বই : পাতাং - লেখক : ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় | Patang : Bhaskar Chattopadhyay

  • বই : পাতাং  - পাঠ প্রতিক্রিয়া
  • লেখক : ভাস্কর চট্টোপাধ্যায়
  • জনরা : ক্রাইম থ্রিলার, পুলিশ প্রসিডিওরাল
  • প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০২০
  • অনুবাদক : শাহরিয়ার সৈকত
  • প্রচ্ছদ : আদনান আহমেদ রিজন
  • প্রকাশনা : আদী প্রকাশন
  • মুদ্রিত মূল্য : ৩০০ টাকা মাত্র
  • রেটিং: ★★★☆☆
  • পৃষ্ঠা : ২২১
  • Review Credit 💕 Peal Roy Partha
▌গোত্তা খাওয়া ❛পাতাং❜
হিন্দিতে পাতাং আর বাংলায় ঘুড়ি। নীল আকাশে উড়তে থাকা ঘুড়ি দেখতে সব সময় সুন্দর। বইয়ের পাতায় সেই সৌন্দর্য কতটা শোভাবর্ধন করেছে সেটা জেনে নেওয়া যাক।


মুম্বাই শহরে টানা বর্ষণে জনজীবন যখন অতিষ্ঠ তখনই বিভিন্ন সংবাদ চ্যানেল এমনকি পুলিশ স্টেশনে উড়ে এসে জুড়ে বসে একই ঢঙের কিছু উড়োচিঠি। সেই চিঠিতে লেখা একটি ধাঁধা। যেখানে পরবর্তী খুন কোথায় হবে তার নির্দেশনা দেওয়া! প্রথম খুন হয়েছে খুবই অদ্ভুত আর ভয়ানক ভাবে। সুউচ্চ স্থানে ঘুড়ির মতো আকার দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে ভিকটিমকে। পরপর আরও দুটো খুন হতে-ই টনক নড়ে পুরো শহরের মানুষের। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে বাকি সবাই হাত ধুয়ে এই খুনের পেছনে পড়ে। কিন্তু কোনো সমাপ্তির রেখা তারা খুঁজে পায় না। অবশেষে উপায় না পেয়ে ভাড়াটে এক প্রাইভেট ডিটেকটিভকে ডাক দেয় পুলিশ কমিশনার। আদেশ দেয়—ডিএসপির সাথে মিলে এই রহস্যের সমাধান করতে। অতঃপর সেই দুঁদে গোয়েন্দা চন্দ্রকান্ত রাঠোর নেমে পরে তার মগজাস্ত্র ব্যবহারে। পাগলাটে এক তুখোড় খুনির সাথে এই মনস্তাত্ত্বিক খেলাটা যে জমজমাট হতে চলেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শেষ পর্যন্ত এই খেলায় কে জিতে—ইঁদুর না বিড়াল? আর এখানে ইঁদুর বা বিড়াল কে?

❛পাতাং❜ গতানুগতিক ধারার বাইরে দুর্দান্ত একটি মনস্তাত্ত্বিক পুলিশ প্রসিডিওরাল থ্রিলার হতে হতে যেন হয়নি। শেষে এসে সেই একই গতানুগতিক ধারার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। টুইস্ট বা টার্নের কোনো কমতি উক্ত উপন্যাসে ছিল না। একেবারে বইয়ের শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পাঠক সত্তা হুকড করে চমকে দেওয়ার সব রকম উপকরণ থাকলেও; শুরু থেকে পুরো কাহিনিটি কেমন যেন অগোছালো আর তাড়াহুড়ো করে শেষ করার একটা তাগিদ ছিল। যেন কোনো সিনেমা সিন বাই সিন মগজে ঝেঁকে বসার আগে কাট কাট করে কেটে চলে যাচ্ছে। কাহিনির গভীরতায় ডুব দেওয়ার সুযোগ খুবই কম পেয়েছি। তেমনই বইয়ের চরিত্রদের সাথে কানেক্ট হওয়ারও।

লেখকের লিখনপদ্ধতিতে সিনেম্যাটিক একটা ভাব সর্বদা প্রকাশ পেয়েছে। পারিপার্শ্বিক আবহ নিয়ে শুধু ধারণা আর সংলাপের ওপর ভর করে পুরো উপন্যাস সাজানো। মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো থাকলেও—যদিও সেটা অল্প; তাও খুব একটা মনে দাগ কেটে যেতে সক্ষম হয়নি। শুরু থেকে একটা অনীহা কাজ করে। হয়তো এই সমস্যাটা শুধু আমার ক্ষেত্রে হয়েছে। যারা পেজ টার্নারের সাথে পুলিশ প্রসিডিওরাল ও মনস্তাত্ত্বিক খেলার মিশ্রণ পড়তে পছন্দ করেন—তাদের কাছে বইটি হয়তো ভালো লাগবে।

বইটি মনঃপূত না হওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে অনুবাদ। অনুবাদের মান জুতসই লাগেনি। সম্পাদনার অভাব ভীষণ বোধ করেছি। সঠিক শব্দের ব্যবহার, বাক্যের অসামঞ্জস্য, বানান ও ব্যাকরণের ভুল মিলিয়ে অনুবাদের কারণে বইটির স্বাদ অনেকটা ম্রিয়মাণ মনে হলো। ৬৬ পৃষ্ঠায় শুরুতে রাঠোর মেয়েটিকে ‘অনন্যা’ বলে সম্বোধন করে অথচ তখনও সে জানত না মেয়েটির নাম অনন্যা! এর কিছুক্ষণ পরে মেয়েটি নিজের পরিচয়ে বলে,

‘বাই দ্য ওয়ে। আমার নাম অনন্যা। অনন্যা ব্যানার্জি।’

এখানে লেখক কি আমার সাথে সাইকোলজিক্যাল গেম খেলল; না অনুবাদক—জানি না। মূল বইয়ে কী লেখা আছে সেটা দেখার প্রয়োজন বোধ করলে অনুবাদ হাতে তুলে নিতাম না।

৭১ পৃষ্ঠায় একটা সংলাপে এক বৃদ্ধা রাঠোরকে যখন নিজের পরিচয়ে দিচ্ছে সেখানে লেখা ছিল—

‘... মানুষজন ছিল পরোপকারী, একে অন্যের দিকে সবাই খেয়াল রাখতো , সবাই একে অপরকে সম্মান করতো , আর আমরা... আমরা একটু বাড়তি সম্মান পেতাম, আমার মনে হয় শিক্ষক ছিলাম বলেই সবাই একটু বেশি সম্মান করতো। বুঝতেই পারছ আমরা সবসময়ই ফ্রাঙ্ক আর আমি আমরা আজীবন শিক্ষকতা করে কাটিয়েছি, আমাদের ছাত্ররা আমাদের ভালোবাসতো , তাদের মাতা পিতারা আমাদের ভালোবাসত, সবাই আমাদের ভালোবাসতো।
──
এই সংলাপে একটু চোখ বুলিয়ে দেখেন ঠিক কোথায় কোথায় ভুল আছে। আর সেগুলো কী কী। এমনকি উক্তি শেষ করে যে ইনভার্টেট কমাও দিবে সেটাও নেই। আর দাঁড়ি-কমার কথা আর বাক্যের সঠিক গঠনের কথা ছেড়ে দিলাম। নামের ওলটপালট তো আছেই। বৃদ্ধ হয়ে যায় বৃদ্ধা, জোয়ান হয়ে যায় বুড়ো এই অবস্থা। যাহোক, মূল গল্প আর অনুবাদের কারণে ❛পাতাং❜ ঠিক জমেনি। বইটি দ্রুত পড়া গেলেও অপূর্ণতার পাল্লা ঠিকই ভারী। আর বাকি সবদিক ছাড় দিলেও একটি পারফেক্ট উপন্যাস হওয়ার যে উপকরণ প্রয়োজন সেখানেও ফাঁকফোকরের অভাব নেই। কিছু চরিত্র তো মনে হলো রংঢং দেখানোর জন্য শুধু পরিচয় করানো। লেখক যে থ্রিল অনুভব করানোর চেষ্টা করেছেন সেটাও বৃথা মনে হলো।

লেখক ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হলেও লেখালিখি করেন ইংরেজিতে। ঠিক কী কারণে অনুবাদক শাহরিয়ার সৈকত মূল লেখকের টোন ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন তা অজানা। যাহোক, আগামীতে তিনি আরও ভালো কাজ করবেন বলে আশাবাদী। আর অবশ্যই যে কমতিগুলোর কথা উল্লেখ করেছি তার দায়ভার অনুবাদকের একার না। প্রকাশনার উচিত ছিল, বইটি ভালো করে সম্পাদক দিয়ে সম্পাদনা করা এবং বানান নিয়ে সতর্ক থাকা। পরিধানের ‘পরা’-কে ‘পড়া’ লিখে এই ভুল যে শুধু উক্ত বইয়ে আছে তা না; এর আগের বইগুলোতে এমন সাধারণ ভুল দৃষ্টিকটু লেগেছে।


একটি বই শুধু পাঠককে কাহিনি উপহার দেয় না তার সাথে সাথে যাবতীয় অনেক বিষয়বস্তুর শিক্ষা দেয়। সেই শিক্ষাকে অন্তত সম্মাননা দিতে একটু-আধটু সতর্ক তো থাকা উচিত। নাহয় বাত্তি ‘জ্বলজ্বল’ করার বদলে ‘জলজল’ হয়ে যাবে। আহা, এই ভুলটাও বইয়ে ছিল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ