বই মসলার যুদ্ধ : লেখক সত্যেন সেন - কেন পড়বেন? | Moshlar Juddho Boi PDF

বই: মসলার যুদ্ধ
লেখক: সত্যেন সেন
প্রকাশক: দ্যু প্রকাশন
মুদ্রিত মূল্য: ১৫০/=
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৯৬

মসলা! খাবার নয়, খাবারের স্বাদবর্ধক মাত্র। মুখরোচক আর বৈচিত্র্যময় খাবার প্রস্তুতে যার বিকল্প নেই। কখনও আবার ব্যবহার হয় ভেষজ চিকিৎসা বা রূপচর্চায়। এই বহুরূপী মসলার রয়েছে এক রক্তক্ষয়ী ইতিহাস! ক্ষমতার পালাবদল, ধর্মবিদ্বেষ আর মুনাফালোভী বিদেশী ঔপনিবেশকদের সীমাহীন অত্যাচারে রচিত এক করুণ অধ্যায়!

বই মসলার যুদ্ধ : লেখক সত্যেন সেন


তৎকালীন ভারতবর্ষের মালাবার উপকূলের কালকিট বন্দরের খ্যাতি প্রায় পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল মসলার সুবাদে। সেখানে তখন একচ্ছত্র অাধিপত্য ছিল আরবদের। আর ওদিকে পর্তুগীজরা চাইছিল এই চাবিকাঠি নিজেদের হাতের মুঠোয় পুরতে। তাই উঠেপড়ে লেগেছে ভারতবর্ষে আসার পথ আবিষ্কারে। গুপ্তচরবৃত্তি করে ধূলো দিয়েছে সেখানকার শাসক আর সাধারণ মানুষের চোখে। ধর্মকে পুঁজি করে ছড়িয়েছে বিদ্বেষ। ছলে, বলে, কৌশলে বারবার হানা দিয়েছে। আরব বণিকদের হটিয়ে শীর্ষস্থান দখল করার জন্য এমন কোনো হঠকারী পথ নেই, যা তারা অবলম্বন করেনি। আর সবশেষে নিজেদের আখের গোছাতেই তাদের মনোযোগ ছিল বেশি।

পর্তুগীজদের এই সাফল্য আর বাজারে একচেটিয়া ব্যবসা কেউ ভালো চোখে দেখেনি। তাদের হটিয়ে এল ডাচরা। এবার তারা একেবারে মসলার স্বর্গভূমি ইন্দোনেশিয়ায় শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসল। ব্যবসায়ী থেকে হয়ে গেল প্রভু। এরপর জল গড়িয়ে বহুদূর। এলো ইংরেজরা। এর পরের ইতিহাস তো সবার জানা! মসলাকান্ড হার মানাল লঙ্কাকান্ডকেও। বদলে গেল মানচিত্র, ক্ষমতার দাবিদার আর ইতিহাস!

'মসলার যুদ্ধ বইটা নিয়ে এত এত আলোচনা দেখেছি যে লোভ সংবরণ করা দায় হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর এবারের বইমেলা থেকে সংগ্রহ করলাম। ছোট্ট একটা তথ্যে পরিপূর্ণ বই। কিন্তু এত চমকপ্রদভাবে লেখা হয়েছে যে ইতিহাসের চেয়ে রূপকথা বলেই মনে হবে বেশি। কোনো একঘেয়েমি পেয়ে বসা ছাড়াই পড়ে গেছি মন্ত্রমুগ্ধের মত। বারবার অবাক হয়েছি মসলাকে ঘিরে এত এত বিচিত্র ঘটনা আর ক্ষমতার পালাবদল দেখে।


একদিকে ধর্মকে আশ্রয় করে ব্যবসা বিস্তারের চক্রান্ত অন্যদিকে নিজভূমিতে দাসে পরিণত হওয়া মানুষদের করুণ ইতিহাস। উপলক্ষ্য সামান্য মসলা! অবশ্য সামান্যই বা বলছি কেন? মসলা তখন ছিল স্বর্ণের চেয়ে দামী। মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা একচেটিয়া ব্যবসা করেও লালসা মেটাতে পারেনি। ফলে বারবার হয়েছে সংঘাত, কখনো কামানের বিপরীতে স্রেফ ঢাল-তলোয়ার দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছে, আবার কখনও বিশ্বাসঘাতকের বিষাক্ত ছোবলে প্রতিরোধ ভেঙে পড়েছে।


এতদিনের চেনা ইতিহাস একেবারে উল্টে গেছে মসলার যুদ্ধ পড়ার পর। ভারতবর্ষের আবিষ্কারক খ্যাত ভাস্কো-ডা-গামার স্বরূপ উন্মোচন হয়েছে দস্যু, ধর্মবিদ্বেষী আর ক্ষমতালোভী হিসেবে!


বিচিত্র পৃথিবীতে কত বিচিত্র ঘটনা ঘটে! মসলার যুদ্ধও তেমনি এক অভিনব যুদ্ধ। যার সাথে জড়িয়ে আছে ক্ষমতা, লালসা আর রক্তের গন্ধ!


চমৎকার পেপারব্যাক বইটির প্রচ্ছদ বেশ সুন্দর। পাতাগুলোও ঝকঝকে। তবে ৮৩ পৃষ্ঠার লেখা ৮৪ পৃষ্ঠায় রিপিট হয়েছে। এছাড়া আর তেমন কোনো অসঙ্গতি চোখে পড়েনি।

মসলার যুদ্ধের রঙ্গমঞ্চে আপনাকে স্বাগতম!

রিভিউ ২

    বইঃ মসলার যুদ্ধ
                    লেখকঃ সত্যেন সেন

মসলার ঘ্রাণ শুধু খাবার স্বাদই পাল্টায় না। একদা এই মসলার ঘ্রাণ ইতিহাস রাজনীতিরও পট পরিবর্তন করে দিয়েছিলো। মসলার ঘ্রাণেই উন্মাদ হয়ে প্রথম ইউরোপীয়রা ভারতে প্রবেশ করেছিল। এই এক মসলার বাণিজ্যর জন্য কতো না পরিকল্পনা, ছল চাতুরি, আর কতোই না রক্ত ভেসেছে সমুদ্রের জলে। তারই ইতিহাস নিয়ে রচনা করেছেন সত্যেন সেন "মসলার যুদ্ধ" নামক গ্রন্থ। 

লেখক সত্যেন সেন সম্পর্কে একটু কথা বলা যাক। সত্যেন সেন ছিলেন একইসাথে একজন লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠক। একজন আজীবন বিপ্লবী নেতা সত্যেন সেন। ব্রটিশ শাসনামল থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমলেও বিভিন্ন সময়ে থাকে দেশে বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছে। তিনি বেশিরভাগ বইই রচনা করেছেন কারাগারে বন্দী অবস্থায়। মসলার যুদ্ধ বইটির সে সময়ের একটা বই। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। 

মসলার যুদ্ধ বইটি লেখক শুরু করেন ১৪৮৮ সালের দক্ষিণ ভারতের কালিকট নামক রাজ্যের বন্দর থেকে। কালিকট রাজ্যের বন্দর ছিল তৎকালীন সময়ে বাণিজ্যর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান। কালিকটে উৎপন্ন গোল মরিচসহ, পুর্ব ভারতের দ্বীপপুঞ্জে উৎপাদিত লবঙ্গ, দারুচিনি, এলাচ এসব মসলা বণিকেরা কালিকট বন্দরে এনে বেচাকেনা করতো। তারপর তা পৌঁছে যেতো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। রাজা জামোরিনের আমল তখন। তার রাজ্যে সকলেই বাণিজ্য করার অনুমতি পেয়েছিল। তবে মসলার বাণিজ্যে আরব বণিকদের প্রভাব প্রতিপত্তি তখন সবচেয়ে বেশি। তারাই ইউরোপীয় বন্দরে বন্দরে মসলার বাণিজ্য করতো।



ইউরোপীয় বণিকেরা মসলার ঘ্রাণে নানা কল্পনাজল্পনা করতে থাকে। তারাও চায় মসলার রাজ্য ভারত থেকে মসলা নিয়ে বাণিজ্য করতে। পর্তুগীজরা ১৪৯৭ সালে আটলান্টিক মহাসাগর ঘুরে ভারতে এসে প্রবেশ করে‌। সেই নৌবহরের নেতৃত্বে ছিলেন নাবিক ভাস্কো দা গামা। কিন্তু তারা অন্যান্য বণিকদের মতো শুধু বাণিজ্য করতে আসেনি তারা সাথে করে নিয়ে এসেছিল কামান। সমুদ্রে দস্যুতা চালিয়েছিল। হজ্ব ফেরত মুসলমানদের জাহাজে তার পুড়িয়ে মারে। ক্রুসেড পরবর্তী সময়কাল তখন। মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে খ্রিস্টান পর্তুগীজরা ভারতে প্রবেশ করে। তাদের ধারণা ছিল এখানেও খ্রিস্টান লোকজন বসবাস করে। স্বাভাবিক ভাবেই আরব বণিকদের তারা ভালোভাবে নেয় নি। কালিকট রাজা তাদের বিতারণ করার ব্যবস্থা করেন কয়েকবার প্রতিহত করার পরেও শেষ পর্যন্ত সেই অগ্নেয়াস্ত্রের মুখে প্রতিরোধ ঠেকানো যায় নি। শুধু কি অগ্নেয়াস্ত্রের জোরে তারা প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিলো? না তা নয়। ‌প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর থেকে কালিকট রাজা সম্মিলিত সাহায্য পান নি। মসলার বাণিজ্যে মিশর সবচেয়ে বেশি লাভবান হতো। কিন্তু তারাও হাল ছেড়ে দিয়েছিলো। পরবর্তীতে অবশ্য তাদেরকেও এর ফলাফল ভোগ করতে হয়েছিল। 

পর্তুগীজদের মসলার বাণিজ্যে আর শেষ পর্যন্ত কোন বাধা রইলো না। তারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এখানে। কয়েকদশক ধাপিয়ে মসলার বাণিজ্য আর লুটতরাজ চালিয়ে যায় এরা। কিন্তু পুর্তুগীজরা একা একা মুনাফা লুটবে অন্য ইউরোপীয় জাতিরা তো আর বসে থাকবে না। তারাও তো ভারতবর্ষের সম্পদের প্রাচুর্য নিয়ে নানা গল্প শোনে আসছে। কিন্তু চাইলেই তো আর হয় না। পর্তুগীজদের গোপন সমুদ্র পথ তারা গোপনেই রেখেছিল। 

কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডাচরাও একসময় এসে পৌঁছায় ভারতবর্ষে। তারা এসে আর বাণিজ্য নয় সরাসরি মসলা উৎপাদনে হাত দিতে শুরু করে। মালয় দ্বীপপুঞ্জে চাষিদের দাদন দিয়ে জমি করায়ত্ত করে তাদেরকে সর্বশান্ত কুলি মজুরে পরিণত করে। এর মধ্য দিয়েই শুরু হয় তাদের ঔপনিবেশিক শাসন। তারপর আসে ইংরেজরা। এভাবে শুরু হয় ভারতবর্ষের এক নতুন অধ্যায়ের। ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার পথ শুরু হয়েছিল এই মসলার ঘ্রাণেই। 

৬৭ পৃষ্ঠার ছোট্ট এই গ্রন্থটি ঐতিহাসিক তথ্যে ঠাসা। অথচ পড়তে গিয়ে একবারও হোঁচট খেতে হয় না পাঠককে। বরং একটা উত্তেজনা কাজ করে পরে কি ঘটছে জানার জন্য। অনেক অজানা তথ্যসহ ইউরোপীয় বণিকদের একটা অন্যরূপ লেখক উন্মোচন করেছেন বইটিতে। 

অনেকদিন থেকে বইটা পড়ার লিস্টে ছিল কিন্তু পড়া হয়ে উঠছিল না। সেদিন তন্ময়ের রিভিউ দেখে বইটা পড়তে শুরু করি। যখন শুরু করলাম দেখি মাত্র ৬৭ পৃষ্ঠার ছোট্ট একটা বই। মাত্র দুবার বসে বইটা শেষ করেছি। ননফিকশন হলেও পড়ার গতি থামে না এই বইটাতে। লেখকের লেখনী চমৎকার বলতেই হবে। 

সবার বই পড়াকে শুভকামনা জানিয়ে শেষ করছি। যাদের আগ্রহ হবে অবশ্যই বইটা পড়ে দেখবেন।

Moshlar Juddho Boi PDF Download Link

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ