মরণ যখন আসবে : ড. আয়েয আল কারনী | Moron Jokhon Ashbe : Dr. Ayez Al Korni

  • বই : মরণ যখন আসবে
  • লেখক : ড. আয়েয আল-কারনী
  • প্রকাশনী : তাদাব্বুর পাবলিকেশন
  • বিষয় : পরকাল ও জান্নাত-জাহান্নাম
  • অনুবাদক : নাজমুল হক সাকিব
  • পৃষ্ঠা : 200
  • ভাষা : বাংলা

অন্তিম মুহূর্ত
আমাদের পূর্বসূরিরা জীবনের অন্তিম মুহূর্ত বলতে সেই মুহূর্তটিকেই বোঝাতেন যা আমরা বর্তমানে অতিবাহিত করছি। কারণ, আমরা প্রত্যেকেই মৃত্যুবরণ করব। প্রত্যেকের জন্যই একটি অন্তিম মুহূর্ত রয়েছে। আমাদের সবাইকেই সে মুহূর্তের সম্মুখীন হতে হবে। তারপর আল্লাহ আমাদের জীবনের সমাপ্তি টানবেন। আমাদেরকে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করাবেন। জগতের সকল রাজা ও প্রজা, নেতা ও অনুসারী, ধনী ও গরিব—সকলেই তার স্বাদ আস্বাদন করবে। সকলকেই সেই অনুভূতিটিকে বরণ করে নিতে হবে। কুরআন বলছে,

هل تخش منهم من أحد أو تسمع لهم ركزا

‘তুমি কি অনুভব করো তাদের কোনো অস্তিত্ব কিংবা শুনতে পাও তাদের কোনো ক্ষীণ আওয়াজ?”
এখানে আমরা তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে আলোচনা করব—
এক. কুরআনুল কারিমে মৃত্যুর আলোচনা।
দুই. পবিত্র হাদিসে মৃত্যুর আলোচনা।
তিন. মৃত্যু সম্পর্কে পূর্বসূরিদের মনোভাব ও মৃত্যু সম্পর্কে অচেতন লোকদের মানসিকতা।
১. সুরা মারইয়াম: ১৮

আমর ইবনুল আস রাযিয়াল্লাহু আনহুর নিকটে মৃত্যু উপস্থিত হলো। তাকে বলা হতো আরবের ‘উরতাবুন'। তিনি ছিলেন অসাধারণ বিচক্ষণতার অধিকারী ব্যক্তি। কিন্তু মৃত্যুর সামনে কী মূল্য আছে বিচক্ষণতার?। জগতের অলঙ্ঘনীয় এ বিধান সকল বিচক্ষণতাকে বাতিল করে দিয়েছে। সকল শক্তিকে পরাস্ত করেছে। জগতের সকল নিরাপত্তাবেষ্টনীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সে ধনীদের অট্টালিকায় অনুপ্রবেশ করেছে। আমর ইবনুল আস রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন মৃত্যুর যন্ত্রণা অনুভব করতে শুরু করলেন তখন তার প্রিয় পুত্র দুনিয়াবিমুখ ও ইবাদতগুজার সাহাবি আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আমার পিতা! আমাকে মৃত্যুর বর্ণনা দিন। আপনিই তার সঠিক বর্ণনা দিতে পারবেন। কারণ, আপনি তা আস্বাদন করে চলছেন। মৃত্যুর পেয়ালা আপনার ঠোঁট ছুঁয়েছে। মৃত্যুযন্ত্রণা আপনি অনুভব করছেন।

জবাবে তিনি বললেন, প্রিয় বৎস আমার! মনে হচ্ছে জগতের সকল পাহাড় আমার বুকের ওপর। মনে হচ্ছে, সুইয়ের ছিদ্র দিয়ে আমি নিশ্বাস ত্যাগ করছি।

বর্ণনাটি লক্ষ করুন। যেন জগতের সকল পাহাড় আমার বুকের ওপর! যেন সুইয়ের ছিদ্র দিয়ে আমি নিশ্বাস ত্যাগ করছি!

ইবনে রজব হাম্বলি রাহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেছেন, উমর ইবনুল খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু কাবুল আহবারকে বললেন, আমাকে মৃত্যুর বর্ণনা দিন।

তিনি বললেন, হে আমিরুল মুমিনিন! কাঁটাযুক্ত বরই গাছের ডাল কিংবা বাবলা গাছের ডাল দিয়ে যদি কাউকে আঘাত করা হয় আর ডালের সবগুলো কাঁটা তার শরীরের শিরায় বিদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে তার যেমন অনুভূতি হবে মৃত্যু তার চেয়েও কঠিন। মনে হয়, শরীরের সকল শিরা কাঁটাযুক্ত ডালের সাথে বাইরে বেরিয়ে আসছে।

আল্লাহ বলেন,

فلولا إذا بلغت الحلقوم (۸۳) وأنتم حينئذ تنظرون (84) و نحن أقرب

২. উন্নতাবুন একজন রোমান সেনানায়কের উপাধি। শব্দটির মৌলিক অর্থ কোনো ভাষার অভিধান থেকেই উদ্ধার করা যায়নি। তবে মেধা, বীরত্ব ও দক্ষতার কারণে সেই সেনাপতিকে এ নামে ডাকা হতো। নামটি প্রসিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় তা সাহসী ও মেধাবী ব্যক্তির জন্য উপমা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আমর ইবনুল আস রাযিয়াল্লাহু আনহুকেও তার সামরিক দক্ষতা ও বীরত্বের কারণে এ নামে ডাকা হতো। অনুবাদক। ১২ মরণ যখন আসবে।

إليه منكم ولكن لا تبصرون (85) فلولا إن كنتم غير مدينين (86)

ترجعونها إن كنتم صدقين

“সুতরাং কেন নয় যখন মৃত্যু তার কণ্ঠদেশে পৌঁছে যায়। আর তোমরা শুধু তা চেয়ে চেয়ে দেখো। আর আমি তখন তোমাদের চাইতে তার বেশি নিকটে থাকি। কিন্তু তোমরা তা দেখতে পাও না। যদি তোমাদের (দাবি অনুযায়ী আখেরাতে কাউকে) প্রতিদান না দেওয়া হয় তবে তোমরা তাকে পুনরায় ফিরিয়ে আনো, যদি তোমরা তোমাদের দাবিতে সত্যবাদী হয়ে থাকো।

এ এক কঠিন পরিস্থিতি। এক ভয়ংকর দৃশ্য। জগতের প্রতিটি মানুষকেই যে পরিস্থির সম্মুখীন হতে হবে। প্রত্যেককেই এ অবস্থা বরণ করে নিতে হবে। আল্লাহ বলেন,

كل من عليها فان (36) ويبقى وجه ربك ذوالجلل و الاكرام

“জগতে যা কিছু রয়েছে সবই ধ্বংসশীল। শুধু অবশিষ্ট থাকবে মহত্ত্ব ও সম্মানের অধিকারী আপনার প্রতিপালকের সত্তা।"

এজন্যই হাসান বসরি রাহিমাহুল্লাহ তার সন্তান ও শিষ্যদের উপদেশ দিয়ে বলতেন, মৃত্যু দুনিয়ার বাস্তবতাকে প্রকাশ করে দিয়েছে। জ্ঞানী লোকের জন্য সে এখানে কোনো আনন্দই অবশিষ্ট রাখেনি।

জ্ঞানীরা বলেছেন, ডাক্তাররা মৃত্যুর ঔষধ বানাতে অক্ষম হয়ে গেছে।

লোকেরা রুগিদের সেবা করতে এসেছে। অবশেষে তারাও মরে গেছে। রুগিরাও মরে গেছে।

রুবাই ইবনে খাইসামের জীবনীতে লেখা হয়েছে, তিনি একবার অসুস্থ হলেন। লোকেরা বলল, আমরা কি আপনার জন্য ডাক্তার ডাকব?। তিনি বললেন, বিষয়টি নিয়ে আমিও চিন্তা করেছিলাম এবং ডাক্তার ডাকার ইচ্ছেও করেছিলাম। কিন্তু আরেকটু ভেবে দেখলাম যে, ডাক্তার ও রুগি উভয়েই মরে যাবে।

৩. সুরা ওয়াকিয়া : ৮৩-৮৬ ৪. সুরা রহমান : ২৬-২৭।
মরণ যখন আসবে।

হায়! আদ জাতি ও সামুদ জাতির চিকিৎসা করতে মহান দুজন চিকিৎসক এসেছিলেন। কিন্তু অবশেষে রুগিরাও মরে গেল। চিকিৎসকরাও মরে গেলেন। সেবকও মরে গেল। সেবাগ্রহীতারাও মরে গেল।

আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর জীবনীতে বিশুদ্ধ সূত্রে উল্লেখ রয়েছে যে, তিনি মৃত্যুশয্যায় ছিলেন। লোকেরা তার নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুলের খলিফা! আমরা কি আপনার জন্য ডাক্তার ডাকতে পারি?। তিনি বললেন, ডাক্তার আমাকে দেখেছে। তারা বলল, ডাক্তার কী বলল?। তিনি বললেন, ডাক্তার বললেন যে, আমি যা ইচ্ছে করি তা করতে পারি।

ডাক্তারকে আমি কীভাবে বোঝাই, কী আমার রোগ?! রোগ যে পেয়েছে আমায় ডাক্তার থেকেই।

আল্লাহ বলেন,

كل نفس ذائقة الموت

‘প্রতিটি প্রাণই মৃত্যুকে আস্বাদনকারী।”

আল্লাহ আরও বলেন,

إنك ميت وإنهم ميتون

‘নিশ্চয় আপনি মৃত্যুবরণ করবেন এবং তারাও মৃত্যুবরণ করবে।”

এসব আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জেনে ফেললেন যে, তিনি অচিরেই মৃত্যুবরণ করবেন। ফলে তিনি তখন থেকেই সেই সময়ের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। সেই পরিস্থিতির জন্য নিজেকে তৈরি রেখেছিলেন।

আবু দারদা রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন মৃত্যুশয্যায় ছিলেন তখন তিনি বললেন, এই পরিস্থিতিতেও কাজে আসে এমন কেউ আছে কি পৃথিবীতে?! এই পরিস্থিতিতেও কাজে আসে এমন কেউ আছে কি পৃথিবীতে?! এই পরিস্থিতিতেও কাজে আসে এমন কেউ আছে কি পৃথিবীতে?!

৫. সুরা আলে ইমরান : ১৮৫।
৬. সুরা যুমার : ৩০। ১৪ মরণ যখন আসবে।

কুরআনুল কারিমে আল্লাহ বারবার আমাদেরকে মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,

واتقوا يوما ترجعون فيه إلى الله ثم توفى كل نفس ما كسبت وهم لا يظلمون

“আর তোমরা ভয় করো সেই দিনকে যেদিন তোমরা আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে। অতঃপর প্রতিটি প্রাণকে পরিপূর্ণরূপে বুঝিয়ে দেওয়া হবে তার প্রতিদান, যা সে উপার্জন করেছে। আর তাদের ওপর কোনো অবিচার করা হবে না।"

আল্লাহ আরও বলেন,

حتى إذا جاء أحدكم الموت توفته رسلنا وهم لا يفرطون (61) ثم ردوا

إلى الله مؤليهم الحق الا له الحكم وهو اسرع الحسبين

*এক পর্যায়ে যখন তোমাদের কারও সামনে মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন আমার প্রতিনিধি ফেরেশতারা তাকে মৃত্যু দান করে আর তাদের ওপর কোনো অবিচার করা হয় না। তারপর তাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হয় তাদের প্রকৃত অভিভাবক আল্লাহর নিকটে। শোনো, তারই জন্য রয়েছে হুকুম করার অধিকার। আর তিনি অতি দ্রুত হিসেব গ্রহণকারী।”

আল্লাহ আরও বলেন,

ولقد خلقنا الإنسان و تعلم ما توسوس به نفسه و نحن أقرب إليه من حبل الوريد (16) إذ يتلقى المتلقين عن اليمين وعن الشمال قعيد (17) ما يلفظ من قول إلا لديه رقيب عتيد (۱۸) وجاءت سكرة الموت بالحق ذلك ما كنت منه تجيد (19) و نفخ في الصور ذلك يوم الوعيد (30) وجاءت كل نفس معها سائق وشهيد (21) لقد كنت في غفل من هذا فكشفنا عنك غطاءك فبصرك اليوم حديد

اد : 10 10 4 دید : - " .
মরণ যখন আসবে ১৫

“আর আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে এবং আমিই সম্যক অবগত তার মনের কুমন্ত্রণা সম্পর্কে। কারণ, আমি তার গ্রীবাবস্থিত ধর্মনির চেয়েও নিকটে। স্মরণ করো সেই সময়কে যখন দুই ফেরেশতা তার ডানে ও বামে বসে তার কর্মকে লিপিবদ্ধ করে। সে যে কথাই উচ্চারণ করে সে কথার জন্যই রয়েছে একজন সদা প্রস্তুত প্রহরী। আর এসেছে মৃত্যুযন্ত্রণা অবশ্যম্ভাবী। এটাই সেই বস্তু যা থেকে তুমি পালিয়ে বেড়াতে। আর ফুঁক দেওয়া হবে শিঙ্গায়। সেটিই হবে প্রতিশ্রুত দিবস। সেদিন প্রতিটি প্রাণই উপস্থিত হবে। আর তার সাথে থাকবে তাকে পরিচালনাকারী ও সাক্ষী। (আর তাকে বলা হবে) তুমি তো ছিলে এ বিষয়ে বেখবর। আজ আমি তোমার ওপর থেকে উঠিয়ে দিয়েছি পর্দা। তাই তোমার দৃষ্টি আজ তীক্ষ্ণ।*

ইমাম তিরমিযি বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেন যে, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

বলেছেন,

أكثروا ذكر هاذم اللذات

‘তোমরা সমস্ত স্বাদকে বিনষ্টকারী বস্তুকে বেশি বেশি স্মরণ করো। ১০

অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে,

فما ذكر في قليل الا كثره ولا كثير الا قلله

'কম বস্তুর মাঝে তাকে স্মরণ করা হলে তা বেশি হয়ে যায়। বেশি বস্তুর মাঝে তাকে স্মরণ করা হলে তা কম হয়ে যায়। ১১

সকল কিছুর স্বাদকে বিনষ্টকারী হলো মৃত্যু, যা দলকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পুরুষ ও নারী কেউই তার হাত থেকে রেহাই পায় না। যা আচমকা আসে এবং মানুষকে আলোকিত প্রশস্ত জগৎ থেকে অন্ধকার সংকীর্ণ একটি গুহায় নিয়ে যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ