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা এই বই। কখনও নিজস্ব অভিজ্ঞতার বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করে না। ‘জনগণের’ লেখা হবার চেষ্টা করে না। কিন্তু তাতে একদমই মনে হয় না যে লেখাটা অন্য কারও জন্য নয়। লেখকের সততা আর ভালনারেলিবিটি খুব সহজেই পাঠক বা পাঠিকাকে উপন্যাসের ভেতর টেনে নিয়ে যায়। কোনো ভণিতা নেই এখানে, ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হওয়ার কোনো জোর নেই, শুধু আছে অনাড়ম্বর বর্ণনা। কাম্যু বলেছিলেন আধুনিক সাহিত্যে, অস্তিত্ববাদী সাহিত্যে পৃথিবীর অ্যাবসার্ডিটির কোনো ব্যাখ্যা থাকা উচিৎ নয়। কারণ দর্শানো উচিৎ নয়। শুধু যা নিজে ভাবছি, যেসবের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি—সেসবের নিখাদ বর্ণনা হচ্ছে সৎ সাহিত্য তৈরি করার একমাত্র পন্থা। Just describe, don’t explain. সেদিক দিয়েও ‘বৃত্তের চারপাশে’-কে সফল বলবো।

এ ধরনের সম্পূর্ণ সততার জন্য যথেষ্ট সাহস লাগে। বিশেষ করে লেখার প্রসঙ্গ যখন এমন, যা নিয়ে লেখককে সারাজীবন কথা শুনতে হয়েছে, তখন অতিরিক্ত সাহস প্রয়োজন। ‘বৃত্তের চারপাশে’-জুড়ে এমন সাহস দেখা যায়। কোনো রাখঢাকের চেষ্টা করা হয়নি, আবার নিজেকে ভিকটিম সাজিয়ে পরিস্থিতি বা অন্যদের ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। শুধু লেখকের কাছে ডিপ্রেশন কোন রূপ ধরে এসেছে, কোথায় তার উৎপত্তি, আর কেন তার কোনো শেষ নেই—খতিয়ে দেখা হয়েছে এই বিষয়গুলো।

কৌশিক জামান হারুকি মুরাকামির ভক্ত হিসেবে পরিচিত। গভীর ভক্তি মাঝে মাঝে কাঁচা লেখার জন্ম দেয়—আমাদের দেশের অগণিত হুমায়ূন ভক্ত লেখকদের দিকে তাকালে যা বোঝা কঠিন নয়। কিন্তু কৌশিক জামান এই ফাঁদে পা দেননি বলে মনে হয়েছে আমার। মুরাকামির কোনো পরিচিত সিগনেচার তার লেখায় লক্ষ করা যায় না। যদি প্রিয় লেখকের কোনোকিছু তিনি নিয়ে থাকেন, তা হচ্ছে একাকীত্বের আবহ, সহজ ভাষায় একটানা গল্প বলে যাওয়ার দক্ষতা, আর জ্যাজের মতো গল্পের ফ্লো বিভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা।

আর শেষ একটা ব্যাপার: লেখক নিজের তারুণ্যের যে সময়ের বর্ণনা দিয়েছেন, আমার তারুণ্য তেমন পরিবেশেই কেটেছে। আন্ডারগ্রাউন্ড মিউজিক সিন, বাংলাদেশের রকস্টার—এসব নিয়ে আমার প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। তাই লেখার এই অংশটাও বেশ ভালো লেগেছে।

যা ভালো লাগেনি:
উপন্যাসে তাড়াহুড়োর একটা ছাপ লক্ষ করা যায়। তবে এই তাড়াহুড়ো লেখায় নয়, গল্প সাজানোতে। আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে আরেকটু সময় নিয়ে বইটা লেখা দরকার ছিল। একবার লিখে তারপর মাথায় কিছুদিন গল্প থিতু হতে দিলে লেখক রিরাইটিং-এর সময় বুঝতে পারতেন কাঠামোতে কোন পরিবর্তনগুলো দরকার। যেমন কিছু জায়গায় আরেকটু সময় দেওয়া দরকার ছিল—একটা গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক শেষ হওয়ার পর মাত্র এক-দুই পৃষ্ঠায় তার প্রভাবের কথা পড়লে মন ভরে না। বেশ অনেকবার চেষ্টার পর লেখক দুটো সফল ইভেন্ট করতে সক্ষম হন। সেই ইভেন্টগুলো করতে যেয়ে কী কী বাধাবিপত্তি হয়েছিল, সাফল্যের কারণগুলো কী ছিল—এগুলো জানতে বেশ আগ্রহ হচ্ছিল, কিন্তু লেখায় যথেষ্ট বিস্তৃত ভাবে এগুলো আসেনি। আর তিনি যে চিরকূটগুলোর কথা বলেছেন, সেগুলোর একটা অন্তত বইয়ে রাখলে ভালো হতো।

সব মিলিয়ে বৃত্তের চারপাশে বইটা চমৎকার লেগেছে। দুই বসায় শেষ করেছি, যেখানে আমার একটা ছোটোগল্প পড়তে আজকাল এক সপ্তাহ লাগে। যারা জীবনে কোনো একবার বিষণ্নতায় ভুগেছেন, তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য। হয়তো এখান থেকেই ক্ষত সারানোর সূচনা হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ