খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা - জন্ম ও শৈশব | সাইফুল্লাহিল মাসলুল খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রাদি.

  • বই : সাইফুল্লাহিল মাসলুল খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রাদি.
  • লেখক : ইলিয়াস আশরাফ
  • প্রকাশনী : হাসানাহ পাবলিকেশন
  • বিষয় : সাহাবীদের জীবনী
  • পৃষ্ঠা : 464, কভার : হার্ড কভার

জন্ম ও শৈশব

খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.। ৫৯৭ খ্রিষ্টাব্দে হিজরতের ২৫ বছর পূর্বে মাখজুম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ওয়ালিদ বিন মুগিরা ছিলেন কুরাইশ গোত্রের একজন সর্দার ও বদান্য ব্যক্তি। তার উপাধি ছিল ওয়াহিদ তথা অনন্য। তার মৃত্যুর পর তার সম্মানে কুরাইশবাসী তাকে এই উপাধিতে ভূষিত করে। কুরাইশের সম্ভ্রান্ত পরিবারের রীতি অনুযায়ী জন্মের কিছুদিন পর খালিদকে আরবের এক গ্রামীণ গোত্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সারাজীবন তিনি যে সুস্বাস্থ্য ও শারীরিক উপযোগিতা, সক্ষমতা উপভোগ করেছেন, তার পেছনে মরু আবহাওয়া ও উৎকৃষ্ট খাদ্য গ্রহণের ছিল বড়ো অবদান। দুধপান শেষে নিয়ম অনুযায়ী পাঁচ বছর বয়সে তিনি তার বাবা মায়ের কাছে ফিরে মক্কায় আসেন।

খালিদ বাল্যকালে একবার হালকা গুটিবসন্তে আক্রান্ত হন। তবে এটি আক্রান্ত মানুষের চেহারা-সুরত ও সৌন্দর্যে যে দাগ ও চিহ্ন এঁকে যায়, খালিদের ক্ষেত্রে সে নিজের কোনো চিহ্ন রাখতে সক্ষম হয়নি। তাই তিনি নিজের সৌম্যকান্তি ও কোমনীয় মুখশ্রী দ্বারা আরব উপদ্বীপের তরুণীদের মনে টান বা আগ্রহ সৃষ্টি করতে সক্ষম ছিলেন। খালিদ ছিলেন এক প্রভাবশালী নেতার ছেলে। তার বাবা ওয়ালিদের ছিল কুরাইশ নেতাদের মাঝে প্রচণ্ড দাপট। যার দরুন তিনি একাই একবছর কাবার পোশাক পরাতেন, আর বাকি কুরাইশরা সকলে মিলে এক বছর কাবার পোশাক পরাত। তাই তারুণ্যে পদার্পণের সাথে সাথে তার মাঝে কিছুটা অহমিকা জায়গা করে নেয়। খালিদের মায়ের নাম ছিল আসমা ও লুবাবাতুস সুগরা। তিনি ছিলেন হারিস বিন হারবের মেয়ে এবং বনি আব্বাসের প্রধান নারী উম্মে ফজল ও রাসুলে আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী মাইমুনা রা. এর বোন। রাসুলের মহিমান্বিত বংশধারা ও বনু মাখজুমের বংশধারা কুরাইশ গোত্রের পূর্বপুরুষ মুররা বিন কাব নামক পুরুষের সাথে গিয়ে এক মোহনায় মিলিত হয়।

৩. আস-সিরাতুল হাসাবিয়া, ১/৩৪৭
৪. জাওয়ামিস সিরাহ লি-ইবনি হাযম, ৩

বনু মাখজুম হলো ইসলামপূর্ব কুরাইশের সর্ব সম্মানিত দশটি উপগোত্রের একটি। এ গোত্রের ওপর যুদ্ধের সময় তাঁবু ও ঘোড়া পরিচালনার দায়িত্ব ছিল। অর্থাৎ, তারা তাঁবু তৈরি করে সেখানে বাহিনীর সরঞ্জামাদি সংরক্ষণ করত এবং যুদ্ধের ময়দানে অশ্বারোহী বাহিনীর নেতৃত্ব দিত। কুরাইশের মাঝে বনু মাখজুমের মর্যাদা ও অবস্থান স্পষ্ট করার জন্য এই একটি বিষয়ই যথেষ্ট যে, তৎকালীন কাবার চার ভাগের এক ভাগ তারা একাই বানিয়েছে; তথা রুকনে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানির মধ্যবর্তী গোটা অংশ। আর বাকিটুকু পুরো কুরাইশ মিলে বানিয়েছে।

খালিদের পিতা ওয়ালিদ পুত্রের লালন-পালনের দায়িত্ব নেন এবং তার মধ্যে আরবের যাবতীয় প্রশংসনীয় গুণাবলি বিকশিত করার জন্য নিজের ঐকান্তিক চেষ্টা ব্যয় করেন। বীরত্ব, ঘোড়সওয়ারি, দয়া, আত্মমর্যাদাবোধ, উদারতা ও বিচক্ষণতার গুণে গুনান্বিত করে তোলেন। খালিদ বাল্যকালেই অশ্বারোহণবিদ্যা আয়ত্ত করেন। অতি দ্রুত বনু মাখজুমের সেরা অশ্বারোহীদের খাতায় নাম লিখিয়ে নেন। তিনি ঘোড়া বিষয়ে এতটাই দক্ষতা অর্জন করেন যে, অনুশীলন করানোর জন্য তাকে ছোটো একটি ঘোড়া দেওয়া হতো এবং সেটাকে তিনি যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরোহণ ও যুদ্ধের উপযোগী করে তুলতে সক্ষম ছিলেন। পাশাপাশি আমরা জানি, তৎকালীন আরবে একমাত্র ঘোড়াই বাহন-জন্তু ছিল না; বরং এর সাথে মরুভূমির জাহাজ উটের ব্যবহারও ছিল ব্যাপক। আর স্বভাবতই যে ব্যক্তি অশ্বারোহণে দক্ষতা অর্জন করত, তার জন্য উট চালনা হতো আরও সহজ। সুতরাং, খালিদ বিন ওয়ালিদের নিকট তৎকালীন সকল বাহনজস্ব ব্যবহারেই ব্যাপক দক্ষতা ছিল বলে অনুমান করা যায়। এ ছাড়া অশ্বারোহণ দক্ষতার পাশাপাশি তিনি তৎকালে প্রচলিত যাবতীয় অস্ত্র ব্যবহারের সমরবিদ্যাও অর্জন করেন। দ্রুতগামী ঘোড়ার পিঠে বসে তির নিক্ষেপ করা ছিল তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। অনুরূপ দ্বন্দ্বযুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য অশ্বারোহণে বা পদাতিকরূপে উভয়ভাবে তরবারি ব্যবহারেও পটু ছিলেন।

খালিদ যৌবনে পদার্পণকালে তার উচ্চতা ছিল ছয় ফুটের চেয়েও বেশি। প্রশস্ত কাঁধ, চওড়া বুক, মজবুত বাহু, সুঠাম দেহ ও চিকন কোমরবিশিষ্ট ছিলেন। ঘন দাড়ি তার চেহারাকে আরও পৌরুষদীপ্ত করে তুলত; যেন ভয়ংকর এক সিংহ। এ রকম একজন ব্যক্তি মক্কাবাসীর নিকট প্রিয়, সম্মানিত ও মূল্যায়নের অধিকারী হবে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। খালিদের তিন ভাই ও দুই বোন ছিল। ভাইদের নাম যথাক্রমে_ (তার পিতার নামে) ওয়ালিদ, উমারা ও আবদে শামস। আর বোনেরা হলেন ফাখিতা ও ফাতিমা।

খালিদের পিতা ওয়ালিদ অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। তাই জীবিকার তাগিদে খালিদের কাজকর্মে লিপ্ত হওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। সুতরাং তিনি অশ্বারোহণ এবং যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জনে প্রবৃত্ত হন। এবং সম্পদের এই ঐশ্বর্যের কারণেই খালিদ স্বগোত্রে দানশীলতা ও উদারতার গুণে স্বনামধন্য হয়ে ওঠেন। খালিদ একাধিকবার শামে ব্যবসায়ী কাফেলার সঙ্গে সফর করেন। এই সুযোগে তিনি সেখানকার বড়ো বড়ো বাণিজ্যিক এলাকা ঘুরে দেখেন এবং সেখানে অবস্থানকারী পারসিক, রোমানীয়, নাবাতীয় ও গাসসানীয় আরবদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। খালিদের অনেক ভাই-বন্ধু ও সাথি-সঙ্গী ছিল, যারা একসাথে শিকার ও ঘোড়সওয়ারে অংশগ্রহণ করত। একসাথে কবিতাবৃত্তি ও মদপানের আসর জমাত। তার বিশেষ সঙ্গীদের মধ্যে ছিল, আমর বিন আস, আমর বিন হিশাম (আবু জাহেল) এবং তার ছেলে ইকরামা প্রমুখ।

ওয়ালিদ তার সন্তানদের শুধু অভিভাবকই ছিলেন না; বরং তাদের সামরিক প্রশিক্ষকও ছিলেন। তার কাছেই খালিদের সামরিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। মরুভূমিতে কীভাবে দ্রুত ছুটতে হয়, কীভাবে শত্রুর ঘাঁটির নিকটে গিয়ে হামলা করতে হয়, এগুলো তিনি পিতা ওয়ালিদের কাছেই শিখেছেন। অনুরূপ আকস্মিক আক্রমণ, শত্রুর উদাসীনতার সময় হামলা এবং পলায়নোন্মুখ হলে তাকে ধাওয়া করার পদ্ধতি ও কৌশলও তার কাছেই রপ্ত করেছেন।

খালিদ পরিণত বয়সে পৌঁছার সাথে সাথে তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞানে পরিণত হয় যুদ্ধ ও সমরকার্য। তার অন্তরের গভীরে সর্বদা রণবাদ্য বাজতে থাকে। এভাবে তার চিন্তা-চেতনাকে ঘিরে নেয় সমরযোগ্যতার প্রকাশ, বিজয় অর্জন হয়ে ওঠে তার একমাত্র বাসনা। আবার তার মানসিক ও শারীরিক যোগ্যতাও ছিল তার পরিপূর্ণ অনুকূলে। তুমুল যুদ্ধের ভেতর ক্ষিপ্রগতিতে প্রবেশের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকে তার হৃদয়। মানুষের মূল্যায়ন ও বিস্ময়ের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার জন্য সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে বিশাল বিজয় ছিনিয়ে আনতে হয়ে ওঠেন বদ্ধপরিকর। প্রচুর রক্তপাত, বিজয় ও রণক্ষেত্র হয়ে যায় তার একমাত্র অভিলাষ। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, তার এই অভিলাষ ও যোগ্যতার সাথে তার ভাগ্যও ছিল সুপ্রসন্ন এবং তার অনুকূলে।
৫. ইবনে হিশাম, ১/৩৬১

রাসুলে আরাবি মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর যখন ওহি অবতীর্ণ হয়, তখন খালিদের বয়স ছিল চব্বিশ বছর। সেই শুরুর সময়ে রাসুলের দলে এসে শামিল হওয়ার সৌভাগ্য তার হয়নি; বরং নতুন দ্বীনের প্রতি তার পিতা ও গোত্রের অবস্থানে থেকে শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণে অটল থাকেন। খালিদের পিতা ওয়ালিদের ইসলাম প্রত্যাহারের কারণ ছিল মিথ্যা গর্ব ও অহমিকা। তিনি প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া নিয়ে চিৎকার করে বলেছিলেন, 'নবুয়ত কেন মুহাম্মাদের ওপর আসবে, আমার ওপর কেন নয়?! অথচ আমি কুরাইশের মাঝে মর্যাদা ও বয়সে বড়ো! অনুরূপ সাকিফ গোত্রের নেতা ইবনে মাসউদও তো ছিল! আমরা যারা কিনা (মক্কা ও তায়েফের ন্যায় বৃহৎ) দুই এলাকার অত্যন্ত সম্মানের অধিকারী ব্যক্তি!'

ওয়ালিদের এই কথার পরিপ্রেক্ষিতেই তার দিকে ইঙ্গিত করে কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত নাজিল করে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وقالوا لولا تزل هذا القرآن على رجل من القريتين عظيم

‘তারা বলে, এ কুরআন দুই জনপদের (অর্থাৎ, মক্কা ও তায়েফের) কোনো এক বড়ো ব্যক্তির ওপর নাজিল হলো না কেন?' (সুরা জুখরুফ : ৩১ )

রাসুলে আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা ছেড়ে ইয়াসরিব তথা মদিনায় হিজরত করার তিন মাস পর ওয়ালিদের মৃত্যু ঘনিয়ে আসে। তখন তিনি তার ছেলেদের ডেকে এনে বলেন, 'সন্তানেরা আমার, আমি তোমাদের তিনটি বিষয়ের অসিয়ত করে যাচ্ছি, এগুলো বাস্তবায়নে তোমরা অবশ্যই যত্নবান হবে ১. (খুজায়া গোত্রের সাথে) আমার বংশীয় দ্বন্দ্ব আছে, তোমরা আমার পক্ষ থেকে এর প্রতিশোধ নেবে। আমি জানি তারা দোষী নয়, তথাপি আমার আশঙ্কা হয়, আজকের পর তোমাদের তিরস্কার করা হবে (তাই তোমরা লড়বে)। ২. সাকিফ গোত্রের সাথে আমার ভাগে সম্পদের যে মুনাফা আসবে, তোমরা তাদের থেকে তা আদায় করবে। ৩. আবু উজাইহিরের সাথে আমার কিছু বোঝাপড়া রয়ে গেছে। সে ওয়ালিদের মেয়েকে বিয়ে করেছে। কিন্তু তাকে তার বাবার বাড়িতে না পাঠিয়েই ছেড়ে দিয়েছে।'

ওয়ালিদ অসিয়ত শেষ করেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। তাকে কুরাইশের বিশিষ্ট নেতাদের ন্যায় বিশেষ শোভাযাত্রায় বিদায় দেওয়া হয়।

পিতার মৃত্যুপরবর্তী কিছু বছর খালিদ মক্কায় স্থির ও শান্তভাবে কাটিয়ে দেন। পিতা থেকে প্রাপ্ত সম্পদ নিয়ে শিষ্ট জীবনযাপন করেন। একটি বিরাট ব্যবসায়ী কাফেলার সাথে প্রথমে শাম, অতঃপর বুসরায় সফর করেন। এই বুসরাই ওই শহর, কয়েক বছর পর যেখানে তার আগমন ঘটবে বিজয়ের উদ্দেশ্যে।

৬. উল্লেখ্য, ওয়ালিদের উত্তরসূরিরা তার অসিয়ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। (সিরাতে ইবনে হিশাম, ২/৫২) ১৮ খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রা.

আর্টিকেলটি ভালো লাগলে অথবা খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা সম্পর্কে বিস্তর ভাবে জানতে অবশ্যই  আপনার প্রিয় অনলাইন শপ থেকে সাইফুল্লাহিল মাসলুল খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রাদি. বইটির অরিজিনাল কপি ক্রয় করুন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ