গভীর রাতে পাশের বাড়ি কিংবা পাশের কোন রুম থেকে রিনিঝিনি শব্দে হাসির আওয়াজ বা নুপূরের শব্দ ভেসে আসছে এই ব্যাপারটা পড়লেই আমার মাথায় ❝ভুল ভুলাইয়া❞ ছবির গানের লাইন বাজতে থাকে,
❝আমি যে তোমার... ছিনছিনছিন (নুপূরের শব্দ)
তুমি যে আমার...ছিনছিনছিন (নুপূরের শব্দ)❞
- বই: লোশক - রিভিউ + পাঠ প্রতিক্রিয়া
- লেখক: সালেহ আহমেদ মুবিন
- জনরা: ফ্যান্টাসি থ্রিলার
- প্রকাশনী: বাতিঘর প্রকাশনী
- Review Credit 💕 Rehnuma Prapty
- মূল্য : ১৫০টাকা (এই মূহূর্তে বাজারে নেই এবং আর আসবে না)
লেখাপড়ার খাতিরে ভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তাহমিদ খান উঠেছে তার দুঃসম্পর্কের এক চাচার বাসায়। উঠেই বুঝতে পারলো এ বাড়ির লোকেরা কেমন জানি। আহমেদ চাচা থাকেন তার স্ত্রী কন্যা নিয়ে। কিন্তু তাদের মুখোমুখি এখনও হয়ে ওঠা হয়নি। এদিকে আবার বাড়ির দেখভালের দায়িত্বে থাকা জলিল মিয়া শুনিয়েছে এ বাড়িতে রাতের বেলা নাকি কী কী দেখা যায়। তাহমিদ যদিও এসব গালগল্পে একেবারেই বিশ্বাস করে না। তবে রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে শুনতে পেলো রিনিঝিনি সুরেলা এক আওয়াজ। শব্দের উৎস যেখানে সেখানে আসলে কেউ থাকে না তালাবদ্ধ অবস্থায় আছে দীর্ঘদিন। তবে কি আসলেই কাউকে দেখতে পেয়েছিল এ বাড়ির লোকেরা? নাকি জলিল মিয়ার এইসব গল্প তাহমিদের মস্তিষ্কেও প্রভাব ফেলছে?
৫৬৩ খ্রিস্টপূর্বে কপিলাবস্তুর শাক্যবংশে জন্ম নেন এক রাজপুত্র। জন্মের পরেই নিজ মাতা তাকে হ*ত্যা করতে চান। পরপর কয়েকবার চেষ্টা করেন নিজেরই ঔরসজাত সন্তানকে হ*ত্যা করতে। তার ভাষ্যমতে সে কোন অ*শুভ সত্তার জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু জ্যোতিষি বলছেন তাদের এই পুত্র একদিন পরম বিখ্যাত হবে। তবে মাঝে কিছু ফাঁড়া আছে। শাক্যবংশের রাজা তবে কী করবেন? স্ত্রীর এমন আচরণের হেতু তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। পুত্রের সুরক্ষা করতে রাণীর এহেন আচরণ তিনি কীভাবে প্রতিরোধ করবেন?
কালের পরিক্রমায় শাক্যবংশের সেই রাজপুত্র হয়ে উঠলেন ❝সিদ্ধার্থ গৌতম বা গৌতম বুদ্ধ❞ নামে। জীবনের এক পর্যায়ে বেছে নিলেন সন্ন্যাস জীবন। কিন্তু কেন?
২৬৯ খ্রিস্টপূর্বে ❝চন্ডাল❞ কিংবা ❝চন্ডাশোক❞ খ্যাত মৌর্য রাজা অশোক মেতে ওঠেন এক র*ক্তের খেলায়। কলিঙ্গ জয় করতে তিনি মেতেছেন এক অসুস্থ খেলায়। রাধাগুপ্তের জাদুবিদ্যার সহায়তায় নিমিষেই বিশাল বাহিনী লন্ডভন্ড হয়ে যায়। জিতে যান অশোক। লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এই বিজয় অশোকের মনে সুখের অনুভূতি না এনে তাকে বিশাদে ভরপুর করে দেয়। নিষ্ঠুর হ*ত্যাযজ্ঞ দেখে তিনি শিউরে উঠেন। অনুতপ্ত হোন নিজের কৃতকর্মের জন্য। মুহুর্তেই ❝চন্ডাশোক❞ থেকে পরিণত হোন ❝ধর্মশোক❞ এ। স্ত্রীর কথায় বুদ্ধের আরাধনা শুরু করেন। গড়ে তোলেন অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার। আলোর পথে শুরু করেন নতুন যাত্রা। তবে আদতেই কি তা আলোর পথের যাত্রা ছিল? না কি ছিল অজান্তেই কোন অন্ধকারের সূচনা?
তাহমিদ দেখা পায় এক অনিন্দ্য সুন্দরীর। নাম অনিন্দিতা। ঘটনাক্রমে জানতে পারে সে আসলে এই জগতের বাসিন্দা নয়। আটকা পরে আছে। মুক্তির অপেক্ষায় আছে। তার দ্বারা রচিত হবে এক সাম্য। কুক্ষীবরের রাজকন্যা সে। কুক্ষীবরের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে অতি প্রাচীনকালের মানুষের ইতিহাসও। এর সাথে জড়িয়ে আছে বৌদ্ধ ধর্মের ত্রাণকর্তা গৌতম বুদ্ধ। এমনকি জড়িয়ে আছেন রাজা অশোকও। অতি প্রাচীনকালের এসব মানুষের সাথে বর্তমানে তাহমিদ, অনিন্দিতা আর এ বাড়ির যোগসূত্রটাই বা কী? জলিল মিয়া ছোটোকালে ক*বর খুঁড়তে গিয়ে কী এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিল যা তাকে আজও তাড়িয়ে বেড়ায়? অনিন্দিতার সেই ❝সর্বোবনতি❞ এর ব্যাপারটাই বা কী?
লোশক কী বা কারা? এর ইতিহাসের সাথে সম্রাট শাহজাহানের কন্যা জাহানারা, গৌতম বুদ্ধ কিংবা অনিন্দিতার যোগ কোথায়?
পাঠ প্রতিক্রিয়া:
তিনটা ভিন্ন সময়ের ঘটনায় রচিত বই ❝লোশক❞। সম্রাট অশোকের যুদ্ধ, গৌতম বুদ্ধের সময়কাল আর বর্তমানের তাহমিদের সময়। বলি বাহুল্য অসাধারণ প্লটের এক উপন্যাস লোশক। তিনটা সময়ের বর্ণনা ধারাবাহিকভাবে দিয়ে গেছেন লেখক। অতীতের ঘটনার রেশ ধরে নিয়ে গেছে সুদূর অতীতে, আবার সেই অতীত থেকেই নিয়ে এসেছেন বর্তমানে। তাহমিদের অনন্দিতাকে দেখা সেটা কি ঘোর না আসলেই সত্য, আবার আহমেদ চাচার বাড়ির চুপচাপ পরিবেশের কৌতূহল, জলিল চাচার নির্মল ব্যবহার খুব দারুণভাবে উপস্থাপন করেছেন লেখক।
সম্রাট অশোকের সেই যুদ্ধের কথা কে না জানে? সে যুদ্ধের সূচনা এবং ইতি টেনেছেন লেখক সম্পূর্ণ নিজের মতো করে। এখানে যদি সত্য খুঁজতে যাই তবে ভিন্নমতের সৃষ্টি হবে। ফ্যান্টাসি জনরা এবং ফিকশন হিসেবে পড়লে উপভোগ্য লাগবে।
গল্পের প্রয়োজনে এখানে লেখক অনেক ঐতিহাসিক চরিত্রের আগমন ঘটিয়েছেন বটে। তবে তাদের বিচরণ করিয়েছেন সম্পূর্ণ নিজের খেয়াল মতো। গৌতম বুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লেখাটা ফ্যান্টাসি কিংবা ফিকশন হিসেবে পড়াই শ্রেয় বলে মনে করি। এর সাথে বাস্তবতার মিল আনতে গেলেই গোল বাঁধবে এবং তা বেঁধেছিলও।
অনিন্দিতার ইতিহাস এবং লোশকের ইতিহাস আমার কাছে অসম্পূর্ণ মনে হয়েছে। যদিও বইটা সিরিজ হবার কথা ছিল তাতে পূর্ণতা পেতে পারতো।
বইয়ের শেষের দিকে নায়কের বেশ কিছু হিউমার এর দৃশ্য বেশ মজা লাগছিল।
এখন কিছু অসংগতির কথায় আসি,
বইয়ের পূর্বকথা অংশটুক বইয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে যথেষ্ঠ। এরপর গল্পের ধারা যেভাবে এগিয়েছে তাতে বইটাকে ভালো লাগতেই শুরু করছিল। কিন্তু মাঝে থেকে শেষে এসে আমার মনে হয়েছে লেখক তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। যৌক্তিক বর্ণনার থেকে পদার্থবিজ্ঞানের খুঁটিনাটি বর্ণনায় পৃষ্ঠা ভরিয়ে ফেলেছেন। যেটার খুব বেশি প্রয়োজন ছিল আমার মনে হয়নি। ভরশূন্য এর শুধু কনসেপ্ট পর্যন্ত থাকলেই ভালো হতো। সেখানে জলিল মিয়াকে বিজ্ঞানের জটিল এ জাতীয় বর্ণনা দিয়ে পৃষ্ঠা ভর্তির কোন মানে ছিল না।
এরপর, লেখক বইতে অন্য কিছু বইয়ের চরিত্রের নামের কথা এনেছেন। যেমন: বাপ্পী খানের অন্ধকার ট্রিলজির কথা, মুমিন নামে একজন চরিত্রের কথা (অক্টারিন বই পড়া না থাকলে এই রেফারেন্স কেউ ধরতে পারবেনা, ফলে তার কাছে এই ব্যাপার বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে। আমিও প্রথমে এই নাম বুঝতে পারিনি), সাম্ভালার মিচনারের কথা বলেছেন। এই বইগুলো কারো পড়া না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে পারার কথা না। পড়ার সময় এই ব্যাপারটা আমার ভালো লাগেনি।
শেষের দিকে লেখক অনেক বেশি তাড়াহুড়ো করে ফেলেছেন। বিজ্ঞানের অপ্রয়োজনীয় বর্ণনা, অন্য বইয়ের রেফারেন্স না টেনে চরিত্রায়নে একটু বেশি পৃষ্ঠা ব্যয় করলে বইটা বেশী উপভোগ্য হতো। রাধাগুপ্ত এবং তার সঙ্গী দুইজনের ভিলেন রোলে আরও বেশী কিছু আশা করেছিলাম। তাদের চরিত্র ঠিক ভিলেন হিসেবে খাপ খায়নি।
লেখক থেকে ভবিষ্যতে আরও ভালো বই পাবো আশা করি।
বই নিয়ে বাড়তি কিছু কথা:
২০২০ সালের মেলায় বইটি প্রথম প্রকাশ পায় এবং এর প্রায় কয়েকমাস পরে বইটি নিয়ে প্রায় তুলকালাম হয়ে যায়। বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে বইতে যেভাবে লেখা হয়েছে সেটা নিয়েই বিরোধ। হয়তো এই ঘটনা সবারই জানা তাই আমি আর পুনরাবৃত্তি করলাম না। ধর্মীয় বিষয়গুলো যদিও বেশ স্পর্শকাতর। সে হিসেবে এই বইকে ফ্যান্টাসি হরর থ্রিলার হিসেবে পড়লে আর সত্য হিসেবে না নিলেই ঝামেলা কম লাগবে মনে করি। তবে লেখকের লিখনশৈলী ভালো এবং বইটা ১২৭ পৃষ্ঠার অনেক ইতিহাসের মিশ্রণে ছোট্ট বই না হয়ে আরেকটু বেটার হতে পারতো।
লোশক ইউনিভার্সের এই বইয়ের শেষে যে ❝সর্বনাশ❞ এর কথা বলা হয়েছে তার কিছুটা ধারনা পেতে ফেসবুকেই প্রকাশিত ❝কুক্ষীবর কিংবা এক বিভ্রম❞ পড়ে নিয়েছি। এর সূচনা লোশকের চার বছর পর। আমার কাছে লোশক থেকে এই লেখাটা অপেক্ষাকৃত বেশি ভালো লেগেছে।
এবার আসি আরেকটু বাড়তি কথায়,
বইটা সম্পর্কে জেনেছিলাম গতবছরের একদম শুরুর দিক। তখনও বইটা পড়া বা সংগ্রহে রাখার জন্য খুব আগ্রহ পাইনি। জানতাম বইটা আর মার্কেটে আসবে না। হঠাৎ করেই মনে হলো বইটা আমার চাই। ভালো হোক কিংবা খারাপ এই বইটা আমার লাগবেই (যেগুলা পাওয়া যাবে না, একেবারেই নাই সেসবের প্রতি আমার অসীম আগ্রহ। সেটা ভালো-ম*ন্দ যাই হোক)। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বইয়ের নাগাল পাচ্ছিলাম না। তখন বিভিন্ন গ্রুপে বইয়ের নাম লিখে অনুসন্ধান চালানো শুরু করলাম। বইয়ের রিভিউ, কমেন্ট ঘেটে ঘেটে প্রায় ২৫-২৭ জনকে বেছে ভেতরবাক্সে টোকা দিলাম (লেখক সহ)। প্রায় বেশিরভাগের থেকেই রিপ্লাই পেলাম বই ছিল এখন নেই, থাকলেও বিক্রি করতে ইচ্ছুক নয় এই জাতীয়। প্রায় আশা ছেড়ে দিয়েছি তখন একজন রিপ্লাই দিল বই আছে সে জোগাড় করে দিতে পারবে। সময় লাগবে। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। এর মাঝেই দুই-তিনদিনের ব্যবধানে আমাকে আরও দুইজন জানালেন বই আছে এবং তারা বিক্রি করবেন না। এমনি উপহার হিসেবে নিতে চাইলে নিতে পারি। এতদিন কোথাও পাইনা এখন প্রায় তিনকপি এসে হাজির। এই বইয়ের খোঁজে আমার পরিচিত দুইজন ছিল। তাই সেই তিন কপিই নিয়ে নিই এবং একটা নিজের জন্য রেখে বাকি দুইটা তাদের জন্য সংগ্রহ করি।
বইয়ের একটা উক্তি আমার খুব ভালো লেগেছে। সেটা দিয়ে দিচ্ছি,
❝পৃথিবীতে কেউ কেউ সম্ভবত সারাজীবন অশান্তিতে থাকবার জন্যই জন্ম নেয়। এটাও হয়তো একটা সাম্য। কে জানে তার জন্য হয়তো পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তে কেউ একজন সুখী হয়েই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে।❞ PDF Download Now
0 মন্তব্যসমূহ
ℹ️ Your Opinion is very important to us, Please Writer your comment below about this Post.....